নারী অধিকার-বিভক্ত রাজনীতির কাছে জিম্মি নারীনীতি? by হামিদা হোসেন
লিঙ্গসমতা অর্জনের লক্ষ্যে জাতিসংঘের বিশ্ব নারী সম্মেলনে বেইজিং কর্মপরিকল্পনায় (১৯৯৫) স্বাক্ষর করার ১৬ বছর পর বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে তার নারী উন্নয়ন নীতি চূড়ান্ত করেছে। এর আগে বিভিন্ন নারী সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শের ভিত্তিতে ১৯৯৭ সালে যে নীতিটি প্রণীত হয়েছিল, তা কার্যকর হয়নি।
পরে সেটি বিভক্ত রাজনীতির কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। নারী উন্নয়ন নীতির ইতিহাসের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, ২০১১ সালের এই নীতিটি কেন নারীদের অধিকারের স্বীকৃতির ব্যাপারে রক্ষণশীল রয়ে গেছে; দেখা যাবে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও আমলাতান্ত্রিক রক্ষণশীলতা কীভাবে এর বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
বেইজিং সম্মেলনের দুই বছর পরে প্রণীত ১৯৯৭ সালের নীতিটির বাস্তবায়ন পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত শুরুই হয়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট। ২০০৪ সালে নারীনীতিটি খুব গোপনে পরিবর্তন করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশনায় ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৪’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৯৭ সালের নীতিটির ৭, ৮, ৯ ও ১২ ধারা সংশোধন করা হয়। এর ফলে সম্পত্তি, জমি ও উত্তরাধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে নারীদের অধিকার অস্বীকার করা হয়, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ সীমিত করা হয়, বয়স্ক নারীদের সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণের অবনমন ঘটানো হয়। এই উল্টোমুখী যাত্রা নারী আন্দোলনের কর্মীদের বিস্মিত করে। কারণ, লিঙ্গসমতা নিয়ে সরকারি বাগাড়ম্বর চলেছে আগের মতোই। খালেদা জিয়া তাঁর মেয়াদকালজুড়ে জনসমক্ষে বক্তৃতায়-ভাষণে নারীসমাজের উন্নয়নে তাঁর সরকারের অবদানের কথা উল্লেখ করতে কখনোই ভোলেননি। আর তাঁর মহিলাবিষয়কমন্ত্রী নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনসংক্রান্ত জাতিসংঘ কমিটির (ইউএনসিডও) কাছে ২০০৪ সালে পেশ করা বাংলাদেশের পঞ্চম প্রতিবেদনে নারীর সম-অধিকারের পথে অবশিষ্ট বাধাগুলো দূর করতে তাঁর সরকারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় বিবাহ, সম্পত্তি, নাগরিকত্ব ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের কথা। সেসব অঙ্গীকার যে পূরণ করা হবে এমন প্রত্যাশা ছিল না। নারীনীতিতে প্রকাশিত পরিবর্তনগুলো বিএনপির উগ্রপন্থী শরিকদের কাজ—এমন সন্দেহ ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ২০০৮ সালে নতুন নারীনীতির ঘোষণা দেন। তার ফলে ইসলামী ঐক্যজোট (চারদলীয় জোটের শরিক) ইস্যুটি নিয়ে রাস্তায় নামার সুযোগ পেয়ে যায়। তাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে সুর মেলান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিনজন উপদেষ্টা। নারী অধিকার আন্দোলন আরও একটা ধাক্কা খায়।
২০১১ সালের নারীনীতিতে কী আছে? মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা এই নীতিটি বিশদ উন্নয়ন পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রীয় নানা বাধ্যবাধকতার তালিকায় ভরা, সেগুলো নেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক নানা চুক্তি থেকে এবং সেগুলো এ দেশে প্রচলিত নানা আইনের আওতার ভেতরেই থেকেছে। নীতিটির শুরুতে আছে নারীদের অবস্থা, রাজনৈতিক সংগ্রামে তাদের অংশগ্রহণ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাদের সংযুক্তির বিবরণ। চলমান দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা ও অন্যায়-অপরাধ দূর করা প্রয়োজন—নারীনীতির লক্ষ্যের মধ্যে এই স্বীকৃতি আছে। নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর পক্ষে সমর্থন জোগানো, তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সামর্থ্য বাড়ানোর পক্ষেও বক্তব্য রয়েছে নারীনীতিতে। সহিংসতা দমন, বৈষম্য নিরসন; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো; বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর নারীদের বিশেষ সহযোগিতার কথাও বলা হয়েছে এতে। ২৩টিরও বেশি বিশদ অধ্যায়ে বিভক্ত এই নারীনীতিতে সিডও সনদের বৈষম্যহীন বিধানগুলো মেনে চলার প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। আরও যেসব বিষয়কে স্পর্শ করা হয়েছে সেগুলো হলো: মেয়েশিশুর সুরক্ষা, শিক্ষার জন্য প্রণোদনা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ, সম্পত্তি অর্জন ও নিয়ন্ত্রণ, ঋণ, জমি, বাজারব্যবস্থা, খাদ্যনিরাপত্তা, কৃষিকাজ, সারা জীবন স্বাস্থ্যসেবা, আশ্রয়, দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসন। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী নারীদের অবস্থা সম্পর্কে উদ্বেগ রয়েছে।
দলিলটি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে গভীর মনোযোগের সঙ্গে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ বাড়লেই নারীদের অধিকার বাড়বে বা অধিকার প্রয়োগে তাদের সামর্থ্য বাড়বে—এমন অনুমান বাস্তবে প্রমাণসাপেক্ষ বলে মনে হয় না। কারণ, আমরা দেখছি, শিল্পক্ষেত্রে নারী শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্রে নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, পরিবারে দ্বিগুণ বোঝা বহন করছে এবং বিশ্ববাজারের আধিপত্যের শিকার হচ্ছে। আর চার দেয়ালের আড়ালে অদৃশ্য যেসব নারী বাসাবাড়িতে কাজ করে, আইনে তাদের কোনো স্বীকৃতিই নেই।
নারীসমাজ চেয়েছিল তাদের অধিকারগুলো সম্পর্কে একটি বিশদ, সামগ্রিক সনদ। কিন্তু এই নারীনীতি নারীর ব্যক্তিগত জীবনের অধিকারগুলো এড়িয়ে গেছে, তাদের ক্ষমতাহীনতার মৌলিক উৎসগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেনি। ১৬.১ ধারা সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে চায়, কিন্তু কেবল রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে। ১৭.১ ধারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা ভোগের সীমা টেনে দিয়েছে; পরিবারের মধ্যে নারীর ব্যক্তিগত অধিকারগুলোর কী হবে, সে বিষয়ে কিছুই বলেনি। ১৬.১ (সি) ধারার ব্যাপারে আপত্তি প্রত্যাহার করে বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সরকার অবশ্যই দ্রুত এগিয়ে যেতে পারত। কিন্তু তা না করায় সিডও সনদের বিধানগুলো অমান্য করা হলো, এতে সরকার সিডও কমিটির বিরাগভাজন হবে। সিডও সনদের বিধানগুলো কতটা কী মেনে চলা হচ্ছে বা হচ্ছে না—সরকারকে তা ওই কমিটিকে জানাতে হবে আগামী দুই বছরের মধ্যে। ২৫.২ ধারায় নারীদের অর্জিত আয়, ঋণ, জমি ও বাজারব্যবস্থায় সুযোগের উল্লেখ রয়েছে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমানাধিকারের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ১৭.৩ ধারায় বলা হয়েছে মানবাধিকারের ভিত্তিতে আইন সংস্কারের কথা, কিন্তু বিভিন্ন সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার, হেফাজত, অভিভাবকত্ব—এসব ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের অধিকারের মধ্যে যে অসমতা আছে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। নারীনীতিতে নারীর ব্যক্তিগত অধিকারগুলো উপেক্ষিত হয়েছে। এতে মনে হয় নারী-পুরুষের মধ্যে সত্যিকারের সমতা সৃষ্টির ব্যাপারে সরকার দ্বিধান্বিত; সরকার সম্ভবত উগ্র ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে সংঘাত এড়াতে চায় এবং সরকারি দলের ভেতরের রক্ষণশীল অংশকে শান্ত করতে চায়।
তাহলে ৮ মার্চ নারীনীতি ঘোষণার পরই রাজনৈতিক বিক্ষোভ-প্রতিবাদ শুরু হলো কেন? অতীতের মতো আবারও কি নারীনীতি বাংলাদেশের বিভক্ত রাজনীতির কাছে জিম্মি হতে যাচ্ছে? চূড়ান্ত খসড়াটি প্রকাশ করার আগেই একটি ধর্মভিত্তিক ডানপন্থী দল প্রতিবাদ শুরু করে, এমনকি ৪ এপ্রিল হরতালেরও ডাক দেয়। সহিংসতার মধ্য দিয়ে হরতাল শেষ হয় এবং আরও বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা আসে। একশ্রেণীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মাদ্রাসা ক্যাডারের এই শক্তি প্রদর্শন কি সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটা কৌশল? নাকি একটা নির্বাচনী কূটচাল? আমাদের মনে রাখা উচিত যে এসব বিক্ষোভ-প্রতিবাদ এসেছে এমন একটি দলের দিক থেকে, যারা ফতোয়ার মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত শাস্তির বিরুদ্ধে আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করেছে। এই দলটি সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করেছে, তারা নারীর ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বৈষম্যের সীমানাগুলো আমাদের চ্যালেঞ্জ করে যেতে হবে, সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। নারীনীতির লক্ষ্যগুলো কর্মপরিকল্পনায় রূপান্তর করতে হবে, প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। প্রতিবন্ধকতা শুধু পশ্চাৎমুখী রাজনৈতিক অন্ধবিশ্বাস বা সামাজিক অন্যায়-অবিচারের সমর্থক রক্ষণশীল জনগোষ্ঠীই নয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা এবং পরিবর্তনের পথে আমলাতান্ত্রিক বাধাও ভালো পরিকল্পনাকে এগোতে দেয় না। নারীনীতিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সামর্থ্য বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কার্যকর সংযোগ স্থাপন করা।
ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ
হামিদা হোসেন: চেয়ারপারসন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র।
বেইজিং সম্মেলনের দুই বছর পরে প্রণীত ১৯৯৭ সালের নীতিটির বাস্তবায়ন পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত শুরুই হয়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট। ২০০৪ সালে নারীনীতিটি খুব গোপনে পরিবর্তন করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকাশনায় ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৪’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৯৭ সালের নীতিটির ৭, ৮, ৯ ও ১২ ধারা সংশোধন করা হয়। এর ফলে সম্পত্তি, জমি ও উত্তরাধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে নারীদের অধিকার অস্বীকার করা হয়, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ সীমিত করা হয়, বয়স্ক নারীদের সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণের অবনমন ঘটানো হয়। এই উল্টোমুখী যাত্রা নারী আন্দোলনের কর্মীদের বিস্মিত করে। কারণ, লিঙ্গসমতা নিয়ে সরকারি বাগাড়ম্বর চলেছে আগের মতোই। খালেদা জিয়া তাঁর মেয়াদকালজুড়ে জনসমক্ষে বক্তৃতায়-ভাষণে নারীসমাজের উন্নয়নে তাঁর সরকারের অবদানের কথা উল্লেখ করতে কখনোই ভোলেননি। আর তাঁর মহিলাবিষয়কমন্ত্রী নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনসংক্রান্ত জাতিসংঘ কমিটির (ইউএনসিডও) কাছে ২০০৪ সালে পেশ করা বাংলাদেশের পঞ্চম প্রতিবেদনে নারীর সম-অধিকারের পথে অবশিষ্ট বাধাগুলো দূর করতে তাঁর সরকারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় বিবাহ, সম্পত্তি, নাগরিকত্ব ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারের কথা। সেসব অঙ্গীকার যে পূরণ করা হবে এমন প্রত্যাশা ছিল না। নারীনীতিতে প্রকাশিত পরিবর্তনগুলো বিএনপির উগ্রপন্থী শরিকদের কাজ—এমন সন্দেহ ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ২০০৮ সালে নতুন নারীনীতির ঘোষণা দেন। তার ফলে ইসলামী ঐক্যজোট (চারদলীয় জোটের শরিক) ইস্যুটি নিয়ে রাস্তায় নামার সুযোগ পেয়ে যায়। তাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে সুর মেলান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিনজন উপদেষ্টা। নারী অধিকার আন্দোলন আরও একটা ধাক্কা খায়।
২০১১ সালের নারীনীতিতে কী আছে? মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা এই নীতিটি বিশদ উন্নয়ন পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রীয় নানা বাধ্যবাধকতার তালিকায় ভরা, সেগুলো নেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক নানা চুক্তি থেকে এবং সেগুলো এ দেশে প্রচলিত নানা আইনের আওতার ভেতরেই থেকেছে। নীতিটির শুরুতে আছে নারীদের অবস্থা, রাজনৈতিক সংগ্রামে তাদের অংশগ্রহণ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাদের সংযুক্তির বিবরণ। চলমান দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা ও অন্যায়-অপরাধ দূর করা প্রয়োজন—নারীনীতির লক্ষ্যের মধ্যে এই স্বীকৃতি আছে। নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর পক্ষে সমর্থন জোগানো, তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সামর্থ্য বাড়ানোর পক্ষেও বক্তব্য রয়েছে নারীনীতিতে। সহিংসতা দমন, বৈষম্য নিরসন; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো; বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর নারীদের বিশেষ সহযোগিতার কথাও বলা হয়েছে এতে। ২৩টিরও বেশি বিশদ অধ্যায়ে বিভক্ত এই নারীনীতিতে সিডও সনদের বৈষম্যহীন বিধানগুলো মেনে চলার প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। আরও যেসব বিষয়কে স্পর্শ করা হয়েছে সেগুলো হলো: মেয়েশিশুর সুরক্ষা, শিক্ষার জন্য প্রণোদনা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ, সম্পত্তি অর্জন ও নিয়ন্ত্রণ, ঋণ, জমি, বাজারব্যবস্থা, খাদ্যনিরাপত্তা, কৃষিকাজ, সারা জীবন স্বাস্থ্যসেবা, আশ্রয়, দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্বাসন। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী নারীদের অবস্থা সম্পর্কে উদ্বেগ রয়েছে।
দলিলটি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে গভীর মনোযোগের সঙ্গে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ বাড়লেই নারীদের অধিকার বাড়বে বা অধিকার প্রয়োগে তাদের সামর্থ্য বাড়বে—এমন অনুমান বাস্তবে প্রমাণসাপেক্ষ বলে মনে হয় না। কারণ, আমরা দেখছি, শিল্পক্ষেত্রে নারী শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্রে নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, পরিবারে দ্বিগুণ বোঝা বহন করছে এবং বিশ্ববাজারের আধিপত্যের শিকার হচ্ছে। আর চার দেয়ালের আড়ালে অদৃশ্য যেসব নারী বাসাবাড়িতে কাজ করে, আইনে তাদের কোনো স্বীকৃতিই নেই।
নারীসমাজ চেয়েছিল তাদের অধিকারগুলো সম্পর্কে একটি বিশদ, সামগ্রিক সনদ। কিন্তু এই নারীনীতি নারীর ব্যক্তিগত জীবনের অধিকারগুলো এড়িয়ে গেছে, তাদের ক্ষমতাহীনতার মৌলিক উৎসগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেনি। ১৬.১ ধারা সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে চায়, কিন্তু কেবল রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে। ১৭.১ ধারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা ভোগের সীমা টেনে দিয়েছে; পরিবারের মধ্যে নারীর ব্যক্তিগত অধিকারগুলোর কী হবে, সে বিষয়ে কিছুই বলেনি। ১৬.১ (সি) ধারার ব্যাপারে আপত্তি প্রত্যাহার করে বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সরকার অবশ্যই দ্রুত এগিয়ে যেতে পারত। কিন্তু তা না করায় সিডও সনদের বিধানগুলো অমান্য করা হলো, এতে সরকার সিডও কমিটির বিরাগভাজন হবে। সিডও সনদের বিধানগুলো কতটা কী মেনে চলা হচ্ছে বা হচ্ছে না—সরকারকে তা ওই কমিটিকে জানাতে হবে আগামী দুই বছরের মধ্যে। ২৫.২ ধারায় নারীদের অর্জিত আয়, ঋণ, জমি ও বাজারব্যবস্থায় সুযোগের উল্লেখ রয়েছে। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমানাধিকারের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ১৭.৩ ধারায় বলা হয়েছে মানবাধিকারের ভিত্তিতে আইন সংস্কারের কথা, কিন্তু বিভিন্ন সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার, হেফাজত, অভিভাবকত্ব—এসব ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের অধিকারের মধ্যে যে অসমতা আছে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। নারীনীতিতে নারীর ব্যক্তিগত অধিকারগুলো উপেক্ষিত হয়েছে। এতে মনে হয় নারী-পুরুষের মধ্যে সত্যিকারের সমতা সৃষ্টির ব্যাপারে সরকার দ্বিধান্বিত; সরকার সম্ভবত উগ্র ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে সংঘাত এড়াতে চায় এবং সরকারি দলের ভেতরের রক্ষণশীল অংশকে শান্ত করতে চায়।
তাহলে ৮ মার্চ নারীনীতি ঘোষণার পরই রাজনৈতিক বিক্ষোভ-প্রতিবাদ শুরু হলো কেন? অতীতের মতো আবারও কি নারীনীতি বাংলাদেশের বিভক্ত রাজনীতির কাছে জিম্মি হতে যাচ্ছে? চূড়ান্ত খসড়াটি প্রকাশ করার আগেই একটি ধর্মভিত্তিক ডানপন্থী দল প্রতিবাদ শুরু করে, এমনকি ৪ এপ্রিল হরতালেরও ডাক দেয়। সহিংসতার মধ্য দিয়ে হরতাল শেষ হয় এবং আরও বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা আসে। একশ্রেণীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মাদ্রাসা ক্যাডারের এই শক্তি প্রদর্শন কি সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটা কৌশল? নাকি একটা নির্বাচনী কূটচাল? আমাদের মনে রাখা উচিত যে এসব বিক্ষোভ-প্রতিবাদ এসেছে এমন একটি দলের দিক থেকে, যারা ফতোয়ার মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত শাস্তির বিরুদ্ধে আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করেছে। এই দলটি সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করেছে, তারা নারীর ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বৈষম্যের সীমানাগুলো আমাদের চ্যালেঞ্জ করে যেতে হবে, সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। নারীনীতির লক্ষ্যগুলো কর্মপরিকল্পনায় রূপান্তর করতে হবে, প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। প্রতিবন্ধকতা শুধু পশ্চাৎমুখী রাজনৈতিক অন্ধবিশ্বাস বা সামাজিক অন্যায়-অবিচারের সমর্থক রক্ষণশীল জনগোষ্ঠীই নয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা এবং পরিবর্তনের পথে আমলাতান্ত্রিক বাধাও ভালো পরিকল্পনাকে এগোতে দেয় না। নারীনীতিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সামর্থ্য বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কার্যকর সংযোগ স্থাপন করা।
ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ
হামিদা হোসেন: চেয়ারপারসন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র।
No comments