সাক্ষাৎকার : মোহাম্মদ রফিকুল আমীন, চেয়ারম্যান, ডেসটিনি গ্রুপ-পালাব কোথায়, বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিশে গেছি
কালের কণ্ঠ : এমএলএম ব্যবসাটা আসলে কী এবং কিভাবে পরিচালিত হয়? মোহাম্মদ রফিকুল আমীন : আসলে এ ব্যবসার মূল নামটা হচ্ছে ডিরেক্ট সেলিং। এর একটি উপশাখা হচ্ছে এমএলএম বা মাল্টি লেভেল মার্কেটিং। ডিরেক্ট সেলিংয়ের আরেকটি শাখা হচ্ছে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং।
এ ছাড়া ডোর-টু-ডোর মার্কেটিং, টেলিমার্কেটিং, ই-কমার্স- এই সব কিছু মিলিয়ে আসলে একটি ইন্ডাস্ট্রি, যাকে বলা হয় ডিরেক্ট সেলিং ইন্ডাস্ট্রি। পৃথিবীর কমবেশি সব দেশেই রয়েছে ডিরেক্ট সেলিং অ্যাক্ট বা আইন। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আমার জানা মতে ভারতে এ আইন সরাসরি না থাকলেও একটি সার্কুলার আছে। কিভাবে ডিরেক্ট সেলিং করতে হবে তার গাইডলাইন আছে। আমাদের কাছাকাছি দেশের মধ্যে মালয়েশিয়ায় এর আইন রয়েছে। ১৯৯৩ সালে মালয়েশিয়ায় এ আইন পাস হয়। তবে সেখানে ডিরেক্ট সেলিং শুরু হয় ১৯৭১-৭২ সালের দিকে আর আইন তৈরি হয় শুরুর ২৩ বছর পর। বাংলাদেশে অনেকেই মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ও মাল্টি পারপাসকে এক করে গুলিয়ে ফেলছে; এটা কিন্তু ঠিক নয়। মাল্টি পারপাস ভিন্ন একটি ধারা, ভিন্ন আইনে চলে, আর মাল্টি লেভেল একটি নতুন আইডিয়া। কিন্তু কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের কথা শুনেছি, তাদের কার্যক্রম আমি দেখিনি। তারা নাকি মাল্টি লেভেলকে মাল্টি পারপাসের আদলে ব্যবহার করছে। আমাকে এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেছিলেন যে মাল্টি পারপাস কেন করেছেন? আমি বললাম, আমরা যারা মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ে টাকাপয়সা আয় করি, তারা এসব অর্থ দিয়ে কী করব? ব্যাংকে ফেলে রাখব? ধরুন, আমি মাল্টি লেভেল থেকে এক সপ্তাহে ১২ হাজার টাকা পেলাম। যদি সেই টাকা মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ শেয়ারে দিই, তাহলে ওই অর্থ আরো বিস্তৃত হবে, পরিধি বাড়বে। আর যদি টাকাটা নিয়ে খরচ করে ফেলতাম, সেটা মানি পলিউশন হতো। দেখুন, আমরা যদি আবর্জনা রিসাইক্লিং করি তাহলে এটাকে বলি পরিবেশ দূষণমুক্ত। তাই এখানে টাকা রিসাইক্লিং করলাম। তাহলে আমরা অপরাধ করলাম কোথায়?
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশে জিজিএন, ইউনিপে টু ইউ, যুবক-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আছে। সেগুলোর সঙ্গে ডেসটিনির পার্থক্য কোথায়? ডেসটিনি যে ব্যবসা করছে, সেটা কি ওইগুলোর মতো প্রতারণামূলক?
মোহাম্মদ রফিকুল আমীন : আপনাকে একটা কথা বলি। প্রতারণা কিন্তু একটা বোনাফায়েড প্ল্যান। কেউ যদি প্ল্যান করে, আমি মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করব, সেটা হচ্ছে প্রতারণা। মনে করুন, কেউ পরীক্ষা দিতে গিয়ে নকল করছে; এটা কিন্তু প্রতারণা। কিন্তু পরীক্ষা দিতে গিয়ে সে যদি ফেল করে এবং সে যদি লেখাপড়া না করায় রেজাল্ট খারাপ করে, তখন আপনি বলতে পারবেন না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে বা বেতন নিয়েছে কিন্তু কিছুই শেখায়নি। এটা কিন্তু ফেল। ফেল ও ফল্ট সম্পূর্ণ আলাদা। আমি আপনাকে এই প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দিই। প্রতিবছর বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালো রেজাল্ট করছে ১০০ শতাংশ। আবার বহু প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে ছাত্র ফেল করে বেশির ভাগ। আপনি শব্দটা ফেল বলবেন, না ফল্ট বলবেন? এখন পর্যন্ত যত এমএলএম কম্পানির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে, ইনটেনশনালি বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো প্রতারণা করা হয়নি। ইনটেনশন কথাটা বললাম এ জন্য যে, তাদের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে যখন প্রতিষ্ঠানটি এক জায়গায় এসে বন্ধ হয়ে গেছে তখন ভোক্তা-পরিবেশকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধরুন, আজকে যদি জিজিএন টিকে থাকত তাহলে আজকে ইতিহাসটা কিন্তু ভিন্নভাবে লেখা হতো। তাহলে জিজিএনকে কিন্তু প্রতারক কম্পানি বলা হতো না। আমিও কিন্তু জিজিএনের একজন ভোক্তা-পরিবেশক ছিলাম। আমি নিজে বলতে পারি, তারা আসলে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতারণা করেনি। তারা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে কাজটি করতে পারেনি। তারা অদক্ষ লোক দিয়ে ব্যবস্থাপনা করেছে। যারা মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ও ডিরেক্ট সেলিং বোঝে না তাদের এনে প্রশাসনিক বিভাগে বসিয়েছে। তারা মানির মিস ম্যানেজমেন্ট করেছে। এতে করে মানি শর্টেজ হয়েছে। সেল পড়ে গেছে। পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে। একপর্যায়ে গিয়ে জিজিএন আর টাকা দিতে পারেনি। আপনি কি জানেন, জিজিএন কত টাকার জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? তখন যদি তাদের কাছে মাত্র দুই কোটি টাকা থাকত, তারা বন্ধ করত না।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশ ব্যাংক তো বলেছে আপনারা তাদের অনুমতি ছাড়াই ব্যাংকিং করছেন...
রফিকুল আমীন : সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা কোনো ব্যাংকিং করছি না। কারণ আমাদের ব্যাংকিং করার কোনো রাইট নেই। আমাদের কার্যক্রম ব্যাংকিং সদৃশ, কিন্তু ব্যাংকিং নয়। সমবায় আইন আমাদের সভ্যদের কাছে শেয়ার বিক্রি করার অধিকার দিয়েছে। আমরা যারা সভ্য, তারা শেয়ার কিনেছি। এটা করার অধিকার সরকারই আমাদের দিয়েছে। আমানত সংগ্রহ এবং ঋণদান- এই পদ্ধতিকে ব্যাংকিং বলে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন তথা নোটিশ। ওই নোটিশটি ছিল মনগড়া।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তকারী দল সরেজমিনে তদন্ত করেছিল?
রফিকুল আমীন : তারা এসেছিল ৬ মার্চ। ৪৫ মিনিট আমার অফিসে ছিল। মানি লন্ডারিং হচ্ছে কি না জানতে এসেছিল। আমরা বলেছিলাম, কোনো বৈদেশিক লেনদেন করি না। তখন তারা সাদা কাগজে ১৫টি বিষয় সম্পর্কে জানতে চায়। তারা যা যা জানতে চেয়েছিল, তার সব কিছু সরবরাহ করা হয়েছে; কিন্তু তারা এর কোনো ফলাফল আমাদের জানায়নি। আমরা কোনো মিস করেছি কি না, আমাদের বিষয়ে কোনো সন্দেহ তৈরি হয়েছে কি না তাও আমাদের জানানো হয়নি। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের মাধ্যমে ব্যাংকের তদন্ত রিপোর্টের কথা জেনেছি। যদি আমাদের জানানো হতো- আপনার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাহলে সেসব বিষয়ে আমরা সংশোধন হতে পারতাম। গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে আমাকে কিছু বলা হয়নি এবং আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।
কালের কণ্ঠ : আপনার বিদেশে বাড়ি আছে এবং বিদেশে টাকা পাচার করছেন, এমন অভিযোগ তোলা হচ্ছে...
রফিকুল আমীন : আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা সরানোর। ৫০০ কোটি তো দূরের কথা, পাঁচ কোটি টাকাও যদি কেউ বের করতে পারে, তাহলে তা বাংলাদেশ সরকারকে দিয়ে দেওয়া হবে। আমার নামে কেনা জমি খুঁজে পাওয়া গেলে যাঁরা রিপোর্ট করেছেন তাঁদের দিয়ে দেওয়া হবে। সরকার ও প্রশাসনের কাছে আমার একটা অনুরোধ থাকবে, কোনো ব্যক্তি বা অন্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিংবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত হওয়ার সময়ে তা যেন পাবলিকলি মিডিয়ায় বা অন্য কারো কাছে আগে প্রকাশ করা না হয় যতক্ষণ না তদন্ত একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারে। কারণ এতে করে ওই প্রতিষ্ঠানকে তো বটেই, মিডিয়াকেও ভিকটিম করা হয়। মিডিয়া অনেক বেশি উৎসাহী হয়ে নিউজ করার পর বুঝতে পারে যে তারা ভুল করেছে। যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম, এটা প্রশাসনের একটা বড় দুর্বলতা এবং অতি উৎসাহী অফিসার যাঁরা আছেন তাঁদের এ ধরনের তদন্ত থেকে দূরে রাখা উচিত এবং নিরপেক্ষ তদন্ত অফিসার নিয়োগ করা উচিত। আমি আমার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই ধরনের নোটিশের ভিত্তিতে কেউ মনগড়া কথা লিখতে পারেন না। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ডেসটিনির পক্ষ থেকে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে কী কী ত্রুটি ছিল বলে আপনার দাবি?
রফিকুল আমীন : ওই প্রতিবেদনে ১৪টি বড় ধরনের ত্রুটি ছিল, যা ১৪টি অফেনসিভ ওয়ার্ড হিসেবে পরিচিত, যে শব্দগুলো কোনো কর্মকর্তা কখনো ব্যবহার করতে পারেন না। এর কারণে আমি ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারি। এখন মামলা করার আগে বিবেচনাধীন ওই উকিল নোটিশ। যদি তাঁরা আবার তাঁদের নোটিশকে সংশোধন করে তা প্রত্যাহার করে নেন, তাহলে আর মামলা করার প্রয়োজন হবে না। আগামী রবিবার সকাল ১১টা পর্যন্ত আমাদের নোটিশের জবাব দেওয়ার সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জবাব সন্তোষজনক না হলে আমরা মামলায় যেতে বাধ্য হব। তাঁরা যদি কঠোর অবস্থান নেন, তাঁদের কথাই যদি সত্য হিসেবে প্রমাণ করার বিষয়ে অনড় থাকেন, তাহলে আমরা কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করতে বাধ্য থাকব। আর পত্রিকাগুলো যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কথিত তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে, তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের চেয়েও আরো বেশি এবং অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে তাদের অনুমোদনহীন কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করা যাবে না। অথচ কিছু পত্রিকা সুনির্দিষ্টভাবে ডেসটিনির নাম উল্লেখ করে লেনদেন না করার কথা বলছে। আসলে বাংলাদেশ ব্যাংক কোথাও ডেসটিনির সঙ্গে লেনদেন না করার কথা বলেনি। ওই সব পত্রিকার বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছি, জবাব দেওয়ার জন্য সময়ও বেঁধে দিয়েছি। ওই সময়ের মধ্যে জবাব না পেলে আগামী রবিবার আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।
কালের কণ্ঠ : ডেসটিনির বিরুদ্ধে আগে কোনো সরকারি সংস্থা তদন্ত করেছে কি?
রফিকুল আমীন : গত ১১ বছরে সরকারের ১১টি বিভাগ ডেসটিনির বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে। ২০০৪ সালে সাপ্তাহিক ২০০০ ম্যাগাজিনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথম তদন্ত হয়। সে সময় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ তদন্ত করে কোনো অনিয়ম পায়নি। তা ছাড়া দুর্নীতি দমন ব্যুরো, ডিজিএফআই, এনএসআই, সিআইডিসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ডেসটিনি গ্রুপের বিভিন্ন বিভাগ তদন্ত করে দেখেছে। কিন্তু কোনো ধরনের দুর্নীতি খুঁজে পায়নি। সবচেয়ে বেশি তদন্ত হয়েছিল ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এ ছাড়া সমবায় অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও তদন্ত করে আমরা কোনো মানি লন্ডারিং করছি না কিংবা পরিচালকরা কোনো টাকা আত্মসাৎ করছে না। এমনকি আমাকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ডেকেও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো তদন্ত সংস্থাই আমাদের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের করতে পারেনি, এখনো আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের প্রায় ৪৫ লাখ সদস্য উদ্ভূত এ পরিস্থিতিকে কিভাবে দেখছেন?
রফিকুল আমীন : পত্রিকায় এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন দেখে অনেকে আতঙ্কিত এবং হতাশ- এটা সত্য। আমাকে অনেকে সরাসরি টেলিফোন করে জানতে চান। পরে আমার কথা শুনে তাঁরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, ডেসটিনি কারো সঙ্গে প্রতারণা করে না এবং ভবিষ্যতেও করবে না। আমরা প্রাণপণ সতর্কতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারবে না কেউ।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে, এখন আবার তদন্ত হচ্ছে...
রফিকুল আমীন : অর্থপাচারের বিষয়টি মিথ্যা ও বানোয়াট। কোনো একটি জায়গায় অর্থপাচারের কয়েকটি উদ্দেশ্য থাকে। একটি হলো- আমার এই দেশে থাকার ইচ্ছা নেই। দেশের বাইরে গিয়ে আরাম-আয়েশে থাকার চিন্তা মাথায় থাকলে টাকা সরিয়ে নিয়ে রাখতে হবে, কারণ আমি আর দেশের মাটিতে ফিরে আসব না। আরেকটি হলো পলিটিক্যালি ভিকটিম হলে। আর তৃতীয়টি হলো, এমন কোনো ব্যবসা চালু করেছি যেখানে আমার বিনিয়োগ দরকার। এ তিনটির কোনোটিই আমার মধ্যে নেই। আমি যদি চলে যাই, শুধু আমি যেতে পারব, কিন্তু আমার প্রতিষ্ঠানের সব সম্পদ রেখেই যেতে হবে। এসবের মালিক ডেসটিনি গ্রুপের সব সদস্যই। আমরা এরই মধ্যে বাংলাদেশের বাইরেও কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। সেই দেশের লোকজনের টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছি। লোকাল পার্টনারকে বলেছি, টাকা সব তোমার, কিন্তু টেকনোলজি সব আমাদের। আমরা ইনভেস্ট করেছি শুধু টেকনোলজি। ডেসটিনির টেকনোলজি দেশের বাইরে ১২টি দেশে প্রমোট করতে চাইছি। আর মানি লন্ডারিংয়ের কথা বলছেন? মানি লন্ডারিং বর্তমানে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পৃথিবীর যেকোনো ব্যাংকে পাঁচ থেকে দশ হাজার ডলারের বেশি ডিপোজিট ধরা পড়লে সেই অর্থ ফ্রিজ করে দেওয়া হয়। আপনাকে ব্যাখ্যা দিতে হবে, ওই টাকা কোথা থেকে এসেছে এবং কিভাবে এসেছে। আপনাকে টাকা রাখতে হবে স্যুটকেস কিংবা ট্রাংকে ভরে। ক্যাশ টাকা বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট দিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
কালের কণ্ঠ : আপনার সম্পর্কে প্রচার আছে আপনি কানাডার সিটিজেন। আপনি যেকোনো সময় ডেসটিনির কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে কানাডা পাড়ি জমাতে পারেন...
রফিকুল আমীন : আমি কানাডার সিটিজেন, লন্ডনে বাড়ি-গাড়ি আছে, আমি যেকোনো সময় পালিয়ে যেতে পারি- এ প্রচারণা শুরু হয়েছে ২০০০ সাল থেকে। ডেসটিনি-২০০০ শুরু করার পর কেউ কেউ বলেছে, ছয় মাস পর আমি পালিয়ে যাব। আবার কেউ বলেছে এক বছর পর পালিয়ে যাব। সেই সময় পার করে আসার পর বলেছে, পাঁচ বছর পর পালিয়ে যাব। এসব মোকাবিলা করে দৃঢ়তার সঙ্গে ডেসটিনি এগিয়ে যাওয়ার পর আবার কেউ কেউ বলতে শুরু করেছে, ২০১২ সালে আমরা পালিয়ে যাব। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নোটিশে উল্লেখ করেছেন, আমরা নাকি ২০১৪ সালে টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে যাব। তাঁরা যেন জ্যোতিষ? সেই ২০০০ সালের রফিকুল আমীন আগেও ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকব। ডেসটিনির পরিবারদের নিয়ে মাথা উঁচু করে থাকব। দেশের সামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা আমরাই রাখব। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে আমরা মিশে গেছি।
কালের কণ্ঠ : ডেসটিনি গ্রুপের সব সম্পদ বা স্থাপনা আপনি এবং গুটিকয়েক ব্যক্তির নামে করা হয়েছে...
রফিকুল আমীন : যারা এসব কথা বলছে, তারা সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত। আমাদের সম্পদ কিন্তু সব স্থাবর হয়ে যাচ্ছে। আর এসব সম্পদ ডেসটিনি গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে। যত সম্পদ আছে এর অধিকাংশের মালিক ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, যার মালিকানা প্রায় ৭০ শতাংশ, ২০ শতাংশের মালিক হচ্ছে ডেসটিনি-২০০০ লি. আর ১০ শতাংশ হচ্ছে ডেসটিনি ট্রি-প্লান্টেশন। এভাবে ১০০ ভাগ সম্পদের মালিক ডেসটিনি গ্রুপ। ব্যক্তির নামে কোনো সম্পদ নেই। যাঁরা বলছেন তাঁরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বলছেন।
কালের কণ্ঠ : আপনারা ছয় বছরে আড়াই গুণ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা সংগ্রহ করছেন। এটা কিভাবে সম্ভব?
রফিকুল আমীন : আমাদের সুউচ্চ ভবন হচ্ছে। খুলনা, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় এসব ভবন হচ্ছে। সেই ভবন নির্মাণের নামই হচ্ছে ডিআইবিসি বা ডেসটিনি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস সেন্টার, যা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মতো। এই ডিআইবিসি প্রজেক্টে যদি কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন, সেটার জন্য ছয় বছর পর আপনি মুনাফা পাবেন আড়াই গুণ। এটাকে যাঁরা অস্বাভাবিক মনে করেন তাঁদের বলছি, ছয় বছরে ব্যাংক কিভাবে দ্বিগুণ মুনাফা দিচ্ছে? আর ডেসটিনির যেখানে বিনিয়োগ করলেন, সেই বিল্ডিংয়ের দাম ছয় বছরে কি একই জায়গায় থাকবে? মনে হয় না। এটা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
কালের কণ্ঠ : প্রায় ৪৫ লাখ সদস্যের জন্য এ মুহূর্তে আপনার পরামর্শ কী?
রফিকুল আমীন : আমি ডেসটিনি গ্রুপের সব সদস্যকে আশ্বস্ত করতে চাই এই বলে যে, তাঁদের হারাবার কিছু নাই। আমরা এখানে ব্যক্তিবিষয়ক কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করিনি। আমরা তৈরি করেছি প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান। মানুষ মারা গেলেও প্রযুক্তি বেঁচে থাকবে। এই প্রযুক্তি তাদের অনেক দূর নিয়ে যাবে। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিষ্ঠান খুবই স্বচ্ছ। কেউ যেন এক টাকাও আত্মসাৎ করতে না পারে, সে জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। যদি কোনো পণ্য বিপণন করি তাহলে ওই সদস্যের কাছে আগেই মোবাইল ফোনে এসএমএস যেতে হবে। এখানে মানি রিসিটই হচ্ছে একটি এসএমএস। আগে এসএমএস না পেলে কেউ টাকা লেনদেন করবে না। এ ছাড়া আমরা কিছুদিন আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী জুন থেকে ডেসটিনি গ্রুপ হবে একটি পেপারলেস প্রতিষ্ঠান। আপনি জুন মাসে আমাদের অফিসে এলে কোনো টেবিলেই কাগজ পাবেন না। শুধু কম্পিউটার পাওয়া যাবে। আমরা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী স্মার্ট সুইচ বাজারজাত করতে যাচ্ছি। যে সুইচ একটি পরিবারে একটি থাকলেই যথেষ্ট। এই স্মার্ট সুইচের মাধ্যমে প্রচুর বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব।
কালের কণ্ঠ : আপনি নিজে থেকে কিছু বলুন।
আমি আশা করব, আমি হয়তো বেঁচে থাকব না, কিন্তু আজ থেকে ২০ বছর পর পৃথিবীতে এটা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে যে বাংলাদেশের উন্নয়নের পেছনে সুনির্দিষ্টভাবে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের ভূমিকা অপরিসীম। আজকে যাঁরা আমাদের সমালোচনা করছেন, যাঁরা তদন্ত করছেন, তাঁরাও আগামী দিনে আমাদের সদস্য হবেন।
* সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কালের কণ্ঠের
নিজস্ব প্রতিবেদক হায়দার আলী
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশে জিজিএন, ইউনিপে টু ইউ, যুবক-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আছে। সেগুলোর সঙ্গে ডেসটিনির পার্থক্য কোথায়? ডেসটিনি যে ব্যবসা করছে, সেটা কি ওইগুলোর মতো প্রতারণামূলক?
মোহাম্মদ রফিকুল আমীন : আপনাকে একটা কথা বলি। প্রতারণা কিন্তু একটা বোনাফায়েড প্ল্যান। কেউ যদি প্ল্যান করে, আমি মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করব, সেটা হচ্ছে প্রতারণা। মনে করুন, কেউ পরীক্ষা দিতে গিয়ে নকল করছে; এটা কিন্তু প্রতারণা। কিন্তু পরীক্ষা দিতে গিয়ে সে যদি ফেল করে এবং সে যদি লেখাপড়া না করায় রেজাল্ট খারাপ করে, তখন আপনি বলতে পারবেন না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে বা বেতন নিয়েছে কিন্তু কিছুই শেখায়নি। এটা কিন্তু ফেল। ফেল ও ফল্ট সম্পূর্ণ আলাদা। আমি আপনাকে এই প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দিই। প্রতিবছর বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালো রেজাল্ট করছে ১০০ শতাংশ। আবার বহু প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে ছাত্র ফেল করে বেশির ভাগ। আপনি শব্দটা ফেল বলবেন, না ফল্ট বলবেন? এখন পর্যন্ত যত এমএলএম কম্পানির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে, ইনটেনশনালি বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো প্রতারণা করা হয়নি। ইনটেনশন কথাটা বললাম এ জন্য যে, তাদের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে যখন প্রতিষ্ঠানটি এক জায়গায় এসে বন্ধ হয়ে গেছে তখন ভোক্তা-পরিবেশকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধরুন, আজকে যদি জিজিএন টিকে থাকত তাহলে আজকে ইতিহাসটা কিন্তু ভিন্নভাবে লেখা হতো। তাহলে জিজিএনকে কিন্তু প্রতারক কম্পানি বলা হতো না। আমিও কিন্তু জিজিএনের একজন ভোক্তা-পরিবেশক ছিলাম। আমি নিজে বলতে পারি, তারা আসলে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতারণা করেনি। তারা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে কাজটি করতে পারেনি। তারা অদক্ষ লোক দিয়ে ব্যবস্থাপনা করেছে। যারা মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ও ডিরেক্ট সেলিং বোঝে না তাদের এনে প্রশাসনিক বিভাগে বসিয়েছে। তারা মানির মিস ম্যানেজমেন্ট করেছে। এতে করে মানি শর্টেজ হয়েছে। সেল পড়ে গেছে। পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে। একপর্যায়ে গিয়ে জিজিএন আর টাকা দিতে পারেনি। আপনি কি জানেন, জিজিএন কত টাকার জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল? তখন যদি তাদের কাছে মাত্র দুই কোটি টাকা থাকত, তারা বন্ধ করত না।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশ ব্যাংক তো বলেছে আপনারা তাদের অনুমতি ছাড়াই ব্যাংকিং করছেন...
রফিকুল আমীন : সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা কোনো ব্যাংকিং করছি না। কারণ আমাদের ব্যাংকিং করার কোনো রাইট নেই। আমাদের কার্যক্রম ব্যাংকিং সদৃশ, কিন্তু ব্যাংকিং নয়। সমবায় আইন আমাদের সভ্যদের কাছে শেয়ার বিক্রি করার অধিকার দিয়েছে। আমরা যারা সভ্য, তারা শেয়ার কিনেছি। এটা করার অধিকার সরকারই আমাদের দিয়েছে। আমানত সংগ্রহ এবং ঋণদান- এই পদ্ধতিকে ব্যাংকিং বলে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন তথা নোটিশ। ওই নোটিশটি ছিল মনগড়া।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তকারী দল সরেজমিনে তদন্ত করেছিল?
রফিকুল আমীন : তারা এসেছিল ৬ মার্চ। ৪৫ মিনিট আমার অফিসে ছিল। মানি লন্ডারিং হচ্ছে কি না জানতে এসেছিল। আমরা বলেছিলাম, কোনো বৈদেশিক লেনদেন করি না। তখন তারা সাদা কাগজে ১৫টি বিষয় সম্পর্কে জানতে চায়। তারা যা যা জানতে চেয়েছিল, তার সব কিছু সরবরাহ করা হয়েছে; কিন্তু তারা এর কোনো ফলাফল আমাদের জানায়নি। আমরা কোনো মিস করেছি কি না, আমাদের বিষয়ে কোনো সন্দেহ তৈরি হয়েছে কি না তাও আমাদের জানানো হয়নি। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের মাধ্যমে ব্যাংকের তদন্ত রিপোর্টের কথা জেনেছি। যদি আমাদের জানানো হতো- আপনার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাহলে সেসব বিষয়ে আমরা সংশোধন হতে পারতাম। গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে আমাকে কিছু বলা হয়নি এবং আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।
কালের কণ্ঠ : আপনার বিদেশে বাড়ি আছে এবং বিদেশে টাকা পাচার করছেন, এমন অভিযোগ তোলা হচ্ছে...
রফিকুল আমীন : আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা সরানোর। ৫০০ কোটি তো দূরের কথা, পাঁচ কোটি টাকাও যদি কেউ বের করতে পারে, তাহলে তা বাংলাদেশ সরকারকে দিয়ে দেওয়া হবে। আমার নামে কেনা জমি খুঁজে পাওয়া গেলে যাঁরা রিপোর্ট করেছেন তাঁদের দিয়ে দেওয়া হবে। সরকার ও প্রশাসনের কাছে আমার একটা অনুরোধ থাকবে, কোনো ব্যক্তি বা অন্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিংবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত হওয়ার সময়ে তা যেন পাবলিকলি মিডিয়ায় বা অন্য কারো কাছে আগে প্রকাশ করা না হয় যতক্ষণ না তদন্ত একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারে। কারণ এতে করে ওই প্রতিষ্ঠানকে তো বটেই, মিডিয়াকেও ভিকটিম করা হয়। মিডিয়া অনেক বেশি উৎসাহী হয়ে নিউজ করার পর বুঝতে পারে যে তারা ভুল করেছে। যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম, এটা প্রশাসনের একটা বড় দুর্বলতা এবং অতি উৎসাহী অফিসার যাঁরা আছেন তাঁদের এ ধরনের তদন্ত থেকে দূরে রাখা উচিত এবং নিরপেক্ষ তদন্ত অফিসার নিয়োগ করা উচিত। আমি আমার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই ধরনের নোটিশের ভিত্তিতে কেউ মনগড়া কথা লিখতে পারেন না। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ডেসটিনির পক্ষ থেকে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে কী কী ত্রুটি ছিল বলে আপনার দাবি?
রফিকুল আমীন : ওই প্রতিবেদনে ১৪টি বড় ধরনের ত্রুটি ছিল, যা ১৪টি অফেনসিভ ওয়ার্ড হিসেবে পরিচিত, যে শব্দগুলো কোনো কর্মকর্তা কখনো ব্যবহার করতে পারেন না। এর কারণে আমি ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারি। এখন মামলা করার আগে বিবেচনাধীন ওই উকিল নোটিশ। যদি তাঁরা আবার তাঁদের নোটিশকে সংশোধন করে তা প্রত্যাহার করে নেন, তাহলে আর মামলা করার প্রয়োজন হবে না। আগামী রবিবার সকাল ১১টা পর্যন্ত আমাদের নোটিশের জবাব দেওয়ার সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জবাব সন্তোষজনক না হলে আমরা মামলায় যেতে বাধ্য হব। তাঁরা যদি কঠোর অবস্থান নেন, তাঁদের কথাই যদি সত্য হিসেবে প্রমাণ করার বিষয়ে অনড় থাকেন, তাহলে আমরা কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করতে বাধ্য থাকব। আর পত্রিকাগুলো যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কথিত তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে, তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের চেয়েও আরো বেশি এবং অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে তাদের অনুমোদনহীন কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করা যাবে না। অথচ কিছু পত্রিকা সুনির্দিষ্টভাবে ডেসটিনির নাম উল্লেখ করে লেনদেন না করার কথা বলছে। আসলে বাংলাদেশ ব্যাংক কোথাও ডেসটিনির সঙ্গে লেনদেন না করার কথা বলেনি। ওই সব পত্রিকার বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছি, জবাব দেওয়ার জন্য সময়ও বেঁধে দিয়েছি। ওই সময়ের মধ্যে জবাব না পেলে আগামী রবিবার আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।
কালের কণ্ঠ : ডেসটিনির বিরুদ্ধে আগে কোনো সরকারি সংস্থা তদন্ত করেছে কি?
রফিকুল আমীন : গত ১১ বছরে সরকারের ১১টি বিভাগ ডেসটিনির বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে। ২০০৪ সালে সাপ্তাহিক ২০০০ ম্যাগাজিনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথম তদন্ত হয়। সে সময় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ তদন্ত করে কোনো অনিয়ম পায়নি। তা ছাড়া দুর্নীতি দমন ব্যুরো, ডিজিএফআই, এনএসআই, সিআইডিসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ডেসটিনি গ্রুপের বিভিন্ন বিভাগ তদন্ত করে দেখেছে। কিন্তু কোনো ধরনের দুর্নীতি খুঁজে পায়নি। সবচেয়ে বেশি তদন্ত হয়েছিল ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এ ছাড়া সমবায় অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও তদন্ত করে আমরা কোনো মানি লন্ডারিং করছি না কিংবা পরিচালকরা কোনো টাকা আত্মসাৎ করছে না। এমনকি আমাকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ডেকেও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো তদন্ত সংস্থাই আমাদের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের করতে পারেনি, এখনো আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের প্রায় ৪৫ লাখ সদস্য উদ্ভূত এ পরিস্থিতিকে কিভাবে দেখছেন?
রফিকুল আমীন : পত্রিকায় এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন দেখে অনেকে আতঙ্কিত এবং হতাশ- এটা সত্য। আমাকে অনেকে সরাসরি টেলিফোন করে জানতে চান। পরে আমার কথা শুনে তাঁরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, ডেসটিনি কারো সঙ্গে প্রতারণা করে না এবং ভবিষ্যতেও করবে না। আমরা প্রাণপণ সতর্কতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারবে না কেউ।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে, এখন আবার তদন্ত হচ্ছে...
রফিকুল আমীন : অর্থপাচারের বিষয়টি মিথ্যা ও বানোয়াট। কোনো একটি জায়গায় অর্থপাচারের কয়েকটি উদ্দেশ্য থাকে। একটি হলো- আমার এই দেশে থাকার ইচ্ছা নেই। দেশের বাইরে গিয়ে আরাম-আয়েশে থাকার চিন্তা মাথায় থাকলে টাকা সরিয়ে নিয়ে রাখতে হবে, কারণ আমি আর দেশের মাটিতে ফিরে আসব না। আরেকটি হলো পলিটিক্যালি ভিকটিম হলে। আর তৃতীয়টি হলো, এমন কোনো ব্যবসা চালু করেছি যেখানে আমার বিনিয়োগ দরকার। এ তিনটির কোনোটিই আমার মধ্যে নেই। আমি যদি চলে যাই, শুধু আমি যেতে পারব, কিন্তু আমার প্রতিষ্ঠানের সব সম্পদ রেখেই যেতে হবে। এসবের মালিক ডেসটিনি গ্রুপের সব সদস্যই। আমরা এরই মধ্যে বাংলাদেশের বাইরেও কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। সেই দেশের লোকজনের টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছি। লোকাল পার্টনারকে বলেছি, টাকা সব তোমার, কিন্তু টেকনোলজি সব আমাদের। আমরা ইনভেস্ট করেছি শুধু টেকনোলজি। ডেসটিনির টেকনোলজি দেশের বাইরে ১২টি দেশে প্রমোট করতে চাইছি। আর মানি লন্ডারিংয়ের কথা বলছেন? মানি লন্ডারিং বর্তমানে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পৃথিবীর যেকোনো ব্যাংকে পাঁচ থেকে দশ হাজার ডলারের বেশি ডিপোজিট ধরা পড়লে সেই অর্থ ফ্রিজ করে দেওয়া হয়। আপনাকে ব্যাখ্যা দিতে হবে, ওই টাকা কোথা থেকে এসেছে এবং কিভাবে এসেছে। আপনাকে টাকা রাখতে হবে স্যুটকেস কিংবা ট্রাংকে ভরে। ক্যাশ টাকা বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট দিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
কালের কণ্ঠ : আপনার সম্পর্কে প্রচার আছে আপনি কানাডার সিটিজেন। আপনি যেকোনো সময় ডেসটিনির কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে কানাডা পাড়ি জমাতে পারেন...
রফিকুল আমীন : আমি কানাডার সিটিজেন, লন্ডনে বাড়ি-গাড়ি আছে, আমি যেকোনো সময় পালিয়ে যেতে পারি- এ প্রচারণা শুরু হয়েছে ২০০০ সাল থেকে। ডেসটিনি-২০০০ শুরু করার পর কেউ কেউ বলেছে, ছয় মাস পর আমি পালিয়ে যাব। আবার কেউ বলেছে এক বছর পর পালিয়ে যাব। সেই সময় পার করে আসার পর বলেছে, পাঁচ বছর পর পালিয়ে যাব। এসব মোকাবিলা করে দৃঢ়তার সঙ্গে ডেসটিনি এগিয়ে যাওয়ার পর আবার কেউ কেউ বলতে শুরু করেছে, ২০১২ সালে আমরা পালিয়ে যাব। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নোটিশে উল্লেখ করেছেন, আমরা নাকি ২০১৪ সালে টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে যাব। তাঁরা যেন জ্যোতিষ? সেই ২০০০ সালের রফিকুল আমীন আগেও ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকব। ডেসটিনির পরিবারদের নিয়ে মাথা উঁচু করে থাকব। দেশের সামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা আমরাই রাখব। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে আমরা মিশে গেছি।
কালের কণ্ঠ : ডেসটিনি গ্রুপের সব সম্পদ বা স্থাপনা আপনি এবং গুটিকয়েক ব্যক্তির নামে করা হয়েছে...
রফিকুল আমীন : যারা এসব কথা বলছে, তারা সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত। আমাদের সম্পদ কিন্তু সব স্থাবর হয়ে যাচ্ছে। আর এসব সম্পদ ডেসটিনি গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে। যত সম্পদ আছে এর অধিকাংশের মালিক ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, যার মালিকানা প্রায় ৭০ শতাংশ, ২০ শতাংশের মালিক হচ্ছে ডেসটিনি-২০০০ লি. আর ১০ শতাংশ হচ্ছে ডেসটিনি ট্রি-প্লান্টেশন। এভাবে ১০০ ভাগ সম্পদের মালিক ডেসটিনি গ্রুপ। ব্যক্তির নামে কোনো সম্পদ নেই। যাঁরা বলছেন তাঁরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বলছেন।
কালের কণ্ঠ : আপনারা ছয় বছরে আড়াই গুণ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা সংগ্রহ করছেন। এটা কিভাবে সম্ভব?
রফিকুল আমীন : আমাদের সুউচ্চ ভবন হচ্ছে। খুলনা, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় এসব ভবন হচ্ছে। সেই ভবন নির্মাণের নামই হচ্ছে ডিআইবিসি বা ডেসটিনি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস সেন্টার, যা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মতো। এই ডিআইবিসি প্রজেক্টে যদি কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন, সেটার জন্য ছয় বছর পর আপনি মুনাফা পাবেন আড়াই গুণ। এটাকে যাঁরা অস্বাভাবিক মনে করেন তাঁদের বলছি, ছয় বছরে ব্যাংক কিভাবে দ্বিগুণ মুনাফা দিচ্ছে? আর ডেসটিনির যেখানে বিনিয়োগ করলেন, সেই বিল্ডিংয়ের দাম ছয় বছরে কি একই জায়গায় থাকবে? মনে হয় না। এটা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
কালের কণ্ঠ : প্রায় ৪৫ লাখ সদস্যের জন্য এ মুহূর্তে আপনার পরামর্শ কী?
রফিকুল আমীন : আমি ডেসটিনি গ্রুপের সব সদস্যকে আশ্বস্ত করতে চাই এই বলে যে, তাঁদের হারাবার কিছু নাই। আমরা এখানে ব্যক্তিবিষয়ক কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করিনি। আমরা তৈরি করেছি প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান। মানুষ মারা গেলেও প্রযুক্তি বেঁচে থাকবে। এই প্রযুক্তি তাদের অনেক দূর নিয়ে যাবে। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিষ্ঠান খুবই স্বচ্ছ। কেউ যেন এক টাকাও আত্মসাৎ করতে না পারে, সে জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। যদি কোনো পণ্য বিপণন করি তাহলে ওই সদস্যের কাছে আগেই মোবাইল ফোনে এসএমএস যেতে হবে। এখানে মানি রিসিটই হচ্ছে একটি এসএমএস। আগে এসএমএস না পেলে কেউ টাকা লেনদেন করবে না। এ ছাড়া আমরা কিছুদিন আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী জুন থেকে ডেসটিনি গ্রুপ হবে একটি পেপারলেস প্রতিষ্ঠান। আপনি জুন মাসে আমাদের অফিসে এলে কোনো টেবিলেই কাগজ পাবেন না। শুধু কম্পিউটার পাওয়া যাবে। আমরা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী স্মার্ট সুইচ বাজারজাত করতে যাচ্ছি। যে সুইচ একটি পরিবারে একটি থাকলেই যথেষ্ট। এই স্মার্ট সুইচের মাধ্যমে প্রচুর বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব।
কালের কণ্ঠ : আপনি নিজে থেকে কিছু বলুন।
আমি আশা করব, আমি হয়তো বেঁচে থাকব না, কিন্তু আজ থেকে ২০ বছর পর পৃথিবীতে এটা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে যে বাংলাদেশের উন্নয়নের পেছনে সুনির্দিষ্টভাবে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের ভূমিকা অপরিসীম। আজকে যাঁরা আমাদের সমালোচনা করছেন, যাঁরা তদন্ত করছেন, তাঁরাও আগামী দিনে আমাদের সদস্য হবেন।
* সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কালের কণ্ঠের
নিজস্ব প্রতিবেদক হায়দার আলী
No comments