আবহাওয়ার বৈরিতা-কে শোনাবে আশ্বাসের বাণী?
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রসঙ্গগুলো সাধারণ্যে অজানা নয় আর। বলা চলে, শুধু জানাশোনার মধ্যেই থেমে নেই, বরং বিষয়গুলো বহুল আলোচিতও বটে। ওয়াকিবহাল মানুষরা দীর্ঘদিন ধরে মেরু অঞ্চলের বরফ গলা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের আরও নানা ঘোরতর বিপদের কথা বলে আসছিলেন। সে আশঙ্কাগুলো
এখন পৃথিবীর নাগরিকদের জীবনে সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়, তখন অতিবর্ষণ ও বন্যায় ডুবে যাচ্ছে একের পর এক জনপদ। অসময়ে ঝড়ঝঞ্ঝার আক্রমণে পর্যুদস্ত হচ্ছে জীবন, ফসল ও মানব বসতি। সহসা ভূকম্পন আর সুনামির আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে চলেছে শহরের পর শহর। যখন বৃষ্টির মৌসুম তখন তীব্র খরায় চৌচির হচ্ছে মাঠ। তীব্র তুষারপাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে ইউরোপ-আমেরিকার জনপদ। গত কয়েক বছরে এমন বহু অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার কথা আমরা জেনেছি। কয়েকটির নিরুপায় শিকারেও পরিণত হয়েছি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যাটি বৈশ্বিক। ফলে কমবেশি সব মহাদেশই আক্রান্ত। কিন্তু এ সমস্যার উত্তর কি একটাই? অনেকেই মনে করেন, সমস্যার মূল উৎস জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক উপাদানগুলো। কেউ কেউ অবশ্য এখন বলতে শুরু করেছেন, 'যত দোষ নন্দ ঘোষ' পদ্ধতিতে আসলে অনেক সমস্যাকে আমরা এড়িয়ে চলেছি। সব প্রশ্নের উত্তর যেমন একটি হতে পারে না, তেমনি বিশ্বের সব সমস্যার দায় শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর চাপানো যাবে না। ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণজনিত কারণে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন জলবায়ুর ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে সত্য, কিন্তু এর জন্য আরও নানা মানবসৃষ্ট ও স্থানীয় কারণও জড়িত। কোথাও হয়তো স্থানীয়ভাবে নির্মিত বাঁধ ও জলাধার প্রকল্প নদীর গতিকে রোধ করেছে। নদীর নিম্নভূমিতে মরুকরণ হয়েছে: গাছপালা কমে গিয়ে নাজুক হয়ে পড়েছে জনবসতি। স্থানীয়ভাবেই উষ্ণ হয়ে পড়েছে আবহাওয়া। কোথাও-বা জনবসতির অধিক ঘনত্ব পরিকল্পিত শহরের স্বপ্নকেই নস্যাৎ করে বসেছে। উদাহরণ হিসেবে ঢাকা শহরের কথাই বলা যায়। অপরিকল্পিত এ নগরে বলতে গেলে বৃক্ষ-বাগানের স্থানই নেই। প্রয়োজনীয় জলাধার নেই। আছে শুধু অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা ভবন আর রাস্তায় অপরিমেয় যান। ফলে দিনভর কার্বন জমে এখানকার বাতাস যে অসহনীয় হয়ে উঠবে_ তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। বিশেষজ্ঞরা জানান, সাধারণ নিয়মে দিনে শহর উষ্ণ আর রাত্রিকালে শীতল হওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকার বাতাস রাত্রিকালেও শীতল হয়ে ওঠে না। এখানকার স্থাপনাগুলো রাতে তাপ ছাড়তে শুরু করে বটে, কিন্তু সে তাপ গ্রহণ করার মতো ব্যবস্থা প্রকৃতিতে নেই। ফলে প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ধীরগতিতে চলে এবং সম্পন্ন হওয়ার আগেই নতুন তাপ সৃষ্টি হতে থাকে। ঢাকা শহরের বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতির সমাধান প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ অসহনীয় পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের অভাব। অত্যধিক তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শহরের মানুষ যখন বৈদ্যুতিক পাখা আর এয়ারকন্ডিশনারে আশ্রয় খোঁজেন, তখন তাদের হতাশ হতে হয় বৈকি। ঢাকার বাইরের জীবনও খুব সুখকর নয়। দেশের অনেক স্থানই সর্বোচ্চ তাপমাত্রার আওতায় আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আলামতগুলো বড় কোনো বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সামনে মানুষ বরাবরই অসহায়। কেননা প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। বিপর্যয়-উত্তর ব্যবস্থার দিকেই তাই গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাপদগ্ধ শহরবাসীকে আশ্বাসের বাণী শোনানোর পরিস্থিতি এখন নেই। কিন্তু এ অবস্থায় সেবা ব্যবস্থাগুলোকে সজাগ রাখতে হবে। বিশেষত, শিশু ও বৃদ্ধদের দিকে নজর রাখতে হবে। ডায়রিয়াসহ স্বাস্থ্য-ঝুঁকিগুলোর কথা বিবেচনায় রেখে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সতর্ক রাখতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে শহরকে আবারও জলাভূমি, বৃক্ষশোভিত পার্ক আর ফাঁকা স্থানে সাজিয়ে তুলতে হবে। নইলে আগামীতে অত্যধিক উষ্ণতাই শহরকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলতে পারে।
No comments