ভূমিপুত্র ফজলুল হক খন্দকার by নূহ-উল-আলম লেনিন
ফজলুল হক খন্দকার আমাদের দেশের বামধারার আদর্শবাদের পতাকাবাহী এবং ক্লাসিক্যাল কৃষক আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় পুরোগামী, সর্বশেষ প্রতিনিধি। তার জীবনাবসানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের বামধারার ঐতিহ্যবাহী কৃষক আন্দোলনের শেষ অধ্যায়টির যবনিকাপাত ঘটল। পরিণত বয়সের সর্বস্বত্যাগী উচ্চশিক্ষিত কৃষক নেতা, বেশ
কয়েকটি কলেজ ও স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, বহুবিধ জনহিতকর সামাজিক কর্মকাণ্ডের উদ্যোক্তা এবং নিজ এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন রাজনৈতিক নেতা হওয়া সত্ত্বেও ফজলুল হক খন্দকারের মৃত্যু আমাদের গণমাধ্যমে যেমন গুরুত্ব পায়নি, তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গন ও তথাকথিত সুশীল সমাজে তেমন কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। এর জন্য ফজলুল হক খন্দকার দায়ী নন। তার মহত্ত্ব, গুরুত্ব এবং অবদানও এতে এতটুকুও ম্লান হয়নি। এতে বরং আমাদের সমাজের উৎকট উন্মার্গগামিতা, আত্মিক শক্তির দেউলিয়াত্ব, আদর্শবাদ, দেশপ্রেম, লোকহিতব্রত এবং ত্যাগ ধর্মের প্রতি ক্ষমাহীন নিরাসক্তিই প্রকাশ পেয়েছে।
ফজলুল হক খন্দকার এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার নিভৃত গ্রাম বাহেরচরে ১৯২৬ সালের ৩ জুলাই জন্ম। শিক্ষা জীবনের পাশাপাশি সম্পৃক্ত হন_ ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন এবং কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে। ১৯৬৬ সালে তিনি কিছুদিনের জন্য কাপাসিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেন। সে সময়েই কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। জেল থেকে মুক্তি লাভের পর একদিকে তিনি রায়পুরায় কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন, অন্যদিকে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে সম্পৃক্ত হন।
ষাটের দশক ছিল বাঙালি জীবনের কূলপ্লাবী দেশপ্রেমের জোয়ার, জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রবল উজ্জীবনের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের স্বপ্নাবেশে সেক্যুলার বামধারার উত্থানের যুগ। চালিকাশক্তি ছিল ছাত্র আন্দোলন। পাশাপাশি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের পুনর্গঠন, ঐতিহ্যবাহী কৃষক আন্দোলনের বিভাজন ও শক্তি-ভারসাম্যের পুনর্বিন্যাস সর্বোপরি নাগরিক মধ্যবিত্ত-বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত আত্মপ্রকাশ, সারাদেশে এক ধরনের বিপ্লবী মেজাজ এনে দিয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটেই অনুষ্ঠিত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং অর্জিত হয়েছে প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা।
১৯৬৭-৬৮ সালে বামপন্থিরা বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলার বিভিন্ন পকেটে স্থানীয় দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে গ্রামীণ কৃষক সমাজকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে। ওই সময় রায়পুরা-বেলাব অঞ্চলে বিশেষ করে বেলাব হাঁটকে কেন্দ্র করে ইজারাবিরোধী সংগঠিত শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন আবদুল হাই ও শামসুল হক। ফজলুল হক খন্দকারও এই আন্দোলনে সর্বতোভাবে যুক্ত হন। পুলিশি নির্যাতন ও জেল-জুলুম সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বেলাব হাটের ইজারাবিরোধী আন্দোলন জয়লাভ করে। প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় কৃষককর্মীদের মধ্যে।
বেলাব কৃষক আন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৬৭ সালে রায়পুরা থেকে সংগঠিত কৃষকদের বিশাল এক শোভাযাত্রা ৬০ মাইল পথ অতিক্রম করে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল। মাধবদী বাজারে রাতের বেলা ঢাকাগামী কৃষকদের ওপর অতর্কিতে পুলিশ হামলা চালায়। বহুসংখ্যক কৃষককর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় কৃষক পদযাত্রীরা। কৃষকদের 'ঢাকা চলো' এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ফজলুল হক খন্দকার।
মুক্তিযুদ্ধকালে রায়পুরা অঞ্চল ছিল ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ গেরিলা বাহিনীর প্রভাবে। শত শত কর্মী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে ফজলুল হক খন্দকার তার সাংগঠনিক প্রতিভা এবং তরুণদের ওপর তার প্রভাবকে ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন।
রায়পুরা কলেজ প্রতিষ্ঠা করে তিনি তার উপাধ্যক্ষ হয়েছিলেন। পরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে সার্বক্ষণিকভাবে কৃষক সমিতির দায়িত্ব নিতে বলা হয়। সামান্যতম দ্বিধা না করে ফজলুল হক খন্দকার কলেজের অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসেন। আশির দশকের মাঝামাঝি একদিকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের সম্পৃক্ত করা, এরশাদ সরকারের ভূমি সংস্কারের ইস্যুতে কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের ঐক্যবদ্ধ করতে গিয়ে ১৭ কৃষক-ক্ষেতমজুর সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম গড়ে তোলা, অন্যদিকে কৃষক সমিতির স্বাধীন উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানীয় দাবি-দাওয়া নিয়ে ছোট-বড় আন্দোলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৭ কৃষক ক্ষেতমজুর সংগঠন ছাড়াও এই সময়ে কৃষক সমিতি ও ক্ষেতমজুর সমিতি বেশ কিছুু ইস্যুতে স্থানীয় ও জাতীয় ভিত্তিতে সভা-সমাবেশ-আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আন্দোলন হলো, উত্তরবঙ্গে তামাকচাষি আন্দোলন, আখচাষি ধর্মঘট, পুর্জিবিরোধী আন্দোলন, পাটের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে রংপুর, গাইবান্ধা, ঈশ্বরদী, নরসিংদী, জামালপুর প্রভৃতি স্থানে পথ অবরোধ কর্মসূচি, খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ ও ডুমুরিয়া, সাতক্ষীরার কলারোয়া এবং বাগেরহাটের মোল্লারহাট প্রভৃতি থানায় চিংড়ি ঘেরের বিরুদ্ধে আন্দোলন, গ্রামীণ ব্যাংকসহ ব্যক্তিমালিকানায় গভীর নলকূপ ছেড়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এবং নলকূপে হ্রাসকৃত মূল্যে ডিজেল ও বিদ্যুৎ সংযোগের দাবিতে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে সভা-সমাবেশসহ দিনাজপুর শহরে কৃষিপণ্য সরবরাহ বন্ধ প্রভৃতি আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। ভূমি সংস্কার ও জমির পুনর্বণ্টনমূলক ক্লাসিক্যাল ধারার বাইরে এনে কৃষকদের উৎপাদন ও পণ্য বাজারজাতকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত দাবি-দাওয়া নিয়ে কিছুটা নতুন ধারার কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার আন্দোলনে বেশকিছু সাফল্যও ছিল।
ফজলুল হক খন্দকার ছিলেন এসব আন্দোলনের পুরোভাগে। প্রকৃতই তিনি ছিলেন ভূমিপুত্র এবং কৃষক দরদি একজন সহজিয়া মানুষ। সুদীর্ঘ জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি গ্রামে, কৃষকদের মধ্যে কাটিয়েছেন। গ্রামজীবনের আধুনিকায়ন, গ্রামাঞ্চলের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, ব্যাংকিং সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ এবং গ্রামজীবন থেকে কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতির অবসান ঘটানো, নারীর প্রতি বৈষম্যের লোপ ঘটিয়ে বিশেষত গ্রামীণ নারীদের সভ্যতার মূলধারায় টেনে আনা প্রভৃতি আপাত সংস্কারমূলক, কিন্তু বাস্তবে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে আমৃত্যু নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন খন্দকার ভাই। এ জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন রায়পুরা কলেজ, মহিলা মহাবিদ্যালয়, গার্লস স্কুল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র ও গণস্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র প্রভৃতি বহুসংখ্যক প্রতিষ্ঠান। বস্তুত রাজনীতিবিদের প্রচলিত পরিচয় ছাপিয়ে উঠেছিল তার সমাজ সংস্কারকের ভাবমূর্তি।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুটিল-জটিল ডায়লেকটিকস বা ডায়নামিকস নিয়ে তার বড় একটা মাথাব্যথা ছিল না। তিনি জনগণের সাধারণ আশা-আকাঙ্ক্ষা যেমন উপলব্ধি করতেন, তেমনি জাতির উন্নতি ও শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কল্যাণের সহজ-সরল পথটিই মানুষের সামনে তুলে ধরতেন। কেবল উপদেশ দিয়ে নয়, বাস্তব কাজ দিয়ে ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেন_ পথ দেখাতেন। আর এখানেই তিনি অন্য রাজনৈতিক নেতাদের থেকে আলাদা। ব্যক্তিগতভাবে অর্থবিত্তের মালিক না হলেও যে জনকল্যাণে বড় বড় প্রতিষ্ঠান গড়া যায়, সামাজিক উদ্যোগ সৃষ্টি এবং সে কাজে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সমবেত করা যায় ফজলুল হক খন্দকার আমাদের সামনে সেই অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। অভাব-অনটন, রাজনৈতিক-সাংগঠনিক সংকট, এমনকি রোগ-শোক-জরাও তাকে কখনও হতোদ্যম করতে পারেনি। বিলাস-বৈভবহীন অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন তিনি। অর্থবিত্ত-খ্যাতির লোভ যেমন তাকে স্পর্শ করেনি, তেমনি অপরের দয়া, অনুগ্রহ বা পরমুখাপেক্ষিতার মতো দৈন্যও তার চারিত্র্য মাহাত্মকে ক্ষুণ্ন করতে পারেনি। অসাধারণ মানবিক গুণাবলির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও জীবনচর্যায় তিনি ছিলেন অতি সাধারণ। আর এতটা অতি সাধারণ ছিলেন বলেই তিনি আমাদের কাছে, আমাদের উত্তর-প্রজন্মের কাছে অসাধারণ মহৎ মানুষ হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
নূহ-উল-আলম লেনিন : রাজনীতিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কৃষক সমিতি
ফজলুল হক খন্দকার এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার নিভৃত গ্রাম বাহেরচরে ১৯২৬ সালের ৩ জুলাই জন্ম। শিক্ষা জীবনের পাশাপাশি সম্পৃক্ত হন_ ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন এবং কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে। ১৯৬৬ সালে তিনি কিছুদিনের জন্য কাপাসিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেন। সে সময়েই কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। জেল থেকে মুক্তি লাভের পর একদিকে তিনি রায়পুরায় কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন, অন্যদিকে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে সম্পৃক্ত হন।
ষাটের দশক ছিল বাঙালি জীবনের কূলপ্লাবী দেশপ্রেমের জোয়ার, জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রবল উজ্জীবনের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের স্বপ্নাবেশে সেক্যুলার বামধারার উত্থানের যুগ। চালিকাশক্তি ছিল ছাত্র আন্দোলন। পাশাপাশি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের পুনর্গঠন, ঐতিহ্যবাহী কৃষক আন্দোলনের বিভাজন ও শক্তি-ভারসাম্যের পুনর্বিন্যাস সর্বোপরি নাগরিক মধ্যবিত্ত-বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত আত্মপ্রকাশ, সারাদেশে এক ধরনের বিপ্লবী মেজাজ এনে দিয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটেই অনুষ্ঠিত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং অর্জিত হয়েছে প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা।
১৯৬৭-৬৮ সালে বামপন্থিরা বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলার বিভিন্ন পকেটে স্থানীয় দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে গ্রামীণ কৃষক সমাজকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে। ওই সময় রায়পুরা-বেলাব অঞ্চলে বিশেষ করে বেলাব হাঁটকে কেন্দ্র করে ইজারাবিরোধী সংগঠিত শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন আবদুল হাই ও শামসুল হক। ফজলুল হক খন্দকারও এই আন্দোলনে সর্বতোভাবে যুক্ত হন। পুলিশি নির্যাতন ও জেল-জুলুম সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বেলাব হাটের ইজারাবিরোধী আন্দোলন জয়লাভ করে। প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় কৃষককর্মীদের মধ্যে।
বেলাব কৃষক আন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৬৭ সালে রায়পুরা থেকে সংগঠিত কৃষকদের বিশাল এক শোভাযাত্রা ৬০ মাইল পথ অতিক্রম করে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল। মাধবদী বাজারে রাতের বেলা ঢাকাগামী কৃষকদের ওপর অতর্কিতে পুলিশ হামলা চালায়। বহুসংখ্যক কৃষককর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় কৃষক পদযাত্রীরা। কৃষকদের 'ঢাকা চলো' এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ফজলুল হক খন্দকার।
মুক্তিযুদ্ধকালে রায়পুরা অঞ্চল ছিল ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ গেরিলা বাহিনীর প্রভাবে। শত শত কর্মী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে ফজলুল হক খন্দকার তার সাংগঠনিক প্রতিভা এবং তরুণদের ওপর তার প্রভাবকে ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন।
রায়পুরা কলেজ প্রতিষ্ঠা করে তিনি তার উপাধ্যক্ষ হয়েছিলেন। পরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে সার্বক্ষণিকভাবে কৃষক সমিতির দায়িত্ব নিতে বলা হয়। সামান্যতম দ্বিধা না করে ফজলুল হক খন্দকার কলেজের অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসেন। আশির দশকের মাঝামাঝি একদিকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের সম্পৃক্ত করা, এরশাদ সরকারের ভূমি সংস্কারের ইস্যুতে কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের ঐক্যবদ্ধ করতে গিয়ে ১৭ কৃষক-ক্ষেতমজুর সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম গড়ে তোলা, অন্যদিকে কৃষক সমিতির স্বাধীন উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানীয় দাবি-দাওয়া নিয়ে ছোট-বড় আন্দোলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৭ কৃষক ক্ষেতমজুর সংগঠন ছাড়াও এই সময়ে কৃষক সমিতি ও ক্ষেতমজুর সমিতি বেশ কিছুু ইস্যুতে স্থানীয় ও জাতীয় ভিত্তিতে সভা-সমাবেশ-আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আন্দোলন হলো, উত্তরবঙ্গে তামাকচাষি আন্দোলন, আখচাষি ধর্মঘট, পুর্জিবিরোধী আন্দোলন, পাটের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে রংপুর, গাইবান্ধা, ঈশ্বরদী, নরসিংদী, জামালপুর প্রভৃতি স্থানে পথ অবরোধ কর্মসূচি, খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ ও ডুমুরিয়া, সাতক্ষীরার কলারোয়া এবং বাগেরহাটের মোল্লারহাট প্রভৃতি থানায় চিংড়ি ঘেরের বিরুদ্ধে আন্দোলন, গ্রামীণ ব্যাংকসহ ব্যক্তিমালিকানায় গভীর নলকূপ ছেড়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এবং নলকূপে হ্রাসকৃত মূল্যে ডিজেল ও বিদ্যুৎ সংযোগের দাবিতে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে সভা-সমাবেশসহ দিনাজপুর শহরে কৃষিপণ্য সরবরাহ বন্ধ প্রভৃতি আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। ভূমি সংস্কার ও জমির পুনর্বণ্টনমূলক ক্লাসিক্যাল ধারার বাইরে এনে কৃষকদের উৎপাদন ও পণ্য বাজারজাতকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত দাবি-দাওয়া নিয়ে কিছুটা নতুন ধারার কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার আন্দোলনে বেশকিছু সাফল্যও ছিল।
ফজলুল হক খন্দকার ছিলেন এসব আন্দোলনের পুরোভাগে। প্রকৃতই তিনি ছিলেন ভূমিপুত্র এবং কৃষক দরদি একজন সহজিয়া মানুষ। সুদীর্ঘ জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি গ্রামে, কৃষকদের মধ্যে কাটিয়েছেন। গ্রামজীবনের আধুনিকায়ন, গ্রামাঞ্চলের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, ব্যাংকিং সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ এবং গ্রামজীবন থেকে কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতির অবসান ঘটানো, নারীর প্রতি বৈষম্যের লোপ ঘটিয়ে বিশেষত গ্রামীণ নারীদের সভ্যতার মূলধারায় টেনে আনা প্রভৃতি আপাত সংস্কারমূলক, কিন্তু বাস্তবে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে আমৃত্যু নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন খন্দকার ভাই। এ জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন রায়পুরা কলেজ, মহিলা মহাবিদ্যালয়, গার্লস স্কুল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র ও গণস্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র প্রভৃতি বহুসংখ্যক প্রতিষ্ঠান। বস্তুত রাজনীতিবিদের প্রচলিত পরিচয় ছাপিয়ে উঠেছিল তার সমাজ সংস্কারকের ভাবমূর্তি।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুটিল-জটিল ডায়লেকটিকস বা ডায়নামিকস নিয়ে তার বড় একটা মাথাব্যথা ছিল না। তিনি জনগণের সাধারণ আশা-আকাঙ্ক্ষা যেমন উপলব্ধি করতেন, তেমনি জাতির উন্নতি ও শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কল্যাণের সহজ-সরল পথটিই মানুষের সামনে তুলে ধরতেন। কেবল উপদেশ দিয়ে নয়, বাস্তব কাজ দিয়ে ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেন_ পথ দেখাতেন। আর এখানেই তিনি অন্য রাজনৈতিক নেতাদের থেকে আলাদা। ব্যক্তিগতভাবে অর্থবিত্তের মালিক না হলেও যে জনকল্যাণে বড় বড় প্রতিষ্ঠান গড়া যায়, সামাজিক উদ্যোগ সৃষ্টি এবং সে কাজে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সমবেত করা যায় ফজলুল হক খন্দকার আমাদের সামনে সেই অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। অভাব-অনটন, রাজনৈতিক-সাংগঠনিক সংকট, এমনকি রোগ-শোক-জরাও তাকে কখনও হতোদ্যম করতে পারেনি। বিলাস-বৈভবহীন অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন তিনি। অর্থবিত্ত-খ্যাতির লোভ যেমন তাকে স্পর্শ করেনি, তেমনি অপরের দয়া, অনুগ্রহ বা পরমুখাপেক্ষিতার মতো দৈন্যও তার চারিত্র্য মাহাত্মকে ক্ষুণ্ন করতে পারেনি। অসাধারণ মানবিক গুণাবলির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও জীবনচর্যায় তিনি ছিলেন অতি সাধারণ। আর এতটা অতি সাধারণ ছিলেন বলেই তিনি আমাদের কাছে, আমাদের উত্তর-প্রজন্মের কাছে অসাধারণ মহৎ মানুষ হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
নূহ-উল-আলম লেনিন : রাজনীতিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কৃষক সমিতি
No comments