উপজেলা পরিষদ-আবারও কেন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত? by বদিউল আলম মজুমদার
নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ‘উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮’-এর কিছু সংশোধনীসহ পুনঃপ্রচলন করা হয়। এর মাধ্যমে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রণীত ‘উপজেলা পরিষদ অধ্যাদেশ, ২০০৮’, যাতে অনেক যুগোপযোগী বিধান অন্তর্ভুক্ত ছিল তা বাতিল হয়ে যায়।
১৯৯৮ সালের উপজেলা পরিষদ সংশোধিত আকারে পুনঃপ্রচলন ছিল একটি অবিবেচনাপ্রসূত অত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বর্তমানে আইনটি সংশোধনের লক্ষ্যে সংসদে একটি বিল উত্থাপন করা হয়েছে, যা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। আমরা মনে করি, প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো বহুলাংশে আগের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের সঙ্গে শুধু নতুন মাত্রাই যোগ করবে।
সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের (বা স্তরের) স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ পুনঃপ্রচলিত আইনে সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত ৩০০ সাংসদকে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা এবং উপজেলা পরিষদের ওপর উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে (২৫ ধারা), যা উপজেলা পরিষদের ওপর সাংসদদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু সাংসদেরা ‘আইন প্রণয়নে’র লক্ষ্যে ‘হাউস অব দ্য পিপল’ বা জাতীয় সংসদের জন্য নির্বাচিত, উপজেলা পরিষদের জন্য নয়। তাই উপজেলা পরিষদের ওপর কর্তৃত্ব করা সংবিধান অনুযায়ী তাঁদের এখতিয়ারবহির্ভূত। এ ছাড়া এ ধরনের বিধান সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদদের প্রতি বৈষম্যমূলক, যা আমাদের সংবিধানের নারী-পুরুষের সম-অধিকার-সম্পর্কিত মৌলিক অধিকারের [অনুচ্ছেদ ২৮(২)] পরিপন্থী।
১৯৯৮ সালের উপজেলা পরিষদ আইনটির পুনঃপ্রচলন ছিল একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে এক চরম দ্বন্দ্বাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে ‘পল্লিজীবনে গতিশীলতা অর্জন’-সম্পর্কিত ‘দিনবদলের সনদে’ অন্তর্ভুক্ত অঙ্গীকার বাস্তবায়ন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কারণ সংঘাত যেখানে, ইতিবাচক কিছু সেখানে ঘটে না। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে উগ্র দলবাজি, ফায়দাবাজি ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিলম্বও স্থানীয় উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।
এটি সুস্পষ্ট যে বিদ্যমান আইনটি অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ ও আত্মঘাতী। তবে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো আইনে পরিণত হলে এটি বহুলাংশে কালাকানুনে পরিণত হবে। বিদ্যমান আইনের ১৩ ধারায় প্রস্তাবিত সংশোধনীটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অনাস্থার মাধ্যমে অপসারণসংক্রান্ত। প্রস্তাবিত বিলে আইনের বিধানটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে: সরকার কর্তৃক অপসারণ, সহকর্মীদের অনাস্থা (১৩ক) এবং সাময়িক বরখাস্ত (১৩খ)। মূলত সহকর্মীদের অনাস্থা প্রস্তাবের যেসব শর্ত বিদ্যমান আইনে রয়েছে—যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া পর পর তিনটি সভায় অনুপস্থিতি; পরিষদ বা রাষ্ট্রের স্বার্থহানিকর কার্যকলাপে জড়িত হওয়া; নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া; অসদাচরণ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার বা পরিষদের অর্থ বা সম্পদের ক্ষতিসাধন, অত্মসাৎ বা অপপ্রয়োগে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি—সেগুলোর ব্যত্যয়ের কারণে সরকার কর্তৃক তদন্ত সাপেক্ষে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও অন্যান্য সদস্যকে অপসারণ করার বিধান বিলে প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে নির্বাচনের অযোগ্য ছিলেন বলে প্রমাণিত হলে এবং বার্ষিক ১২টির মধ্যে ন্যূনতম নয়টিতে উপস্থিত না থাকলেও প্রস্তাবিত বিল অনুযায়ী সরকার উপজেলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অপসারণ করতে পারবে। এটি সুস্পষ্ট যে প্রস্তাবিত বিলে উপজেলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অপসারণের জন্য সরকারকে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সরকার কর্তৃক অপসারণের ও সাময়িক বরখাস্তের এই বিধানের ব্যাপক অপপ্রয়োগের এবং অতীতের মতো নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকারে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বস্তুত, অপপ্রয়োগের এই সম্ভাবনা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে, কারণ অসদাচরণ ও নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ ছাড়া ওপরে উল্লিখিত অপরাধগুলোর কোনো সংজ্ঞা আইনে দেওয়া নেই। উল্লেখ্য, এ ধরনের অপপ্রয়োগ রোধের লক্ষ্যেই গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ গঠন করা হয়েছিল।
এ ছাড়া আইনে বিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণ বা শারীরিক ও মানসিক অসামর্থ্যের কারণে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা পরিষদের অন্য সদস্যদের সহকর্মীদের অনাস্থার মাধ্যমে অপসারণ করার বিধান প্রস্তাবিত বিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (ধারা ১৩ক)। তবে সরকার অনুমোদন করলেই, সেই অনুমোদন চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে, অনাস্থা কার্যকর হবে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সরকারের এ ধরনের অগাধ ক্ষমতাও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হতে বাধ্য।
উপরন্তু, অপসারণ ও সাময়িক বরখাস্তের বেলায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পুনঃবিবেচনার মাধ্যমে অপসারণ আদেশ বাতিল ও প্রত্যাহার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রেও পক্ষপাতিত্বের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং ন্যায়নীতিবোধ উপেক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে।
প্রস্তাবিত বিলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী হলো সাংসদদের উপদেষ্টা করার বিধানসম্পর্কিত। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিদ্যমান আইনের ২৫(১) ধারা অনুযায়ী, সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত ৩০০ সাংসদ উপজেলা পরিষদের ‘উপদেষ্টা হইবেন এবং পরিষদ উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ করিবে’। প্রস্তাবিত বিলে এই বিধানের শেষ অংশটুকু—পরিষদ উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ করিবে—বাদ দেওয়া হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এই সংশোধনী আকর্ষণীয় মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে তা নয়। বাস্তবে সাংসদদের অনেকেই ইতিমধ্যে উপজেলা পরিষদের ‘দখল’ নিয়ে নিয়েছেন, এতে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। আইনের এই পরিবর্তন হলেও তাঁরা পরিষদের ওপর থেকে নিজেদের হাত গুটিয়ে নেবেন বলে আশা করা দুরাশামাত্র।
এ ছাড়া, আইনের ২৫(১) উপধারা সংশোধন করা হলেও, ২৫(২) উপধারায় কোনো পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়নি। আর কেনই বা আইনের ২৫(১) ধারার সংশোধন? নিশ্চয়ই উপজেলা পরিষদের ওপর সাংসদদের কর্তৃত্ব সমস্যার সৃষ্টি করছে—প্রসঙ্গত, যা হবে বলে আমরা শুরু থেকেই বারবার সাবধান করে আসছিলাম। সমস্যা যদি হয়েই থাকে, তা হলে সাংসদদের উপজেলা পরিষদ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিযুক্ত করা নয় কেন? প্রসঙ্গত, স্থানীয় সরকারের অন্য কোনো স্তরেই তাঁদের উপদেষ্টা করা হয়নি এবং উপজেলা পরিষদের প্রতি এই বৈষম্য কেন? এর পেছনের উদ্দেশ্যই বা কী?
প্রস্তাবিত বিলে আইনের ২৯ ধারা সংশোধনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা ও ভূমিসংক্রান্ত উপজেলা পরিষদের স্থায়ী কমিটি বিলোপ করার সুপারিশ করা হয়েছে। আইন সংশোধনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির বিলোপ হবে আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ আমাদের সংবিধানের ৫৯(২)(খ) ধারা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব এবং ‘কুদরত-ই-ইলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ’ মামলার রায় অনুযায়ী, সংসদ আইন করেও তা রহিত করতে পারে না। আর স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য হলো স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যার সমাধান। যেহেতু অধিকাংশ সমস্যাই স্থানীয় এবং এগুলোর সমাধানও স্থানীয়, তাই স্থানীয় সরকার-প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যপরিধি আরও বিস্তৃত করাই হবে অধিক যুক্তিযুক্ত।
বিদ্যমান আইনের ৩৩ ধারা অনুযায়ী ইউএনওরা উপজেলা পরিষদের সচিব হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রস্তাবিত বিলে তাঁদের একই সঙ্গে পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব প্রদানের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই প্রস্তাব অযৌক্তিক, কারণ ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাররা উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের ওপর উপজেলা পরিষদের নির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ করেছেন। এরপর কীভাবে নির্বাহী ক্ষমতা সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর অর্পণ করা হয়?
রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। আর গণতন্ত্র মানে সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের শাসন। এ ছাড়া সংবিধানের ৫৯(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য পরিচালনা সুস্পষ্টভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এখতিয়ারভুক্ত। তাই সরকারি কর্মকর্তাদের উপজেলা পরিষদের নির্বাহী দায়িত্ব প্রদান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার শুধু পরিপন্থীই হবে না, তা হবে আমাদের সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। উপরন্তু, সংসদে উত্থাপিত বিলে বিদ্যমান আইনের ২৬ ধারা সংশোধন করে পরিষদের নির্বাহী ক্ষমতা উপজেলা চেয়ারম্যানের ওপর ন্যস্ত করার প্রস্তাব আনা হয়েছে। একই বিলে যুগপৎভাবে দুজনকে নির্বাহী দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব! প্রসঙ্গত, প্রধান নির্বাহী হিসেবে অবশ্যই উপজেলা চেয়ারম্যানদের দায়বদ্ধতা, পেশাদারিত্বমূলক ও সুশৃঙ্খল আচরণ নিশ্চিত করতে হবে এবং তাঁদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে।
প্রস্তাবিত বিলে চারটি ইতিবাচক বিধানও রয়েছে। বিদ্যমান আইনের ধারা ৮ পরিবর্তন করে উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যোগ্যতার মাপকাঠি আরও কঠোর করা হয়েছে। তবে প্রার্থী নিজে পরিষদের ঠিকাদার হলে কিংবা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হলে তাঁর নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার বিষয়টি আইনে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত বিলে সরকারের পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্বাচনী বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে [ধারা ২০, ধারা ৬৩(৩)], যদিও আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা সরকারের হাতে রক্ষিত। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত বিলে ৬৮ক, ৬৮খ ও ৬৮গ ধারা অন্তর্ভুক্ত করে নাগরিক সনদ, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার বিধান সংযোজন করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এসব প্রস্তাব কাঙ্ক্ষিত ও প্রশংসনীয়।
আরেকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রদের উপজেলা পরিষদের পূর্ণ সদস্য করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এটি বর্তমান উপজেলা পরিষদ আইনের আরেকটি অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং এ কারণে উপজেলা পরিষদ ভবিষ্যতে স্বাধীন সত্তা হিসেবে কাজ করতে পারবে না। কারণ সংজ্ঞাগতভাবেই প্রতিটি স্থানীয় সরকার-প্রতিষ্ঠান একে অপর থেকে স্বাধীন। তাই আমাদের প্রস্তাব হবে আইন সংশোধন করে সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রদের উপজেলা পরিষদের ‘এক্স-অপিসিও’ বা ভোটাধিকারবিহীন সদস্যে পরিণত করা, যেমন ব্যবস্থা রয়েছে প্রতিবেশী ভারতে।
আমাদের প্রশ্ন, আমাদের সাংবিধানিক নির্দেশনার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সরকার কি উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করতে চায়? যদি চায়, তাহলে জোড়াতালি দিয়ে তা করা সম্ভব হবে না। উপজেলা আইনটিকে সম্পূর্ণ পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’।
সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের (বা স্তরের) স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ পুনঃপ্রচলিত আইনে সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত ৩০০ সাংসদকে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা এবং উপজেলা পরিষদের ওপর উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে (২৫ ধারা), যা উপজেলা পরিষদের ওপর সাংসদদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু সাংসদেরা ‘আইন প্রণয়নে’র লক্ষ্যে ‘হাউস অব দ্য পিপল’ বা জাতীয় সংসদের জন্য নির্বাচিত, উপজেলা পরিষদের জন্য নয়। তাই উপজেলা পরিষদের ওপর কর্তৃত্ব করা সংবিধান অনুযায়ী তাঁদের এখতিয়ারবহির্ভূত। এ ছাড়া এ ধরনের বিধান সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদদের প্রতি বৈষম্যমূলক, যা আমাদের সংবিধানের নারী-পুরুষের সম-অধিকার-সম্পর্কিত মৌলিক অধিকারের [অনুচ্ছেদ ২৮(২)] পরিপন্থী।
১৯৯৮ সালের উপজেলা পরিষদ আইনটির পুনঃপ্রচলন ছিল একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে এক চরম দ্বন্দ্বাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে ‘পল্লিজীবনে গতিশীলতা অর্জন’-সম্পর্কিত ‘দিনবদলের সনদে’ অন্তর্ভুক্ত অঙ্গীকার বাস্তবায়ন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কারণ সংঘাত যেখানে, ইতিবাচক কিছু সেখানে ঘটে না। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে উগ্র দলবাজি, ফায়দাবাজি ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিলম্বও স্থানীয় উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।
এটি সুস্পষ্ট যে বিদ্যমান আইনটি অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ ও আত্মঘাতী। তবে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো আইনে পরিণত হলে এটি বহুলাংশে কালাকানুনে পরিণত হবে। বিদ্যমান আইনের ১৩ ধারায় প্রস্তাবিত সংশোধনীটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অনাস্থার মাধ্যমে অপসারণসংক্রান্ত। প্রস্তাবিত বিলে আইনের বিধানটিকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে: সরকার কর্তৃক অপসারণ, সহকর্মীদের অনাস্থা (১৩ক) এবং সাময়িক বরখাস্ত (১৩খ)। মূলত সহকর্মীদের অনাস্থা প্রস্তাবের যেসব শর্ত বিদ্যমান আইনে রয়েছে—যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া পর পর তিনটি সভায় অনুপস্থিতি; পরিষদ বা রাষ্ট্রের স্বার্থহানিকর কার্যকলাপে জড়িত হওয়া; নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া; অসদাচরণ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার বা পরিষদের অর্থ বা সম্পদের ক্ষতিসাধন, অত্মসাৎ বা অপপ্রয়োগে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি—সেগুলোর ব্যত্যয়ের কারণে সরকার কর্তৃক তদন্ত সাপেক্ষে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও অন্যান্য সদস্যকে অপসারণ করার বিধান বিলে প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে নির্বাচনের অযোগ্য ছিলেন বলে প্রমাণিত হলে এবং বার্ষিক ১২টির মধ্যে ন্যূনতম নয়টিতে উপস্থিত না থাকলেও প্রস্তাবিত বিল অনুযায়ী সরকার উপজেলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অপসারণ করতে পারবে। এটি সুস্পষ্ট যে প্রস্তাবিত বিলে উপজেলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অপসারণের জন্য সরকারকে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সরকার কর্তৃক অপসারণের ও সাময়িক বরখাস্তের এই বিধানের ব্যাপক অপপ্রয়োগের এবং অতীতের মতো নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকারে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বস্তুত, অপপ্রয়োগের এই সম্ভাবনা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে, কারণ অসদাচরণ ও নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ ছাড়া ওপরে উল্লিখিত অপরাধগুলোর কোনো সংজ্ঞা আইনে দেওয়া নেই। উল্লেখ্য, এ ধরনের অপপ্রয়োগ রোধের লক্ষ্যেই গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ গঠন করা হয়েছিল।
এ ছাড়া আইনে বিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণ বা শারীরিক ও মানসিক অসামর্থ্যের কারণে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা পরিষদের অন্য সদস্যদের সহকর্মীদের অনাস্থার মাধ্যমে অপসারণ করার বিধান প্রস্তাবিত বিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (ধারা ১৩ক)। তবে সরকার অনুমোদন করলেই, সেই অনুমোদন চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে, অনাস্থা কার্যকর হবে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সরকারের এ ধরনের অগাধ ক্ষমতাও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হতে বাধ্য।
উপরন্তু, অপসারণ ও সাময়িক বরখাস্তের বেলায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পুনঃবিবেচনার মাধ্যমে অপসারণ আদেশ বাতিল ও প্রত্যাহার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রেও পক্ষপাতিত্বের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং ন্যায়নীতিবোধ উপেক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে।
প্রস্তাবিত বিলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী হলো সাংসদদের উপদেষ্টা করার বিধানসম্পর্কিত। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিদ্যমান আইনের ২৫(১) ধারা অনুযায়ী, সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত ৩০০ সাংসদ উপজেলা পরিষদের ‘উপদেষ্টা হইবেন এবং পরিষদ উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ করিবে’। প্রস্তাবিত বিলে এই বিধানের শেষ অংশটুকু—পরিষদ উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ করিবে—বাদ দেওয়া হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এই সংশোধনী আকর্ষণীয় মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে তা নয়। বাস্তবে সাংসদদের অনেকেই ইতিমধ্যে উপজেলা পরিষদের ‘দখল’ নিয়ে নিয়েছেন, এতে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। আইনের এই পরিবর্তন হলেও তাঁরা পরিষদের ওপর থেকে নিজেদের হাত গুটিয়ে নেবেন বলে আশা করা দুরাশামাত্র।
এ ছাড়া, আইনের ২৫(১) উপধারা সংশোধন করা হলেও, ২৫(২) উপধারায় কোনো পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়নি। আর কেনই বা আইনের ২৫(১) ধারার সংশোধন? নিশ্চয়ই উপজেলা পরিষদের ওপর সাংসদদের কর্তৃত্ব সমস্যার সৃষ্টি করছে—প্রসঙ্গত, যা হবে বলে আমরা শুরু থেকেই বারবার সাবধান করে আসছিলাম। সমস্যা যদি হয়েই থাকে, তা হলে সাংসদদের উপজেলা পরিষদ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিযুক্ত করা নয় কেন? প্রসঙ্গত, স্থানীয় সরকারের অন্য কোনো স্তরেই তাঁদের উপদেষ্টা করা হয়নি এবং উপজেলা পরিষদের প্রতি এই বৈষম্য কেন? এর পেছনের উদ্দেশ্যই বা কী?
প্রস্তাবিত বিলে আইনের ২৯ ধারা সংশোধনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা ও ভূমিসংক্রান্ত উপজেলা পরিষদের স্থায়ী কমিটি বিলোপ করার সুপারিশ করা হয়েছে। আইন সংশোধনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির বিলোপ হবে আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ আমাদের সংবিধানের ৫৯(২)(খ) ধারা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব এবং ‘কুদরত-ই-ইলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ’ মামলার রায় অনুযায়ী, সংসদ আইন করেও তা রহিত করতে পারে না। আর স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য হলো স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যার সমাধান। যেহেতু অধিকাংশ সমস্যাই স্থানীয় এবং এগুলোর সমাধানও স্থানীয়, তাই স্থানীয় সরকার-প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যপরিধি আরও বিস্তৃত করাই হবে অধিক যুক্তিযুক্ত।
বিদ্যমান আইনের ৩৩ ধারা অনুযায়ী ইউএনওরা উপজেলা পরিষদের সচিব হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রস্তাবিত বিলে তাঁদের একই সঙ্গে পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব প্রদানের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই প্রস্তাব অযৌক্তিক, কারণ ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাররা উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের ওপর উপজেলা পরিষদের নির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ করেছেন। এরপর কীভাবে নির্বাহী ক্ষমতা সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর অর্পণ করা হয়?
রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। আর গণতন্ত্র মানে সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের শাসন। এ ছাড়া সংবিধানের ৫৯(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য পরিচালনা সুস্পষ্টভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এখতিয়ারভুক্ত। তাই সরকারি কর্মকর্তাদের উপজেলা পরিষদের নির্বাহী দায়িত্ব প্রদান গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার শুধু পরিপন্থীই হবে না, তা হবে আমাদের সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। উপরন্তু, সংসদে উত্থাপিত বিলে বিদ্যমান আইনের ২৬ ধারা সংশোধন করে পরিষদের নির্বাহী ক্ষমতা উপজেলা চেয়ারম্যানের ওপর ন্যস্ত করার প্রস্তাব আনা হয়েছে। একই বিলে যুগপৎভাবে দুজনকে নির্বাহী দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব! প্রসঙ্গত, প্রধান নির্বাহী হিসেবে অবশ্যই উপজেলা চেয়ারম্যানদের দায়বদ্ধতা, পেশাদারিত্বমূলক ও সুশৃঙ্খল আচরণ নিশ্চিত করতে হবে এবং তাঁদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে।
প্রস্তাবিত বিলে চারটি ইতিবাচক বিধানও রয়েছে। বিদ্যমান আইনের ধারা ৮ পরিবর্তন করে উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যোগ্যতার মাপকাঠি আরও কঠোর করা হয়েছে। তবে প্রার্থী নিজে পরিষদের ঠিকাদার হলে কিংবা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হলে তাঁর নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার বিষয়টি আইনে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত বিলে সরকারের পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্বাচনী বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে [ধারা ২০, ধারা ৬৩(৩)], যদিও আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা সরকারের হাতে রক্ষিত। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত বিলে ৬৮ক, ৬৮খ ও ৬৮গ ধারা অন্তর্ভুক্ত করে নাগরিক সনদ, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার বিধান সংযোজন করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এসব প্রস্তাব কাঙ্ক্ষিত ও প্রশংসনীয়।
আরেকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রদের উপজেলা পরিষদের পূর্ণ সদস্য করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এটি বর্তমান উপজেলা পরিষদ আইনের আরেকটি অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং এ কারণে উপজেলা পরিষদ ভবিষ্যতে স্বাধীন সত্তা হিসেবে কাজ করতে পারবে না। কারণ সংজ্ঞাগতভাবেই প্রতিটি স্থানীয় সরকার-প্রতিষ্ঠান একে অপর থেকে স্বাধীন। তাই আমাদের প্রস্তাব হবে আইন সংশোধন করে সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রদের উপজেলা পরিষদের ‘এক্স-অপিসিও’ বা ভোটাধিকারবিহীন সদস্যে পরিণত করা, যেমন ব্যবস্থা রয়েছে প্রতিবেশী ভারতে।
আমাদের প্রশ্ন, আমাদের সাংবিধানিক নির্দেশনার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সরকার কি উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করতে চায়? যদি চায়, তাহলে জোড়াতালি দিয়ে তা করা সম্ভব হবে না। উপজেলা আইনটিকে সম্পূর্ণ পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’।
No comments