সরকারের সঙ্গে জাতীয় পার্টির দূরত্ব বাড়ছেই-নেপথ্যে এরশাদের মামলা by মোশতাক আহমদ

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের তিন বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার না হওয়ায় সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা। এজন্য দলের কেউ কেউ আওয়ামী লীগকে বিশ্বাসভঙ্গকারী হিসেবে দেখছেন।


দলের নেতা-কর্মীদের মতো এরশাদ নিজেও বিষয়টিতে চরম ক্ষুব্ধ বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আর এ কারণে বেশ কিছুদিন ধরে কৌশলে মহাজোটের কর্মসূচি এড়িয়ে চলছে জাতীয় পার্টি। সরকারও বিষয়টি আঁচ করতে পেরে মহাজোটের কর্মসূচিতে যোগ দিতে জাতীয় পার্টিকে চাপ দিচ্ছে না। তাই কর্মসূচিগুলো মহাজোটের ব্যানারে না দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ১৪ দলের ব্যানারে। সর্বশেষ গত ১৪ মার্চ রাজধানীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের মহাসমাবেশ হয়। সেখানেও জাতীয় পার্টি ছিল অনুপস্থিত।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার গঠনের পর এরশাদের মামলা প্রত্যাহার না হওয়া এবং মহাজোট গঠনের সময় সম্পাদিত (জলিল-হাওলাদার স্বাক্ষরিত) ১৩ দফা চুক্তি বাস্তবায়ন না করায় আওয়ামী লীগকে আর বিশ্বাস করছে না জাতীয় পার্টির অনেক নেতা-কর্মীই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য জানিয়েছেন, মহাজোট গঠনের সময় চুক্তিতে জাপার প্রধান শর্ত ছিল, এরশাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার করা। কিন্তু সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়ার পরও কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। মামলা প্রত্যাহারের জন্য এরশাদ নিজেও দুবার লিখিত আবেদন করেছেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিক সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাপার দূরত্ব ক্রমাগত বাড়ছে।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের ১৭ মে প্রথম দফায় মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন এরশাদ। ওই আবেদনে রাডার ক্রয় দুর্নীতি, মঞ্জুর হত্যা মামলা, বিটিভির ক্যাব্ল্ ক্রয় দুর্নীতি মামলাসহ চারটি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়। প্রথম দফায় আবেদনে অগ্রগতি না হলে দ্বিতীয় দফায় গত বছরের ২০ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রসচিব বরাবর মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন এরশাদ। আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, আগে জমা দেওয়া আবেদনে তিনি তাঁর পক্ষে সব কাগজ জমা দিয়েছেন।
সূত্র আরো জানায়, আবেদনের পরও নিজের মামলা প্রত্যাহার না হওয়ায় মহাজোট নিয়ে বেশ অনেকবার উল্টোপাল্টা বক্তব্য দেন এরশাদ। ওই সময় এরশাদ বা জাপা প্রতিনিধিকে ডেকে মান ভাঙাতে আওয়ামী লীগ সক্ষম হলেও সম্প্রতি পরিস্থিতি অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক থেকে বেরিয়ে এরশাদ বলেছিলেন, মহাজোটে আছি এবং থাকব। কিন্তু সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এরশাদের দুটি বৈঠক হলেও বেরিয়ে 'মহাজোটে আছি এবং থাকব' এ ধরনের বক্তব্য থেকে বিরত থাকেন এরশাদ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৪ মার্চের আগে এরশাদকে গণভবনে চায়ের দাওয়াত দিয়ে ডেকে মহাসমাবেশে যোগদানের আহ্বান জানান। কিন্তু এরশাদ এতে রাজি হননি। চিকিৎসার অজুহাতে ১৪ মার্চের আগের দিন সিঙ্গাপুরে চলে যান এরশাদ। এর আগে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে মহাজোটের মহাসমাবেশেও যোগ দেয়নি জাতীয় পার্টি।
প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন হলে তার নামে মোট ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ২০০৬ সালে বিএনপির সঙ্গে এরশাদের জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলে পাঁচটি মামলা প্রত্যাহার করে নেয় বিএনপি। অপর ২২টি মামলার মধ্যে ১৮টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। বিচারাধীন রয়েছে শুধু মঞ্জু হত্যা, রাডার ক্রয়, বিটিভির ক্যাব্ল্ ক্রয় দুর্নীতিসহ চারটি মামলা। এসব মামলার মধ্যে মঞ্জুর হত্যা মামলা নিয়ে এরশাদ বেশি চিন্তিত বলে জাপা সূত্র জানিয়েছে। রাডার ক্রয় মামলা প্রত্যাহারের জন্য সরকার সুপারিশ করলেও বাধ সেধেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক বলছে, উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই এরশাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এজন্য সরকার সুপারিশ করলেই তারা প্রত্যাহার করবে না। আইনি লড়াই করেই কেবল এরশাদ এ মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন।
এ বিষয়ে দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, সরকার এরশাদের মামলাসহ অনেক মামলাই প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। তবে এখনো দুদক কারো মামলাই প্রত্যাহার করেনি। কারণ আদালত থেকে মামলার নিষ্পত্তি হলে দুদক ও অভিযুক্ত সবার জন্যই এটা সম্মানজনক হবে বলে মনে করে দুদক। জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, আওয়ামী লীগ তাদের নেতা-কর্মীদের নামে দায়ের হওয়া ছয় হাজারের বেশি মামলা প্রত্যাহার করে নিলেও এরশাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করছে না। তিনি বলেন, মহাজোটে থেকেও এরশাদের একটি মামলাও প্রত্যাহার হয়নি, কী মহাজোট করলাম কিছুই বুঝি না।
আওয়ামী লীগ জাপার সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে- এমন মন্তব্য করে জাপার সাবেক এ মহাসচিব বলেন, 'আমি একজন আইনজীবী হিসেবে যদি আইনের কথা বলি তাহলেও বলব এরশাদের মামলাগুলো চলতে পারে না। তিনি বলেন, একটি মামলায় পরপর ৩ ধার্য তারিখে বাদী ও সাক্ষীরা উপস্থিত না হলে মামলাটি খারিজ করে দেওয়া হয়। আর এরশাদের কয়েকটি মামলায় ২০ বছর ধরে সাক্ষীরা হাজির হচ্ছেন না। তার পরও মামলাগুলো চলছে।'
এরশাদের উপদেষ্টা আবদুস সবুর আসুদ বলেন, 'তিন বছর পার হয়ে গেছে আমরা আর সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছি না। আমাদের মনে হয়, সরকার মামলাগুলো ঝুলিয়ে রেখে ফায়দা লুটতে চায়। তিনি বলেন, আমি আওয়ামী লীগকে বলে দিতে চাই, ভয় দেখিয়ে কখনো বন্ধুত্ব হয় না। আর এক পক্ষের আগ্রহে কখনো বন্ধুত্ব টিকে থাকতে পারে না। এরশাদের নামে দায়ের করা মামলাগুলো সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বলে দাবি করে তিনি বলেন, আমি আশা করি সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।'
পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, 'এরশাদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে ২৭টি মামলা করা হয়েছিল। আমি অবিলম্বে এরশাদের নামে দায়ের করা রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।'
জাপার একাধিক সিনিয়র নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন, মামলার জালে বন্দি হয়ে পড়েছে এরশাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। আগামীতে এককভাবে নির্বাচন করার ঘোষণা বা মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে এরশাদ যতই কথা বলুন না কেন খুব সহসাই তিনি মহাজোট ছাড়তে পারছেন না। কারণ এখনো তাঁর ঘাড়ে ঝুলছে চারটি মামলা। আওয়ামী লীগ এই মামলাগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

No comments

Powered by Blogger.