শেয়ারবাজার-অপরাধ প্রমাণ করতে অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন by ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী

পুঁজিবাজারে অনিয়ম তদন্তে গঠিত কমিটি বেশ দ্রুততার সঙ্গে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। সরকার এখনো প্রতিবেদনটি প্রকাশ না করলেও এর মূল পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করতে না চাইলেও বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে ইতিমধ্যে তা


প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি দাখিল ও তথ্যাদি প্রকাশের ব্যাপারে সরকার ও কমিটির মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হবে। তবে ইতিমধ্যেই পূর্ণ প্রতিবেদনটি সংবাদমাধ্যমের হস্তগত হয়েছে। এমতাবস্থায় সরকারিভাবে তা প্রকাশের গুরুত্ব তেমনটি আর নেই।
কমিটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এবারের বিপর্যয় মূলত প্রাথমিক বাজারের কর্মকাণ্ড থেকে উদ্ভূত। অর্থাৎ প্রাইমারি বাজারে বুক বিল্ডিং পদ্ধতি, ডাইরেক্ট লিস্টিং, প্রাক-আইপিও প্লেসমেন্ট ইত্যাদি ব্যবস্থার অপপ্রয়োগের মাধ্যমে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে, যা সেকেন্ডারি মার্কেটকে উত্তপ্ত করেছে এবং পরিণতিতে ধস নেমেছে। পর্যবেক্ষণটি আংশিকভাবে সঠিক হতে পারে। তবে তা সেকেন্ডারি মার্কেটে মূল্যবৃদ্ধির একমাত্র কারণ হতে পারে না। মৌলিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সেকেন্ডারি মার্কেট স্বাভাবিক থাকলে এসব পদ্ধতির অপপ্রয়োগ করে আইপিও বা প্রাক-আইপিওর মূল্য ‘আকাশচুম্বী’ করা সম্ভব নয়। যখন সেকেন্ডারি মার্কেট অতি মূল্যায়িত হয়ে পড়ে বা কারসাজির মাধ্যমে তা অতি মূল্যায়িত করা হয়, তখনই প্রাইমারি মার্কেটের এসব আইপিও মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতির এ পর্যায়ে অপব্যবহার করা সম্ভব। এখানেও ঠিক সেটাই ঘটেছে এবং একপর্যায়ে অস্বাভাবিক প্রাইমারি মার্কেট এবং অস্বাভাবিক সেকেন্ডারি মার্কেট একে অপরকে প্রভাবিত করে সম্পূর্ণ পুঁজিবাজারকে বিপর্যয়ের পথে ঠেলে দিয়েছে।
বুক বিল্ডিং পদ্ধতির ব্যাপক অপপ্রয়োগ করে প্রাক-আইপিও মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করার অভিযোগ এসেছে। অভিযোগটি অনেকাংশেই সত্য। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই পদ্ধতির মাধ্যমে একটি মাত্র কোম্পানিই এ পর্যন্ত মার্কেটে তালিকাভুক্ত হয়েছে। কোম্পানির নাম আরএকে সিরামিকস। বর্তমান বাজারেও এই শেয়ারের মূল্য ইস্যু মূল্যের অনেক বেশি। অর্থাৎ, বুক বিল্ডিং পদ্ধতির যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বাজারভিত্তিক প্রাইম ডিসকভারি সম্ভব। পরবর্তীকালে বেশ কিছু কোম্পানি অতি মূল্যায়িত বাজারের সুযোগ গ্রহণ করে এই পদ্ধতির অপব্যবহারের মাধ্যমে অস্বাভাবিক চড়া দামে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট বরাদ্দ করেছে এবং এর প্রভাবে সেকেন্ডারি মার্কেট আরও উত্তপ্ত হয়েছে। বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে কোম্পানির মৌল ভিত্তির ওপর মূল্য নির্ধারণ না করে অতি মূল্যায়িত বাজারের বিরাজমান মূল্যকে ভিত্তি ধরে প্লেসমেন্ট শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি করে কিছু কোম্পানি বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু যাঁরা চড়া দামে এই প্রাক-আইপিও প্লেসমেন্ট ক্রয় করেছেন, তাঁদের বিচার-বুদ্ধি সম্পর্কে প্রশ্নের অবকাশ থেকে যায়। প্রাক-প্লেসমেন্ট শেয়ার ন্যূনতম এক বছর লক-ইন থাকে। অর্থাৎ প্রসপেক্টাস প্রকাশিত হওয়ার পর এক বছরের মধ্যে তা বিক্রি করা যায় না। একটি অতি মূল্যায়িত বাজার এক বছর ধরে রাখা যাবে, এ রকম দুরাশা অবাস্তব। আর এক বছরের মধ্যে বাজারে পতন ঘটলে প্লেসমেন্ট শেয়ার গ্রহণকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ ধরনের ঝুঁকি নিয়ে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তি চড়া দামে প্লেসমেন্ট বরাদ্দ গ্রহণ করার জন্য কেন এতটা উৎসাহিত হলেন, তা বোধগম্য নয়। এ ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই অদূরদর্শিতার ফল এখন তাঁরা ভোগ করছেন। তাঁদের বিনিয়োগকৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ এখন আটকে গেছে এবং কখন ও কীভাবে তা ফেরত পাবেন, তা অনিশ্চিত।
এই পরিস্থিতি থেকে আমরা কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। প্রথমত, এই অভিজ্ঞতার আলোকে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির সংস্কার প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, প্রাক-আইপিও প্লেসমেন্ট কখন, কী মূল্যে, কার কাছে, কত পরিমাণ শেয়ার বরাদ্দ করা যাবে, তার একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার।
এরপর যে প্রসঙ্গটি এসে পড়ে তা হচ্ছে ডাইরেক্ট লিস্টিং পদ্ধতি। অভিজ্ঞতা থেকে এটা এখন পরিষ্কার যে একটি অতি মূল্যায়িত বাজারে, ব্যাপক চাহিদার পটভূমিতে এই পদ্ধতি সাধারণ বিনিয়োগকারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে এই পদ্ধতির সঙ্গে এসইসির কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। এই পদ্ধতিতে লিস্টিং করার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জের। স্টক এক্সচেঞ্জ অপব্যবহার রোধে এই পদ্ধতি বন্ধ করে দিলেও দুটি কোম্পানি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে বাজারে এসেছে। উভয় ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সুতরাং এই পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়ন ও সংস্কার প্রয়োজন।
একজন অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী কম মূল্যের বাজারে শেয়ার ক্রয় করলে এবং মূল্যবৃদ্ধি পেলে তা বিক্রয় করবেন, এটাই স্বাভাবিক আচরণ। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেউ যদি বিপুল পরিমাণ আয় করে থাকেন, তবে তিনি কোনো অপরাধ করেছেন বলা যায় না। পুঁজিবাজারে অনেকেই স্বল্প সময়ে অনেক অর্থ উপার্জন করেন, আবার অনেক সময় সর্বস্ব হারান। এটা যেকোনো দেশেই ঘটতে পারে। তবে কোনো বিনিয়োগকারী যদি কোনো বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত হয়ে লাভ করেন, তবে তা অবশ্যই অপরাধমূলক কাজ। সেটা প্রমাণসাপেক্ষ। সুতরাং পুঁজিবাজার থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেই তাঁকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা ঠিক হবে না। ঢালাও বক্তব্য দিয়ে কোনো কিছু প্রমাণ করা যাবে না। এই পরিস্থিতিতে যাঁদের প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত তদন্ত প্রয়োজন। এটা প্রমাণ করতে হবে যে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি সিকিউরিটিজ আইন ভঙ্গ করে অর্থ উপার্জন করেছেন। এ ধরনের অপরাধ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯, সুবিধাভোগী ব্যবসা আইন ইত্যাদিতে বিস্তারিতভাবে চিহ্নিত করা আছে। এসব আইনের আওতায় অপরাধ প্রমাণ করতে হবে। সেটা না করলে মিডিয়া-ঝড়েই বিষয়টির পরিসমাপ্তি ঘটবে, প্রকৃত অপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হবে না। সুতরাং এ পর্যায়ে আবেগতাড়িত না হয়ে নিরপেক্ষভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সেটা যতটা সম্ভব দ্রুত করা দরকার।
কমিটির প্রতিবেদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। সেটা হচ্ছে, প্রাথমিক বাজার অতি মূল্যায়িত করার বিষয়ে অডিটরদের ভূমিকা।
সাম্প্রতিক প্রাক-আইপিও এবং আইপিও মূল্য নির্ধারণে অডিট রিপোর্টসমূহের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একটি কোম্পানির সার্বিক আর্থিক মূল্যায়ন হয় নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে। এই অডিট রিপোর্ট পরীক্ষা করেই কোম্পানির লিস্টিং অনুমোদন করা হয় এবং এই প্রতিবেদন আইপিও মূল্য নির্ধারণে বিরাট ভূমিকা রাখে। একইভাবে এই নিরীক্ষিত প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে ব্যাংক ঋণ অনুমোদন করে, ক্রেডিং রেটিং কোম্পানিসমূহ রেটিং প্রদান করে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর আদায় করে। নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন যদি সঠিক না হয়, তবে তা পুঁজিবাজারসহ সামগ্রিকভাবে আর্থিক সেক্টরকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। অনেককে বলতে শোনা যায় যে কোনো কোনো অডিট ফার্মকে দিয়ে যেকোনো আর্থিক প্রতিবেদনে নিরীক্ষা প্রত্যয়ন গ্রহণ করা সম্ভব। অভিযোগটি যদি সত্য হয়, তবে তা ভয়াবহ। সরকারের বিষয়টি গুরুত্বসহ পরীক্ষা করা প্রয়োজন। নিরীক্ষার মান উন্নয়নের জন্য একটি ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল গঠন করার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। অডিট ফার্মগুলোরও বিভিন্ন সমস্যা আছে। এ সবকিছু পর্যালোচনা করে অডিটের মান উন্নয়নে আইসিএবির বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সবশেষে, এসইসির ভূমিকা সম্পর্কে কিছু না বললে লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তদন্ত প্রতিবেদন এবং সংবাদমাধ্যম বাজার বিপর্যয়ের জন্য প্রধানত এসইসির ভূমিকাকে দায়ী করেছে। এসইসিকে বিতর্কিত ভূমিকা পালন, অন্যের পরামর্শে পরিচালিত হওয়া, যোগসাজশে অনৈতিক কর্মে বৈধতা প্রদান, বাজার নিয়ন্ত্রণে শৈথিল্য ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এসব অভিযোগ গুরুতর। তবে সব অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হতে পারে। প্রমাণ করা যাক বা না যাক, সাম্প্রতিককালে এসইসির ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এমতাবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে তা পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। তবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো এসইসিতেও অনেক মেধাবী ও সৎ কর্মকর্তা কাজ করছেন। ঢালাওভাবে সবাইকে দায়ী করলে এসব কর্মকর্তা নিরুৎসাহী হয়ে উদ্যম হারিয়ে ফেলবেন। এতে করে প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এটি দ্রুততার সঙ্গে করা দরকার। বিষয়টি প্রলম্বিত করলে সব কর্মকর্তাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন এবং প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজারের এই সংকটময় সময়ে যথাযথ ভূমিকা পালনে বাধাগ্রস্ত হবে।
এসইসির কিছু শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে পরিবর্তন করলেই প্রতিষ্ঠানটি বদলে যাবে, এমনটি আশা করার কারণ নেই। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে শক্তিশালী করার কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। স্বল্প কিছু কর্মকর্তা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে। পাঁচ বছর আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে প্রাত্যহিক কেনাবেচা ছিল মাত্র ৩০ কোটি টাকার মতো। গত বছর শেষের দিকে মাঝেমধ্যে তা তিন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। আগের সেই ছোট্ট প্রতিষ্ঠান দিয়ে এই বাজারকে দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কি না, সেটাও বিবেচনায় আনা দরকার। এই প্রতিষ্ঠানে কোনো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নেই, অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ নেই, আর্থিক বিশ্লেষক নেই। প্রশিক্ষণের তেমন কোনো সুযোগ নেই। প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা অনেকটা ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতো। এখানে যে ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন লোকবল প্রয়োজন, বর্তমান বেতনকাঠামো দিয়ে তাঁদের আকৃষ্ট করা সম্ভব নয়। বিষয়গুলো এসইসি পুনর্গঠনের সময় বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। সরকার দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে প্রতিষ্ঠানটি যে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: সাবেক চেয়ারম্যান, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন।

No comments

Powered by Blogger.