রথযাত্রা উৎসব by তারাপদ আচার্য্য

জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা এবং রথযাত্রা সূর্যের অয়নপথ পরিক্রমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সূর্যের দক্ষিণায়ন যাত্রার সঙ্গে বর্ষাগমনের সম্পর্ক স্বতঃসিদ্ধ। আর বর্ষারম্ভেরই উৎসব জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা। সূর্য-সপ্তাশ্ব বাহিত রথে আকাশলোক পরিক্রমণ করেন। জগন্নাথদেবও রথে আরোহণ করে গুণ্ডিচা যাত্রা করেন।


অয়নপথে সূর্যের দিকে যাত্রা ও উত্তরে প্রত্যাগমন জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিবৃত্ত। বলরাম ও সুভদ্রা জগন্নাথদেবের সঙ্গী। স্কন্দ পুরাণমতে, জগন্নাথদেবের সঙ্গী বলরাম বিষ্ণুর অনন্ত শয্যার অংশীদার।
শ্রী জগন্নাথদেবের প্রাকট্য সম্বন্ধে কিংবদন্তি ও শাস্ত্রীয় উক্তি, উভয় বিবরণ পাওয়া যায়। উৎকল ভাষায় রচিত 'দেউল-তোলা' নামক উড়িষ্যায় বহুল প্রচারিত একটি কবিতা গ্রন্থ থেকে শ্রী জগন্নাথদেবের প্রাকট্যের ইতিহাস প্রচারিত হয়েছে। শ্রী ব্রহ্মার প্রথম পরার্ধে চতুর্বূ্যহ-ভগবান নীলমাধবমূর্তিরূপে শঙ্খক্ষেত্র-নীলচলে পতিত-নীচকে কৃপাবিতরণার্থ অবতীর্ণ হন। দ্বিতীয় পরার্ধে মনু-সন্ধি গত হলে সত্যযুগ আরম্ভ হয়। সেই সময় শ্রী ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজ মালবদেশের অবন্তীনগরীতে রাজত্ব করতেন। তিনি শ্রী ভগবানের সাক্ষাৎকার লাভ করার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়েছিলেন। ভগবৎপ্রেরিত কোনো এক বৈষ্ণব তখন শ্রী ইন্দ্রদ্যুম্নের রাজসভায় উপস্থিত হয়ে কথা প্রসঙ্গে শ্রী নীলমাধবের কথা বলেন। রাজা এ সংবাদ পেয়ে বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন ব্রাহ্মণকে শ্রী নীলমাধবের অনুসন্ধানে পাঠান। সবাই বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এলেও বিদ্যাপতি অনেক কষ্টে অনেক ঘটনার পর নীলমাধবের সন্ধান দেন; কিন্তু রাজা শেষ পর্যন্ত নীলমাধবের দেখা পান না। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজ শ্রী নীলমাধবের দেখা না পেয়ে অনশন করে প্রাণত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তখন জগন্নাথদেব তাকে স্বপ্নে বললেন, তুমি চিন্তা করো না, সমুদ্রের বাঙ্কিমুহান নামক জায়গায় দারুব্রহ্মরূপে ভাসতে ভাসতে আমি উপস্থিত হবো। রাজা এ-স্বপ্ন দেখার পরে সৈন্যসামন্তসহ ওই জায়গায় উপস্থিত হয়ে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মাকৃত শ্রী দারুব্রহ্মকে দেখতে পান এবং মন্দির স্থাপন করেন।
রাজা দারুব্রহ্মকে মূর্তিতে প্রকট করার জন্য বহু দক্ষ শিল্পীকে আহ্বান করলেন; কিন্তু তারা কেউ দারুব্রহ্ম স্পর্শ করতে পারলেন না। তাদের অস্ত্রশস্ত্র সবই ভেঙে গেল। অবশেষে স্বয়ং ভগবান 'অনন্ত মহারাণা' নামে আত্মপরিচয় দিয়ে একজন বৃদ্ধশিল্পীর ছদ্মবেশে রাজার দরবারে হাজির হয়ে ২১ দিনের মধ্যে দরজা বন্ধ করে বিগ্রহকে প্রকটিত করবেন, এমনটি কথা দিলেন। ওই বৃদ্ধের উপদেশানুসারে রাজা অন্য কারিগরদের তিনটি রথ তৈরি করতে বললেন। বৃদ্ধ কারিগর দারুব্রহ্মকে ভেতরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে কাজ শুরু করলেন; কিন্তু দু'সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পর কারিগরের অস্ত্রশস্ত্রের কোনো শব্দ না পেয়ে রাজা অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন। শেষে মন্ত্রীর নিষেধ সত্ত্বেও রাজ্ঞীর পরামর্শানুসারে জোর করে মন্দিরের দরজা খুলে ফেললেন। সেখানে তিনি বৃদ্ধ কারিগরকে দেখতে পেলেন না। কেবল দেখলেন, দারুব্রহ্ম তিনটি শ্রীমূর্তিরূপে প্রকটিত রয়েছে। আর সামনে এগিয়ে দেখলেন, মূর্তির হাতের আঙুল ও পায়ের আঙুল প্রকাশিত হয়নি। বিচক্ষণ মন্ত্রী জানালেন, ওই কারিগর আর কেউ নন, তিনি স্বয়ং জগন্নাথ। রাজা অপরাধ করেছেন_ এই মনে করে কুশশয্যায় প্রাণত্যাগ করবেন বলে ঠিক করলেন। রাতে জগন্নাথদেব তাকে স্বপ্নে বললেন, আমি এইরূপ দারুব্রহ্ম আকারেই শ্রীপুরুষোত্তম নামে শ্রী নীলাচলে নিত্য অধিষ্ঠিত আছি।
ধর্মাতিহাস থেকে জানা যায়, কাঠ দিয়ে তৈরি বিষ্ণুদেবের মূর্তির মতো জগন্নাথদেবের মূর্তিকেও পূজা করা হতো আদিকাল থেকে। জগন্নাথদেবের রথযাত্রা কত পুরনো তা না জানা গেলেও পুরীর জগন্নাথদেবের মূর্তিকেই জগন্নাথদেবের পূজার আদি বলে মনে করা হয়। নীলাচলে বিষ্ণুর জীবন্ত মূর্তি, নীলমাধবের অন্তর্ধান ও পুরীর রাজা ইন্দ্রদ্যুস্ন কর্তৃক বিশ্বকর্মাকে দিয়ে জগন্নাথদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠার বিস্তারিত বিবরণ স্কন্দ পুরাণের উৎকলখণ্ডে বর্ণিত আছে। জগন্নাথদেবের ত্রিমূর্তি বলরাম সুভদ্রা ও কৃষ্ণ বা জগন্নাথ। স্কন্দ পুরাণে জগন্নাথদেব নীল মেঘের মতো বর্ণ, কাঠ দিয়ে তৈরি, শঙ্খচক্রধারী বলভদ্র ও সুভদ্রা একসঙ্গে অবস্থিত।
উৎকলখণ্ডের বর্ণনা অনুযায়ী, জগন্নাথদেব শঙ্খচক্রধারী, সুতরাং দ্বিভুজ; কিন্তু প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে বিশ্বকর্মা জগন্নাথদেবের মূর্তি তৈরি করার সময় কারও প্রবেশ ছিল নিষেধ, এমনকি আদেশদাতা রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নেরও না। বিশ্বকর্মা মূর্তি তৈরি করছেন তো করছেনই। এক দিন দুই দিন করে বেশ ক'দিন কেটে যাওয়ার পর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন অধৈর্য হয়ে বন্ধ দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। রাজা সেখানে দেখতে পান মূর্তির অঙ্গ অসম্পন্ন রয়েছে এবং সেখানে বিশ্বকর্মা নেই। সেই থেকেই জগন্নাথদেবের মূর্তি অসম্পন্ন।
সারদা তিলকতন্ত্রে পুরুষোত্তমের ধ্যানে বিষ্ণুকে জগন্নাথদেব এবং পুরুষোত্তম বলা হয়েছে। তাই জগন্নাথদেবকে পুরুষোত্তমও বলা হয়ে থাকে।
হিন্দু সমাজের প্রতিটি পূজা-অর্চনার পেছনে পুণ্যলাভের একটা ব্যাপার থাকে। জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রাও তার ব্যতিক্রম নয়। খুব সকালে উঠে জগন্নাথদেবের সঙ্গে স্নানযাত্রায় অংশগ্রহণকারী হাজার হাজার পুণ্যার্থী মনে করে থাকেন, তাদের পূর্বের যত পাপ-পঙ্কিলতা থাকে স্নানযাত্রায় অংশগ্রহণ করলেই তা বিনাশ হয়ে যায় এবং অশেষ পুণ্য অর্জিত হয়। যুগ যুগ ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এ বিশ্বাস অবিচল ছিল,
আছে, থাকবে।
 

No comments

Powered by Blogger.