চারদিক-দুয়ারে বৈশাখ by শারমিন নাহার

ঋতু বদলের হাওয়ায় প্রকৃতিতে নতুন আর ঘন সবুজ পাতা গজিয়েছে আরও আগেই। চারদিকে বসন্তের যাই যাই রব, আর বৈশাখ দ্বারে দাঁড়িয়ে কড়া যেন নেড়েই চলেছে। ঝকঝকে আকাশ কখনো হালকা, কখনো বা কালচে মেঘে ঢেকে যায়, নামে একপশলা বৃষ্টি। প্রকৃতি কিছুটা ঠান্ডাও হয়, তবে একেবারে ঠান্ডা হওয়ার জো নেই,


সময়টা যেহেতু চৈত্রের দাবদাহের। তাই বারবার পিচঢালা পথটা যেন আরও তেতে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে বইতে থাকে লিলুয়া বাতাস। তবে এই তপ্ত দাহতেও কাজের বিরাম নেই চারুকলার শিক্ষার্থীদের। ঢের কাজ জমে আছে, আর পুরোটাই শেষ করতে হবে বৈশাখের প্রথম প্রহরের আগেই। প্রতিটি কাজ শেষ করে ভালোয় ভালোয় মঙ্গল শোভাযাত্রাটা শুরু করাই আমাদের লক্ষ্য, বলছিলেন চারুকলার অঙ্কন ও চিত্রাঙ্কন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রত্নেশ্বর সূত্রধর। ‘প্রথম বর্ষ থেকেই বর্ষবরণের প্রস্তুতির সঙ্গে আমি জড়িত। শুধু আমি কেন, চারুকলার সবাই। বর্ষবরণ উদ্যাপনের কাজগুলো চারুকলার শিক্ষার্থীরা নিজেরা করলেও এই আয়োজন এখন কেবল চারুকলার শিক্ষার্থীদের একার কোনো অনুষ্ঠান নয়। এই আয়োজন যেন পুরো জাতির। কাজগুলো নিজের আগ্রহে আর একান্ত ভালো লাগা থেকে করি। শেষের দুই দিন সকাল থেকে কাজ শুরু করি, কাজ চলে সারা রাত। এক মুহূর্তের জন্য বিরাম নিই না, কিন্তু তার পরও ক্লান্তি স্পর্শ করে না।’ বললেন তিনি।
গ্রাফিক্স ডিজাইনের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী কিশোর মজুমদার বললেন, ‘১ এপ্রিল থেকে বর্ষবরণের প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়েছে, চলবে পয়লা বৈশাখের সকাল পর্যন্ত। আর এই নিরবচ্ছিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িত থাকতে অনেক ভালো লাগে। সবচেয়ে ভালো লাগে আমাদের এই আয়োজনের যত খরচ তার সব টাকাই আমরা নিজেরা সংগ্রহ করি। নিজেদের বানানো সরা, মুখোশ, ছোট মাটির শোপিস, টি-শার্ট, ছাত্র আর শিক্ষকের আঁকা জলরঙের ছবি বিক্রির মাধ্যমে। এই কাজে সবার অংশগ্রহণ যে স্বতঃস্ফূর্ত, তা বোঝা যায় কাজের প্রতি এদের একাগ্রতা দেখে।’
ফারা, সূচনা, মুক্তা, নিপা, নির্ঝর—ওরা সবাই বন্ধু। এবারই ভর্তি হয়েছে চারুকলায়। এবারই বর্ষবরণ আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পেরে অনেক বেশি খুশি। চারুকলার ছোট্ট ছবি আঁকার ঘরে চলছে মুখোশ বানানোর কাজ। প্রত্যেকেই একে অপরকে সাহায্য করছে। উদ্দেশ্য সঠিক সময়ে কাজটা শেষ করা। চারুকলার বাইরের আমতলায় চলছে মঙ্গল শোভাযাত্রার আনুষঙ্গিক জিনিস তৈরির কাজ। বড় বড় মুখোশ আর সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া লোকসাহিত্যকে পুনরায় উজ্জীবিত করার জন্য বিশেষ কিছু প্রাণীর প্রতিকৃতি তুলে ধরা হবে। আয়োজনের সঙ্গে জড়িত ব্যাচের সদস্য চঞ্চল কর্মকার জানান, ‘এবারের লোকসাহিত্যের মধ্য থেকে তুলে ধরা হয়েছে কুমির আর কাকাতুয়া পাখিকে। বর্ণিল আর সৌন্দর্যের জন্য রাখা হয়েছে ময়ূর। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পুরোনো বছরের সব কালিমা দূর করে নতুনের আগমনী বার্তা নিয়ে আসবে বলেই মনে করেন সবাই।
চারুকলার এসব আয়োজনের বাইরেও রয়েছে বৈশাখের নানা আয়োজন। কেউ নিজে সাজতে, কেউ বা প্রিয়জনকে সাজিয়েই খুশি থাকেন। তাই নতুন বছরের প্রথম দিনের জন্য আয়োজনের কমতি থাকে না। চারুকলার দেয়াল ঘেঁষেই অস্থায়ী চুড়ির দোকানগুলো অন্তত সে কথাই বলে দেয়। বছরের অন্য সময়ে ফুটপাতের চুড়ির দোকান খুব একটা দেখা না গেলেও বৈশাখের জন্য আগেভাগেই বেড়ে গেছে দোকানের সংখ্যা। তাই বর্ষবরণের কর্মযজ্ঞ দেখতে, আর এক গোছা চুড়ি কিনতে অনেকেই আসছেন দূরদূরান্ত থেকে। সেদিন পড়ন্ত বিকেলে গুলশান থেকে এসেছিল রাফিদ আর এশা। উদ্দেশ্য, বৈশাখের আয়োজন দেখা। তবে আয়োজন দেখার ফাঁকে রাফিদ এশাকে কিনে দিল কয়েক গোছা কাচের চুড়ি। চুড়ি পেয়ে এশার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘লাল আর সাদা রঙের চুড়ি যেন বৈশাখী আগমনী বার্তা নিয়ে আসে।’ বলল সে।
কেবল চারুকলা কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই নয়, বরং ঢাকা নগরের অনেক জায়গাতেই লক্ষ করা যায় বৈশাখী আগমনী বার্তা। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের ধারেই ২ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে বৈশাখী মেলা। খুব ছোট পরিসরে হলেও অনেকেই আসছেন এখানে। ধানমন্ডি ৯ নম্বর সড়কের বাসিন্দা স্বপন ছুটির দিন বিকেলে এসেছেন স্ত্রীর জন্য লাল, সবুজ ও সাদা রঙের চুড়ি কিনতে। স্ত্রী বর্তমানে প্রবাসী, দীর্ঘ আট মাস পর বৈশাখ পালনের উদ্দেশ্যেই দেশে আসছেন। স্বপন জানান, ‘পোশাক তো আগেই কিনেছি, এখন কয়েক রঙের চুড়ি কিনলাম আর বৈশাখ তো সর্বজনীন, তাই আয়োজনটা একটু বেশি।’
সারা বছর রমিজ মিয়া অন্য ব্যবসা করলেও বৈশাখ উপলক্ষে কিছু দিন ধরে তালপাতার পাখার ব্যবসা শুরু করেছেন, বিক্রিও হচ্ছে ভালো—এমনটা জানা যায় রমিজ মিয়ার কথা থেকে। কিংবা রাস্তার ধারের মাটির সানকির দোকানও সরব হয়ে যাচ্ছে বৈশাখের আগমনেই। আর বাঙালি এই নতুনের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারছে না। কেউ দুই চোখ ভরে দেখছে আয়োজন, কেউ বা প্রিয়জনের জন্য কিনে ফেলছে পছন্দের উপহার। আর সবটুকুই সাড়ম্বরে বৈশাখের প্রথম ক্ষণকে বরণ করে নেওয়ার জন্য।
শারমিন নাহার

No comments

Powered by Blogger.