সরল গরল- এক ‘ছোট্ট পরি’র মায়ের মৃত্যু by মিজানুর রহমান খান
ভাবলেশহীন চোখে বাবার কোলে নুসরাত সামিয়ার একটি হূদয়বিদারক আলোকচিত্র ২৫ সেপ্টেম্বরের প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে।
রিকশা
থেকে বাসের ধাক্কায় ছিটকে পড়েছিল সে আর তার মা। পাঁচ বছরের মেয়েটির
চোখের সামনে তার মায়ের শরীর রক্তে ভিজল। নিথর হলো। এটা দুর্ঘটনা, নাকি
হত্যাকাণ্ড? পুলিশ অপরাধীকে ধরতে পারবে না। ধরবে না। বাসের মালিক হয়তো আসল
ঘটনা জানবেন বা জানবেন না। জানলেও তিনি হয়তো কোনো দাপ্তরিক ব্যবস্থা
নেবেন না। তিনি কোনো তদন্ত করতেই যাবেন না। কারণ জানাজানি হলে বিপদ বাড়বে।
ভালোমানুষি দেখাতে গিয়ে পস্তাতে হবে। খাল কেটে কুমির আনা হবে। আইন
প্রয়োগকারী সংস্থাও নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যাবে না। তারা একটি
অপমৃত্যুর মামলা নেবে। কোনো ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ নেই, যারা এ ধরনের গাফিলতির
জন্য কারও কাছে কৈফিয়ত তলব করবে। এমনকি এই সমাজে এ নিয়ে কোনো মামুলি
বিতর্কও উঠবে না। যদিও গণমাধ্যমে বড় করে এসেছে, সেটাও বরাতের জোরে।
আলোকচিত্রী যথাস্থানে ছিলেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় চালকের শাস্তিই যে দেশে অত্যন্ত বিরল ঘটনা, সেখানে তা লঘু কি গুরু সেই বিতর্ক যথেষ্ট বাস্তবসম্মত বলে প্রতীয়মান হওয়া কঠিন। সরকারের কোনো সংস্থা এ পর্যন্ত কোনো তথ্য হাজির করতে পারেনি যে, প্রতিদিন গড়ে কত লোক মরে যায়, বছরে কতজন লোকের শাস্তি নিশ্চিত হয়। আমি অভিযুক্তের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই না। লঘু শাস্তি চাই। আইনে যা আছে সেই শাস্তিটা চাই। শাস্তিও চাই না, পদক্ষেপগুলোর ব্যাপারে তথ্য চাই।
আমার মনে হয় হরতালে-মিছিলে ক্যাম্পাসে লাশ পড়ে, বিচার হয় না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ছাত্রলীগের কর্মীকে শিবির, কি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ খুন করে অথচ তার বিচার হয় না। এভাবে দেশে একটি দায়মুক্তির সংস্কৃতি চলছে। মনে হয় এই সংস্কৃতি থেকে চালকসমাজও বিচ্ছিন্ন থাকতে চায় না। আমার মনে হয় না চালকেরা ৩০২ ধারাকে খুব ভয় পান। এই ভয় অন্য রকম। বিচার থেকে পালানোর রেট খামোখা বাড়বে। সে কারণে অপ্রিয় হলেও এটাই নিষ্ঠুর বাস্তবতা যে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার আওতায় তাদের অপরাধ শাস্তিযোগ্য করাই দুর্ঘটনা রোধের রক্ষাকবচ নয়। সড়ক দুর্ঘটনাকে সরসারি ৩০২ ধারায় অপরাধ গণ্য করা যাবে না। তবে যাঁরা ভুয়া লাইসেন্সধারী, তাঁদের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ চাইছে নাগরিক সমাজ। স্বপ্রণোদিত হয়ে কাউকে হত্যা করার অভিযোগই মূলত ৩০২ ধারায় বিচার্য। আমাদের চালকসমাজের মধ্যে অনেকের যোগ্যতা নিশ্চয় আন্তর্জাতিক মানের। সমস্যা হলো দুর্নীতি। অপশাসনের কারণে অদক্ষ, আধা দক্ষরা লাইসেন্স পান। দেশে এই একটি খাত যেখানে দুই নম্বর লাইসেন্স ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ বের করা যায়। এবং তা মোটা অঙ্কে বিক্রি হয়, সার্জেন্টরা তা দেখেও না দেখার, বুঝেও না বোঝার ভান করেন। সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় মামলা দায়েরের দাবি উঠেছিল। সেই মামলা তুলে নেওয়া হলেও অবাক হব না। নাগরিক সমাজের পক্ষে আন্দোলনরতরা সর্বোচ্চ শাস্তির প্রতি একটা সাধারণ প্রবণতা বোধগম্য কারণেই দেখিয়ে থাকেন। এটাও সত্য যে পেশাদার চালকদের মধ্যে যে অংশটি নিয়মনীতি ও আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে গাড়ি চালান এবং মানুষের প্রাণহানিকে সর্বদা শাস্তি অযোগ্য দুর্ঘটনা বলে অভ্যাসগতভাবেই গণ্য করেন, তাঁদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি বা আরও মাত্রার শাস্তি ও জরিমানা হয়তো একটি কার্যকর রক্ষাকবচ হতে পারে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সাম্প্রতিক এক রায়ে বলেছেন, যে ক্ষেত্রে চালক কোনো জনাকীর্ণ জনপদের মধ্য দিয়ে গাড়ি চালাবেন এবং তাতে কারও মৃত্যু ঘটলে তা কেবলই অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা বলে গণ্য হবে না। এই অপরাধ তখন কালপাবেল হোমিসাইড বা দণ্ডনীয় নরহত্যা বলে গণ্য হবে। তথ্যের অভাবে আমি হলফ করে বলতে পারি না যে রোকসানার মৃত্যু এই সংজ্ঞায় পড়ে কি না। তবে জনাকীর্ণ রাস্তা ঢাকাসহ সারা দেশেই বেশুমার। ঘাতক মিনিবাসটি আটক করা গেছে। এই সুবাদে ক্ষতিপূরণ আদায়ের আইনি পথ খোলা। কিন্তু তা আদৌ করা হবে বলে ভরসা পাই না। তবে ‘লেনদেন’ কিংবা রফা নিশ্চয় একটা হবে। গাড়ির মালিক তো তাঁর গাড়ি ফেলে রেখে লোকসান গুনবেন না। এই মালিককে ধরলে দুর্ঘটনা না নরহত্যা সেটা জানা অসম্ভব নয়। কিন্তু আইনের আপন গতি মুখ লুকাবে। নিহত রোকসানার ভাই মঞ্জু মোল্লার দাবি, মিনিবাসটি প্রথমে রিকশাটিকে ধাক্কা দিয়ে ব্রেক কষে। তিনি নিচে পড়ে যান। ওই অবস্থায় চালক পালাতে চাইলে গাড়ির চাকায় পিষ্ট হন তিনি। যদিও তাঁর ধারণা, কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেই চালকের মনে ভয় থাকত। এত বেপরোয়া ভাব আসত না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও নৌপরিবহনমন্ত্রীর সক্রিয় তৎপরতায় শ্রমিক-মালিক-সরকার সম্প্রতি এক ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয় যে সড়ক দুর্ঘটনায় তদন্ত ছাড়া হত্যা মামলা করা যাবে না। আচ্ছা তা-ই সই। রোকসানা দিয়েই শুরু করুন। তিন সন্তানের এই মায়ের মৃত্যুকে সম্মান করুন। কে আছেন একটি তদন্তের ঘোষণা দেবেন। তদন্ত করে হত্যা মামলা দায়ের করার যুক্তি আমি নাকচ করি না। কারণ যুক্তি মানলে এটা মানতে হবে যে রিকশাচালকের দোষেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অনেক গাড়িচালকের মানবিকতাও আমাদের শ্রদ্ধাশীল করে। তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অনেক সময় দুর্ঘটনার কবল থেকে পথচারীদের প্রাণ বাঁচান।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, নৌপরিবহনমন্ত্রীর প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপোষকতায় পুরো বিষয়টিকে যেভাবে নির্বাচনকে সামনে রেখে শ্রমিক নেতার কাজ শ্রমিক নেতা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে, তাতে সরকারের সত্যিকারের কর্তব্য পালনের শর্ত পূরণ হয়েছে বলে বিশ্বাস করা কঠিন। প্রথম আলোয় শিরোনাম এসেছে যে, ‘পরিবহন ধর্মঘট ডেকে দাবি আদায় করেছেন নৌমন্ত্রী আর সড়ক দুর্ঘটনায় চালকের লঘু শাস্তিতে সম্মত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।’ এ থেকে জনমনে ধারণা হতে পারে যে সড়ক দুর্ঘটনা রোধের বিষয়টি কেবলই একটি কৌশলগত এবং জনগণের চোখে ধুলো দেওয়ার একটি বিষয়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ সড়ক পরিবহন খাতের একটি সার্বিক সুব্যবস্থাপনাগত বিষয়। দেশে যে সুশাসন নেই বা ভঙ্গুর, এটা তারই ইঙ্গিতবহ। আইনকানুন ও তদারকের ব্যবস্থা হতে হবে সার্বক্ষণিক এবং সে জন্য ভালো সড়ক ও যানবাহন যেমন, তেমনি দক্ষ চালক তৈরি হলো পূর্বশর্ত। যখনই সড়ক দুর্ঘটনায় উল্লেখযোগ্য কারও মৃত্যু ঘটে তখনই একটা শোরগোল পড়ে। কিছুদিনের মধ্যে আন্দোলন স্তিমিত হলে আবার সব অনিয়ম আগের মতোই চলতে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। লোক দেখানো কিছু সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু এখন তারই বাস্তবায়ন চাই। তারও আগে চাই প্রচলিত আইনের কার্যকর প্রয়োগ এবং সে বিষয়ে দ্রুত তথ্যলাভের অধিকার।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সংশ্লিষ্ট আইনসমূহ বিশেষ করে মোটর ভেহিকেলস অ্যাক্ট ও ন্যাশনাল হাইওয়েজ অ্যাক্ট কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। চালকদের ছাড়পত্র প্রদানে দুর্নীতিই হলো অবহেলাজনিত দুর্ঘটনার একটি বিরাট উৎস। অথচ ১৮ সেপ্টেম্বর সিদ্ধান্ত হয়েছে, কেবল চক্ষু পরীক্ষা করেই ছাড়পত্র পুনর্নবায়ন করা যাবে। সারা দুনিয়ায় এটা স্বীকৃত যে একবার ছাড়পত্র লাভ করলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনির্দিষ্ট মেয়াদে কোনো কায়েমি অধিকার দাবি করতে পারেন না। বহুবিধ কারণে একজন পেশাদার চালকের ছাড়পত্র স্থগিত বা বাতিল হতে পারে। বাংলাদেশে বেপরোয়া চালকদের রুখতে হলে চালকের যোগ্যতা ও গাড়ির ফিটনেস উভয়কেই অব্যাহত নজরদারি এবং আইনি কড়াকড়ির মধ্যে রাখতে হবে। নির্বাচনী প্রচারাভিযানকে সামনে রেখে বর্তমান সরকার যদি সড়ক খাতের শৃঙ্খলা আনার ব্যাপারে তাদের আমলের আইনি এবং আনুষঙ্গিক সংস্কার ও তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে একটি বিস্তারিত তথ্যচিত্র প্রকাশ করে তাহলে আমরা তাদের দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ ধারণা পেতে পারি। অন্যথায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের সাফল্য দাবি করা একটি স্লোগানসর্বস্ব বিষয় হিসেবেই প্রতিভাত হবে। এরশাদের আমলেও শাস্তি বাড়ানোর দাবি শ্রমিকেরা ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। সংগঠিত শক্তির কাছে সরকারের নতজানু হওয়ার এই অশুভ ধারাবাহিকতার অবসান দরকার। কিন্তু নতুন করে আমরা দেখছি, বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের কী করে দলীয় স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগানো যায় শেষ বেলায় তার একটি কসরত দেখাচ্ছেন কোনো কোনো মন্ত্রী।
নুসরাত শান্তিনগরে লিটল অ্যানজেলসের ছাত্রী। ছোট্ট পরিটা অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। তবে ওর মা রোকসানা বেগমই ওই ত্রিপক্ষীয় চুক্তির পর প্রথম বলি হলেন। পুলিশের সঙ্গে একমত, ৩০৪খ ধারাতেই মামলা হবে। আশু বিচারও আশা করি না। কিন্তু চুক্তির শর্তমতে প্রথম তদন্ত ও তার প্রথম প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনসমক্ষে প্রকাশ করুন।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পুরোধা ইলিয়াস কাঞ্চন। গতকাল তিনি আমাকে বলেন, তাঁর ২১ বছরের টানা আন্দোলনে এ পর্যন্ত একটি শাস্তির ঘটনা জানেন। মগবাজারে কলেজছাত্রী সিলভী কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় নিহত হন। দুই বছর পর সেই শোকে তাঁর বাবা মারা যান। মা মামলা চালিয়েছিলেন। ঘাতক চালকের সাত বছর জেল হয়েছিল। হলে কী হবে, পুলিশ তাঁকে খুঁজে পায়নি। পেঁয়াজের উৎপাদন ও চাহিদার সঠিক তথ্য সরকারের কাছে নেই। সড়কের লাশের সঠিক হিসাবও তাদের কাছে নেই। চিত্রতারকা কাঞ্চনের মতে, প্রতিবছর গড়ে ১৩ থেকে ১৪ হাজার মানুষ নিহত হয়। আরও ২৫ হাজার আহত হয়। সেই দেশের মিডিয়ায় কোনো একজন জেলফেরতার ছবি দুর্লভ।
১৯৮৩ সালে ৩০৪(খ) ধারায় সর্বসাধারণের ব্যবহার্য রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে কারও মৃত্যু ঘটালে ১৪ বছর সাজার মেয়াদ ছিল। ইলিয়াস কাঞ্চন জানালেন, এই শাজাহান খানেরাই আন্দোলন করে তা তিন বছর করলেন। জানতে চাইলাম, শুধুই তাঁরা? বিএনপি? বললেন, ‘এখানে তাদের ঐক্য আছে। আমাকে জুতার মালা পরানো হলে বিএনপি নীরব থেকেছে। তারাও চায় না সাজার মেয়াদ বাড়ুক।’
এর পরও ভাঙা রেকর্ড শুনতে হবে, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিলেই দেশ থেকে অপরাধের দায়মুক্তির সংস্কৃতি উবে যাবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments