চারদিক-লাঙ্গলবন্দের পুণ্যস্নান তিথি by তারাপদ আচার্য্য
ত্রেতাযুগে অশোকাষ্টমী তিথিতে লাঙ্গলবন্দ মহাতীর্থের উদ্ভব। সেই থেকে চৈত্র মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। একসময় লাঙ্গলবন্দের ওপর দিয়ে প্রবাহিত আদি ব্রহ্মপুত্র ছিল বিশাল স্রোতস্বিনী। ব্রিটিশ আমলে আসামের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্রের মূল স্রোতধারা যমুনায় সরে যায়।
ধীরে ধীরে ক্ষীণকায় হতে থাকে আদি ব্রহ্মপুত্র। প্রতিবছর চৈত্র মাসের অশোকাষ্টমী তিথিতে এখানে পুণ্যস্নানের জন্য সমবেত হন লাখ লাখ সনাতন ধর্মাবলম্বী নর-নারী। স্নান উপলক্ষে বসে বিরাট মেলা। বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভুটান থেকে আসেন বহু পুণ্যার্থী। সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীড়ে অবগাহন করে তাঁরা কলুষমুক্ত হন।
পৌরাণিক কাহিনি থেকে জানা যায়, ত্রেতাযুগের সূচনাকালে মগধ রাজ্যে ভাগীরথীর উপনদী কৌশিকীর তীর ঘেঁষে এক সমৃদ্ধ নগর ছিল, যার নাম ভোজকোট। এই নগরে গাধি নামে চন্দ্রবংশীয় একজন রাজা ছিলেন। গাধির ছিল এক ছেলে ও এক মেয়ে। ক্ষত্রিয়কুলে জন্ম হলেও মহষির স্বীকৃতিলাভের জন্য বশিষ্ঠ মুণির সঙ্গে বিশ্বামিত্রের দ্বন্দ্ব পৌরাণিক কাহিনির এক চমৎকার সংযোজন। সেই দ্বন্দ্বে বশিষ্ঠ মুণি ছিলেন অটল ও নির্বিকার। দ্বন্দ্ব চলাকালীন ধীরে ধীরে বিশ্বামিত্রের মধ্যে ক্ষত্রিয়সুলভ ক্রোধের প্রশমন এবং ব্রহ্মতেজের স্ফুরণ ঘটে। বিশ্বামিত্রের বোন সত্যবতী ছিলেন অসামান্য রূপসী। সত্যবতী বয়ঃপ্রাপ্ত হলে ভৃগুবংশীয় এক ব্রাহ্মণ সন্তান রিচিকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পরে রিচিক মুণির ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে জমদগ্নি নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। এই ঋষি জমদগ্নিই হচ্ছেন পরশুরামের বাবা। ঋষি জমদগ্নির পাঁচ পুত্রসন্তানের মধ্যে প্রথম সন্তানের নাম রুষণ্নন্ত, দ্বিতীয় পুত্রের নাম সুষেণ, তৃতীয় পুত্রের নাম বসু, চতুর্থ পুত্রের নাম বিশ্বাসুর, পরশুরাম ছিলেন সবার ছোট; অর্থাৎ পঞ্চম পুত্র। পরশুরামের জন্মকালে বিশ্বজুড়ে চলছিল মহাসংকট। তমোগুণে আচ্ছন্ন ক্ষত্রিয়গণ দুর্দান্ত হিংসাকার্য ও পাপাচার শুরু করেছিল। রাজশক্তি প্রজাপালনের পরিবর্তে হিংস্র মূর্তি ধারণ করলে যা হয়, বিভিন্ন রাজ্যে তা-ই ঘটছিল। রাজশক্তির অত্যাচারে হাহাকার পড়ে গিয়েছিল প্রজাকুলের মধ্যে। কারও ধন-মান আর জীবনের নিরাপত্তা বলতে কোনো কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। পাপের ভারে আক্রান্ত পৃথিবী রসাতলে যাওয়ার উপক্রম হয়। এহেন দুর্যোগময় মুহূর্তে পৃথিবীকে কলুষমুক্ত করতে নারায়ণের অংশ হিসেবে ধরাধামে অবতীর্ণ হন পরশুরাম। তিনি ছিলেন বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। শৈশবে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল রাম। পরে ক্ষত্রিয় নিধনকল্পে হাতে পরশু বা কুঠার তুলে নিয়েছিলেন বলে তিনি পরশুরাম নামে খ্যাতি লাভ করেন। ভৃগুবংশে জন্ম বলে তাঁর আরেক পরিচয় ভার্গব। ঋষি জমদগ্নি মুণির পুত্র হিসেবে জামদগ্ন্য নামেও তিনি পরিচিত।
একদিন পরশুরামের মা রেণুকা দেবী জল আনতে গঙ্গার তীরে যান। সেখানে পদ্মমালী (মতান্তরে চিত্ররথ) নামক গন্ধর্বরাজ স্ত্রীসহ জলবিহার করছিলেন (মতান্তরে অপ্সরীগণসহ)। পদ্মমালীর রূপ এবং তাঁদের সমবেত জলবিহারের দৃশ্য রেণুকা দেবীকে এমনভাবে মোহিত করে যে তিনি তন্ময় হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। অন্যদিকে ঋষি জমদগ্নির হোমবেলা পেরিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে তাঁর মোটেও খেয়াল নেই। সংবিত ফিরে পেয়ে রেণুকা দেবী কলস ভরে ঋষি জমদগ্নির সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ান। তপোবলে ঋষি জমদগ্নি সবকিছু জানতে পেরে রেগে গিয়ে ছেলেদের মাকে হত্যার আদেশ দেন। প্রথম চার ছেলে মাকে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু পরশুরাম পিতার আদেশে মা এবং আদেশ পালন না করা ভাইদের কুঠার দিয়ে হত্যা করেন। পরবর্তীকালে পিতা খুশি হয়ে বর দিতে চাইলে তিনি মা এবং ভাইদের প্রাণ ফিরে চান। তাতেই রাজি হন ঋষি জমদগ্নি। কিন্তু মাতৃহত্যার পাপে পরশুরামের হাতে কুঠার লেগেই থাকে। অনেক চেষ্টা করেও সেই কুঠার খসাতে পারেন না তিনি। পিতার কাছে জিজ্ঞাসা করেন তাঁর পাপমুক্তির উপায়ের কথা। পিতা বলেন, তুমি মাতৃহত্যা ও স্ত্রীলোক হত্যা—এই দুই পাপে আক্রান্ত হয়েছ, তাই তোমাকে তীর্থে তীর্থে ঘুরতে হবে, যে তীর্থের জলের স্পর্শে তোমার হাতের কুঠার খসে যাবে; মনে রাখবে, সেই তীর্থই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম তীর্থস্থান। পিতার কথামতো পরশুরাম তীর্থে তীর্থে ঘুরতে লাগলেন। শেষে সব তীর্থ ঘুরে ব্রহ্মকুণ্ডে পুণ্য জলে স্নান করে তাঁর হাতের কুঠার খসে যায়। পরশুরাম মনে মনে ভাবেন, এই পুণ্য বারিধারা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে মানুষ খুব উপকৃত হবে। তাই তিনি হাতের খসে যাওয়া কুঠারকে লাঙ্গলে রূপান্তর করে পাথর কেটে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে মর্ত্যলোকের সমভূমিতে সেই জলধারা নিয়ে আসেন। লাঙ্গল দিয়ে সমভূমির বুক চিরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন তিনি। ক্রমাগত ভূমি কর্ষণজনিত শ্রমে পরশুরাম ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার অন্তর্গত সোনারগাঁয়ে এসে তিনি লাঙ্গল চালানো বন্ধ করেন। এ জন্য এই স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্দ। এরপর এই জলধারা কোমল মাটির বুক চিরে ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিশেছে। পরবর্তীকালে এই মিলিত ধারা বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে।
তারাপদ আচার্য্য: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, নাগবাড়ী, নারায়ণগঞ্জ।
পৌরাণিক কাহিনি থেকে জানা যায়, ত্রেতাযুগের সূচনাকালে মগধ রাজ্যে ভাগীরথীর উপনদী কৌশিকীর তীর ঘেঁষে এক সমৃদ্ধ নগর ছিল, যার নাম ভোজকোট। এই নগরে গাধি নামে চন্দ্রবংশীয় একজন রাজা ছিলেন। গাধির ছিল এক ছেলে ও এক মেয়ে। ক্ষত্রিয়কুলে জন্ম হলেও মহষির স্বীকৃতিলাভের জন্য বশিষ্ঠ মুণির সঙ্গে বিশ্বামিত্রের দ্বন্দ্ব পৌরাণিক কাহিনির এক চমৎকার সংযোজন। সেই দ্বন্দ্বে বশিষ্ঠ মুণি ছিলেন অটল ও নির্বিকার। দ্বন্দ্ব চলাকালীন ধীরে ধীরে বিশ্বামিত্রের মধ্যে ক্ষত্রিয়সুলভ ক্রোধের প্রশমন এবং ব্রহ্মতেজের স্ফুরণ ঘটে। বিশ্বামিত্রের বোন সত্যবতী ছিলেন অসামান্য রূপসী। সত্যবতী বয়ঃপ্রাপ্ত হলে ভৃগুবংশীয় এক ব্রাহ্মণ সন্তান রিচিকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। পরে রিচিক মুণির ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে জমদগ্নি নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। এই ঋষি জমদগ্নিই হচ্ছেন পরশুরামের বাবা। ঋষি জমদগ্নির পাঁচ পুত্রসন্তানের মধ্যে প্রথম সন্তানের নাম রুষণ্নন্ত, দ্বিতীয় পুত্রের নাম সুষেণ, তৃতীয় পুত্রের নাম বসু, চতুর্থ পুত্রের নাম বিশ্বাসুর, পরশুরাম ছিলেন সবার ছোট; অর্থাৎ পঞ্চম পুত্র। পরশুরামের জন্মকালে বিশ্বজুড়ে চলছিল মহাসংকট। তমোগুণে আচ্ছন্ন ক্ষত্রিয়গণ দুর্দান্ত হিংসাকার্য ও পাপাচার শুরু করেছিল। রাজশক্তি প্রজাপালনের পরিবর্তে হিংস্র মূর্তি ধারণ করলে যা হয়, বিভিন্ন রাজ্যে তা-ই ঘটছিল। রাজশক্তির অত্যাচারে হাহাকার পড়ে গিয়েছিল প্রজাকুলের মধ্যে। কারও ধন-মান আর জীবনের নিরাপত্তা বলতে কোনো কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। পাপের ভারে আক্রান্ত পৃথিবী রসাতলে যাওয়ার উপক্রম হয়। এহেন দুর্যোগময় মুহূর্তে পৃথিবীকে কলুষমুক্ত করতে নারায়ণের অংশ হিসেবে ধরাধামে অবতীর্ণ হন পরশুরাম। তিনি ছিলেন বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। শৈশবে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল রাম। পরে ক্ষত্রিয় নিধনকল্পে হাতে পরশু বা কুঠার তুলে নিয়েছিলেন বলে তিনি পরশুরাম নামে খ্যাতি লাভ করেন। ভৃগুবংশে জন্ম বলে তাঁর আরেক পরিচয় ভার্গব। ঋষি জমদগ্নি মুণির পুত্র হিসেবে জামদগ্ন্য নামেও তিনি পরিচিত।
একদিন পরশুরামের মা রেণুকা দেবী জল আনতে গঙ্গার তীরে যান। সেখানে পদ্মমালী (মতান্তরে চিত্ররথ) নামক গন্ধর্বরাজ স্ত্রীসহ জলবিহার করছিলেন (মতান্তরে অপ্সরীগণসহ)। পদ্মমালীর রূপ এবং তাঁদের সমবেত জলবিহারের দৃশ্য রেণুকা দেবীকে এমনভাবে মোহিত করে যে তিনি তন্ময় হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। অন্যদিকে ঋষি জমদগ্নির হোমবেলা পেরিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে তাঁর মোটেও খেয়াল নেই। সংবিত ফিরে পেয়ে রেণুকা দেবী কলস ভরে ঋষি জমদগ্নির সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ান। তপোবলে ঋষি জমদগ্নি সবকিছু জানতে পেরে রেগে গিয়ে ছেলেদের মাকে হত্যার আদেশ দেন। প্রথম চার ছেলে মাকে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু পরশুরাম পিতার আদেশে মা এবং আদেশ পালন না করা ভাইদের কুঠার দিয়ে হত্যা করেন। পরবর্তীকালে পিতা খুশি হয়ে বর দিতে চাইলে তিনি মা এবং ভাইদের প্রাণ ফিরে চান। তাতেই রাজি হন ঋষি জমদগ্নি। কিন্তু মাতৃহত্যার পাপে পরশুরামের হাতে কুঠার লেগেই থাকে। অনেক চেষ্টা করেও সেই কুঠার খসাতে পারেন না তিনি। পিতার কাছে জিজ্ঞাসা করেন তাঁর পাপমুক্তির উপায়ের কথা। পিতা বলেন, তুমি মাতৃহত্যা ও স্ত্রীলোক হত্যা—এই দুই পাপে আক্রান্ত হয়েছ, তাই তোমাকে তীর্থে তীর্থে ঘুরতে হবে, যে তীর্থের জলের স্পর্শে তোমার হাতের কুঠার খসে যাবে; মনে রাখবে, সেই তীর্থই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম তীর্থস্থান। পিতার কথামতো পরশুরাম তীর্থে তীর্থে ঘুরতে লাগলেন। শেষে সব তীর্থ ঘুরে ব্রহ্মকুণ্ডে পুণ্য জলে স্নান করে তাঁর হাতের কুঠার খসে যায়। পরশুরাম মনে মনে ভাবেন, এই পুণ্য বারিধারা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে মানুষ খুব উপকৃত হবে। তাই তিনি হাতের খসে যাওয়া কুঠারকে লাঙ্গলে রূপান্তর করে পাথর কেটে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে মর্ত্যলোকের সমভূমিতে সেই জলধারা নিয়ে আসেন। লাঙ্গল দিয়ে সমভূমির বুক চিরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন তিনি। ক্রমাগত ভূমি কর্ষণজনিত শ্রমে পরশুরাম ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার অন্তর্গত সোনারগাঁয়ে এসে তিনি লাঙ্গল চালানো বন্ধ করেন। এ জন্য এই স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্দ। এরপর এই জলধারা কোমল মাটির বুক চিরে ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিশেছে। পরবর্তীকালে এই মিলিত ধারা বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে।
তারাপদ আচার্য্য: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, নাগবাড়ী, নারায়ণগঞ্জ।
No comments