সহজিয়া কড়চা-জাতির স্বপ্ন ও সংবিধান by সৈয়দ আবুল মকসুদ

কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বা সমবায় সমিতি কিংবা কোনো খেলাধুলার ক্লাবের গঠনতন্ত্র আর একটি রাষ্ট্রের সংবিধান এক সমান নয়। সমিতি বা ক্লাবের গঠনতন্ত্রের কোনো ধারা সংশোধন, সংযোজন বা বিয়োজন করলে দেশের কোটি কোটি মানুষের এবং অনাগতকালের প্রজন্মের পর প্রজন্মের মানুষের কিছু আসে-যায় না।


ক্লাব বা সমিতি উঠে গেলেও দেশের মানুষের কিছু আসে-যায় না। কিন্তু একটি দেশ যখন স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তখন তার নেতারা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে মৌলিক কানুন তৈরি করেন, তা কোনো স্বল্পমেয়াদি দলিল নয়।
তবে বাস্তবতা হলো, রাষ্ট্রের সংবিধান ঐশী গ্রন্থের মতো অপরিবর্তনীয়ও নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তাতে নতুন কথা যোগ হতে পারে, পুরোনো কোনো ধারা পরিবর্তন করা যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর অর্জিত অনেক স্বাধীন দেশের সংবিধান বহুবার সংশোধন ও পরিবর্তন করা হয়েছে। তাতে আমূল অথবা মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। দেশের নাম পর্যন্ত বদলানো হয়েছে। যেমন সিলোন বা সিংহল হয়েছে শ্রীলঙ্কা, বার্মা হয়েছে মিয়ানমার। এসব করা হয় মোটামুটি সর্বসম্মতভাবে, ক্ষমতাসীন বিশেষ দলের অথবা সাময়িক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় নয়।
এক কালের নেতারাই যদি ভবিষ্যতের সব মানুষের কাজ করে যান, তা হলে পরবর্তী প্রজন্মগুলোর আর কিছুই করার থাকে না। নতুন নতুন যুগ আসে নতুন নতুন দাবি নিয়ে। সেই দাবি সেই প্রজন্মের মানুষকেই পূরণ করতে হয়। সময়, জগৎ, জীবন স্থির হয়ে বসে থাকে না। মানুষ সব সময় সঠিক কাজটি করতে পারে না। ভুল করতে করতেই এগোতে থাকে। একসময় ভুল তার চোখে পড়ে। বুদ্ধিমান হলে ভুল সে শুধরে নেয়। বুদ্ধিহীন বা মাথামোটা হলে ভুলের বোঝা সে বহন করে চলে। তখন অমঙ্গল তার পিছু ছাড়ে না।
ব্যক্তির স্বপ্ন থাকে, সম্প্রদায়ের স্বপ্ন থাকে, সমষ্টিগতভাবে একটি জাতিরও স্বপ্ন থাকে। তার সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে কৃষ্ণাঙ্গ মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ‘এক স্বপ্ন’ ছিল। ১৯৬৩ সালে ঘোষিত সেই স্বপ্ন অংশবিশেষ বাস্তবায়িত হয় একুশ শতকের প্রথম দশকে বারাক হুসেন ওবামার সাফল্যের ভেতর দিয়ে। নেলসন ম্যান্ডেলার এক স্বপ্ন ছিল তাঁর শোষিত-নিপীড়িত জাতিকে নিয়ে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাঁকে সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তাঁর জাতিকে তিনি উপহার দিয়েছেন মুক্তি। মুক্তি অর্জনের পর, তাঁকে ও তাঁর জাতিকে যাঁরা বন্দী করে নিপীড়ন করেছেন যুগ যুগ, তাঁদের তিনি ক্ষমা করে দেন—তাঁরা অনুকম্পা না চাইতেই। ক্ষমতা পেয়েও স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেন। বড় নেতা ও বড় মানুষের সেটাই বৈশিষ্ট্য।
আমাদের এই বঙ্গের শোষিত-বঞ্চিত মানুষগুলোরও একটি স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্ন স্বশাসিত হওয়ার স্বপ্ন। অন্য কারও তাঁবেদারি না করার স্বপ্ন। অন্য কেউ যেন তাদের দাবিয়ে না রাখে সেই স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের একটি অংশ পূরণ হয় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে পরাভূত করার মাধ্যমে—১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। স্বপ্নের গোটাটাই পূরণ হওয়া বাঞ্ছনীয়—অংশত নয়। ১৯৭২-এ যেদিন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়, সেদিন স্বপ্নের অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়ে যায়।
কোনো জাতির স্বপ্নের ‘অনেকটা’ আর পুরোটা পূরণ হওয়া এক কথা নয়। পুরোটা পূরণ হওয়া সাধনা ও সময়সাপেক্ষ। সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ সাধনা ছাড়া কোনো জাতির স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব নয়। কোনো জাতির যেকোনো মতাদর্শী একটি গোষ্ঠী তার স্বপ্নের একটি অংশই মাত্র পূরণ করতে পারে, পুরো স্বপ্নটি নয়। রাষ্ট্রের সংবিধানে সব শ্রেণী-পেশা, জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাই কাম্য।
রাষ্ট্রের সংবিধান লেখা আর জমির দলিল লেখা প্রায় একই ধরনের কাজ। দলিল লেখার ভাষায় যেমন একটি গদ আছে, তেমনি সংবিধান রচনায়ও কিছু বাঁধাধরা গদ আছে। ভূমি অফিসগুলোর সামনের গাছতলায় বা ছাউনিতে বসে দলিল লেখেন একজন, কিন্তু ওই দলিলে উল্লিখিত ভূসম্পত্তির মালিক ও ভোগদখলকারী মানুষ বহু। দলিল লেখক জানেন ওই ভূসম্পত্তির মালিক তিনি নন, দলিলটি লেখার দায়িত্ব বর্তেছে ঘটনাক্রমে তাঁর ওপর।
রাষ্ট্রের সংবিধান লেখার দায়িত্বও কারও না কারও ওপর বর্তায়। ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দুই সপ্তাহের মধ্যে সংবিধানের খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের নেতা ড. ভীমরাও রামজী আম্বেদকরের ওপর। তিনি ছয় মাসের মধ্যে সব শ্রেণীর সঙ্গে কথা বলে সংবিধানের খসড়া তৈরি করেন। হিন্দু কোড বিল নিয়ে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে আম্বেদকরের তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়। জওহরলাল নেহরু রাজেন্দ্র প্রসাদের বিরুদ্ধে গিয়ে আম্বেদকরকেই সমর্থন দেন। সংবিধানের যেকোনো অংশ নিয়ে মতপার্থক্য ঘটা স্বাভাবিক, শেষ পর্যন্ত যুক্তির ধোপে যা টেকে, তা-ই গ্রহণ করতে হয়। পণ্ডিত নেহরু ছিলেন রাষ্ট্রনায়ক ও বুদ্ধিজীবী। কারও অযৌক্তিক দাবি, তা তিনি যত বড় নেতাই হোন, অগ্রাহ্য করার সাহস তাঁর ছিল। ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতীয় ইউনিয়নের সংবিধান গৃহীত হয়ে যায়।
মহারাষ্ট্র সরকার প্রকাশিত আম্বেদকর রচনাবলির ত্রয়োদশ খণ্ডের নাম: ড. আম্বেদকর দ্য প্রিন্সিপাল আর্কিটেক্ট অব দ্য কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া। বইটিতে চোখ বোলালেই জানা যায়, সবার সমর্থনযোগ্য একটি সংবিধান লিখতে গিয়ে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে কী পরিশ্রমটা তিনি করেছেন। তখন উপমহাদেশের মানুষ টেলিভিশনের নামও জানত না, সুতরাং টিভি চ্যানেলকে প্রতিদিন সংবিধানে কী থাকবে না থাকবে, সে সম্পর্কে একটি করে বোমা ফাটানোর সৌভাগ্য আম্বেদকরের হয়নি। খবরের কাগজের লোকদেরও তাঁর দরজায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ার সাধ্য ছিল না। কারণ নাছোড়বান্দা রিপোর্টার হাতবোমা ছুড়ে মারলেও বাবা সাহেবের মুখ দিয়ে একটি কথাও বের হতো না। তবে দুই বছর পত্রপত্রিকায় সংবিধানসংক্রান্ত পরামর্শমূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অবস্থাটা কী, তা একমাত্র বিধাতা ছাড়া আর কেউ যে বলতে পারবেন, তা মনে হয় না। একটি থিসিসের কিছু পাতা পোকায় কাটলে এবং কিছু কিছু পাতা হারিয়ে গেলে যে অবস্থা হয়—আমাদের সংবিধানের আজ সেই অবস্থা। তার কোথায় কী লেখা আছে না আছে, তা খুঁজে বের করা যেমন-তেমন মানুষের কাজ নয়। পাঠযোগ্য হোক বা দুর্বোধ্য, একটা কনস্টিটিউশন যে আমাদের এখনো আছে—সে এক বিরাট সান্ত্বনা।
একজন নীরোগ মানুষ আর বিভিন্ন কঠিন রোগে জর্জরিত ও শয্যাগত একজন রোগীর মধ্যে যে পার্থক্য, বাহাত্তরের সংবিধানের সঙ্গে বর্তমান সংবিধানের সেই ব্যবধান। সেই সংবিধানের চিকিৎসা চলছে। নানা রকম কঠিন ব্যামো। মেডিকেল যে বোর্ড বসেছে, তাতে ডাক্তারের সংখ্যা এক ডজনের বেশি। রোগীর অপারেশনেরও প্রয়োজন হবে, মেডিসিনেরও প্রয়োজন হবে। কিন্তু মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা সব একই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। চোখের ডাক্তারকে দিয়েই ব্রেইন টিউমার অপারেশন করানো হবে। ডাক্তাররা মনে করছেন, চোখ আর মাথা তো এক জায়গায়ই। চোখের ছানি যদি কাটতে পারি, তো মাথার খুলি খুলে টিউমার কাটতে পারব না কেন? কিন্তু তিনি বোঝার চেষ্টা করেন না যে ছানি কাটা অস্ত্র দিয়ে ব্রেইনের টিউমার ফেলতে গেলে রোগী মারা না গেলেও চিরকালের জন্য অচেতন হয়ে যেতে পারে।
নেতাদের বক্তৃতা থেকে বোঝা গেছে যে মহাজোট সরকারের একটি এজেন্ডা আছে। সেই এজেন্ডার সারকথা হলো জাতির যত গলদ আছে, তা তাঁরা সাফ করবেন। যাঁরা জাতির গলদ সাফ করতে চান, তাঁদের কাছে সংবিধানের গলদ দূর করা নস্যি। অতি দ্রুত সংবিধানের তাঁরা এমন এক শুদ্ধরূপ দেবেন—আগামী পাঁচ শ বছরেও তা স্পর্শ করার সাধ্যি থাকবে না কোনো সরকারের। এই নশ্বর পৃথিবীতে নশ্বরতর সংবিধানের তাঁরা একটি অবিনশ্বর রূপ দিতে চাইছেন। তাতে যদি তাঁরা সফল হন, এবং হতেই হবে, তা হলে তা হবে মানবজাতির ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব কীর্তি।
কয়েক মাস ধরে সংবিধান নিয়ে এক কঠিন কলহ শুরু হয়েছে। এই কাইজ্যার শেষ কেয়ামতের আগে হবে, সে ভরসা নেই। সংবিধান লেখেন ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন প্রকাণ্ড পণ্ডিতেরা। কিন্তু তা যদি আমাদের মতো নাদানও পড়ে না বুঝতে পারে, তা হলে বুঝতে হবে, ওটা জনগণের সংবিধান নয়। সংবিধানের অনাগত সংস্করণ নিয়ে কত কথা ও থিসিস প্রচারিত হচ্ছে। কোনো সংবিধান অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা দখল ঠেকাতে পারে—তা আমি বিশ্বাস করি না। তা পারে জনগণ। যেদিন শেষ রাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কেউ ক্ষমতা ডাকাতি করতে চাইবে, সেদিন সকালবেলা জনগণের যার যা আছে, তা-ই নিয়ে রাস্তায় নামলেই অসাংবিধানিক পেশিওয়ালারা পালানোর পথ খুঁজে পাবে না। সে জন্য জনগণের মনোবল তৈরি করতে হবে।
সংবিধানে যাঁদের কথা বানান করে বলা আছে তাঁরা হলেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীরা, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টারা, স্পিকার, সংসদ সদস্যরা, প্রধান বিচারপতি ও বিচারকেরা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনাররা, প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানেরা প্রভৃতি।
সংবিধানে যাঁদের কথা লেখা আছে, দেশটা শুধু তাঁদের কয়েকজনের নয়। দেশটাকে ষোলো কোটি দিয়ে ভাগ দিলে, তাঁরা প্রত্যেকে মাত্র এক ভগ্নাংশের মালিক। ঠিক তাঁদের সমান মালিকানা যাদের তারা হলো: যে চাষি খেতের আলে বসে বাড়ি থেকে গামছায় বেঁধে আনা পান্তাভাত খায়, ফ্যাক্টরিতে যে শ্রমিক ক্ষুধা পেটে নিয়ে কাজ করে, ফুটপাতে বসে যে লোকটি তরিতরকারি বিক্রি করে, নগরের অলিগলিতে যে নারী কাঁধে বস্তা নিয়ে সুর করে ডেকে হাঁড়িবাসন মাজার ছাই বিক্রি করে, যে বালকটি সকাল না হতেই খালিপেটে পিঠে বস্তা নিয়ে বের হয় কাগজ ও শিশিবোতল কুড়াতে, যে হাজং, চাকমা, মুরং, মান্দি বা বর্মণ নারী একদিন সকালে গিয়ে দেখে, তার জমিটুকুতে বড় দলের নেতার ভাগিনা মাটি কাটছে, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে হাতবাঁধা অবস্থায় যে নিরস্ত্র মানুষটি ‘ক্রসফায়ারে’ মারা যায়।
গ্রাম্য কবিগানের মতো বাহাস শুরু করেছেন কিছু লোক। গ্রাম্য কবিয়ালেরা মাঠে-ঘাটে দর্শকের সামনে বাহাস করতেন, আমাদের দেশগতপ্রাণেরা টিভি চ্যানেলের ডান্ডার সামনে মুখ নিয়ে মনের যাবতীয় কথা ফাঁস করে দিচ্ছেন। কার ক্ষমতা বেশি হবে—রাষ্ট্রপতির না প্রধানমন্ত্রীর; সংসদের না সুপ্রিম কোর্টের; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুদ্দৎ কত দিনের, একবার এসে গ্যাট হয়ে বছর দুই বসে থাকবে কি না; কে কাকে ইমপিচ করার লাইসেন্স পাবে, সংসদে সাধারণ ও নারীর সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বাড়িয়ে দলের সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো যায় কতটা; জাতির জনকের মর্যাদা; স্বাধীনতার ৪০ বছর পর ‘স্বাধীনতার ঘোষকের’ রেট্রোসপেকটিভ স্বীকৃতি প্রভৃতি।
এসব কি কোনো বাহাসের বিষয় হলো, যখন নয়া উপনিবেশবাদী বিশ্বে দুর্বল দেশের বিপদের শেষ নেই? প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো দরিদ্র চাষি, কারখানার শ্রমিক, ফুটপাতের হকার, ছাইওয়ালি, কাগজ কুড়ানো বালক, আদিবাসী নারীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানে কী আছে। তাদের নাগরিক অধিকার ও মানুষ হিসেবে তাদের স্বাধীনতা রক্ষার অঙ্গীকার যে সংবিধানে নেই, তা প্রত্যাখ্যান করার পূর্ণ অধিকার তাদের আছে।
একটি ইলেকশনের রহমতি ফলাফলই শেষ কথা নয়। আর যে কোনো দিন কেউ এমন ভোট ও আসন পাবেন না—কে দিব্যি দিয়ে বলতে পারে? আমাদের এমন দেশ, এখানে ৩০০ আসনের মধ্যে যদি ২৯৫ আসন কোনো দিন কোনো মেগাজোট পায়, তাতে বিদেশি বন্ধুরা অবাক হলেও আমরা বিস্মিত হব না। ১৯৫৪ এবং ১৯৭০, ২০০১ এবং ২০০৮ তো তারই পূর্বাভাস। এবারের অবিনশ্বর সংবিধানটি যদি তাঁরা ছুড়ে ফেলে দেন—কী বলার থাকবে? সেই সরকার যদি দেশের কলাম লেখকদেরও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেন, রাজনীতিকেরা মাথা চাপড়েও তা ঠেকাতে পারবেন কি?
একটি জাতি যখন পরাধীন থাকে অথবা অন্য কারও অংশ হয়ে থাকে, তখনকার কথা আলাদা। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে যখন আত্মপ্রকাশ করে, তখন তা পরিচালিত হয় দুটি সংবিধান দিয়ে। একটি সংবিধান অলিখিত, অপরিবর্তনীয় ও অদৃশ্য: দেশটির দীর্ঘকালের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সেই সংবিধানেই বাংলা শাসিত হয়ে আসছে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময় থেকে বা তারও বহু আগে থেকে। সেই সংবিধানের আলোকেই বাংলা শাসন করেছেন পাল রাজারা, সেন রাজারা, হোসেন শাহি সুলতানেরা, মোগল আমলের নবাবেরা। ইংরেজরা এসেও সেই সংবিধান অস্বীকার করতে পারেনি। বাহাত্তরের ১১ মাস সংবিধান ছাড়া দেশ চলল কীভাবে? দ্বিতীয় সংবিধানটি লিখিত, যা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নিয়মকানুনের একটি সংকলন মাত্র। সেটি দলীয় নয়, সর্বসম্মত হতে হবে।
শাসকই আসল, সাংবিধানিক রীতিনীতি নয়। যে শাসকের গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ ও ন্যায়বিচারবোধ নেই, কোনো সংবিধানের বাবারও সাধ্য নেই তাঁকে দিয়ে জনগণের কল্যাণ করায়। তবে একটি ভালো সংবিধানে জাতির স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটে এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের ব্যবস্থা থাকে। পরামর্শ দেওয়ার এখতিয়ার নেই। একজন নগণ্য নাগরিক হিসেবে শুধু এটুকু বলতে চাই: এমন কোনো সংবিধান উপহার দেবেন না, যা জাতির দুঃস্বপ্নের কারণ হয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.