সরল গরল-উন্নত সংসদীয় গণতন্ত্রে কেয়ারটেকার মডেল by মিজানুর রহমান খান
তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে সেই স্যার স্টিফেন নিনিয়ানের দেশ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। উন্নত দেশগুলোও এ বিষয়ে ক্রমশ কনভেনশন ও আইনের দিকে ঝুঁকছে। এমনকি সংসদের জননীর দেশ ব্রিটেনও। কিন্তু তারা কেউ বাংলাদেশ মডেলের মতো ভাবছে না।
তাদের যে চেষ্টা ও উদ্যোগ, তার সঙ্গে আমাদের দেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মহিমান্বিত করার চলতি প্রয়াসের মধ্যে তফাত আছে। এখন আমাদের সেই তফাতটির দিকেই বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। এটা ভাবা স্রেফ বাতুলতা যে বাংলাদেশ মডেল বিশ্ব একদিন গ্রহণ করবে।
বাংলাদেশ মডেল মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার সঙ্গে তুলনীয়। আর অন্যরা মাথার স্থানে মাথা রাখছে, মাথাব্যথা সারানোর জন্য ওষুধ খাচ্ছে। এখন আমাদের ঠিক করতে হবে যে আমরা কী করব। তবে একটা উপলব্ধি আছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে আপিল বিভাগে অ্যামিকাস কিউরিগণ কিংবা চলমান বিতর্কে আমরা ওই তফাতের স্পষ্টকরণ দেখতে পাই না। ঐতিহ্যবাহী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা এক জিনিস, যা অস্থায়ী হবে না। কারণ ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনকালে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রভাব সৃষ্টি করতে চাইবে। সেটা আগামী ১০ বা ২০ বছর পরে ভালো হয়ে যাবে, তা বাস্তবসম্মত মনে করি না। এমনকি বাংলাদেশ সংঘাতমূলক একটা ব্যবস্থা থেকে উতরে গেলেও ঐতিহ্যবাহী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আবেদন ফুরাবে না। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ব্রিটেন সংঘাতমূলক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে না। তাহলে তারা কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কায়েম করছে?
কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৎ চিন্তা থেকে বাংলাদেশ মডেলের কেয়ারটেকার ব্যবস্থার উদ্ভাবন ঘটেনি। বাংলাদেশের জনগণ ও রাজনীতিকেরা নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করা বা কেয়ারটেকার কনভেনশন তৈরির সময় ও সুযোগ পাননি। জেনারেল ইয়াহিয়ার এলএফও আর জেনারেল জিয়া ও এরশাদের এলএফওর অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনগুলো সময় নিয়েছে দেড় যুগ। সময়টা ছিল নানামুখী ঘাত-প্রতিঘাত ও নানা চড়াই-উতরাইয়ে ভরপুর। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার ইস্যু খুব আলোচিত হওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে জেনারেল এরশাদের ভোট ডাকাতি ও ব্যালট বাক্স ভরার রাজনীতি বাংলাদেশের মানুষের মনে ‘ক্ষমতাসীন সরকারকে’ খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে। আর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাফল্য মানুষের মনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি গভীর আস্থা সৃষ্টি করে। এক অর্থে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কার্যকর বিরোধী দল তৈরি হওয়ার পরে সম্পূর্ণ বেসামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে সাহাবুদ্দীন আহমদের নির্বাচনই ছিল প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আর তাই বিএনপি যখন দেশ শাসনে অদক্ষতা দেখাল, জাতীয় পার্টির প্রতি প্রতিহিংসার রাজনীতি তীব্র করল, তখন আওয়ামী লীগ জামায়াতসহ সব বিরোধী দলকে এককাট্টা করল। ব্যাপকভিত্তিক নির্বাচনকেন্দ্রিক আইনকানুন সংস্কারে বিএনপি সরকারের ওপর ছিল ঐতিহাসিক দায়িত্ব। কিন্তু তারা তা করতে অস্বীকার করল। মনে পড়ে, সিইসি বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ আন্তরিকভাবে ভোটার আইডি কার্ড প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন হলো রেফারি। তার হাতে হলুদ কার্ড ও লাল কার্ড দুটোই থাকতে হবে। এই লাল কার্ড দেখানোর বিষয়টি ছিল স্পর্শকাতর। একদিন আমার সঙ্গে সিইসির কয়েক ঘণ্টা আলোচনা হয়, আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার নয়। নির্বাচন কমিশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তার বরাতে আমি একটি প্রতিবেদন তৈরি করি। সেই প্রতিবেদনটি ১৯৯৫ সালের গোড়ায় ভোরের কাগজ-এর প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল শিশির ভট্টাচার্য্যের একটি কার্টুন। খেলার মাঠ। রেফারির হাতে বাঁশি। সেটি ছাপা হওয়ার পর ক্ষমতাসীন বিএনপি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। নির্বাচন কমিশন একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়। তাতে তারা একবাক্যের একটি প্রতিবাদ দেয়। তারা বলে, নির্বাচন কমিশনের কোনো কর্মকর্তা সাক্ষাৎকার দেননি। ভোরের কাগজ-এ সেটিও ছাপা হয়। যদিও পরে বিচারপতি রউফের মতাদর্শ আমাকে আহত করেছে। আমি আজও মনে করি, নির্বাচন কমিশনের হাতে লাল কার্ড থাকা উচিত। খেলার যেকোনো পর্যায়ে কমিশন যাতে দুর্বৃত্ত প্রার্থীকে বের করে দিতে পারে। কিন্তু এ ধরনের ক্ষমতা না দিতে দুই দলই এককাট্টা। দুদক, মানবাধিকার কমিশন বা আইন কমিশন কারও কাছে লাল কার্ড রাখা তারা নিরাপদ মনে করে না। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সুপ্রিম কোর্ট তা নয়। সুপ্রিম কোর্টের স্বাধীনতা বিপন্ন হলে, সেখানে অদক্ষতা বাসা বাঁধলে তার খেসারত সাধারণ মানুষের জীবনে সবচেয়ে ব্যাপক ও করুণ হবে। শাসকশ্রেণী তা সে যে পক্ষেই থাকুক, তার কোনো কিছুতেই তেমন আসে-যায় না।
২১ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ এরশাদকে হটানোর পরে নির্বাচনে হেরে দারুণ হকচকিত হয়েছিল। তার দরকার ছিল যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা। মাগুরার বিতর্কিত উপনির্বাচনকে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্বে যা কেউ ভাবেনি তা-ই তারা ভাবল। তারা চাইল সাংবিধানিক ও স্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০১ সালে শেখ হাসিনা মেয়াদ শেষে বিধিমতো পদত্যাগ করেন। তখন বিএনপি স্বৈরাচারের পতনের ‘আনন্দে’ ‘বিজয় মিছিল’ বের করেছিল। এই অপমানজনক ও আত্মঘাতী সমীকরণই বাংলাদেশ মডেলের চালিকাশক্তি। স্যার নিনিয়ান ব্যর্থ হন। কারণ তাঁর ফর্মুলায় প্রধানমন্ত্রীর পদচ্যুতি ছিল না। অস্ট্রেলিয়ার গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ানের অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত তিনি ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার গভর্নর জেনারেল। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার, কুইন্স কাউন্সেল এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক। ১৯৯১ সালে তিনি উত্তর আয়ারল্যান্ড শান্তি আলোচনায় বড় ভূমিকা রাখেন। নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বাধীন ক্রান্তিকালীন সরকারে তিনি আইন উপদেষ্টা ছিলেন। যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালে তিনি বিচারক ছিলেন। তাঁর আরও অনেক মহৎ কীর্তি আছে। তবে সম্ভবত শুধু বাংলাদেশেই আমরা তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করেছি। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেলদের কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়, তা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছেন স্যার ডেভিড স্মিথ। ঢাকায় নিনিয়ানের কুশপুত্তলিকা দাহ করার বিষয়টি এতে ঠাঁই পেয়েছে।
তবে আমাদের এখানে যে রাজনীতিকেরা বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ মডেল রপ্তানিযোগ্য, তাঁদের চিন্তার জন্য কিছু খোরাক দিচ্ছি। স্যার নিনিয়ানের দেশে কেয়ারটেকার কনভেনশন আছে। কনস্টিটিউশনাল প্রসেসেস ফলোয়িং জেনারেল ইলেকশন (ফিফথ রিপোর্ট অব সেশন ২০০৯-২০১০) নামে ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সের জাস্টিস কমিটির একটি প্রতিবেদন রয়েছে। এ থেকে দেখা যায়, ব্রিটেন কেয়ারটেকার সরকার প্রশ্নে অস্ট্রেলিয়াকে অনুসরণ করার কথা ভাবছে। কেয়ারটেকার কনভেনশনের সময় নীতি-নির্ধারণী প্রক্রিয়া নিয়ে তারা চিন্তিত। তারা যা এতকাল অনুসরণ করছে, তা এখন লিখে নেবে। তাই রিপোর্টে দেখি, মন্ত্রণালয়গুলো কেয়ারটেকার পিরিয়ডে সাধারণভাবে দৈনন্দিন কাজকর্ম চালাবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব সময় মনে রাখবেন, তাঁরা একটি কেয়ারটেকার পরিবেশ অতিক্রম করছেন। এ সময় তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে বিশেষভাবে যত্নশীল হবেন। মন্ত্রিসভার সচিব এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে সচেষ্ট থাকবেন।
১৯৮৬ সালের দ্য কনস্টিটিউশন অ্যাক্টে নিউজিল্যান্ডের মন্ত্রিসভার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, বিদায়ী মন্ত্রিসভার যে মন্ত্রী পুনর্নির্বাচিত হননি, তাঁর সংসদ সদস্য পদ চলে যাওয়ার ২৮ দিনের মধ্যে পদত্যাগ করবেন। এই সময়ে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনে কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের আরেক মন্ত্রীকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। তবে তিনিও কেয়ারটেকার সামর্থ্য নিয়েই কাজ করবেন। অস্ট্রেলিয়ার বিধান সম্পর্কে ব্রিটিশরা বলছে, একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনগত বৈধতা আছে, কিন্তু রাজনৈতিক বৈধতা নেই। পরবর্তী নির্বাচনের ফলাফল স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এই সরকারের কাজ হবে নৈমিত্তিক কাজ চালিয়ে নেওয়া।
তবে নিউজিল্যান্ডের সাংবিধানিক অবস্থান হচ্ছে: ‘কেয়ারটেকার সরকার একটি আইনানুগ নির্বাহী কর্তৃপক্ষ। এই সরকারের ক্ষমতা আগের নির্বাহী সরকারের মতোই থাকবে। যদি কোনো তাৎপর্যপূর্ণ বা বিতর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার পড়ে, তাহলে তারা বিলম্বিত করবে বা একটি অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থান নেবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে। কমন্সের ওই প্রতিবেদনমতে, ‘ব্রিটেন ওই রকম একটা কেয়ারটেকার কনভেনশন তখনই গ্রহণ করবে, যখন দেখা যাবে যে সদ্য ঘোষিত নির্বাচনের ফলাফলে কোনো দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্পষ্ট নয়। এ অবস্থা কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ হতে পারে।’
প্রফেসর জর্জ উইন্টারটনের মতে, কেয়ারটেকার কনভেনশন অস্ট্রেলিয়ায় খুবই কার্যকরভাবে চলছে। অস্ট্রেলিয়ার ২০১০ সালের কনভেনশন গুরুত্বপূর্ণ। কেয়ারটেকার সময়ে বাজেট কী করে পাস হবে, সে সম্পর্কেও নির্দিষ্ট বিধান আছে। সরকারি ও বিরোধী দলের নির্বাচনী অঙ্গীকার মেটাতে রয়েছে ১৯৯৮ সালে চার্টার অব বাজেট অনেস্টি অ্যাক্ট। কেয়ারটেকার আমলের শুরুতে অর্থ বিভাগ গাইডলাইন জারি করে। বিরোধী দলের সঙ্গে নির্বাচন-পূর্ব আলাপ-আলোচনার জন্য ১৯৭৬ সালের সরকারি দল সংসদে গাইডলাইনের খসড়া উপস্থাপন করে। ১৯৮৭ সালে সিনেটে পাস হওয়া একটি গাইডলাইন বর্তমানে কার্যকর রয়েছে। এটা আবার কেয়ারটেকার কনভেনশনস থেকে ভিন্ন। ১৯৭৫ সালে অস্ট্রেলিয়া সাংবিধানিক সংকটে পড়ে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের মতো ম্যালকম ফ্রেসারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হয়। নতুন নির্বাচন দিয়ে তিনি বিদায় নেন। সেই থেকে সেখানে গড়ে ওঠে কেয়ারটেকার কনভেনশন। এই কনভেনশন বলেছে, এর আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এ ধরনের কনভেনশন কানাডা ও ইউরোপেও রয়েছে।
আমাদের হয়তো কনভেনশনে চলবে না। আমরা কনভেনশন ও আইন দুটোই করতে পারি। তবে সংসদকে বিলুপ্ত রেখে কোনো মডেল চাই না। কারণ সেটা রাষ্ট্রে রাজনৈতিক শূন্যতার জন্ম দেয়। খুলে দেয় দরজা। সেই দরজা দিয়ে কত কী ঘটে যায়, ঘটে যেতে পারে। বাংলাদেশ মডেলের কেয়ারটেকার সামরিক শাসন ঠেকাবে না। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের পথে যেতে হবে। স্যার নিনিয়ানের ৫+৫+১ ফর্মুলা বা তেমন চেতনায় উত্তরণ হওয়া উচিত বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংস্কারের লক্ষ্য।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
বাংলাদেশ মডেল মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার সঙ্গে তুলনীয়। আর অন্যরা মাথার স্থানে মাথা রাখছে, মাথাব্যথা সারানোর জন্য ওষুধ খাচ্ছে। এখন আমাদের ঠিক করতে হবে যে আমরা কী করব। তবে একটা উপলব্ধি আছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে আপিল বিভাগে অ্যামিকাস কিউরিগণ কিংবা চলমান বিতর্কে আমরা ওই তফাতের স্পষ্টকরণ দেখতে পাই না। ঐতিহ্যবাহী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা এক জিনিস, যা অস্থায়ী হবে না। কারণ ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনকালে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রভাব সৃষ্টি করতে চাইবে। সেটা আগামী ১০ বা ২০ বছর পরে ভালো হয়ে যাবে, তা বাস্তবসম্মত মনে করি না। এমনকি বাংলাদেশ সংঘাতমূলক একটা ব্যবস্থা থেকে উতরে গেলেও ঐতিহ্যবাহী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার আবেদন ফুরাবে না। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ব্রিটেন সংঘাতমূলক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে না। তাহলে তারা কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কায়েম করছে?
কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৎ চিন্তা থেকে বাংলাদেশ মডেলের কেয়ারটেকার ব্যবস্থার উদ্ভাবন ঘটেনি। বাংলাদেশের জনগণ ও রাজনীতিকেরা নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করা বা কেয়ারটেকার কনভেনশন তৈরির সময় ও সুযোগ পাননি। জেনারেল ইয়াহিয়ার এলএফও আর জেনারেল জিয়া ও এরশাদের এলএফওর অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনগুলো সময় নিয়েছে দেড় যুগ। সময়টা ছিল নানামুখী ঘাত-প্রতিঘাত ও নানা চড়াই-উতরাইয়ে ভরপুর। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার ইস্যু খুব আলোচিত হওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে জেনারেল এরশাদের ভোট ডাকাতি ও ব্যালট বাক্স ভরার রাজনীতি বাংলাদেশের মানুষের মনে ‘ক্ষমতাসীন সরকারকে’ খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে। আর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাফল্য মানুষের মনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি গভীর আস্থা সৃষ্টি করে। এক অর্থে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কার্যকর বিরোধী দল তৈরি হওয়ার পরে সম্পূর্ণ বেসামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে সাহাবুদ্দীন আহমদের নির্বাচনই ছিল প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আর তাই বিএনপি যখন দেশ শাসনে অদক্ষতা দেখাল, জাতীয় পার্টির প্রতি প্রতিহিংসার রাজনীতি তীব্র করল, তখন আওয়ামী লীগ জামায়াতসহ সব বিরোধী দলকে এককাট্টা করল। ব্যাপকভিত্তিক নির্বাচনকেন্দ্রিক আইনকানুন সংস্কারে বিএনপি সরকারের ওপর ছিল ঐতিহাসিক দায়িত্ব। কিন্তু তারা তা করতে অস্বীকার করল। মনে পড়ে, সিইসি বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ আন্তরিকভাবে ভোটার আইডি কার্ড প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন হলো রেফারি। তার হাতে হলুদ কার্ড ও লাল কার্ড দুটোই থাকতে হবে। এই লাল কার্ড দেখানোর বিষয়টি ছিল স্পর্শকাতর। একদিন আমার সঙ্গে সিইসির কয়েক ঘণ্টা আলোচনা হয়, আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার নয়। নির্বাচন কমিশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তার বরাতে আমি একটি প্রতিবেদন তৈরি করি। সেই প্রতিবেদনটি ১৯৯৫ সালের গোড়ায় ভোরের কাগজ-এর প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল শিশির ভট্টাচার্য্যের একটি কার্টুন। খেলার মাঠ। রেফারির হাতে বাঁশি। সেটি ছাপা হওয়ার পর ক্ষমতাসীন বিএনপি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। নির্বাচন কমিশন একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়। তাতে তারা একবাক্যের একটি প্রতিবাদ দেয়। তারা বলে, নির্বাচন কমিশনের কোনো কর্মকর্তা সাক্ষাৎকার দেননি। ভোরের কাগজ-এ সেটিও ছাপা হয়। যদিও পরে বিচারপতি রউফের মতাদর্শ আমাকে আহত করেছে। আমি আজও মনে করি, নির্বাচন কমিশনের হাতে লাল কার্ড থাকা উচিত। খেলার যেকোনো পর্যায়ে কমিশন যাতে দুর্বৃত্ত প্রার্থীকে বের করে দিতে পারে। কিন্তু এ ধরনের ক্ষমতা না দিতে দুই দলই এককাট্টা। দুদক, মানবাধিকার কমিশন বা আইন কমিশন কারও কাছে লাল কার্ড রাখা তারা নিরাপদ মনে করে না। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সুপ্রিম কোর্ট তা নয়। সুপ্রিম কোর্টের স্বাধীনতা বিপন্ন হলে, সেখানে অদক্ষতা বাসা বাঁধলে তার খেসারত সাধারণ মানুষের জীবনে সবচেয়ে ব্যাপক ও করুণ হবে। শাসকশ্রেণী তা সে যে পক্ষেই থাকুক, তার কোনো কিছুতেই তেমন আসে-যায় না।
২১ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ এরশাদকে হটানোর পরে নির্বাচনে হেরে দারুণ হকচকিত হয়েছিল। তার দরকার ছিল যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা। মাগুরার বিতর্কিত উপনির্বাচনকে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্বে যা কেউ ভাবেনি তা-ই তারা ভাবল। তারা চাইল সাংবিধানিক ও স্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০১ সালে শেখ হাসিনা মেয়াদ শেষে বিধিমতো পদত্যাগ করেন। তখন বিএনপি স্বৈরাচারের পতনের ‘আনন্দে’ ‘বিজয় মিছিল’ বের করেছিল। এই অপমানজনক ও আত্মঘাতী সমীকরণই বাংলাদেশ মডেলের চালিকাশক্তি। স্যার নিনিয়ান ব্যর্থ হন। কারণ তাঁর ফর্মুলায় প্রধানমন্ত্রীর পদচ্যুতি ছিল না। অস্ট্রেলিয়ার গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ানের অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত তিনি ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার গভর্নর জেনারেল। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার, কুইন্স কাউন্সেল এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক। ১৯৯১ সালে তিনি উত্তর আয়ারল্যান্ড শান্তি আলোচনায় বড় ভূমিকা রাখেন। নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বাধীন ক্রান্তিকালীন সরকারে তিনি আইন উপদেষ্টা ছিলেন। যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালে তিনি বিচারক ছিলেন। তাঁর আরও অনেক মহৎ কীর্তি আছে। তবে সম্ভবত শুধু বাংলাদেশেই আমরা তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করেছি। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেলদের কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়, তা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছেন স্যার ডেভিড স্মিথ। ঢাকায় নিনিয়ানের কুশপুত্তলিকা দাহ করার বিষয়টি এতে ঠাঁই পেয়েছে।
তবে আমাদের এখানে যে রাজনীতিকেরা বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ মডেল রপ্তানিযোগ্য, তাঁদের চিন্তার জন্য কিছু খোরাক দিচ্ছি। স্যার নিনিয়ানের দেশে কেয়ারটেকার কনভেনশন আছে। কনস্টিটিউশনাল প্রসেসেস ফলোয়িং জেনারেল ইলেকশন (ফিফথ রিপোর্ট অব সেশন ২০০৯-২০১০) নামে ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সের জাস্টিস কমিটির একটি প্রতিবেদন রয়েছে। এ থেকে দেখা যায়, ব্রিটেন কেয়ারটেকার সরকার প্রশ্নে অস্ট্রেলিয়াকে অনুসরণ করার কথা ভাবছে। কেয়ারটেকার কনভেনশনের সময় নীতি-নির্ধারণী প্রক্রিয়া নিয়ে তারা চিন্তিত। তারা যা এতকাল অনুসরণ করছে, তা এখন লিখে নেবে। তাই রিপোর্টে দেখি, মন্ত্রণালয়গুলো কেয়ারটেকার পিরিয়ডে সাধারণভাবে দৈনন্দিন কাজকর্ম চালাবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব সময় মনে রাখবেন, তাঁরা একটি কেয়ারটেকার পরিবেশ অতিক্রম করছেন। এ সময় তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে বিশেষভাবে যত্নশীল হবেন। মন্ত্রিসভার সচিব এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে সচেষ্ট থাকবেন।
১৯৮৬ সালের দ্য কনস্টিটিউশন অ্যাক্টে নিউজিল্যান্ডের মন্ত্রিসভার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, বিদায়ী মন্ত্রিসভার যে মন্ত্রী পুনর্নির্বাচিত হননি, তাঁর সংসদ সদস্য পদ চলে যাওয়ার ২৮ দিনের মধ্যে পদত্যাগ করবেন। এই সময়ে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনে কেয়ারটেকার গভর্নমেন্টের আরেক মন্ত্রীকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। তবে তিনিও কেয়ারটেকার সামর্থ্য নিয়েই কাজ করবেন। অস্ট্রেলিয়ার বিধান সম্পর্কে ব্রিটিশরা বলছে, একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনগত বৈধতা আছে, কিন্তু রাজনৈতিক বৈধতা নেই। পরবর্তী নির্বাচনের ফলাফল স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এই সরকারের কাজ হবে নৈমিত্তিক কাজ চালিয়ে নেওয়া।
তবে নিউজিল্যান্ডের সাংবিধানিক অবস্থান হচ্ছে: ‘কেয়ারটেকার সরকার একটি আইনানুগ নির্বাহী কর্তৃপক্ষ। এই সরকারের ক্ষমতা আগের নির্বাহী সরকারের মতোই থাকবে। যদি কোনো তাৎপর্যপূর্ণ বা বিতর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার পড়ে, তাহলে তারা বিলম্বিত করবে বা একটি অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থান নেবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে। কমন্সের ওই প্রতিবেদনমতে, ‘ব্রিটেন ওই রকম একটা কেয়ারটেকার কনভেনশন তখনই গ্রহণ করবে, যখন দেখা যাবে যে সদ্য ঘোষিত নির্বাচনের ফলাফলে কোনো দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্পষ্ট নয়। এ অবস্থা কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ হতে পারে।’
প্রফেসর জর্জ উইন্টারটনের মতে, কেয়ারটেকার কনভেনশন অস্ট্রেলিয়ায় খুবই কার্যকরভাবে চলছে। অস্ট্রেলিয়ার ২০১০ সালের কনভেনশন গুরুত্বপূর্ণ। কেয়ারটেকার সময়ে বাজেট কী করে পাস হবে, সে সম্পর্কেও নির্দিষ্ট বিধান আছে। সরকারি ও বিরোধী দলের নির্বাচনী অঙ্গীকার মেটাতে রয়েছে ১৯৯৮ সালে চার্টার অব বাজেট অনেস্টি অ্যাক্ট। কেয়ারটেকার আমলের শুরুতে অর্থ বিভাগ গাইডলাইন জারি করে। বিরোধী দলের সঙ্গে নির্বাচন-পূর্ব আলাপ-আলোচনার জন্য ১৯৭৬ সালের সরকারি দল সংসদে গাইডলাইনের খসড়া উপস্থাপন করে। ১৯৮৭ সালে সিনেটে পাস হওয়া একটি গাইডলাইন বর্তমানে কার্যকর রয়েছে। এটা আবার কেয়ারটেকার কনভেনশনস থেকে ভিন্ন। ১৯৭৫ সালে অস্ট্রেলিয়া সাংবিধানিক সংকটে পড়ে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের মতো ম্যালকম ফ্রেসারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হয়। নতুন নির্বাচন দিয়ে তিনি বিদায় নেন। সেই থেকে সেখানে গড়ে ওঠে কেয়ারটেকার কনভেনশন। এই কনভেনশন বলেছে, এর আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এ ধরনের কনভেনশন কানাডা ও ইউরোপেও রয়েছে।
আমাদের হয়তো কনভেনশনে চলবে না। আমরা কনভেনশন ও আইন দুটোই করতে পারি। তবে সংসদকে বিলুপ্ত রেখে কোনো মডেল চাই না। কারণ সেটা রাষ্ট্রে রাজনৈতিক শূন্যতার জন্ম দেয়। খুলে দেয় দরজা। সেই দরজা দিয়ে কত কী ঘটে যায়, ঘটে যেতে পারে। বাংলাদেশ মডেলের কেয়ারটেকার সামরিক শাসন ঠেকাবে না। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের পথে যেতে হবে। স্যার নিনিয়ানের ৫+৫+১ ফর্মুলা বা তেমন চেতনায় উত্তরণ হওয়া উচিত বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংস্কারের লক্ষ্য।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments