স্মরণ-শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন by তামান্না ইসলাম অলি
জয়নুল আবেদিনের জন্ম ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জে। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ, মা জয়নাবুন্নেসা। বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। ১৯৭৬ সালের ২৮ মে তিনি আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে যান। চিত্রকর্মের ওপর পড়াশোনা করেন কলকাতার সরকারি চারুকলা বিদ্যায়তনে।
কৃতিত্বের সঙ্গে পড়াশোনা শেষ করেন জয়নুল। ১৯৩৮ সালে ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে এখানেই শুরু করেন শিক্ষকতা। দেশভাগের কিছুদিন পর ফিরে আসেন দেশে। দেশে ফেরেন জন্মভূমির প্রতি অঙ্গীকার পূরণের তাগিদে। নিজের ঘাড়ে তুলে নেন এ দেশে চিত্রকলা শিক্ষার ভার। ১৯৪৮-এ প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম আর্ট স্কুল_গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস। তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় পর্যায়ক্রমে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় চারুকলা মহাবিদ্যালয় হিসেবে। মাত্র ১৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু করেছিলেন যাত্রা। এর ধারাবাহিকতায় আজকের মহীরুহ বাংলাদেশ চারুকলা ইনস্টিটিউট। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তিনি কমনওয়েলথ বৃত্তি পেয়ে ইংল্যান্ড যান। সেখানে লন্ডনের স্কুল অব আর্টে ছাপচিত্র ও চিত্রশিল্পে উচ্চশিক্ষা নেন। তবে তাঁর কর্মজীবনের দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন এ দেশের চারুশিল্পী সমাজ গড়ে তোলার কাজে। জয়নুল আবেদিনের আঁকায় উঠে আসত মানুষ, মানুষের আনন্দ-বেদনার গল্প। একেকটি ছবি যেন একেকটি জীবনের গল্প। চারুশিল্পী কামরুল হাসান তাঁর এক লেখায় জয়নুলের আঁকা কাকের ছবির উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, 'এই সাদামাটা উপস্থাপনের মধ্যে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের যাতনা দুর্ভোগের সব কিছু ফুটে উঠেছে। আর এমন সৃজন-নৈপুণ্য অন্য কোনো শিল্পীর পক্ষে সম্ভব নয়।' জয়নুল দেশের বাইরে থাকার সময় এবং পরবর্তী সময়ে এঁকেছেন অনেক বিষয়ভিত্তিক মানসম্পন্ন ছবি, যাতে পাশ্চাত্যের শিল্পকর্মের ছাপও রয়েছে। সেদিক থেকে এ দেশের নিরীক্ষাধর্মী আধুনিক চিত্রশিল্পচর্চার পথপ্রদর্শকও তিনি। আজকের অনেক বড় শিল্পীই তাঁর ছাত্র বা স্নেহধন্য। তাঁরাই তাঁকে উপাধি দিয়েছিল 'শিল্পাচার্য'। তাঁর নামকরা ছবির মধ্যে পাইন্যার মা, গুণ টানা, রমণী-১, চিন্তা, স্নান শেষে, কলসি কাঁখে, কৃষক, আয়না নিয়ে বধূ, একাকী বনে, মা ও শিশু, তিন পল্লী রমণী, ঝড়, মই দেওয়া, বিদ্রোহী, মুখ-চতুষ্টয় ইত্যাদি। জয়নুল চাইতেন শিল্পীরা ছবি আঁকবেন, শিল্পচর্চা করবেন। আর এর মাধ্যমে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হবে, যা এ দেশের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। ঢাকার ছবি আঁকার প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এবং ময়মনসিংহ জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার প্রতিষ্ঠাতা তিনি। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের জন্য জয়নুল ১৯৩৮ সালে অর্জন করেন সর্বভারতীয় চারুকলা প্রদর্শনী স্বর্ণপদক। ১৯৫৬-৫৭ সালে পান রকফেলার ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ। ১৯৫৯ সালে চিত্রকলায় পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পুরস্কার প্রাইড অব পারফরম্যান্স পান। এ ছাড়া স্বাধীনতা দিবস পদক (মরণোত্তর) এবং দিলি্ল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করি।
তামান্না ইসলাম অলি
তামান্না ইসলাম অলি
No comments