আরেক আলোকে-কিবা তব আচরণ, কিবা তব বাণী? by ইনাম আহমদ চৌধুরী
কী কারণে বা কী উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মনমোহন সিং এসব অযাচিত মন্তব্য করেছেন অথবা তাকে দিয়ে এসব বক্তব্য প্রকাশ করানো হয়েছে তা স্বয়ং সিং মহোদয় বা ভারত সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানে। তার সম্ভাব্য সফরের পূর্বে ওই ধরনের অনভিপ্রেত এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য সে কতটুকু হানিকারক তা সহজেই অনুমেয়।
বিশেষ করে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এটা তো খুবই মর্যাদাহানিকর এবং ক্ষতিকারক হয়েছে। এ ধরনের প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপমূলক মন্তব্যগুলোকে সরকার হজম করবে? সরকারের প্রতিক্রিয়া এ ব্যাপারে বিশেষভাবে লক্ষ্য করবে জনগণ
'কি বা তব আচরণ, কিবা তব বাণী? কিসের এ আলামত নির্ণয় ন জানি।' মাতৃভাষার প্রতি বিশ্বস্ততার বিশ্বাস হন্তাদের সম্পর্কে একজন প্রবীণ কবির বহুল প্রচলিত দুটি চরণের প্যারোডিই আজকের খবরের কাগজে প্রকাশিত দুটি লোমহর্ষক সংবাদ পঠনের এ প্রতিক্রিয়াই মনেতে জাগল।
ভারতকে আমরা বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবেই জ্ঞান করেছি। ইদানীং পত্রপত্রিকায় প্রকাশ, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নাকি অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশ তার ডালা উজাড় করে ভারতকে সম্প্রতি সবকিছু ঢেলে দিচ্ছে। সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করে, 'অসভ্যে'র মতো কোনো চার্জ, মাশুল, 'ফিন্স', ট্যাক্স বা কোনো পাওনা না চেয়ে বাণিজ্য বা অবকাঠামোর সম্ভাব্য ক্ষতিসাধন স্বীকার করে, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন না তুলে আমাদের সরকার ভারতকে 'ট্রানজিট' দিচ্ছে। অথচ আমাদেরই প্রার্থিত এ জাতীয় ট্রানজিটের আবেদন বা অনুরোধ ভারত চরম বিদ্রূপাত্মক অবহেলায় প্রত্যাখ্যান করেছিল মাত্র পাঁচ-ছয় দশক আগে। ঔপনিবেশিক পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে এসে যখন বাংলাদেশ (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগাকূল ছিল। আমাদের সরকার টিপাইমুখ নিয়ে উচ্চবাচ্য করছে না। পানিসম্পদমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন_ হোক বাঁধ, তারপর দেখা যাবে কী লাভ-ক্ষতি হলো। সীমান্তে নির্বিচারে শত শত নিরস্ত্র বাঙালি হত্যাকে নির্বিকারচিত্তে গ্রহণ করে কদাচিৎ মৃদু প্রতিবাদলিপি পাঠিয়ে দায়সারা কাজ করছে সরকার। আশ্বস্ত বোধ করেছিলাম, যখন খবরের কাগজে দেখেছিলাম ভারতীয় বিএসএফকে মারণাস্ত্র ব্যবহার বারণ বা নিরুৎসাহ করা হবে। যাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিরস্ত্র বাঙালি নাগরিক হত্যা করা না হয়। কিন্তু ১ জুলাইয়ের কাগজের একটি খবর দেখে মহাআতঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ হলাম। সংবাদে প্রকাশ, এবার পাথরের ঢিল ছুড়ে মিজানুর রহমান (২৮) নামে এক বাংলাদেশি তরুণকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। ... বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এবং এলাকাবাসী জানায়, বামন দল (পাটগ্রাম) সীমান্তের ৮৩৭ নম্বর মেইন পিলারের কাছে বৃহস্পতিবার ভোরে ভারতীয় ১০৪ ব্যাটালিয়নের বিএস বাড়ি ক্যাম্পের টহলদারি দলের সদস্যরা বাংলাদেশি কতিপয় তরুণের দিকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি ঢিল ছোড়ে। এতে মিজানুর রহমান মারাত্মকভাবে এবং জহির উদ্দিন আহত হন। জহির উদ্দিন পালিয়ে আসেন। তবে জীবন্মৃত মিজানুর রহমান অথবা তার লাশ বিএসএফ স্থানীয় সানিয়াজার নদীতে ফেলে দেয়। পরে বাংলাদেশ বিজিবি কর্তৃক হস্তান্তরিত লাশ পেয়ে পাটগ্রাম থানার ওসি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। সত্যিই তো, বিএসএফ এবার গুলি করে হত্যা করেনি। পাথরের ঢিল ছুড়ে নিরস্ত্র বাঙালিকে মেরেছে। মাত্র আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করার তাদের কথা তো রেখেছে।
পৃথিবীর দুই সার্বভৌম রাষ্ট্রের একটির সীমান্ত রক্ষী কর্তৃক এ ধরনের হত্যার কাহিনী ইতিহাসে কোথাও ঘটেছে বলে শুনিনি। বলিষ্ঠভাবে এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো বাংলাদেশ সরকার এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবশ্য করণীয়। কী করে তা দেখার জন্য জাতি আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আর এ অমানবিক বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারতীয় বিএসএফকে জানাই চরম নিন্দা ও ধিক্কার। এরই মধ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং অত্যন্ত অবিজ্ঞজনোচিত প্রথা বিগর্হিত একটি অসত্য এবং কটু মন্তব্য করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি একজন সাবধানী লোক বলেই পরিচিত, যিনি সতর্কতার সঙ্গে তার বক্তব্য প্রকাশ করেন। এ ক্ষেত্রে স্পষ্টতই তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিবেশিত তথ্য এবং পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে এ ধরনের বৈরী মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, 'আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সেখানকার (বাংলাদেশ) ২৫ শতাংশ মানুষ জামায়াতের সমর্থক এবং তারা প্রচণ্ড ভারতবিদ্বেষী। তাদের ঘিরে বিভিন্ন সময়ে আইএসআই নানা রকম চক্রান্ত করছে। কাজেই যে কোনো সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। আরও কিছু কথার অবতারণা করে তিনি আরও বলেছেন, ... এ জন্যই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা অনেক উদার। আমরা ধনী দেশ নই, তারপরও বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিচ্ছি।'
আশ্চর্য! সবাই হতবাক এবং ক্ষুব্ধ হয়েছেন এ ধরনের অযৌক্তিক, অসত্য, অসঙ্গতি এবং হঠকারী পৃষ্ঠপোষকতাসুলভ, বৈরী মন্তব্য শুনে। আমার দীর্ঘ রাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক জীবনে প্রতিবেশী কোনো দেশ ও জাতি সম্পর্কে যাকে বন্ধুজনোচিত মনে করা হয় তার সম্পর্কে এমন মন্তব্য শুনিনি। কিসের এই ঔদার্য? সে একশ' মিলিয়ন ডলার পেনের কথা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং উল্লেখ করেছেন, এ ধরনের কঠিন শর্তযুক্ত সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট পরিত্যাজ্য। এই তথাকথিত ঋণ বাংলাদেশের কী উপকারে আসবে? ভারতের ট্রানজিটের সুবিধার জন্য ভারত থেকে ভারতের পরামর্শক অনুযায়ী আমদানি করার জন্য? আর কমিটমেন্ট চার্জ এবং সুদসহ তা ফেরত দেওয়ার জন্য? বাংলাদেশের আমদানির 'অর্ডার অব প্রায়োরিটি' অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার দিয়ে কি আমরা কিছু আমদানি করতে পারব? না। আমি দীর্ঘকাল সরকারের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ছিলাম। এ ধরনের কোনো সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট বা সরবরাহকারীর ঋণের প্রস্তাব সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে সজোরে প্রত্যাখ্যান করতাম। আমার এখনও মনে হয়, রাজনৈতিক চাপে কিংবা স্বার্থবহির্ভূত কোনো কারণে বর্তমান সরকার এটি গ্রহণ করেছে। আর এ নিয়ে মনমোহন সিং কিংবা ভারতের কি-না দম্ভ। সরকারকে অনুরোধ, ফিরিয়ে দিন এই অযাচিত ক্ষতিকারক ঋণ।
মনমোহন সিংয়ের এ অযাচিত, ভিত্তিহীন এবং অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্যে বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন, এমনকি কয়েকজন বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ, কয়েকজন ভারতীয় কূটনীতিকও। বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার এবং বর্তমান একটি 'থিঙ্কট্যাঙ্ক'-এর পরিচালক দেব মুখার্জি বলেছেন, 'মনমোহনের বক্তব্য ভিত্তিহীন, দুঃখজনক। ... দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কথাগুলো বলেননি। আমি মনে করি, মন্তব্যগুলো দুর্ভাগ্যজনক। সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি পরিষ্কার ভাষণই বলেছেন_ 'অন্য একটি দেশের জনগণকে এভাবে মূল্যায়ন করাকে আমি যথার্থ মনে করি না।' বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষ জামায়াতপন্থি এই বক্তব্যের ক্ষোভ মিশ্রিত বিস্ময়ে সিক্রি বলেন, 'সংখ্যাটি কোত্থেকে এলো? এক-তৃতীয়াংশ ভোট বিএনপিতে পড়ে এবং সমসংখ্যক ভোট পড়ে আওয়ামী লীগে। বাকি ৩৩ শতাংশের বেশিরভাগই ভাসমান। তারাও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় স্বাধীনভাবে ভোট দেন। আমি মনে করি না যে, ২৫ শতাংশ মানুষ ভারতবিরোধী। 'ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে তিনি আরও বলেন, 'এর ভিত্তিতে কেউ কাউকে শ্রেণীবদ্ধ করতে পারেন না। পাকিস্তানের জনগণের ব্যাপারেও আপনি এ রকম শ্রেণী তৈরি করতে পারেন না। এরকমভাবে সরকার বা প্রতিষ্ঠানকে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়, জনগণকে নয়।'
কী কারণে বা কী উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মনমোহন সিং এসব অযাচিত মন্তব্য করেছেন অথবা তাকে দিয়ে এসব বক্তব্য প্রকাশ করানো হয়েছে তা স্বয়ং সিং মহোদয় বা ভারত সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা অথবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানে। তার সম্ভাব্য সফরের আগে ওই ধরনের অনভিপ্রেত এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য সে কতটুকু হানিকারক তা সহজেই অনুমেয়। বিশেষ করে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এটি তো খুবই মর্যাদাহানিকর এবং ক্ষতিকারক হয়েছে। এ ধরনের প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপমূলক মন্তব্যগুলোকে সরকার হজম করবে? সরকারের প্রতিক্রিয়া এ ব্যাপারে বিশেষভাবে লক্ষ্য করবে জনগণ। ভারত সরকার কি বাংলাদেশে একটি সাংঘর্ষিক অস্থিতিমূলক অবস্থা সৃষ্ট করতে চাচ্ছে?
আর ভারত সরকার এবং তাদের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে বাংলাদেশের জনগণ পরিষ্কারভাবে বলতে চায়_ মেহেরবানি করে নিজের চরকায় তেল দেন। অনর্থক আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মাথা গলাবেন না, যা করার তা করুন। আপনাদের সীমান্ত রক্ষীদের বর্বরোচিত আচরণ থেকে নিবৃত্ত করুন। ধন্যবাদ।
ইনাম আহমদ চৌধুরী : সাবেক সচিব
ও কলাম লেখক
'কি বা তব আচরণ, কিবা তব বাণী? কিসের এ আলামত নির্ণয় ন জানি।' মাতৃভাষার প্রতি বিশ্বস্ততার বিশ্বাস হন্তাদের সম্পর্কে একজন প্রবীণ কবির বহুল প্রচলিত দুটি চরণের প্যারোডিই আজকের খবরের কাগজে প্রকাশিত দুটি লোমহর্ষক সংবাদ পঠনের এ প্রতিক্রিয়াই মনেতে জাগল।
ভারতকে আমরা বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবেই জ্ঞান করেছি। ইদানীং পত্রপত্রিকায় প্রকাশ, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নাকি অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশ তার ডালা উজাড় করে ভারতকে সম্প্রতি সবকিছু ঢেলে দিচ্ছে। সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করে, 'অসভ্যে'র মতো কোনো চার্জ, মাশুল, 'ফিন্স', ট্যাক্স বা কোনো পাওনা না চেয়ে বাণিজ্য বা অবকাঠামোর সম্ভাব্য ক্ষতিসাধন স্বীকার করে, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন না তুলে আমাদের সরকার ভারতকে 'ট্রানজিট' দিচ্ছে। অথচ আমাদেরই প্রার্থিত এ জাতীয় ট্রানজিটের আবেদন বা অনুরোধ ভারত চরম বিদ্রূপাত্মক অবহেলায় প্রত্যাখ্যান করেছিল মাত্র পাঁচ-ছয় দশক আগে। ঔপনিবেশিক পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে এসে যখন বাংলাদেশ (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগাকূল ছিল। আমাদের সরকার টিপাইমুখ নিয়ে উচ্চবাচ্য করছে না। পানিসম্পদমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন_ হোক বাঁধ, তারপর দেখা যাবে কী লাভ-ক্ষতি হলো। সীমান্তে নির্বিচারে শত শত নিরস্ত্র বাঙালি হত্যাকে নির্বিকারচিত্তে গ্রহণ করে কদাচিৎ মৃদু প্রতিবাদলিপি পাঠিয়ে দায়সারা কাজ করছে সরকার। আশ্বস্ত বোধ করেছিলাম, যখন খবরের কাগজে দেখেছিলাম ভারতীয় বিএসএফকে মারণাস্ত্র ব্যবহার বারণ বা নিরুৎসাহ করা হবে। যাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিরস্ত্র বাঙালি নাগরিক হত্যা করা না হয়। কিন্তু ১ জুলাইয়ের কাগজের একটি খবর দেখে মহাআতঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ হলাম। সংবাদে প্রকাশ, এবার পাথরের ঢিল ছুড়ে মিজানুর রহমান (২৮) নামে এক বাংলাদেশি তরুণকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। ... বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এবং এলাকাবাসী জানায়, বামন দল (পাটগ্রাম) সীমান্তের ৮৩৭ নম্বর মেইন পিলারের কাছে বৃহস্পতিবার ভোরে ভারতীয় ১০৪ ব্যাটালিয়নের বিএস বাড়ি ক্যাম্পের টহলদারি দলের সদস্যরা বাংলাদেশি কতিপয় তরুণের দিকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি ঢিল ছোড়ে। এতে মিজানুর রহমান মারাত্মকভাবে এবং জহির উদ্দিন আহত হন। জহির উদ্দিন পালিয়ে আসেন। তবে জীবন্মৃত মিজানুর রহমান অথবা তার লাশ বিএসএফ স্থানীয় সানিয়াজার নদীতে ফেলে দেয়। পরে বাংলাদেশ বিজিবি কর্তৃক হস্তান্তরিত লাশ পেয়ে পাটগ্রাম থানার ওসি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। সত্যিই তো, বিএসএফ এবার গুলি করে হত্যা করেনি। পাথরের ঢিল ছুড়ে নিরস্ত্র বাঙালিকে মেরেছে। মাত্র আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করার তাদের কথা তো রেখেছে।
পৃথিবীর দুই সার্বভৌম রাষ্ট্রের একটির সীমান্ত রক্ষী কর্তৃক এ ধরনের হত্যার কাহিনী ইতিহাসে কোথাও ঘটেছে বলে শুনিনি। বলিষ্ঠভাবে এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো বাংলাদেশ সরকার এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবশ্য করণীয়। কী করে তা দেখার জন্য জাতি আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আর এ অমানবিক বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারতীয় বিএসএফকে জানাই চরম নিন্দা ও ধিক্কার। এরই মধ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং অত্যন্ত অবিজ্ঞজনোচিত প্রথা বিগর্হিত একটি অসত্য এবং কটু মন্তব্য করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি একজন সাবধানী লোক বলেই পরিচিত, যিনি সতর্কতার সঙ্গে তার বক্তব্য প্রকাশ করেন। এ ক্ষেত্রে স্পষ্টতই তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিবেশিত তথ্য এবং পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে এ ধরনের বৈরী মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, 'আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সেখানকার (বাংলাদেশ) ২৫ শতাংশ মানুষ জামায়াতের সমর্থক এবং তারা প্রচণ্ড ভারতবিদ্বেষী। তাদের ঘিরে বিভিন্ন সময়ে আইএসআই নানা রকম চক্রান্ত করছে। কাজেই যে কোনো সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। আরও কিছু কথার অবতারণা করে তিনি আরও বলেছেন, ... এ জন্যই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা অনেক উদার। আমরা ধনী দেশ নই, তারপরও বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিচ্ছি।'
আশ্চর্য! সবাই হতবাক এবং ক্ষুব্ধ হয়েছেন এ ধরনের অযৌক্তিক, অসত্য, অসঙ্গতি এবং হঠকারী পৃষ্ঠপোষকতাসুলভ, বৈরী মন্তব্য শুনে। আমার দীর্ঘ রাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক জীবনে প্রতিবেশী কোনো দেশ ও জাতি সম্পর্কে যাকে বন্ধুজনোচিত মনে করা হয় তার সম্পর্কে এমন মন্তব্য শুনিনি। কিসের এই ঔদার্য? সে একশ' মিলিয়ন ডলার পেনের কথা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং উল্লেখ করেছেন, এ ধরনের কঠিন শর্তযুক্ত সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট পরিত্যাজ্য। এই তথাকথিত ঋণ বাংলাদেশের কী উপকারে আসবে? ভারতের ট্রানজিটের সুবিধার জন্য ভারত থেকে ভারতের পরামর্শক অনুযায়ী আমদানি করার জন্য? আর কমিটমেন্ট চার্জ এবং সুদসহ তা ফেরত দেওয়ার জন্য? বাংলাদেশের আমদানির 'অর্ডার অব প্রায়োরিটি' অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার দিয়ে কি আমরা কিছু আমদানি করতে পারব? না। আমি দীর্ঘকাল সরকারের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ছিলাম। এ ধরনের কোনো সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট বা সরবরাহকারীর ঋণের প্রস্তাব সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে সজোরে প্রত্যাখ্যান করতাম। আমার এখনও মনে হয়, রাজনৈতিক চাপে কিংবা স্বার্থবহির্ভূত কোনো কারণে বর্তমান সরকার এটি গ্রহণ করেছে। আর এ নিয়ে মনমোহন সিং কিংবা ভারতের কি-না দম্ভ। সরকারকে অনুরোধ, ফিরিয়ে দিন এই অযাচিত ক্ষতিকারক ঋণ।
মনমোহন সিংয়ের এ অযাচিত, ভিত্তিহীন এবং অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্যে বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন, এমনকি কয়েকজন বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ, কয়েকজন ভারতীয় কূটনীতিকও। বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার এবং বর্তমান একটি 'থিঙ্কট্যাঙ্ক'-এর পরিচালক দেব মুখার্জি বলেছেন, 'মনমোহনের বক্তব্য ভিত্তিহীন, দুঃখজনক। ... দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কথাগুলো বলেননি। আমি মনে করি, মন্তব্যগুলো দুর্ভাগ্যজনক। সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি পরিষ্কার ভাষণই বলেছেন_ 'অন্য একটি দেশের জনগণকে এভাবে মূল্যায়ন করাকে আমি যথার্থ মনে করি না।' বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষ জামায়াতপন্থি এই বক্তব্যের ক্ষোভ মিশ্রিত বিস্ময়ে সিক্রি বলেন, 'সংখ্যাটি কোত্থেকে এলো? এক-তৃতীয়াংশ ভোট বিএনপিতে পড়ে এবং সমসংখ্যক ভোট পড়ে আওয়ামী লীগে। বাকি ৩৩ শতাংশের বেশিরভাগই ভাসমান। তারাও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় স্বাধীনভাবে ভোট দেন। আমি মনে করি না যে, ২৫ শতাংশ মানুষ ভারতবিরোধী। 'ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে তিনি আরও বলেন, 'এর ভিত্তিতে কেউ কাউকে শ্রেণীবদ্ধ করতে পারেন না। পাকিস্তানের জনগণের ব্যাপারেও আপনি এ রকম শ্রেণী তৈরি করতে পারেন না। এরকমভাবে সরকার বা প্রতিষ্ঠানকে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়, জনগণকে নয়।'
কী কারণে বা কী উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মনমোহন সিং এসব অযাচিত মন্তব্য করেছেন অথবা তাকে দিয়ে এসব বক্তব্য প্রকাশ করানো হয়েছে তা স্বয়ং সিং মহোদয় বা ভারত সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা অথবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানে। তার সম্ভাব্য সফরের আগে ওই ধরনের অনভিপ্রেত এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য সে কতটুকু হানিকারক তা সহজেই অনুমেয়। বিশেষ করে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এটি তো খুবই মর্যাদাহানিকর এবং ক্ষতিকারক হয়েছে। এ ধরনের প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপমূলক মন্তব্যগুলোকে সরকার হজম করবে? সরকারের প্রতিক্রিয়া এ ব্যাপারে বিশেষভাবে লক্ষ্য করবে জনগণ। ভারত সরকার কি বাংলাদেশে একটি সাংঘর্ষিক অস্থিতিমূলক অবস্থা সৃষ্ট করতে চাচ্ছে?
আর ভারত সরকার এবং তাদের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে বাংলাদেশের জনগণ পরিষ্কারভাবে বলতে চায়_ মেহেরবানি করে নিজের চরকায় তেল দেন। অনর্থক আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মাথা গলাবেন না, যা করার তা করুন। আপনাদের সীমান্ত রক্ষীদের বর্বরোচিত আচরণ থেকে নিবৃত্ত করুন। ধন্যবাদ।
ইনাম আহমদ চৌধুরী : সাবেক সচিব
ও কলাম লেখক
No comments