প্রত্নতত্ত্ব-মন ব্যথা কাহারে জানাই by সাইফুদ্দীন চৌধুরী

রাজশাহীর তানোর উপজেলার গাঙহাটি জিয়োতকুড়ি গ্রামের একটি মজাপুকুর পুনঃখননকালে ৩০ ফুট গভীরে একটি ইমারতের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, এখান থেকে একটি প্রস্তর নির্মিত ভাস্কর্যও সংগৃহীত হয়েছে, যা এখন স্থানীয় পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, স্থাপনাটি গুপ্ত আমলের।


একই শাসনামলের আরও তিনটি প্রত্নপীঠ (mound) পাওয়া গেছে এই তানোরের বিহারৈইল, ধানোরা ও পাড়িশোঁ গ্রামে। সদ্য আবিষ্কৃত গাঙহাটি জিয়োতকুড়ির আশপাশেই কামারগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে ওই প্রত্নপীঠগুলো কামারগাঁও ইউপির অন্তর্ভুক্ত। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান, খ্রিষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে গুপ্ত সম্রাট শ্রীগুপ্তের শাসনামলে এসব অঞ্চলেও গুপ্ত প্রাধান্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। গুপ্ত শাসনকালে পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি বেশ কটি মণ্ডলে বিভক্ত ছিল। অনুমান করা হচ্ছে, তানোরের এই অঞ্চল কোনো একটি মণ্ডলে ছিল। প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ কাশীনাথ দীক্ষিত তাঁর ১৯২২-২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অ্যানিউআল রিপোর্ট’-এ লিখেছেন, গুপ্ত আমলে বিশাল এলাকা নিয়ে এখানে একটি প্রাচীন নগর গড়ে উঠেছিল। তিনি এসব স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন করে ১৯২১ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন কাজ সম্পন্ন করেন। এই উৎখননেই এখানকার প্রত্নপীঠ থেকে বেলেপাথরে তৈরি সারনাথ ঘরানার গুপ্ত আমলের একটি বুদ্ধমূর্তি উদ্ধার করা হয়। মূর্তিটি বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালক বি স্পুনারও গুপ্ত আমলে তৈরি এই মূর্তিটির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ১৯২২-২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত রিপোর্টে লিপিবদ্ধ করেছেন। কেবল সারনাথ রীতির বুদ্ধমূর্তিই নয়, আরও বেশ কিছু বুদ্ধমূর্তি ও যক্ষীর মূর্তি ওই খননকালে পাওয়া গেছে। কাশীনাথ দীক্ষিত তাঁর প্রতিবেদনে তানোরে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন ইমারতগুলোর যে বর্ণনা দিয়েছেন, গাঙহাটি জিয়োতকুড়ির ইমারতের সঙ্গে তা অনেকটাই সাদৃশ্যযুক্ত। এখানকার ইমারতের দেয়ালও দীক্ষিত বর্ণিত অন্য প্রত্নপীঠের ইমারতের দেয়ালের সমান পুরু, ১ দশমিক ৩৮ থেকে ১ দশমিক ৪৬ মিটার। তবে বিহারৈইল, ধানোরা, পাড়িশোঁ স্তূপের তুলনায় গাঙহাটি জিয়োতকুড়ির স্তূপের গভীরতা সামান্য একটু বেশি। বিহারৈইলে খননকাজ সম্পন্ন হলেও ধানোরা কিংবা পাড়িশোঁতে সে সময় কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ হয়নি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ রিপোর্টে স্তূপগুলো চিহ্নিত করে রিপোর্টে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়। রিপোর্টে উল্লেখ আছে, বিহারৈইলের মতো ধানোরা ও পাড়িশোঁর ‘রাজবাড়ি’ এবং ‘বুরুজে’র কথা। পাড়িশোঁর চারদিকই ছিল পরিখাবেষ্টিত। এগুলো এখন প্রায় মজে গেছে। রাজশাহীর ইতিহাস গ্রন্থে কাজী মোহাম্মদ মিছের পাড়িশোঁয় শিল্প সুষমামণ্ডিত রিলিফ পদ্ধতির বামন বারাহীর প্রস্তর ভাস্কর্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন।
বঙ্গে গুপ্তাধিকারের অনন্য কেন্দ্র তানোরের বিহারৈইল, ধানোরা, পাড়িশোঁ ঘুরে বোঝার উপায় নেই, ব্রিটিশ-ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগের শনাক্ত করা ও সংরক্ষিত জায়গা ছিল এগুলো। এসব প্রত্নপীঠ এখন রূপান্তরিত হয়েছে বসতবাড়ি আর কৃষিজমিতে। বিহারৈইলের একাংশ এখন কবরস্থান হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। গাঙহাটি জিয়োতকুড়ির ভাগ্যেও ভবিষ্যতে এমন কিছুই হয়তো ঘটবে। মজাপুকুর পুনঃখনন করে মৎস্য চাষ প্রকল্প তো শুরুই হয়ে যাবে। এমন ঘটনা অনেক জায়গায়ই ঘটেছে। বিদ্রোহী কৈবর্ত রাজাদের বিজয়ের স্মারক ধীবর দিঘি এখন মৎস্য চাষ প্রকল্পের আওতায় চলছে—দেশে আমিষের তো বড় অভাব।
দেশের ঐতিহাসিক কীর্তি রক্ষার জন্য অনেক লেখালেখি হচ্ছে। মিছিল-আন্দোলনও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। বস্তুত অর্থে কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না। সারা জীবন সীমিত ক্ষমতা নিয়ে এ বিষয়ে আমিও সাধ্যমতো সামান্য কিছু লেখালেখির চেষ্টা করেছি। দেশের প্রাচীনতম সংগ্রহশালায় প্রায় দুই দশক পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছি। দেশের প্রাচীন পুরাকীর্তির স্মৃতিবহ স্থানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। দেখে কষ্ট পেয়েছি। এ নিয়ে লেখালেখি করেছি। ঢাকার বিনত বিবির মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে, দেশের অনেক ঐতিহাসিক ইমারত ভেঙে আধুনিক স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে, ঐতিহ্যবাহী ভবন সংরক্ষণের নামে ভবনের চরিত্র বিকৃত করা হচ্ছে প্লাস্টার সিমেন্টের প্রলেপ লাগিয়ে। এই কাগজেই অনেক লিখেছি। কে শোনে কার কথা! আমাদের পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এসব ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের গুরুত্ব বোধহয় সবচেয়ে বেশি। একদিন নিশ্চয়ই সময় আসবে সেই কাজ শুরু করার। এই কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা অবিমৃশ্যকারিতার জন্য নিশ্চয় আমাদেরই দোষারোপ করবেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, এ যে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ আমাদের। এসব দেখার, প্রতিকারের কেউ কী নেই? স্বগত গুনগুন করে গাইতে ইচ্ছে করে, ‘মন ব্যথা কাহারে জানাই’।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.