জীবনযাত্রা-পানি পাওয়া সহজ নয় by মুশফিকুর রহমান

গরমের তীব্রতা এখনো প্রকট হয়ে ওঠেনি। ঢাকা শহরে পানির জন্য হাহাকার, এক কলসি পানির জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষার ছবি পত্রিকার শিরোনাম হয় তাপমাত্রা বাড়লে। অথচ নদীর দেশে আমরা বাস করি। এখানে সুপেয় জলধারায় সিঞ্চিত হয়ে উর্বর জমিতে সহজে ফসল ফলে। খাল, বিল আর নদীতে নানা জাতের মাছ মেলে।


বিভিন্ন পেশার মানুষ খুব সহজ না হলেও কর্মচঞ্চল জীবন যাপন করে। এ দেশেও খাওয়ার পানির জন্য মানুষ উৎকণ্ঠিত প্রহর পাড়ি দেয়—এ যেন বিশ্বাস করা কঠিন। গ্রামের ঘরের বউ-ঝিরা খাওয়ার পানির জন্য প্রতিদিন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এখনো কলসি ভরে পানি নিয়ে আসেন, এ কথা অনেকেরই অজানা। কিন্তু পরিষ্কার ও নিরাপদ পানির জন্য মানুষের বছরজুড়ে হাহাকার দেখতে আমাদের যেতে হবে রাজধানী ঢাকা থেকে দূরে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাটির সামান্য গভীরে পানির উপস্থিতি থাকলেও বিষাক্ত আর্সেনিকের কারণে ওই পানি পানের অযোগ্য। মধুমতী নদীর পারে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া, বাগেরহাটের মোল্লাহাট, চিতলমারী তেমনই আর্সেনিক-দূষণের এলাকা। অনেক টিউবওয়েলের পানি দূষিত। লোনা পানি ও আর্সেনিকের দূষণ এখানকার পানির জন্য সাধারণ সমস্যা। চৈত্র-বৈশাখে পুকুর-নদীও শুকিয়ে যায়। পরিষ্কার পুকুর সহজে তেমন মেলে না। জেনে বা না জেনে দূষিত পানি পান করে অনেকেই আর্সেনিকের ক্ষতিকর দূষণের শিকার। এমনকি লাল রং চিহ্নিত আর্সেনিক-আক্রান্ত টিউবওয়েল থেকে খাওয়ার পানি নিয়মিত নেওয়ার মানুষের সংখ্যাও কম নয়। গোপালগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়া, বাগেরহাট এলাকায় যাদের বাস, তাদের অনেককে নিত্যদিনের খাওয়ার পানির জোগান পেতে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়।
বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলা কমপ্লেক্সে কাজ করেন সুমিত্রা মণ্ডল। তিনি গুরুতরভাবে আর্সেনিক-দূষণের শিকার। দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা কমপ্লেক্সের ভেতর আর্সেনিক-দূষিত টিউবওয়েলের পানি পান করেছেন। এখন উপজেলা কমপ্লেক্সের পুকুর থেকে ব্র্যাকের সহায়তায় স্থাপিত শোধনাগারের সরবরাহ করা পানি খাওয়া এবং রান্নার কাজে ব্যবহার করেন। একই জায়গার স্বপ্না চক্রবর্তী ও ববিতা রানী দাসসহ আরও প্রায় সাড়ে ৬০০ মানুষ একই উৎসের পানির ওপর নির্ভরশীল।
খাওয়ার পানির জন্য প্রাচীনকাল থেকেই পুকুর তৈরি এবং তা সংরক্ষণ করে পানি সংগ্রহ করা এ অঞ্চলের জন্য ছিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। নদীর পানিও ছিল অন্যতম অবলম্বন। নতুন প্রযুক্তির লভ্যতা ও মানুষের স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুকুর কিংবা নদীর পানি পরিশোধনের তাগিদ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে পরিশোধিত পানি সরবরাহ পাইপলাইনের মাধ্যমে ব্যবহারকারীকে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত গভীরতার পরিষ্কার পুকুর পেলে সেখানকার পানি পরিশোধনের আয়োজন করা সম্ভব হয়।
চিতলমারী উপজেলা কমপ্লেক্সে যে পুকুরটি রয়েছে, সেটির পানির ওপর সরাসরি নির্ভরশীল আশপাশের প্রায় সাড়ে ৬০০ মানুষ। এই পুকুরের পানি পাম্প দিয়ে তুলে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পরিশোধন করে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার লিটার পানি পাইপলাইনের সাহায্যে ১৪টি ট্যাপ পয়েন্টে দিনে দুবার সরবরাহ করা হয়। চিতলমারী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ সোহেল হাসানও চিতলমারী উপজেলার সুপেয় পানি সমস্যার কথা বললেন। এই এলাকায় পানযোগ্য পানির ভূগর্ভস্থ স্তর অনেক গভীরে এবং সবখানে তা সহজে পাওয়া যায় না। সে কারণে টিউবওয়েল স্থাপন ব্যয়বহুল।
চিতলমারী উপজেলায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২৪৪টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি স্থাপন ও পরিচালনা করছে ব্র্যাক। অন্য এনজিওগুলোর কেউ কেউ অনুরূপ কিছু প্রকল্পে জড়িত। কিন্তু উপজেলার প্রায় দেড় লাখ মানুষের প্রয়োজন মেটাতে তা পর্যাপ্ত নয়। তা ছাড়া চিতলমারী উপজেলায় পুকুরের পানি পরিশোধন করে বিভিন্ন ক্ষমতার ৮১টি ‘পন্ড স্যান্ড ফিল্টারে’র সাহায্যে মানুষকে নিরাপদ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এই উপজেলায় ৮১টি পন্ড স্যান্ড ফিল্টারের মধ্যে ১৬টি স্থাপন ও পরিচালনা করছে ব্র্যাক। এ জন্য উপকারভোগী মানুষ নিজেরা একটি করে কমিটি গঠন করে পরিবারপ্রতি মাসে সামান্য টাকা পরিচালনা ফি বাবদ দেয়। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, উপকারভোগীদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় ফিল্টার সচল রাখা সহজ ও কার্যকর হয়েছে।
বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলায় ব্র্যাকের ‘ওয়াশ’ কর্মসূচির অধীনে প্রতিটিতে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে দুটি গভীর নলকূপ, ওভারহেড ট্যাংক ও পানি সরবরাহ পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে উদয়পুর আড়ুয়াকান্দি পল্লি নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পসংলগ্ন দুই বর্গকিলোমিটার এলাকার প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষের ঘরে পাইপলাইনে পানি সরবরাহ করছে। একই উপজেলার গড়ফা পল্লি নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প চালু হওয়ার জন্য প্রায় প্রস্তুত হয়েছে। এ প্রকল্প চালু হলে সংলগ্ন এলাকার প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ নিরাপদ পানি সরবরাহ পাবে।
নিরাপদ পানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের তাগিদ এবং ভূপৃষ্ঠের নদী-জলাধার থেকে পানি শোধন করে তা মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া পৌরসভায় ২০০২ সালে চালু করা হয়েছে একটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। পার্শ্ববর্তী মধুমতী নদীর শাখা বাঘিয়া নদী থেকে দিনে তিন লাখ লিটার পানি তুলে এই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পরিশোধন করে তা সরবরাহ করা হচ্ছে ২ দশমিক ৫৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত পৌরসভা ও সন্নিহিত এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষকে। পরিবেশ বদলে যাওয়ার প্রভাব এখন আর দূরবর্তী বিষয় নয়। শুকনো মৌসুমে লবণমুক্ত পানি মধুমতী ও তার শাখানদীতেও দুর্লভ হয়ে উঠছে। ফলে টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার মেয়র মো. ইলিয়াস হোসেন ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে শোধনের উপযোগী পর্যাপ্ত পানি পেতে তাই পৌর এলাকার একটি পুকুর সংস্কার করে তাতে পানি সংরক্ষণের পরিকল্পনা করছেন।
জীবনের আবশ্যিক উপাদান পানি ক্রমেই দুর্লভ হয়ে উঠছে। পানির ভূগর্ভস্থ উৎসগুলোও সংকুচিত হচ্ছে। নিরাপদ পানি পেতে ক্রমেই আমাদের ভূপৃষ্ঠের উৎসগুলোর দিকে নজর দিতে হচ্ছে। ব্যয়বহুল হলেও পরিবেশসম্মত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হলে আমরা ভূপৃষ্ঠের পানির উৎস থেকে আমাদের প্রয়োজনের অনেকটাই পূরণ করতে পারি।
মুশফিকুর রহমান: পরিবেশবিষয়ক লেখক।

No comments

Powered by Blogger.