লিবিয়া-বিপ্লব, না ঔপনিবেশিক যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি? by মশিউল আলম

লিবিয়ায় যা চলছে, তা কি বিপ্লব? তিউনিসিয়া ও মিসরের মতো স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থান? গাদ্দাফির টানা ৪১ বছরের স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে লিবিয়ার জনগণ অবশেষে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে? তাহলে বেনগাজি ও অন্য কয়েকটি শহরে প্রায় একই সময়ে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ওপর সশস্ত্র হামলা, বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায়


ভাঙচুর-লুটপাট, একদম শুরু থেকেই ‘বিদ্রোহী’ যুবকদের হাতে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র—এসবের তাৎপর্য কী? তারা এসব অস্ত্র পেল কোথা থেকে? পূর্বপরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছাড়া কি এ রকম সুসংগঠিত সশস্ত্র অভিযান শুরু হতে পারে? স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভ কি প্রথম থেকেই এমন সংগঠিত ও সহিংস হয়?
এর আগে তিউনিসিয়ায় বা মিসরে কিন্তু এ রকম হয়নি। ওই দুটি দেশে বিক্ষোভকারীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। ফেসবুক-টুইটার প্রজন্মের ওই তরুণ-যুবকেরা, বিশেষত মিসরে, আন্দোলনের শুরু থেকেই ছিল অহিংস, কোনো অস্ত্রপাতি ছিল না তাদের হাতে। বরং তাদেরই ওপর চড়াও হয়েছিল সরকারের পুলিশ। মোবারকের গুপ্ত পুলিশের একটা বড় অংশ সাদা পোশাকে খুন-জখম ও অনেক নাশকতা করেছে। একপর্যায়ে কায়রোর ফ্রিডম স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের ওপর মোবারক লেলিয়ে দিয়েছিলেন ভাড়াটে সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনী। কিছু কিছু জায়গায় পুলিশ সাদা পোশাকে লুটপাট চালিয়েছিল—জনগণের আন্দোলনকে বিপথে নেওয়ার চেষ্টায়। কিন্তু আন্দোলনকারীরা বিপথগামী হয়নি। শান্তিপূর্ণভাবেই তারা মোবারককে বিদায় নিতে বাধ্য করেছে। বেন আলীও পালিয়ে সৌদি আরবে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন—বিক্ষোভকারীদের কালাশনিকভ বা আরপিজি ব্যবহার করতে হয়নি।
তিউনিসিয়ার বেন আলী ও মিসরের হোসনি মোবারক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন এ কারণে যে, তাঁদের পায়ের তলার সব মাটি সরে গিয়েছিল। সামরিক বাহিনীগুলোও তাঁদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কিন্তু লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির অবস্থা ঠিক সে রকম নয়। তাঁর পায়ের তলায় এখনো কিছু মাটি আছে, নইলে তিনি নিজের জায়গায় এখনো রয়েছেন কী করে? গাদ্দাফির সামরিক বাহিনী, জবরদস্ত আমলাতন্ত্র, পার্টির জনকমিটিগুলোর অধিকাংশই এখনো তাঁর সঙ্গে আছে। রাজধানী ত্রিপোলিতে বিদ্রোহীরা সুবিধা করতে পারেনি; শুধু এ জন্য নয় যে সেখানে গাদ্দাফির সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি বেশি, বরং এ কারণেও যে রাজধানীর জনসাধারণ গাদ্দাফির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। যারা তাঁকে উৎখাত করার জন্য অস্ত্র হাতে পথে বের হয়েছে, তারা বহু গোত্রে বিভক্ত লিবিয়ার সমস্ত জনসাধারণের প্রতিনিধি নয়। আমেরিকান ওয়েবসাইট কাউন্টারপাঞ্চ লিখেছে, খালিফা হিফতার নামের এক লিবীয় সিআইএর চর আমেরিকা থেকে লিবিয়ায় ফিরে গেছেন গাদ্দাফির বিরুদ্ধে লড়াইরত বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিতে। ব্রিটিশ ও মার্কিন সামরিক গোয়েন্দারাও এখন লিবিয়ায় খুব সক্রিয়। তারা বাছবিচার করছে বিদ্রোহীদের কোন অংশকে অস্ত্র দেওয়া উচিত, কোন অংশকে নয়। কারণ, ইয়েমেনের ঘাঁটিগুলো থেকে আল-কায়েদার জঙ্গিরাও গিয়ে ঢুকে পড়েছে লিবিয়ায়।
লিবিয়ার এই গৃহযুদ্ধ একান্তই তার নিজস্ব সংকট, এ থেকে উত্তরণের পথ লিবীয়রা নিজেরাই বের করে নেবে—এ রকম ভেবে ‘মহান বিশ্বসম্প্রদায়’ হাত গুটিয়ে বসে নেই। গাদ্দাফির সশস্ত্র সেনাদের হাত থেকে লিবিয়ার ‘নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণকে রক্ষা’ করতে হবে, তাই লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ দরকার—এই বলে আমেরিকার নেতৃত্বে ‘দি ওয়ার্ল্ড কমিউনিটি’ লিবিয়ায় হাজির। আকাশ থেকে তারা বোমা ফেলছে, গোলা নিক্ষেপ করছে; ভূমধ্যসাগর থেকে ছুড়ছে টমাহক মিসাইল। সাদ্দামের হাতে ‘ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র’ আছে—এই ভুয়া অজুহাতে এবং ইরাকের জনগণকে ‘মুক্তি ও গণতন্ত্র’ উপহার দেওয়ার সংকল্প নিয়ে ইরাকে তারা যা করেছে, এখন ভিন্ন অজুহাতে লিবিয়ায় ঠিক তা-ই শুরু করেছে। ইরাকে এ পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে যারা, আজ তারা লিবিয়ায় ঢুকেছে সেখানকার নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণকে রক্ষা করতে! এখন সামনের দিনগুলোতে হিসাব রাখতে হবে, বেসামরিক নিরস্ত্র মানুষ গাদ্দাফির সেনাদের হাতে মারা যায় কতজন, আর ‘দি ওয়ার্ল্ড কমিউনিটি’র বাহিনীর হাতে বেঘোরে প্রাণ হারায় কতজন। কদিন আগেই তাদের হাতে মারা গেল নয়জন বিদ্রোহী, তিনজন মেডিকেল শিক্ষার্থী আর একজন অ্যাম্বুলেন্স-কর্মী। তারপর গত ৬ এপ্রিল আবার ব্রেগা শহরে ন্যাটো বাহিনীর হামলায় মারা গেল তেরোজন বিদ্রোহী। উইকিলিকসের ফাঁস করা ভিডিওচিত্র ‘কোল্যাটারাল মার্ডার’ দেখিয়েছে, বাগদাদে আমেরিকান সেনারা অ্যাপাচি হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে কী নৃশংস কৌতুকের সঙ্গে হত্যা করেছে ১২ জন নিরীহ সাধারণ মানুষকে, যাদের মধ্যে ছিল রয়টারের তিনজন সাংবাদিক-ক্যামেরাম্যান, এমনকি একটি শিশুও। একটা করে মানুষ মেরে তারা হেসে তৃপ্তি প্রকাশ করেছে ‘নাইস শট!’ বলে। আফগানিস্তানে তারা কী বর্বরভাবে সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে, তার ছবিও সম্প্রতি ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয়েছে।
এই আমেরিকা তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে এখন ঢুকেছে লিবিয়ায়। পণ্ডিতেরা বলছেন, এটা উপনিবেশবাদের নতুন চেহারা: নয়া উপনিবেশবাদ। কথাটা অতিব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেছে; কিন্তু বাস্তবতার বর্ণনায় এর চেয়ে জুতসই শব্দ এখনো কেউ খুঁজে পায়নি। বিশ্ব সম্প্রদায় বা ‘ওয়ার্ল্ড কমিউনিটি’ কথাটার বাতাবরণে আফগানিস্তানে, ইরাকে, লিবিয়ায় সামরিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে নয়া উপনিবেশবাদ, যার মোড়ল আমেরিকা। আমেরিকার ‘মুক্তি ও গণতন্ত্র’ রপ্তানির বাজার সিলেক্টিভ। সব স্বৈরশাসকের দেশে তারা ওগুলো রপ্তানি করে না। তৃতীয় বিশ্বের স্বৈরশাসকদের সম্পর্কে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিনডন জনসন নাকি বলতেন, ‘তারা বাস্টার্ড হতে পারে, তবে আমাদের বাস্টার্ড।’ মানে নিজেদের লোক। ইরানের শাহ, মিসরের মোবারক, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো, পাকিস্তানের আইয়ুব খান—কে ‘বাস্টার্ড’ ছিলেন না? এখনো তো জর্ডান, মরক্কো, বাহরাইনের শাসকেরা ‘বাস্টার্ড’। কিন্তু আমেরিকা তাঁদের উৎখাত করার তাগিদ বোধ করছে না, কারণ তাঁরা ‘আমাদের বাস্টার্ড’। লিবিয়ার ব্যাপারে আমেরিকা তক্কে তক্কে ছিল, কারণ গাদ্দাফি ‘আমাদের বাস্টার্ড’ নন। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন শত্রুপক্ষের মিত্র। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরও তিনি সোজা রাস্তায় আসেননি। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে যাকে পার্টনার বলে, গাদ্দাফির লিবিয়া আমেরিকার কাছে তা নয়। ওবামা আসার আগে বুশ সাহেব আফ্রিকা অঞ্চলে আমেরিকার আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে ‘ইউএস আফ্রিকা কম্যান্ড’ (আফ্রিকম) গঠন করেছেন; আফ্রিকার ৪৯টি দেশ সেটিতে যোগ দিয়েছে, কিন্তু গাদ্দাফি যোগ দেননি।
তাঁর অপরাধ আরও আছে। তেলের দাম পড়ে গেলে ২০০৯ সালের শুরুর দিকে তিনি বলেছিলেন, তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর উচিত বিদেশি কোম্পানিগুলোর হাত থেকে তেলক্ষেত্রগুলো নিজ নিজ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়া, মানে জাতীয়করণ করা। ‘আমাদের তেলের দাম ওঠানামার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতেই নিয়ে নেওয়া উচিত’—২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি গাদ্দাফি এমন কথা বলেছিলেন। তাঁর এই কথা শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিল সেই সব বহুজাতিক বিদেশি কোম্পানি, যারা লিবিয়ায় টাকা বানাচ্ছে: অ্যাংলো-ডাচ কোম্পানি শেল, ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিল, হেস কর্প, ম্যারাথন অয়েল, অক্সিডেন্টাল, ওএমভি, নরওয়ের স্টেটঅয়েল, ইতালির এনি, কানাডীয় পেট্রো কানাডা। তারপর, বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রডাকশন শেয়ারিং অ্যাগ্রিমেন্ট সংশোধন করে গাদ্দাফি ৫৪০ কোটি মার্কিন ডলার রাজস্ব জমা করেছিলেন লিবিয়ার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে।
আরও আছে। গাদ্দাফি সামরিক সরঞ্জাম কেনেন রাশিয়ার কাছ থেকে। এই মুহূর্তে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থা রাসআবারোনএক্সপোর্তর কাছ থেকে লিবিয়ার চার শ কোটি ডলারের অস্ত্র কেনার চুক্তি আছে (গাদ্দাফির পতন ঘটলে রাশিয়া এই অর্থ হারাবে)। বেসামরিক খাতেও রাশিয়ার সঙ্গে গাদ্দাফির লিবিয়ার ব্যবসা অনেক। তাৎনেফৎ, গাজপ্রোম, স্ত্রোইত্রান্সগাজ, রাশান রেলওয়ে—এসব রুশ কোম্পানি লিবিয়ায় ব্যবসা করছে। গাদ্দাফি সিতর, বেসিন ও গাদামেসে তিনটি তেলক্ষেত্র উন্নয়নের জন্য তাৎনেফৎ কোম্পানিকে ছাড় দিয়েছেন। তাৎনেফৎ লিবিয়ায় শুধু ২০০৯ সালেই বিনিয়োগ করেছে ৪৩ লাখ ডলার। ২০০৮ সালে লিবিয়ার ন্যাশনাল অয়েল করপোরেশনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত এক সহযোগিতা স্মারকের আওতায় তাৎনেফৎ লিবিয়ায় নতুন নতুন তেলক্ষেত্রের অনুসন্ধান ও নির্মাণের অংশীদারি পেয়েছে। গাদ্দাফি সিতর থেকে বেনগাজি পর্যন্ত ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ আধুনিক দ্রুতগতির ট্রেন চলাচলের উপযোগী রেলপথ নির্মাণের কাজ (২২০ কোটি ইউরোর প্রকল্প) দিয়েছেন রাশান রেলওয়েকে। এসব ছাড়াও রাশিয়ার বিভিন্ন কাঁচামালের অন্যতম বৃহৎ ক্রেতা গাদ্দাফির লিবিয়া।
আমেরিকা ও তার মিত্ররা যেন বা মোক্ষম মুহূর্তটির অপেক্ষায় ওত পেতে ছিল। আরব বিশ্বে গণজাগরণের সুবাদে সেই মুহূর্তটি তারা এবার লুফে নিয়েছে। এখন তো সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। মুক্তকচ্ছ পুঁজিতান্ত্রিক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ আমেরিকানদের প্রিয়পাত্র। লিবিয়ায় নো ফ্লাই জোন আরোপের প্রস্তাবে রাশিয়া জাতিসংঘে ভেটো দেয়নি। রুশ জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন অবশ্য লিবিয়ায় ফ্রাঙ্কো-মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপকে মধ্যযুগীয় হামলা বলে নিন্দা করেছেন; কিন্তু পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে দায়িত্বশীল প্রেসিডেন্ট যখন পুতিনের নিন্দার সমালোচনা করলেন, তখন পুতিন চেপে গেলেন। রাশিয়ার কোম্পানিগুলো এখন পথ খুঁজছে কীভাবে লিবিয়ায় অন্তত বেসামরিক ব্যবসাগুলো ধরে রাখা যায়।
কিন্তু লিবিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্রদের সীমাহীন লোভ। তারা সেসব ভাগাভাগি করে লুটেপুটে নেবেই; গাদ্দাফিকে যদি এই মুহূর্তে হটাতে না-ও পারে, লিবিয়ার একটা অংশকে অন্তত আলাদা করে ফেলবে। বিদ্রোহীরা তাদের অধিকৃত এলাকায় ইতিমধ্যে গাদ্দাফির ন্যাশনাল অয়েল করপোরেশনের প্রতিপক্ষ একটা সংস্থা গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল-এর সাবেক সম্পাদক পল ক্রেইগ রবার্ট কাউন্টারপাঞ্চ-এ ঠিকই লিখেছেন: ‘আমরা লিবিয়ায় যা দেখছি, তা উপনিবেশবাদের পুনর্জন্ম। তবে এখনকার পার্থক্য হলো, এবার ইউরোপের ভিন্ন ভিন্ন সরকার নিজ নিজ সাম্রাজ্য বিস্তার ও সম্পদ আহরণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়নি। নতুন উপনিবেশবাদ সক্রিয় হয়েছে “দি ওয়ার্ল্ড কমিউনিটি”র বাতাবরণে।’
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.