তারুণ্য-অভিভাবকদের করণীয় by মো. তাজুল ইসলাম

২২ মার্চ ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় দশম শ্রেণীর ছাত্র গেরলিও নিমালনের একটি চিন্তা-উদ্রেককারী লেখা প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছে। এ জন্য প্রথম আলোকে ধন্যবাদ। নষ্ট, পচে যাওয়া ক্ষয়িষ্ণু সমাজ নিয়ে আমাদের অনেক উদ্বেগ রয়েছে। এ জন্য অনেকেই নতুন প্রজন্মের তরুণদের কাছ থেকে অনেক কিছু প্রত্যাশা করেন।
তারা এ সমাজ-রাজনীতি বদলে দেবে, একটি সমৃদ্ধ ও মর্যাদাশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে ইত্যাদি বাণী আমরা অনেকেই আউড়িয়ে থাকি। আমাদের পূর্বসূরিরাও আমাদের নিয়ে এ রকম অনেক উদ্দীপনাময় কথাবার্তা বলতেন। কিন্তু আমরা কি তাঁদের স্বপ্ন-প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছি?
গেরলিও নিমালন যে ক্ষোভ, অভিযোগ মুক্তকণ্ঠে প্রকাশ করেছে, সেগুলো আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি শিশু-কিশোরের মনের কথা। আমরা কি আমাদের সন্তানদের এই অনুচ্চারিত চাপা ক্ষোভ, অভিযোগ ও হতাশাগুলোর কথা কখনো জানতে চেয়েছি? যেসব অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের বিভিন্ন আবেগগত ও আচরণগত সমস্যা নিয়ে আমাদের চেম্বারে আসেন, গভীর মনোবিশ্লেষণ করে সেসব মনো-সমস্যার যে কারণ আমরা খুঁজে বের করি, গেরলিও নিমালন একজন স্কুলছাত্র হয়েও প্রাঞ্জল ভাষায়, সরল তবে বেগবান ভাষায় সেসব কারণ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। তার বক্তব্যের নির্যাস হচ্ছে: ১. আমরা শিশু-কিশোরদের শুধু একটি তাড়াই বারবার দিয়ে থাকি—‘পড়ো, পড়ো, এটা পড়ো, সেটা পড়ো, এখন পড়ো, তখনো পড়ো’। অহর্নিশ এই একই তাড়া দেওয়া তাদের বিরক্ত করে, জ্বালাতন করে ও প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রাখে। আনন্দের সঙ্গে পড়া; জানা ও শেখার জন্য পড়া; নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য পড়ার যে তাগিদ ও আগ্রহ—এ কারণে সেটি নষ্ট হয়ে যায়। পড়াশোনার প্রতি বিরক্তি ও ঘৃণা চলে আসে। ফলে ‘পড়ো’ ব্যাপারটি হয়ে দাঁড়ায় প্রায় নির্যাতনের সমতুল্য। ২. সার্টিফিকেট অর্জনই অভিভাবকদের মূল লক্ষ্য। পড়াশোনার বাইরে ‘খেলাধুলা, নাচ-গান, অঙ্কন, অভিনয়, বলা ও লেখার গুণ’ কোনোটিই কাজের কিছু নয়। আমরা ভুলে যাই শিশুর পূর্ণ মানসিক বিকাশ, সবল ব্যক্তিত্ব নির্মাণ ও জীবন-পরীক্ষায় সফল হতে হলে পড়াশোনার বাইরেও আরও অনেক কিছু অর্জন করতে হবে। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুরা তার পরিবেশ থেকে জীবন-দক্ষতা ও সৃজনশীল অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। তা ছাড়া কে শচীন টেন্ডুলকার হবে বা কে বিল গেটস হবে—আমরা তা আগে থেকে নির্ধারণ করতে পারি না। ৩. মুখস্থ করো—‘সব কিছু মুখস্থ করো, জান-প্রাণ দিয়ে মুখস্থ করো’। মুখস্থ করে, নোট বা গাইড বই পড়ে বা কোচিং ক্লাস থেকে ধার করা বিদ্যা বয়ে নিয়ে মস্তিষ্ক ভর্তি করলে সেটি হবে মাথায় জ্ঞান ও খড়কুটো জমানোর মতো। জ্ঞানের খড়কুটো নয়, আমাদের সন্তানদের দিতে হবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সবল, তাজা বীজ। যে বীজ অঙ্কুরিত হয়ে, শাখা-প্রশাখায় বৃদ্ধি পেয়ে জ্ঞানের বটবৃক্ষ হয়ে উঠবে। শিশুরা সব সময়ই সৃজনশীল। মুখস্থবিদ্যা দিয়ে সে সৃজনশীলতার চারাগাছকে আমরা যেন মেরে না ফেলি। আনন্দহীন মুখস্থ পড়াশোনা শুধু সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে, তা নয়। এর ফলে জ্ঞান অর্জনের প্রতি তাদের বিরক্তি বাড়ে ও ক্রমশ অনাগ্রহী হয়ে ওঠে।
৪. মেধাবী ও বিদ্বান হওয়া মানে: ‘পরীক্ষায় উচ্চ নম্বর পাওয়া, প্রথম হওয়া, সেরা ফল অর্জন করা।’ আমরা ভুলে যাই আমরা নিজেরা কেমন ফলাফল করেছি। নিজেদের অপূর্ণতা, ব্যর্থতার ক্ষতিপূরণ করতে আমরা সন্তানদের দ্বারা অধিক অর্জনের দিকে বেশি উৎসাহী হয়ে উঠি। পরীক্ষায় প্রথম হয় কেবল একজনই। তা ছাড়া পরীক্ষায় প্রথম হলেই মূল জীবন-পরীক্ষায় অনেকেই চরমভাবে ব্যর্থ হন, অন্যদের থেকে অনেক পিছিয়ে থাকেন। সন্তানদের জন্য অতি উচ্চমান নির্ধারণ করে দিয়ে আমরা তাদের অনিবার্য, ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিই। সে ব্যর্থতা তাকে হতাশ করে, ক্ষুব্ধ করে ও তার শক্ত বিশ্বাসের ভিতকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়।
৫. অন্যদের সঙ্গে তুলনা: যারা ভালো রেজাল্ট করে তাদের সঙ্গে ‘অন্তহীনভাবে তুলনা করা’। এর ফলে শিশুর আত্মসম্মান বোধে আঘাত লাগে। সে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়। তার ভেতর হতাশা ও হীনম্মন্যতা বোধ তৈরি হয়। সে নিজেকে অপছন্দ করতে শুরু করে এবং অন্যদেরও অপছন্দ ও ঘৃণা করতে শেখে। ফলে তার পক্ষে ‘ভালো কিছু করা’ সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।
তবে অভিভাবকেরা প্রশ্ন করতে পারেন—তাহলে আমরা কি সন্তানদের পড়াশোনার জন্য কোনো চাপ দেব না? তাদের ইচ্ছামতো চলতে দেব? উত্তর হচ্ছে—না, সন্তানদের ওপর অবশ্যই আমাদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। তাদের পড়াশোনা, অন্য কাজ বা আচরণের ওপর নিবিড় তত্ত্বাবধান ও নিরীক্ষণ থাকতে হবে। আরও যা যা করতে হবে: তাদের একজন পূর্ণ ব্যক্তির মতো সম্মান করতে হবে; তারা ইতিমধ্যে কী জানে ও কোন কোন বিষয়ে দক্ষ সে ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে; তাদের উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত রাখতে হবে। শিশুরা যা-ই করে সবই প্রশংসার যোগ্য—তাই প্রতিবার তাদের প্রশংসা করতে হবে ও কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে; তাদের কখনো সমালোচনা করবেন না, উপহাস করবেন না বা অন্যদের সঙ্গে তুলনা করবেন না, তাদের নিজেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে বলুন, অন্যদের সঙ্গে নয় (এবারের ফলাফলের চেয়ে পরেরবারের ফলাফল যাতে ভালো হয় সেটি করতে উৎসাহ দিন, অমুকের মতো ফলাফল করার জন্য নয়); পড়াশোনা ছাড়াও খেলাধুলা, নাচ-গান, চিত্রাঙ্কন, অভিনয় প্রভৃতি ক্ষেত্রেও তাদের উৎসাহ দিন; হূদয়ের উষ্ণতা ও ভালোবাসা দিয়ে আত্মিক বন্ধন তৈরি করুন; অতি উচ্চমান নির্ধারণ না করে বাস্তবভিত্তিক প্রত্যাশা করুন; ‘ব্যর্থতা ও চ্যালেঞ্জের মূলে অধিক চেষ্টা’ ও ‘লেগে থাকার’ জন্য উদ্বুদ্ধ করুন; নিজেদের নিয়ে যাতে তারা গর্ব অনুভব করে তেমন আত্মপরিচিতি ও আত্মসম্মানবোধ তৈরিতে সহায়তা করুন; তাদের কাজের ও ফলাফলের মূল্যায়ন সবার সামনে না করে তাদের ডেকে নিয়ে আলাদাভাবে বলুন; স্কুল-কলেজে ভালো ফল করা ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দেওয়ার নাম করে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করার প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করুন। বিজ্ঞানসম্মত এ ধারণা তাদের সামনে তুলে ধরুন; শিক্ষার ধরনের মধ্যে ব্যক্তিগত ও সামাজিক সামর্থ্যগুলোকেও জায়গা করে দিতে হবে; সর্বোপরি এমন পরিবেশ তৈরি করুন, যা সবার কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেয় যে সব ছাত্রছাত্রীই শিখতে সক্ষম।
 মো. তাজুল ইসলাম: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
bap@agmi.com

No comments

Powered by Blogger.