চারদিক-‘বধ্যভূমি ৭১’ by বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী

সত্তর থেকে আশি বছরের পুরোনো একটি বিশাল বটগাছ। গাছটির ডালপালা বেশ বিস্তৃত। চারপাশে সমানভাবে সম্প্রসারিত। দেখে মনে হয়, সোঁদা মাটির গন্ধ নিতে গাছটি চারপাশে তার অনেকগুলো বাহু মেলে ধরেছে। বিশাল এই বটগাছের পাশ দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে পাহাড়ি ঝরনাধারা—ভুড়বুড়িয়া ছড়া।


ভুড়বুড়িয়া ছড়ার এক পাশে জেমস ফিনলে কোম্পানির ভাড়াউড়া চা-বাগান। বাগানে চোখজুড়ানো সমান্তরাল চায়ের আবাদ। অন্য পাশে বিজিবি ১৪ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর। পাকিস্তান আমলে এই বটগাছের নিচে একজন সাধুর আস্তানা ছিল। এখানে চা-শ্রমিক ও বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মানত করত, পূজা দিত। জায়গাটি ‘সাধু বাবার থলি’ নামে পরিচিত ছিল। দৃষ্টিনন্দন এই পুণ্যস্থান আরও পবিত্র হয়েছে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের নয় মাসে; এই পুণ্যভূমে ঘুমিয়ে আছে শত-সহস্র তাজা প্রাণ।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে এখানে হত্যা করেছে। হত্যার আগে বটগাছের ডালে ঝুলিয়ে হানাদারেরা তাঁদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। শুধু মুক্তিযোদ্ধা নন, তাঁদের স্বজন ও মুক্তিকামী সাধারণ মানুষকেও ধরে এনে বটগাছের ডালে উল্টো করে বেঁধে রেখেছে। তৃষ্ণায়, মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করে তাঁরা এখানে শহীদ হয়েছেন।
সবুজ গালিচা বিছানো চায়ের জনপদ থেকে জন্ম নেওয়া পাহাড়ি উচ্ছল ঝরনাধারা স্বাধীনতাসংগ্রামের নয়টি মাস এখানটায় এসে রক্তে প্লাবিত হয়েছে। ভুড়বুড়িয়া নামের এই ঝরনাধারাটি না-জানি কত শত-সহস্র অকুতোভয় মুক্তিসেনা, মুক্তিকামী সাধারণ বাঙালি আর পাশের ভুড়বুড়িয়া চা-বাগানের আদিবাসী নিরীহ শ্রমিকদের পবিত্র রক্ত-মাংস-কঙ্কাল বুকে ধারণ করেছে। হয়তো এর কিছু অংশ তার জন্মঋণ শোধ করতে বয়ে নিয়ে গেছে উপজেলার পশ্চিম সীমান্তে, হাইল হাওরে।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এই পবিত্র স্থানে ‘বধ্যভূমি ৭১’ নামে গড়ে তোলা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। এটি গড়ে উঠেছে বিজিবি ১৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুরুল হুদার উদ্যোগে। তাঁর এই আন্তরিক উদ্যোগের সার্বক্ষণিক সহযাত্রী হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সাইয়্যিদ মুজীবুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা বিরাজ সেন, কালীঘাট ইউপির চেয়ারম্যান পরাগ বাড়ৈ এবং আরও কয়েকজন।
শ্রীমঙ্গলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়েজ আহাম্মদ, সহকারী কমিশনার (ভূমি) গোলাম মওলা, জেমস ফিনলে চা কোম্পানির কর্মকর্তারা স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সের ভূমি জটিলতার দ্রুত নিষ্পত্তি করেছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সাধারণ মানুষের অর্থ ও শ্রমসহায়তায় কমপ্লেক্সটি পরিণতির দিকে এগোচ্ছে।
৪০তম স্বাধীনতাবার্ষিকীতে উপজেলা প্রশাসন প্রথমবারের মতো উপজেলা কমপ্লেক্সের বাইরে এসে এই বধ্যভূমিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের শ্রীমঙ্গল উপজেলা কমান্ড উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কয়েক শ সদস্যকে নিয়ে ‘বধ্যভূমি ৭১’-এর বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এখানে তাঁরা এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে শহীদদের আত্মার শান্তি প্রার্থনা করেছেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়েজ আহাম্মদ। প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান উপজেলা চেয়ারম্যান রনধীর কুমার দেব। বিশেষ অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সাইয়্যিদ মুজীবুর রহমান, বিজিবি ১৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুরুল হুদা, মুক্তিযুদ্ধের আরেক সংগঠক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ মনির, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এম এ রহিম, বর্তমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল মতলিব, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহাদাত হোসেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন কালীঘাট ইউপির চেয়ারম্যান পরাগ বাড়ৈ, মুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন।
বিশাল বটগাছটির ছায়ায় মাটিতে বসে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি দেখেছি। সরকারি দু-একজন কর্মকর্তা বাদে সব বক্তাই বধ্যভূমিটির ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তাঁদের বক্তব্য থেকে জেনেছি, বধ্যভূমিসংলগ্ন শ্রমকল্যাণ কার্যালয়ে ছিল পাকিস্তানি হানাদারের ক্যাম্প। ওই ক্যাম্পে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা থাকতেন। ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে শ্রীমঙ্গল ছিল যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। পাকিস্তানি হানাদারেরা মৌলভীবাজার এবং এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ওই ক্যাম্পে নিয়ে আসত। পরে তাঁদের এই বধ্যভূমিতে এনে গুলি করে হত্যা করত। স্বজনেরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন—এই অপরাধে কত শত নিরীহ মানুষকে এখানে এনে বটগাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে নির্যাতন করেছে হানাদারেরা! এখানে এই মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন মুক্তিযোদ্ধা সমীর সোম, মইন উদ্দিন, জৈন উল্লাহ, শংকর দেবনাথ, মো. আলতাফ, কদর আলী, সুদর্শন...।
মুক্তিযোদ্ধাদের বক্তৃতা শুনে শিশুদের কাঁদতে দেখেছি। শুধু শিশুরাই নয়, মধ্যবয়সী অনেককেই রুমালে চোখ মুছতে দেখেছি। পাশে বসা এক নারীর দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে দেখেছি। কথা বলে জেনেছি, তিনি মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ফিরে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর কাছে যুদ্ধকালীন স্মৃতি মানে আলোছায়ার খেলা—কখনো অবছা, কখনো অন্ধকার।
মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘বধ্যভূমি ৭১’ নামের স্মৃতিসৌধটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে এখানে সাধারণ মানুষের ঢল নামে। সৌধস্থলে স্থানীয় শিল্পীরা পরিবেশন করে আবৃত্তি, দেশাত্মবোধক গান ও নৃত্য। ছিল সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তীর সংগ্রহে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্থিরচিত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহূত সামগ্রীর প্রদর্শনী।
বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী

No comments

Powered by Blogger.