ঢাকায় ১৩ এপ্রিল শোডাউনের প্রস্তুতি ইসলামী দলগুলোর-গোয়েন্দা প্রতিবেদনে নাশকতার আশঙ্কা by মাসুদুল আলম তুষার

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে নানা অঘটনের আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। পহেলা বৈশাখের ঠিক আগের দিন ইসলামী দলগুলো বড় ধরনের শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে তাঁদের কাছে তথ্য রয়েছে।


জানা গেছে, রাজধানীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক মহাসমাবেশের চেয়েও বড় জনসমাবেশ ঘটাতে চায় তারা। আর সেখানে যুদ্ধাপরাধের বিচার বিঘ্নিত করা ও অভিযুক্ত নেতাদের রক্ষায় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা মুসল্লির ছদ্মবেশে হামলাসহ নাশকতা ঘটাতে পারে- এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার মাধ্যমে এই মহাসমাবেশ প্রত্যাহার অথবা রাজধানীর বাইরে কোথাও আয়োজনে রাজি করানোর জন্য গোয়েন্দারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করেছেন। এরই মধ্যে ইসলামী দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের ওপর নজরদারি শুরু হয়েছে। তাদের দলীয় ও ঘরোয়া বৈঠকগুলোও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে ১৩ এপ্রিলের মহাসমাবেশ প্রত্যাহার বা স্থান পরিবর্তনে রাজি নন আয়োজকরা।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুস আহম্মদ মহাসমাবেশ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মহাসমাবেশে কয়েক লাখ মুরিদ ও মুসল্লির সমাগম হবে বলে আমরা ধরে নিচ্ছি। সমমনা অনেক সংগঠন ও ব্যক্তিকে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে। এটি আমাদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি, যা পরিবর্তনের চিন্তা-ভাবনা করছি না। সমাবেশের নিরাপত্তা ও স্থানের বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে মহাসমাবেশের পরদিন পহেলা বৈশাখ হওয়ার কারণে আমাদের কর্মসূচি পরিবর্তন করার জন্যও তারা প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে আলোচনা হলেও কর্মসূচি পরিবর্তনের সুযোগ নেই। এরই মধ্যে দেশব্যাপী প্রচার ও দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু হয়েছে।'
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সম্প্রতি জমা দেওয়া গোয়েন্দাদের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৩ এপ্রিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের উদ্যোগে পল্টন মোড়ে বাদ জুমা এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' কথাটি সংবিধান থেকে তুলে দেওয়া, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও জনদুর্ভোগের প্রতিবাদ এবং ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার দাবিতে এ মহাসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। চরমোনাইয়ের পীর ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁদের বার্ষিক মাহফিলে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। গত ২৭ মার্চ মোহাম্মদ ফয়জুল করীম সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে মহাসমাবেশের ঘোষণা দেন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, সারা দেশে চরমোনাই পীরের অনেক মুরিদ রয়েছে। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র ও শিক্ষক এবং ব্যবসায়ী রয়েছেন। এ ছাড়া সারা দেশ থেকে বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, চরমোনাই পীরের কর্মী, সমর্থক, মুরিদরা এই মহাসমাবেশে যোগ দেবেন। সমাবেশকে শোডাউনে পরিণত করতে সংগঠনটি দেশের বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার লাগানোসহ প্রচারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিববিরোধী আন্দোলন, আইনমন্ত্রী ও ইফার ডিজির বক্তব্যের প্রতিবাদে তাঁদের অপসারণ, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধ, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির দাবি, বিডিআর বিদ্রোহ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। সেখানে তারা বড় ধরনের সমাবেশও করতে সমর্থ হয়েছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ইসলামী সমমনা দলগুলো নীতিগতভাবে চারদলীয় জোটের সঙ্গে একাত্ম থাকলেও তারা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বড় কোনো আন্দোলন গড়ে তোলেনি। বিভিন্ন ইসলামী ইস্যুতে সরকারবিরোধী অবস্থান ও কর্মসূচি গ্রহণ করলেও সরকারের পতন ঘটানো কিংবা লাগাতার আন্দালন গড়ে তোলার মতো কোনো পরিকল্পনা খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ায় এবং জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের আটকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৩ এপ্রিলের মহাসমাবেশে বড় ধরনের কোনো অঘটন ঘটানো হতে পারে। সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে মহাসমাবেশে আগত মুসল্লির ভিড়ে মিশে গিয়ে জামায়াত ও শিবিরের সশস্ত্র্র ক্যাডাররা কোনো নাশকতা বা আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ড ঘটানোর চেষ্টা করতে পারে।
প্রতিবেদনে গোয়েন্দারা সুপারিশ করেছেন সরকারের পক্ষ থেকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের কর্মসূচি প্রত্যাহারে রাজি করাতে। তা না হলে মহাসমাবেশের স্থান পরিবর্তন করে এমন কোনো স্থানে অনুমতি দেওয়া যেতে পারে, যেখানে মহাসমাবেশ হলে রাজধানীতে সমস্যা হবে না।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মহাসমাবেশে আমন্ত্রিত অতিথি ও সমাবেশ প্রস্তুতি নিয়ে গোয়েন্দারা খোঁজ নিচ্ছেন। এই সমাবেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ছাড়াও সমমনা ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো শরিক হবে। এরই মধ্যে ২৩টি ইসলামী সমমনা সংগঠন মহাসমাবেশকে সমর্থন দিয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোটের ফজলুল হক আমিনী গ্রুপের সঙ্গে তাদের নীতিগত ও আদর্শগত মতবিরোধ রয়েছে। এ দুটি সংগঠন সমাবেশে অংশ নেবে না। নীতি ও আদর্শগত বিরোধ না থাকায় ১৩ এপ্রিলের মহাসমাবেশে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, সর্বদলীয় ইসলামী ঐক্য পরিষদ, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামসহ বিভিন্ন সমমনা ইসলামী রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
ইসলামী সংগঠনের এ ধরনের শোডাউন প্রসঙ্গে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ২০১০ সালের ৫ নভেম্বর মুক্তাঙ্গনের সামনের সড়কে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ইস্যুতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মহাসমাবেশ করেছিল। ওই মহাসমাবেশে খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা আহমাদ উল্লাহ আশরাফ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ, বিকল্প ধারার সাংগঠনিক সম্পাদক মাহী বি চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসাসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নীলু, খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা জাফর উল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক নাঈমুল হাসান খান, হাটহাজারী মাদ্রাসার মোহাদ্দিস মাওলানা মমতাজুল করীম বোবা হুজুর, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মো. নিজাম উদ্দিন, ন্যাপ মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মর্তুজা প্রমুখ বক্তব্য রেখেছিলেন। এ ছাড়া গত বছরের ২ ও ৩ মে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকার মুক্তাঙ্গনে হাইকোর্টের ফতোয়াবিরোধী রায়, নারী নীতিমালা ও জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিল, সংবিধানে কোরআন-সুন্নাহবিরোধী ধারা বাতিলসহ বিভিন্ন দাবিতে গণ-অবস্থান কর্মসূচি দিয়েছিল। কিন্তু কর্মসূচির আগের দিন বিকেলে মুক্তাঙ্গনসহ আশপাশের স্থান দখলের চেষ্টা করার সময় পুলিশ বাধা দেয়। পরে মুক্তাঙ্গনসহ আশপাশে ১৪৪ ধারা জারি করলে তারা ওই কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। পরে ১০ জুলাই দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করা হয়। ইসলামী সংগঠনের এ ধরনের কর্মসূচিতে বাধাদানের বিষয়কে বেশ জটিল বলে মনে করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সে ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে আগাম আলোচনার মাধ্যমে সংকট সুরাহার দিকেই তাঁরা জোর দিচ্ছেন।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, সরকার যদি শেষ পর্যন্ত মহাসমাবেশের অনুমতি দেয় সে ক্ষেত্রে নির্ধারিত স্থানসহ আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে 'সুইপিং' করতে হবে। সচিবালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ভেতরে ও বাইরের 'রুফটপে' পর্যাপ্ত পুলিশি নজরদারির ব্যবস্থা রাখতে হবে। একই সঙ্গে মুক্তাঙ্গনের চারপাশে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখতে হবে। অন্য মহাসমাবেশের মতোই এ ক্ষেত্রে ভিডিও ক্যামেরা, স্টিল ক্যামেরা, বায়নোকুলার, সিসিটিভির মাধ্যমে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.