ডেমাক্লিসের তলোয়ার by এম আবদুল হাফিজ

এমনিতেই নিত্যদিনকার দুর্ভোগের অন্ত নেই। তার ওপর ঘাড়ের ওপর ঝুলন্ত ডেমাক্লিসের তরবারির দুশ্চিন্তা। একটি মনোরম মুহূর্তেও তা গর্দানে নিপতিত হয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারে। বাস্তব জীবনে সুখানুভূতি না থাকলেও কল্পনায়ও তা উপলব্ধির অবকাশ নেই। কেননা অপ্রত্যাশিতভাবে অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে ঘাড়ে এমন এক বোঝা চেপে


বসতে পারে, যা বহনের কায়িক শক্তি বা মানসিক প্রস্তুতি আমাদের না-ও তো থাকতে পারে। এখনই আমরা অনুভব করি যে, আমাদের পিঠে প্রবাদের উটের পিঠে শেষ খড়কুটো পর্যন্ত চাপানো হয়েছে। অতঃপর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বোঝাও আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পারে_ তা সত্ত্বেও জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে কর্তৃপক্ষ আমাদের পৃষ্ঠদেশে বোঝা চাপিয়েই যাচ্ছে। সেই গ্রিক পুরাণের সুস্বাদু ব্যঞ্জনে আপ্যায়িত ডেমাক্লিসের গ্রীবা বরাবর ধারালো তরবারি ঝুলে থাকার অস্বস্তির মতো।
আমাদের গ্রীবা বরাবর রয়েছে দ্রব্যমূল্যের, বিদ্যুৎ মূল্যের বা জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা। তাই কদাচিৎ আমরা এমন কোনো সমীকরণে পেঁৗছতে সক্ষম, যখন আমরা ভাবতে পারি যে, আমাদের গর্দান এখন শঙ্কামুক্ত। এই ধরুন অদ্যকার বিদ্যুৎ মূল্যবৃদ্ধি। এটি নাকি গত তিন মাসে চতুর্থবার বিদ্যুৎ মূল্যবৃদ্ধি। যদিওবা আমরা এই বর্ধিত মূল্য শোধে হিসাবের নানা কারসাজিতে (হয়তো অফিসের টিফিনে কাটছাঁট করে, হয়তো হেঁটে অফিসে গিয়ে বা নিরামিষ খাদ্যের আশ্রয় নিয়ে) সক্ষম হলাম; কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই যে, আগামী এক বা দু'মাসে বিদ্যুৎ খাতে না হোক, অন্য কোনো খাতে মূল্যবৃদ্ধি আমাদের সব হিসাবকে তছনছ করে দেবে না! তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আমরা সর্বক্ষণের জন্য ডেমাক্লিসের তলোয়ারের নিচেই রয়েছি। সেই একই শঙ্কা,
একই অস্বস্তি!
সন্দেহ নেই যে, ডেমাক্লিসের তরবারি গ্রিক পুরাণে বর্ণিত শুধুই একটি রূপক। কিন্তু এই অভিব্যক্তির পরিধি ব্যাপক এবং গভীর। এর সঙ্গে ছড়িয়ে আছে জনগণ, তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং জনগণকে ধারণকারী জনপদের স্থিতিশীলতা। ক্ষমতার দণ্ড ধারণ করে কিছু লোক জনগণের ভাগ্য নিয়ে পরিহাসের খেলা খেলতে পারে। কিন্তু সেই ভাগ্যলিপি নিয়েই কি আমরা জন্মেছি! খানিকটা ক্রূর ভাষায় বলতে গেলে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' খেতেই কি
আমাদের জন্ম!
ইউনিটপ্রতি ৩০ পয়সা বর্ধিত বিদ্যুতের মূল্য অনেকের জন্য সরোবরে বারিকণার মতো। কিন্তু আমাদের মতো যাদের কোনো আয় নেই, যারা কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে জীবনযাপন নামক তরীটি ভাসমান রাখে তাদের জন্য এই সামান্য বৃদ্ধিই তরীটিকে টালমাটাল করে। বিদ্যুৎ তো একটি মাত্র খাত। এ রকম আরও কত খাতে ছোট ছোট বর্ধিত মূল্য দিবা শেষে দানবাকার
ধারণ করে।
আমাদের মতো পেনশনভোগী ও নিম্ন আয়ের মানুষ এটুকুতেই জীবনধারণে ভারসাম্য হারায়। তাদের জীবন থেকে তখন হারিয়ে যায় সাধ-আহ্লাদের বস্তুগুলো এবং তা পরিণত হয় গতানুগতিকতার একটি যন্ত্রে। সংবাদপত্রে দেখেছি, কেউ কেউ যার মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও আছেন এমন করে বারবার বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে উষ্মা প্রকাশ করেছেন এবং সহনীয় বৃদ্ধি সম্বন্ধে তাদের অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সরকারও সম্ভবত এমন অবস্থানে আছে যে, তাদের জেনেশুনেই এই অপ্রিয় পদক্ষেপগুলো নিতে হয়। এ অবস্থার পরিবর্তনে সরকার বলি বা কর্তৃপক্ষ বলি তাদের সুযোগ-সুবিধার অনেকটাই ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ছাড়তে হবে। অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে সমতা না হলেও এক সামাজিক ঊয়ঁরষরনৎরঁস আনার উদ্যোগ নিতে হবে। নতুবা টানাপড়েনের জীবন বিবর্ণ থেকে বিবর্ণতরই হতে থাকবে। মনে হবে কতকাল থোকা থোকা আঙুর খাইনি, সপরিবারে চেরি ব্লসম বা কৃষ্ণচূড়ার আগুন দেখিনি। এই সবকিছু মিলেই তো জীবন। তা অবশ্যই সর্বক্ষণ একটি ঝুলন্ত তরবারির নিচে অস্বস্তিকর জীবনের জন্য নয়।

ব্রিগেডিয়ার এম আবদুল
হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.