গদ্যকার্টুন-ব্যাটিং কোচ বোলিং কোচের মতো ‘টকিং’ কোচ চাই by আনিসুল হক
ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে বাংলাদেশ হোয়াইটওয়াশ করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ওই সময় ওখানকার কাগজে প্রচ্ছদকাহিনি করা হয়েছিল সাকিব আল হাসানকে নিয়ে, তার শিরোনাম ছিল আইস-ম্যান। বরফমানুষ। সাকিব সহজেই মাথা গরম করেন না বলে তাঁর খ্যাতি ছিল। তাঁর যে জিনিসটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগে,
তা হলো তাঁর মুখের হাসি। খুব দুঃসময়ে ব্যাট করতে নেমেও তাঁর মুখের হাসিটা তিনি ধরে রাখতে পারেন।
সাকিব আল হাসান সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপের সময় নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ৫৮-বিপর্যয়ের পর যখন সাবেক ক্রিকেটাররা টেলিভিশন টক শোতে বলতে লাগলেন, টিমের কোনো গেম-প্ল্যান ছিল না, তখন এই বরফমানুষটা মাথা ঠান্ডা রাখতে পারলেন না; বলে ফেললেন, সাবেক ক্রিকেটাররা যাঁরা এসব বলছেন, তাঁরা কে কী করেছেন আমরা জানি, রেকর্ড বইয়ে সব লেখা আছে, তাঁরা এত কথা বলেন কেন? এই উক্তি যেন খড়ের গাদায় দেশলাইয়ের কাঠি ছুড়ে ফেলল। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। দর্শকদের দুয়োধ্বনির জবাবে তিনি যে সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করেছেন, সেটা নিয়ে পত্রপত্রিকায় ও ইন্টারনেটে নিন্দার ঝড় বয়ে গেল। আর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে চলতি ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণের জবাবে তিনি যে অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলেন, তাও স্পষ্ট। গত পরশুর প্রায় সব কাগজেই তাঁর এই পারফরম্যান্সের সমালোচনা করা হয়েছে। দু-একটা কাগজে বলা হয়েছে, কেবল প্রতিপক্ষের আগুনে ফাস্ট বল খেলতে শিখলে চলবে না, তাঁকে শিখতে হবে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের বল কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়!
কথাটা কিন্তু কেবল কথার কথা নয়, এটা একটা গুরুতর বিষয়। সাকিব আল হাসান কেবল একজন ২৪ বছরের যেকোনো তরুণ নন, তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। তিনি কেবল তাঁর নিজেকে প্রতিনিধিত্ব করেন না, তিনি বাংলাদেশকেই প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি আমাদের রাষ্ট্রদূত। তাঁর প্রতিটি কথা, প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে মাপা; কারণ, তাঁর মুখ দিয়েই কথা কয়ে উঠছে বাংলাদেশ। তার ওপর তিনি এ দেশের কোটি তরুণের আইডলও। তাঁকে দেখেই শিখবে দেশের শিশু-কিশোর-তরুণেরা। কাজেই তিনি যে কেবল ভালো ব্যাট করবেন, ভালো বল করবেন, ভালো ফিল্ডিং করবেন, মাঠের খেলায় ভালো অধিনায়কত্ব করবেন, তা-ই প্রত্যাশিত নয়; তিনি চলায়-বলায়-আচারে-ব্যবহারে—সবদিক দিয়েই একজন আইডলের মতো আচরণ করবেন, এটা আমাদের প্রত্যাশিত।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বোলিং কোচ আছেন, ব্যাটিং কোচ আছেন, ফিল্ডিং কোচ আছেন, এবার একজন টকিং কোচ চাই, যিনি শেখাবেন কোন কথা কীভাবে বলতে হবে, কোন কথার জবাব দিতে হবে, কোন কথাটা ব্যাটসম্যানের বল ছেড়ে দেওয়ার মতো করে ছেড়েই দিতে হবে। ফিল্ডাররা যখন স্লেজিং করেন, তখন ব্যাটসম্যানদের যেমন মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়, তেমনি সাংবাদিকেরা, ক্রীড়া-ভাষ্যকারেরা যখন সমালোচনার তুবড়ি ছোটাবেন, তখনো তাঁদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে, ব্যাট সরিয়ে নিতে হবে, মুখ বন্ধ রাখতে হবে। দল জিততে থাকলে অবশ্য এই সবই সহজ হয়ে যায়, কিন্তু দল যখন হারতে থাকে, তখন সবই কঠিন মনে হয়। সেই কঠিন কাজটাই সহজভাবে করতে পারতে হবে একজন অধিনায়ককে।
দেশের শিশু-কিশোরেরা সাকিব আল হাসানকে দেখে শিখবে, কিন্তু ২৪ বছরের এই তরুণটি শিখবেন কার কাছ থেকে? বিশেষ করে সেই দেশে, যে দেশে নেতা-নেত্রীরা কথা বলেন না যেন ঝগড়া করেন। যে দেশে জাতীয় সংসদের স্পিকারকে বারবার সতর্ক করে দিতে হয় সংসদ সদস্যদের, তাঁরা যেন শালীন ভাষায় কথা বলেন। সেই দেশে, যে দেশের একজন জাতীয় নেত্রী আরেকজন নেত্রী সম্পর্কে বলে ফেলেন, উনি উন্মাদ হয়ে গেছেন। যে দেশের সরকারি দলের যুব সংগঠনের নেতারা সভা করে বলেন, তাঁদের অমুক তিন মন্ত্রী যেন মুখ বন্ধ করে রাখেন, কারণ ওই মন্ত্রীরা মুখ খুললেই ‘ফাউল’ হয়ে যায়।
কাজেই ‘টকিং কোচ’ যে কেবল আমাদের ক্রিকেট দলের জন্য লাগবে, তা-ই নয়; টকিং কোচ লাগবে আমাদের জাতীয় নেতা-নেত্রীদের জন্যও। আমাদের প্রধানমন্ত্রী একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি মুখের ওপরে অপ্রিয় সত্য কথা বলে ফেলতে অভ্যস্ত। ওটা ছোটবেলার গুণ বলে বিবেচিত হতে পারে, সাধারণ মানুষের জন্যও ওটা একটা সদভ্যাস বলেই গণ্য হবে, কিন্তু যখন আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিরোধী নেত্রী, যখন আপনি প্রতিনিধিত্ব করেন একটি দেশকে বা দেশের অনেক মানুষকে, তখন অনেক সময় কথা কম বলা, না বলা, কৌশলী হওয়াই হতে পারে রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণ। আগেকার দিনে রাজা-বাদশাদের সভায় বিদূষক থাকতেন, বীরবল কিংবা দোপেয়াজা বা গোপাল ভাঁড়, অপ্রিয় কথাগুলো তাঁদের মুখ দিয়েই বেরোত, কিন্তু আজকাল দেখি গোপাল ভাঁড়ের দায়িত্ব আমাদের বড় নেতারাই নিজের মুখে তুলে নিয়েছেন। সব অপ্রিয় কথা কেন শেখ হাসিনাকেই বলতে হবে? তিনি তো কেবল আওয়ামী লীগের নেত্রী নন, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষেরই তিনি নেত্রী। যে কথা আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটির নেতার মুখে মানায়, সেই কথা তাঁর মুখে কেন আমরা শুনব? সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে এত ভালো করল, তার একটা কারণ শেখ হাসিনা ভোটের আগে কথা বলেছিলেন অত্যন্ত মেপে এবং তাঁর মুখ থেকে অপ্রয়োজনীয় কথা শোনা যায়নি বললেই চলে। কিন্তু আজকাল দেখা যাচ্ছে, তিনি আবার মুখ খুলেছেন। আমাদের মনে আছে, ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে তাঁর বেতার-টেলিভিশন ভাষণে আক্রমণাত্মক বচনের সমালোচনা হয়েছিল প্রচুর; অনেকে মনে করেন, ওই এক ভাষণই ছিল ভোটারদের মন পাল্টে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ছিলেন যথেষ্টই বিনয়ী। তুলনায় বিএনপি ছিল ঔদ্ধত্যপূর্ণ। বদরুদ্দোজা চৌধুরী টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আগামী ২০ বছরেও বিএনপি বিরোধী আসনে বসবে না। সেই নির্বাচনেই মানুষ বিএনপিকে তার আসন চিনিয়ে দিয়েছিল।
কাজেই আমাদের খেলোয়াড়দের যেমন, আমাদের নেতা-নেত্রীদেরও তেমনি কথা বলার কোচিং করতে হবে, সম্ভবত কথা বলার চেয়েও শিখতে হবে কথা না বলাটা। ক্রিকেটে যেমন বল না খেলাটাও একটা খেলা, তেমনি রাজনীতিতেও কথা না বলাটাও একটা রাজনীতি।
মহাবীর আলেকজান্ডার রাজ্যের পর রাজ্য জয় করে আসেন ভারতে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ সালে। ঝিলম নদীর তীরে রাজা পুরু তাঁকে রুখে দাঁড়ান। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। পুরু পরাজিত হন। তাঁকে বন্দী করে আলেকজান্ডারের সামনে আনা হয়। আলেকজান্ডার তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি আমার কাছে কী রকম ব্যবহার আশা করেন? পুরু জবাব দেন, একজন রাজার কাছে আরেকজন রাজা যে রকম ব্যবহার আশা করতে পারে, আমি আপনার কাছে সেই রকম ব্যবহারই আশা করি। আলেকজান্ডার তাঁর কথায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মুক্তি দেন এবং রাজ্য ফিরিয়ে দেন।
আমরা বাংলাদেশের অধিনায়কদের কাছ থেকে, তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়কই হোন, আর বাংলাদেশ নামের দেশটার অধিনায়ক হোন, অধিনায়কোচিত আচার-আচরণ, উক্তি, বক্তৃতা আশা করি। তাঁরা যখন বাজে কথা বলেন, তখন কেবল তাঁদের নিজেদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় না, দেশের মানুষও অধোবদন হয়ে পড়ে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
সাকিব আল হাসান সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপের সময় নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ৫৮-বিপর্যয়ের পর যখন সাবেক ক্রিকেটাররা টেলিভিশন টক শোতে বলতে লাগলেন, টিমের কোনো গেম-প্ল্যান ছিল না, তখন এই বরফমানুষটা মাথা ঠান্ডা রাখতে পারলেন না; বলে ফেললেন, সাবেক ক্রিকেটাররা যাঁরা এসব বলছেন, তাঁরা কে কী করেছেন আমরা জানি, রেকর্ড বইয়ে সব লেখা আছে, তাঁরা এত কথা বলেন কেন? এই উক্তি যেন খড়ের গাদায় দেশলাইয়ের কাঠি ছুড়ে ফেলল। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। দর্শকদের দুয়োধ্বনির জবাবে তিনি যে সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করেছেন, সেটা নিয়ে পত্রপত্রিকায় ও ইন্টারনেটে নিন্দার ঝড় বয়ে গেল। আর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে চলতি ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণের জবাবে তিনি যে অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলেন, তাও স্পষ্ট। গত পরশুর প্রায় সব কাগজেই তাঁর এই পারফরম্যান্সের সমালোচনা করা হয়েছে। দু-একটা কাগজে বলা হয়েছে, কেবল প্রতিপক্ষের আগুনে ফাস্ট বল খেলতে শিখলে চলবে না, তাঁকে শিখতে হবে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের বল কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়!
কথাটা কিন্তু কেবল কথার কথা নয়, এটা একটা গুরুতর বিষয়। সাকিব আল হাসান কেবল একজন ২৪ বছরের যেকোনো তরুণ নন, তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। তিনি কেবল তাঁর নিজেকে প্রতিনিধিত্ব করেন না, তিনি বাংলাদেশকেই প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি আমাদের রাষ্ট্রদূত। তাঁর প্রতিটি কথা, প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে মাপা; কারণ, তাঁর মুখ দিয়েই কথা কয়ে উঠছে বাংলাদেশ। তার ওপর তিনি এ দেশের কোটি তরুণের আইডলও। তাঁকে দেখেই শিখবে দেশের শিশু-কিশোর-তরুণেরা। কাজেই তিনি যে কেবল ভালো ব্যাট করবেন, ভালো বল করবেন, ভালো ফিল্ডিং করবেন, মাঠের খেলায় ভালো অধিনায়কত্ব করবেন, তা-ই প্রত্যাশিত নয়; তিনি চলায়-বলায়-আচারে-ব্যবহারে—সবদিক দিয়েই একজন আইডলের মতো আচরণ করবেন, এটা আমাদের প্রত্যাশিত।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বোলিং কোচ আছেন, ব্যাটিং কোচ আছেন, ফিল্ডিং কোচ আছেন, এবার একজন টকিং কোচ চাই, যিনি শেখাবেন কোন কথা কীভাবে বলতে হবে, কোন কথার জবাব দিতে হবে, কোন কথাটা ব্যাটসম্যানের বল ছেড়ে দেওয়ার মতো করে ছেড়েই দিতে হবে। ফিল্ডাররা যখন স্লেজিং করেন, তখন ব্যাটসম্যানদের যেমন মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়, তেমনি সাংবাদিকেরা, ক্রীড়া-ভাষ্যকারেরা যখন সমালোচনার তুবড়ি ছোটাবেন, তখনো তাঁদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে, ব্যাট সরিয়ে নিতে হবে, মুখ বন্ধ রাখতে হবে। দল জিততে থাকলে অবশ্য এই সবই সহজ হয়ে যায়, কিন্তু দল যখন হারতে থাকে, তখন সবই কঠিন মনে হয়। সেই কঠিন কাজটাই সহজভাবে করতে পারতে হবে একজন অধিনায়ককে।
দেশের শিশু-কিশোরেরা সাকিব আল হাসানকে দেখে শিখবে, কিন্তু ২৪ বছরের এই তরুণটি শিখবেন কার কাছ থেকে? বিশেষ করে সেই দেশে, যে দেশে নেতা-নেত্রীরা কথা বলেন না যেন ঝগড়া করেন। যে দেশে জাতীয় সংসদের স্পিকারকে বারবার সতর্ক করে দিতে হয় সংসদ সদস্যদের, তাঁরা যেন শালীন ভাষায় কথা বলেন। সেই দেশে, যে দেশের একজন জাতীয় নেত্রী আরেকজন নেত্রী সম্পর্কে বলে ফেলেন, উনি উন্মাদ হয়ে গেছেন। যে দেশের সরকারি দলের যুব সংগঠনের নেতারা সভা করে বলেন, তাঁদের অমুক তিন মন্ত্রী যেন মুখ বন্ধ করে রাখেন, কারণ ওই মন্ত্রীরা মুখ খুললেই ‘ফাউল’ হয়ে যায়।
কাজেই ‘টকিং কোচ’ যে কেবল আমাদের ক্রিকেট দলের জন্য লাগবে, তা-ই নয়; টকিং কোচ লাগবে আমাদের জাতীয় নেতা-নেত্রীদের জন্যও। আমাদের প্রধানমন্ত্রী একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি মুখের ওপরে অপ্রিয় সত্য কথা বলে ফেলতে অভ্যস্ত। ওটা ছোটবেলার গুণ বলে বিবেচিত হতে পারে, সাধারণ মানুষের জন্যও ওটা একটা সদভ্যাস বলেই গণ্য হবে, কিন্তু যখন আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিরোধী নেত্রী, যখন আপনি প্রতিনিধিত্ব করেন একটি দেশকে বা দেশের অনেক মানুষকে, তখন অনেক সময় কথা কম বলা, না বলা, কৌশলী হওয়াই হতে পারে রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণ। আগেকার দিনে রাজা-বাদশাদের সভায় বিদূষক থাকতেন, বীরবল কিংবা দোপেয়াজা বা গোপাল ভাঁড়, অপ্রিয় কথাগুলো তাঁদের মুখ দিয়েই বেরোত, কিন্তু আজকাল দেখি গোপাল ভাঁড়ের দায়িত্ব আমাদের বড় নেতারাই নিজের মুখে তুলে নিয়েছেন। সব অপ্রিয় কথা কেন শেখ হাসিনাকেই বলতে হবে? তিনি তো কেবল আওয়ামী লীগের নেত্রী নন, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষেরই তিনি নেত্রী। যে কথা আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটির নেতার মুখে মানায়, সেই কথা তাঁর মুখে কেন আমরা শুনব? সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে এত ভালো করল, তার একটা কারণ শেখ হাসিনা ভোটের আগে কথা বলেছিলেন অত্যন্ত মেপে এবং তাঁর মুখ থেকে অপ্রয়োজনীয় কথা শোনা যায়নি বললেই চলে। কিন্তু আজকাল দেখা যাচ্ছে, তিনি আবার মুখ খুলেছেন। আমাদের মনে আছে, ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে তাঁর বেতার-টেলিভিশন ভাষণে আক্রমণাত্মক বচনের সমালোচনা হয়েছিল প্রচুর; অনেকে মনে করেন, ওই এক ভাষণই ছিল ভোটারদের মন পাল্টে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ছিলেন যথেষ্টই বিনয়ী। তুলনায় বিএনপি ছিল ঔদ্ধত্যপূর্ণ। বদরুদ্দোজা চৌধুরী টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আগামী ২০ বছরেও বিএনপি বিরোধী আসনে বসবে না। সেই নির্বাচনেই মানুষ বিএনপিকে তার আসন চিনিয়ে দিয়েছিল।
কাজেই আমাদের খেলোয়াড়দের যেমন, আমাদের নেতা-নেত্রীদেরও তেমনি কথা বলার কোচিং করতে হবে, সম্ভবত কথা বলার চেয়েও শিখতে হবে কথা না বলাটা। ক্রিকেটে যেমন বল না খেলাটাও একটা খেলা, তেমনি রাজনীতিতেও কথা না বলাটাও একটা রাজনীতি।
মহাবীর আলেকজান্ডার রাজ্যের পর রাজ্য জয় করে আসেন ভারতে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ সালে। ঝিলম নদীর তীরে রাজা পুরু তাঁকে রুখে দাঁড়ান। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। পুরু পরাজিত হন। তাঁকে বন্দী করে আলেকজান্ডারের সামনে আনা হয়। আলেকজান্ডার তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি আমার কাছে কী রকম ব্যবহার আশা করেন? পুরু জবাব দেন, একজন রাজার কাছে আরেকজন রাজা যে রকম ব্যবহার আশা করতে পারে, আমি আপনার কাছে সেই রকম ব্যবহারই আশা করি। আলেকজান্ডার তাঁর কথায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মুক্তি দেন এবং রাজ্য ফিরিয়ে দেন।
আমরা বাংলাদেশের অধিনায়কদের কাছ থেকে, তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়কই হোন, আর বাংলাদেশ নামের দেশটার অধিনায়ক হোন, অধিনায়কোচিত আচার-আচরণ, উক্তি, বক্তৃতা আশা করি। তাঁরা যখন বাজে কথা বলেন, তখন কেবল তাঁদের নিজেদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় না, দেশের মানুষও অধোবদন হয়ে পড়ে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments