কালের পুরাণ-বুদ্ধদেব, মমতা ও আমাদের নেতা-নেত্রীরা by সোহরাব হাসান
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচনী প্রচারণা ইতিমধ্যে জমে উঠেছে। প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। প্রথম দফা ভোট গ্রহণ ১৮ এপ্রিল। কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন রাজ্যে লালদুর্গের পতন ঘটাতে।
অন্যদিকে বামফ্রন্টও মসনদ টিকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। দীর্ঘ ৩৩ বছরের শাসনে বামফ্রন্টের যেমন সাফল্য আছে, তেমনি আছে ব্যর্থতাও। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, দখলবাজি, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর জুলুমের এন্তার অভিযোগ আছে। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে শিল্প গড়তে গিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়েছে সরকার। হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। বেকারত্ব প্রকট। একদা অগ্রসর পশ্চিমবঙ্গ অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীরা ব্যাপক দুর্নীতি কিংবা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত—এ ধরনের নালিশ পরম শত্রুও আনতে পারেনি। নির্বাচনী প্রচারেও ব্যক্তি নয়, সরকারের নীতির সমালোচনা করছে বিরোধী দল।
এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর ভেতরের পাতার ছোট্ট একটি খবরে চোখ আটকে গেল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নির্বাচন কমিশনের কাছে মনোনয়নপত্র জমার সঙ্গে যে হলফনামা দাখিল করেন, তাতে তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণও রয়েছে। কলকাতা শহরে তাঁর কোনো বাড়ি নেই। ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। তিনি থাকেন কলকাতার পালম এলাকায় নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য নির্মিত দুই কক্ষের একটি সরকারি ফ্ল্যাটে। তাঁর নগদ অর্থ জমা আছে মাত্র পাঁচ হাজার রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় আট হাজার টাকা)। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য শিক্ষকতা করেন। সেই সূত্রে নিউ টাউনে ৭২০ বর্গফুটের একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। এ ছাড়া আছে নগদ অর্থ সাত হাজার রুপি, ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবে তিন লাখ তিন হাজার ২৫২ রুপি এবং পাঁচ লাখ রুপির স্থায়ী আমানত। তাঁদের একমাত্র মেয়েকে কলকাতায়ই পড়াশোনা করিয়েছেন।
২০০০ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন, তখন তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত বাড়ি ‘ইন্দিরা ভবন’-এ উঠতে বলা হয়েছিল। তিনি রাজি হননি। জ্যোতি বসু যত দিন বেঁচে ছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাড়িতে থেকেছেন। এটি ছিল নেতার প্রতি বুদ্ধদেবের সম্মান দেখানো। এমনকি জ্যোতি বসু মারা যাওয়ার পরও ইন্দিরা ভবনে ওঠেননি বুদ্ধদেব। খবরটি পড়ে পশ্চিমবঙ্গে ১১ বছর মুখ্যমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থাকা মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হলো। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের নিকটাত্মীয়। তিনি নিজেও কবিতা লেখেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে তাঁর প্রবন্ধ বই হূদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর পাঠকদের দৃষ্টি কেড়েছে। এর পাশাপাশি আমাদের নেতা-নেত্রীদের কথা ভাবুন। সরকারি বাড়ির বরাদ্দ নিয়ে তাঁরা ঝগড়াঝাটি, কাড়াকাড়ি, মারামারি, আদালতে দৌড়াদৌড়ি করতেও বাধে না। একবার কেউ এই পদ পেলে সাতপুরুষে আর কিছু করতে হয় না। তবে ব্যতিক্রম যে নেই, তা বলব না। তাঁরা ব্যতিক্রম হয়েই আছেন (যেমন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীও থাকেন ৭০০ বর্গফুটের একটি বাসায়। মন্ত্রী হওয়ার পরও সেই বাসা তিনি পরিবর্তন করেননি)।
বাংলাদেশে যাঁরা একবার মন্ত্রী-সাংসদ হয়েছেন অথচ ঢাকার অভিজাত এলাকায় বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট নেই—এ রকম উদাহরণ দুর্লভ। নামে-বেনামে একাধিক বাড়ির মালিক হয়েও মিথ্যা হলফনামা দিয়ে উত্তরা ও পূর্বাচলে প্লট নেওয়ার জন্য লাইন দেন তাঁরা। রাজউক যতবার জমি বরাদ্দ করেছে, ততবারই সাংসদদের ভাগ্য খুলে গেছে। অন্যান্য পেশার মানুষের মতো তাঁদের লটারি করে প্লট নিতে হয় না। দরখাস্ত দিলেই মঞ্জুর হয়ে যায়। এর পরই যাঁদের অগ্রাধিকার, তাঁরা হলেন সামরিক-বেসামরিক আমলা। মন্ত্রী-সাংসদেরা আসেন পাঁচ বছরের জন্য। আর আমলারা স্থায়ী। সামরিক, আধা সামরিক সরকারের আমলে তাঁদের আরও পোয়াবারো। কোথায় আইনের ফাঁকফোকর আছে, কোন আইনে কী সংশোধনী আনলে কতটা লাভবান হওয়া যাবে, সেই কূটবুদ্ধি দিতেও তাঁরা ওস্তাদ। মন্ত্রী-আমলাদের সম্পর্কটা হলো তুমিও খাও, আমাকেও ভাগ দাও। এই ভাগাভাগি নিয়ে মাঝেমধ্যে সমস্যাও দেখা দেয়।
পশ্চিমবঙ্গে কেবল বুদ্ধদেব নন, অধিকাংশ মন্ত্রী-সাংসদ খুবই সাদামাটা জীবন যাপন করেন। অনেকেরই কলকাতা শহরে নিজস্ব বাড়ি নেই। করতেও চান না। এটি যে কেবল বামপন্থী রাজনীতিকদের বেলায় ঘটেছে, তা নয়। কালীঘাটে মমতা ব্যানার্জির টালির ছাউনি দেওয়া বাড়িতে যাঁরা গেছেন, তাঁরা জানেন কত সাধারণ জীবন যাপন করেন তিনি। তাঁর বসার ঘরে কোনো সোফা নেই, চেয়ার নেই। কয়েকটি মোড়া ও একটি তক্তপোষ। কেবল বামফ্রন্টের বিরোধিতার কারণে মমতা মানুষের মন জয় করেননি, তাঁদের বিপদে-আপদে সব সময় পাশে থেকেছেন, আছেন। এই নৈতিক জোর না থাকলে তিন দশক ধরে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারতেন না। পশ্চিমবঙ্গের নেতা-নেত্রীরা রাজনীতি করেন দেশ ও জনসেবার জন্য। আর আমাদের রাজনীতিকেরা (অধিকাংশ) নিয়োজিত আত্মসেবায়, স্বজন সেবায়, বড়জোর দলসেবায়। এই দলে সুবিধা না হলে ওই দলে ভিড়ে যান। আর ওই দলেও সুবিধা না হলে ‘মধ্যরাতের পরিবর্তনের’ জন্য অপেক্ষা করেন।
বাংলাদেশে বহু গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আছে। গবেষণার জন্য তারা মোটা অঙ্কের বিদেশি অনুদানও পেয়ে থাকে। সরকারি ও বিরোধী দলের যেসব সাংসদ আছেন, ১৫ বা ২০ বছর আগে তাঁদের কী সম্পত্তি ছিল, আজ কী পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, একবার গবেষণা করতে পারেন। অবাক করা অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
গত ১৬ মার্চ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘সরকারের সব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী উপদেষ্টা, সিটি মেয়র ও সাংসদকে সম্পদের বিবরণী জমা দিতে হবে। এই হিসাব নির্ধারিত ফরমে জমা দিতে হবে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে।’ কিন্তু আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কী ছিল? প্রতিশ্রুতি ছিল ‘প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সদস্য এবং তাঁদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।’ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে হিসাব জমা দেওয়া আর জনসমক্ষে প্রকাশ করা এক কথা নয়। আমরা বুঝতে পারছি না মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের হিসাব নিয়ে কেন এই ঢাকগুড়গুড়? অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পর প্রথম আলোর টেলিফোন মন্তব্যে পাঠকেরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, জনসমক্ষে না জানালে সম্পদের হিসাব দিয়ে কোনো লাভ হবে না। গত সেপ্টেম্বরে অর্থমন্ত্রী আয়কর বিবরণী জমা দিয়ে নিজের সম্পদের হিসাব জানিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের মাধ্যমে দেশবাসীও তা জেনেছেন। তিনি পারলে অন্যদের আপত্তির কারণটি বোধগম্য নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই বলেন, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা দুর্নীতিবাজ নন। সে ক্ষেত্রে তাঁদের সম্পদ ও আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে আপত্তি কোথায়? হিসাব দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে, মন্ত্রী হওয়ার আগে কার কী ছিল এবং এখন কী আছে। আওয়ামী লীগের নেতারা কথায় কথায় চারদলীয় জোটের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জনগণ কিছু পায়। অন্যরা এলে নিজেরাই সবকিছু লুটেপুটে খায়।’ কারা পায়, কতটুকু পায়—সেই হিসাবটি দয়া করে দেশবাসীকে জানান। না হলে তারা ভাববে, চারদলীয় জোট সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তথা মহাজোটের কোনো পার্থক্য নেই। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি তদন্তে গঠিত কমিটি বৃহস্পতিবার যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে মনে হয় না ‘জনসেবক’ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এবং ‘জনদুশমন’ বিএনপির প্রভাবশালীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে অর্থমন্ত্রী কাদের নাম বাদ দিতে চাইছেন? তাঁরা কি বিএনপির প্রভাবশালী, না আওয়ামী লীগের? কিংবা দুই দলের প্রভাবশালীরা মিলেমিশে কাজটি করেছেন? এ প্রশ্নের জবাব সরকারকেই দিতে হবে।
কয়েক দিন আগে মোহালিতে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলা অনুষ্ঠিত হলো। আমরা দেখলাম, ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভিআইপি বক্সে বসে খেলা দেখলেও সোনিয়া গান্ধী ও ছেলে রাহুল ছিলেন সাধারণ দর্শক গ্যালারিতে। বাংলাদেশে ভাবা যায়, কোনো শীর্ষ নেত্রী বা ‘যুবরাজ’ গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছেন? কেউ হয়তো বলবেন, ‘আমাদের মন্ত্রীরা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সরকার চালান। সে ক্ষেত্রে তাঁদের প্রটোকল মেনে চলতে হয়। এই প্রটোকল প্রসঙ্গে আশির দশকের একটি ঘটনা মনে পড়ল। বাংলাদেশের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী ভারতে গিয়েছিলেন তাঁর প্রতিপক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলাপ করতে। তিন দফা বৈঠকে বাংলাদেশের মন্ত্রী প্রতিবারই তাঁর স্যুট-টাই বদল করলেও ভারতীয় মন্ত্রী একই পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আসেন। বাংলাদেশের মন্ত্রী লজ্জা পেয়ে চতুর্থবার স্যুট-টাই বদলাননি। মন্ত্রী দেশে ফিরে বন্ধুদের কাছে এ ঘটনা বলেছেন। এই হলো ‘পরাশক্তি’ ভারতের মন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীদের যাপিত জীবন।
একটি দেশ ও সমাজ কেবল দালানকোঠা, শিল্পকারখানা কিংবা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না। তার দাঁড়ানোর জন্য নৈতিক শক্তিও থাকা চাই। থাকা চাই সততা ও মূল্যবোধ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি খারাপ বলা যাবে না। তৈরি পোশাক, প্রবাসী-আয়সহ অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। তার পরও তারা যেই জায়গাটিতে এগিয়ে আছে, সেই জায়গাটি হলো নৈতিক শক্তি, সততা, নীতিবোধ। গত ২৬ মার্চ শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী প্রথম আলোয় ‘বাংলাদেশের ইতি-নেতি’ উপসম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের রাজনীতি, সমাজ ও শিক্ষাঙ্গন—সর্বত্র নৈতিকতার সর্বগ্রাসী অবক্ষয় ঘটেছে।’ এর জন্য কি কেবল সামরিক শাসকেরা দায়ী? কেবল মৌলবাদীরা দায়ী? ২০০৮ সালে নির্বাচনে তো তারা পরাস্ত হয়েছে। তাহলে মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করতে কেন এত অনীহা? কেন শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতাদের নাম প্রকাশ করা যাবে না? যারা জনগণের পকেট থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ছিনতাই করে নিয়েছে, তাদের নাম কেন অর্থমন্ত্রী আড়াল করবেন?
এখানেই ভারত, আরও নির্দিষ্ট করে বললে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকদের সঙ্গে আমাদের রাজনীতিকদের ফারাকটি স্পষ্ট।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর ভেতরের পাতার ছোট্ট একটি খবরে চোখ আটকে গেল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নির্বাচন কমিশনের কাছে মনোনয়নপত্র জমার সঙ্গে যে হলফনামা দাখিল করেন, তাতে তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিবরণও রয়েছে। কলকাতা শহরে তাঁর কোনো বাড়ি নেই। ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। তিনি থাকেন কলকাতার পালম এলাকায় নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য নির্মিত দুই কক্ষের একটি সরকারি ফ্ল্যাটে। তাঁর নগদ অর্থ জমা আছে মাত্র পাঁচ হাজার রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় আট হাজার টাকা)। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য শিক্ষকতা করেন। সেই সূত্রে নিউ টাউনে ৭২০ বর্গফুটের একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। এ ছাড়া আছে নগদ অর্থ সাত হাজার রুপি, ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবে তিন লাখ তিন হাজার ২৫২ রুপি এবং পাঁচ লাখ রুপির স্থায়ী আমানত। তাঁদের একমাত্র মেয়েকে কলকাতায়ই পড়াশোনা করিয়েছেন।
২০০০ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন, তখন তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত বাড়ি ‘ইন্দিরা ভবন’-এ উঠতে বলা হয়েছিল। তিনি রাজি হননি। জ্যোতি বসু যত দিন বেঁচে ছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাড়িতে থেকেছেন। এটি ছিল নেতার প্রতি বুদ্ধদেবের সম্মান দেখানো। এমনকি জ্যোতি বসু মারা যাওয়ার পরও ইন্দিরা ভবনে ওঠেননি বুদ্ধদেব। খবরটি পড়ে পশ্চিমবঙ্গে ১১ বছর মুখ্যমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থাকা মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হলো। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের নিকটাত্মীয়। তিনি নিজেও কবিতা লেখেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে তাঁর প্রবন্ধ বই হূদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর পাঠকদের দৃষ্টি কেড়েছে। এর পাশাপাশি আমাদের নেতা-নেত্রীদের কথা ভাবুন। সরকারি বাড়ির বরাদ্দ নিয়ে তাঁরা ঝগড়াঝাটি, কাড়াকাড়ি, মারামারি, আদালতে দৌড়াদৌড়ি করতেও বাধে না। একবার কেউ এই পদ পেলে সাতপুরুষে আর কিছু করতে হয় না। তবে ব্যতিক্রম যে নেই, তা বলব না। তাঁরা ব্যতিক্রম হয়েই আছেন (যেমন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীও থাকেন ৭০০ বর্গফুটের একটি বাসায়। মন্ত্রী হওয়ার পরও সেই বাসা তিনি পরিবর্তন করেননি)।
বাংলাদেশে যাঁরা একবার মন্ত্রী-সাংসদ হয়েছেন অথচ ঢাকার অভিজাত এলাকায় বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট নেই—এ রকম উদাহরণ দুর্লভ। নামে-বেনামে একাধিক বাড়ির মালিক হয়েও মিথ্যা হলফনামা দিয়ে উত্তরা ও পূর্বাচলে প্লট নেওয়ার জন্য লাইন দেন তাঁরা। রাজউক যতবার জমি বরাদ্দ করেছে, ততবারই সাংসদদের ভাগ্য খুলে গেছে। অন্যান্য পেশার মানুষের মতো তাঁদের লটারি করে প্লট নিতে হয় না। দরখাস্ত দিলেই মঞ্জুর হয়ে যায়। এর পরই যাঁদের অগ্রাধিকার, তাঁরা হলেন সামরিক-বেসামরিক আমলা। মন্ত্রী-সাংসদেরা আসেন পাঁচ বছরের জন্য। আর আমলারা স্থায়ী। সামরিক, আধা সামরিক সরকারের আমলে তাঁদের আরও পোয়াবারো। কোথায় আইনের ফাঁকফোকর আছে, কোন আইনে কী সংশোধনী আনলে কতটা লাভবান হওয়া যাবে, সেই কূটবুদ্ধি দিতেও তাঁরা ওস্তাদ। মন্ত্রী-আমলাদের সম্পর্কটা হলো তুমিও খাও, আমাকেও ভাগ দাও। এই ভাগাভাগি নিয়ে মাঝেমধ্যে সমস্যাও দেখা দেয়।
পশ্চিমবঙ্গে কেবল বুদ্ধদেব নন, অধিকাংশ মন্ত্রী-সাংসদ খুবই সাদামাটা জীবন যাপন করেন। অনেকেরই কলকাতা শহরে নিজস্ব বাড়ি নেই। করতেও চান না। এটি যে কেবল বামপন্থী রাজনীতিকদের বেলায় ঘটেছে, তা নয়। কালীঘাটে মমতা ব্যানার্জির টালির ছাউনি দেওয়া বাড়িতে যাঁরা গেছেন, তাঁরা জানেন কত সাধারণ জীবন যাপন করেন তিনি। তাঁর বসার ঘরে কোনো সোফা নেই, চেয়ার নেই। কয়েকটি মোড়া ও একটি তক্তপোষ। কেবল বামফ্রন্টের বিরোধিতার কারণে মমতা মানুষের মন জয় করেননি, তাঁদের বিপদে-আপদে সব সময় পাশে থেকেছেন, আছেন। এই নৈতিক জোর না থাকলে তিন দশক ধরে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারতেন না। পশ্চিমবঙ্গের নেতা-নেত্রীরা রাজনীতি করেন দেশ ও জনসেবার জন্য। আর আমাদের রাজনীতিকেরা (অধিকাংশ) নিয়োজিত আত্মসেবায়, স্বজন সেবায়, বড়জোর দলসেবায়। এই দলে সুবিধা না হলে ওই দলে ভিড়ে যান। আর ওই দলেও সুবিধা না হলে ‘মধ্যরাতের পরিবর্তনের’ জন্য অপেক্ষা করেন।
বাংলাদেশে বহু গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আছে। গবেষণার জন্য তারা মোটা অঙ্কের বিদেশি অনুদানও পেয়ে থাকে। সরকারি ও বিরোধী দলের যেসব সাংসদ আছেন, ১৫ বা ২০ বছর আগে তাঁদের কী সম্পত্তি ছিল, আজ কী পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, একবার গবেষণা করতে পারেন। অবাক করা অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
গত ১৬ মার্চ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘সরকারের সব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী উপদেষ্টা, সিটি মেয়র ও সাংসদকে সম্পদের বিবরণী জমা দিতে হবে। এই হিসাব নির্ধারিত ফরমে জমা দিতে হবে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে।’ কিন্তু আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কী ছিল? প্রতিশ্রুতি ছিল ‘প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সদস্য এবং তাঁদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে।’ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে হিসাব জমা দেওয়া আর জনসমক্ষে প্রকাশ করা এক কথা নয়। আমরা বুঝতে পারছি না মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের হিসাব নিয়ে কেন এই ঢাকগুড়গুড়? অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পর প্রথম আলোর টেলিফোন মন্তব্যে পাঠকেরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, জনসমক্ষে না জানালে সম্পদের হিসাব দিয়ে কোনো লাভ হবে না। গত সেপ্টেম্বরে অর্থমন্ত্রী আয়কর বিবরণী জমা দিয়ে নিজের সম্পদের হিসাব জানিয়েছিলেন। সাংবাদিকদের মাধ্যমে দেশবাসীও তা জেনেছেন। তিনি পারলে অন্যদের আপত্তির কারণটি বোধগম্য নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই বলেন, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা দুর্নীতিবাজ নন। সে ক্ষেত্রে তাঁদের সম্পদ ও আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে আপত্তি কোথায়? হিসাব দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে, মন্ত্রী হওয়ার আগে কার কী ছিল এবং এখন কী আছে। আওয়ামী লীগের নেতারা কথায় কথায় চারদলীয় জোটের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জনগণ কিছু পায়। অন্যরা এলে নিজেরাই সবকিছু লুটেপুটে খায়।’ কারা পায়, কতটুকু পায়—সেই হিসাবটি দয়া করে দেশবাসীকে জানান। না হলে তারা ভাববে, চারদলীয় জোট সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তথা মহাজোটের কোনো পার্থক্য নেই। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি তদন্তে গঠিত কমিটি বৃহস্পতিবার যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে মনে হয় না ‘জনসেবক’ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এবং ‘জনদুশমন’ বিএনপির প্রভাবশালীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে অর্থমন্ত্রী কাদের নাম বাদ দিতে চাইছেন? তাঁরা কি বিএনপির প্রভাবশালী, না আওয়ামী লীগের? কিংবা দুই দলের প্রভাবশালীরা মিলেমিশে কাজটি করেছেন? এ প্রশ্নের জবাব সরকারকেই দিতে হবে।
কয়েক দিন আগে মোহালিতে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলা অনুষ্ঠিত হলো। আমরা দেখলাম, ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভিআইপি বক্সে বসে খেলা দেখলেও সোনিয়া গান্ধী ও ছেলে রাহুল ছিলেন সাধারণ দর্শক গ্যালারিতে। বাংলাদেশে ভাবা যায়, কোনো শীর্ষ নেত্রী বা ‘যুবরাজ’ গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছেন? কেউ হয়তো বলবেন, ‘আমাদের মন্ত্রীরা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সরকার চালান। সে ক্ষেত্রে তাঁদের প্রটোকল মেনে চলতে হয়। এই প্রটোকল প্রসঙ্গে আশির দশকের একটি ঘটনা মনে পড়ল। বাংলাদেশের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী ভারতে গিয়েছিলেন তাঁর প্রতিপক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলাপ করতে। তিন দফা বৈঠকে বাংলাদেশের মন্ত্রী প্রতিবারই তাঁর স্যুট-টাই বদল করলেও ভারতীয় মন্ত্রী একই পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আসেন। বাংলাদেশের মন্ত্রী লজ্জা পেয়ে চতুর্থবার স্যুট-টাই বদলাননি। মন্ত্রী দেশে ফিরে বন্ধুদের কাছে এ ঘটনা বলেছেন। এই হলো ‘পরাশক্তি’ ভারতের মন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীদের যাপিত জীবন।
একটি দেশ ও সমাজ কেবল দালানকোঠা, শিল্পকারখানা কিংবা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না। তার দাঁড়ানোর জন্য নৈতিক শক্তিও থাকা চাই। থাকা চাই সততা ও মূল্যবোধ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি খারাপ বলা যাবে না। তৈরি পোশাক, প্রবাসী-আয়সহ অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। তার পরও তারা যেই জায়গাটিতে এগিয়ে আছে, সেই জায়গাটি হলো নৈতিক শক্তি, সততা, নীতিবোধ। গত ২৬ মার্চ শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী প্রথম আলোয় ‘বাংলাদেশের ইতি-নেতি’ উপসম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের রাজনীতি, সমাজ ও শিক্ষাঙ্গন—সর্বত্র নৈতিকতার সর্বগ্রাসী অবক্ষয় ঘটেছে।’ এর জন্য কি কেবল সামরিক শাসকেরা দায়ী? কেবল মৌলবাদীরা দায়ী? ২০০৮ সালে নির্বাচনে তো তারা পরাস্ত হয়েছে। তাহলে মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করতে কেন এত অনীহা? কেন শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতাদের নাম প্রকাশ করা যাবে না? যারা জনগণের পকেট থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ছিনতাই করে নিয়েছে, তাদের নাম কেন অর্থমন্ত্রী আড়াল করবেন?
এখানেই ভারত, আরও নির্দিষ্ট করে বললে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকদের সঙ্গে আমাদের রাজনীতিকদের ফারাকটি স্পষ্ট।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments