ইতিউতি-বোরো ফসলের পরের চিন্তা by আতাউস সামাদ
বোরো ধান কাটার কাজ প্রায় শেষ হয়ে আসছে। পাকা ফসলের সোনালি-বাদামি রং দিয়ে মোড়ানো মাঠগুলো আবার নিজের রূপে ফেরত যাচ্ছে, শুকনো মাটি ও পড়ে থাকা খড়ে মাখামাখি। এরই মধ্যে কোথাও কোথাও দেখা যায় ধানের ছোট বীজতলা। দেরাই নামে আগাম প্রজাতির ধান চাষ হচ্ছে আজকাল।
যদিও ব্যাপকভাবে নয়। এই ধান কাটা হবে ভাদ্র মাসে। এ ধরনের চাষাবাদ আশা জাগায়; ধূলিধূসর প্রান্তরে এখানে-ওখানে কোনো কোনো ছোট জলাশয়ের গা ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা ধানের চারাগুলো। একটা ভালো ফসল ঘরে উঠেছে। এরপর আমন ধানের জন্য আশা করা। তার মধ্যে আরো কিছু ধানের ফসল! ভালোই তো। সারা বছর কোনো না কোনো ফসল ফললে খাদ্যঘাটতি আর উত্তরোত্তর মূল্যস্ফীতির আতঙ্ক কিছুটা কমবে।
বোরো ফসলের প্রভাব ইতিমধ্যে চালের বাজারে পড়তে শুরু হয়েছে। মোটা চালের দাম ঢাকা শহরে ৩৩ টাকা কেজি পর্যন্ত নেমে এসেছে। মাস দুয়েক আগে এই চালের দামই হঠাৎ ৪০ টাকা কেজি পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। আর ৩৭-৩৮ টাকা কেজি তো ছিল অনেক দিন। বোরো ফসল ভালো হলে চালের দাম কমবে�কৃষি-অর্থনীতিবিদদের এই আশাবাদ বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে। তাঁদের ধন্যবাদ, আমরা স্বস্তি পাচ্ছি। সরকারও খুশি। কৃষকদের ঘরে খোরাকির ধান যত বেশি দিন থাকবে তাঁরাও পরবর্তী ফসলের চাষ করবেন ততটুকুই নির্ভার হয়ে। তবে এবার প্রচুর ধান হওয়া সত্ত্বেও সব চাষিই তাঁদের আনন্দ ধরে রাখতে পারেননি। কারণ, তাঁদের মধ্যে অনেকেই যাঁরা দাদন নিয়ে চাষ করেছিলেন, অর্থাৎ ঋণ করে মূলধন সংগ্রহ করে তার বদলে কম দামে ধান ফিরিয়ে দিয়ে সেই ঋণ শোধ করার প্রতিশ্র�তি দিয়েছিলেন, তাঁরা পর্যাপ্ত লাভ করতে পারলেন না। ভালো ধান থেকেও তাঁদের ভালো উপার্জন হলো না। আবার মোটা চালের ধানের দাম ফসল তোলার মৌসুমের শুরু থেকেই নিুগামী থাকায় সাধারণভাবে কৃষকদের গড়পড়তা আয় কম হয়েছে। কৃষকদের এই এক সমস্যা�ফসল যদি ভালো না হয় তাহলে বিক্রয় মূল্য চড়া থাকলেও বেচার মতো ধানের পরিমাণ হাতে প্রায় থাকেই না। এর ফলে কৃষির খরচ তোলা এবং খোরাকির ধান ধরে রাখা একেবারেই দুঃসাধ্য হয়ে যায়। আবার যদি খুব ভালো ফলন হয় তো ফসলের দাম এমনই কমে যায় যে লাভের অঙ্ক খুবই ছোট হয়ে যায়। সম্ভবত এ জন্যই আজকাল গ্রামে গেলে শোনা যায়, শুধু কৃষির আয় দিয়ে এখন আর কোনো কৃষক পরিবারের সারা বছর চলে না। সবারই দ্বিতীয় আয় হওয়ার উপায় বের করা এখন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এই তথ্যটি সরকারের নীতিনির্ধারক ও পরিকল্পনাবিদদের জন্য জেনে রাখা ও মনে রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) তার সর্বশেষ বার্তায় জানিয়েছে, চাল ছাড়া আর সব খাদ্যশস্যের দাম বর্তমান উচ্চ মাত্রায়ই থাকবে। তদুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আবহাওয়ার অনিশ্চয় আচরণের দরুন এগুলো সরবরাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যাচ্ছে না। তবে প্রধান চাল বিক্রেতা দেশগুলোতে এখনো রপ্তানিযোগ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে, যার ফলে চালের আন্তর্জাতিক মূল্য তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম থাকবে বলে আশা করা যায়। (সূত্র : ইন্টারনেট)। বাংলাদেশের জন্য এ খবরটা কিছুটা স্বস্তির।
বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে খাদ্যভাণ্ডারে মজুদ বাড়ানোর কাজ করছে। একটি সূত্রমতে, বাংলাদেশ সরকারের গুদামে বর্তমান মজুদ হচ্ছে চাল তিন লাখ ৩০ হাজার টন আর গম আছে দুই লাখ ৯৬ হাজার টন। সরকারের আমদানি করা খাদ্যশস্যের মধ্যে বন্দরে জাহাজ থেকে নামানোর অপেক্ষায় চাল রয়েছে দুই লাখ টন আর গম আছে এক লাখ ৩৯ হাজার টন। আরো আমদানির ব্যবস্থা হয়েছে তিন লাখ ৭০ হাজার টন চাল এবং দুই লাখ ৩৯ হাজার টন গম। এই চাল ও গম আসবে আগামী ছয় মাস ধরে। বাজারে বোরো ধানের সরবরাহ থাকা অবস্থায় সরকারের এই মজুদব্যবস্থা খারাপ নয়। একটু সতর্ক হয়ে এ মন্তব্য করলাম তিনটি কারণে, যথা�১. আমরা আমাদের জন্য খাদ্যশস্যের প্রকৃত চাহিদা কত তা এখনো সঠিকভাবে জানি না। দেশের জনসংখ্যা কত তা নিয়ে বিতর্ক আছে। সম্প্রতি যে আদমশুমারি হয়েছে তাতেও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়ার সম্ভাবনা কম এ জন্য যে গণনাকারীরা অনেক বাড়িতেই যাননি; ২. গুদাম ও বন্দরে জাহাজ মিলিয়ে সরকারের হাতে আছে ৯ লাখ ৬৫ হাজার টন চাল। আমাদের জনসংখ্যা যখন এখনকার চেয়ে কম ছিল, অর্থাৎ কয়েক বছর আগেও, সরকারের হাতে ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য রাখাটা �আবশ্যক� বলে ধরা হতো। মজুদ ৯ লাখ টনের নিচে নেমে গেলে আমদানির তোড়জোড় চলত। আর পাঁচ-ছয় লাখ টনে চলে গেলে তা দুশ্চিন্তার কারণ হতো; ৩. দেশের নিজস্ব উৎপাদন থেকে কত ধান-চাল শেষ পর্যন্ত বাজারে আসবে আমাদের সেটা জানা প্রয়োজন। কারণ, ব্যবসায়ীরা এখন কম দামে নতুন ধান কিনছেন বলে তাঁদের গুদামে জায়গা করার জন্যও মজুদ করা ধান-চাল কিছু হলেও বিক্রি করে দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এখন থেকে কিছুদিন পর তাঁরা বাজারে চাল সরবরাহের পরিমাণ কমিয়েও দিতে পারেন। অন্যদিকে কৃষকের ঘরে রক্ষিত খোরাকির ধান কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে খুচরা বাজারে চালের ক্রেতার সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং বাজারে চাহিদার চাপ বাড়বে। কাজেই সরকারকে সারাক্ষণ খবর রাখতে হবে আর হিসাব করতে হবে, কখন তার মজুদ থেকে চাল ও গম বাজারজাত করবে।
শুনতে পাই, গত শুকনো মৌসুমে অর্থাৎ গত শীত এবং শেষ হয়ে আসা এই গ্রীষ্মে সরকার নাকি বড় আকারে ওয়ার্কস প্রোগ্রাম, অর্থাৎ কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি হাতে নেয়নি। হতে পারে, আমরা ঢাকা ও অন্যান্য অনেক শহরে সকালেই যে জনস্রোত দেখি তা এ জন্য যে গ্রাম থেকে অনেক মানুষ শহরে শ্রমিকের কাজের খোঁজে আসেন। বিষয়টা সরকার অনুসন্ধান করে দেখতে পারে। রাজধানী ঢাকার বাজারগুলোতে, এমনকি যেগুলোকে বিপণিবিতান বলা হয় সেগুলোতেও বিভিন্ন দোকানে কর্মচারীর সংখ্যা যেন বেশি মনে হয়। আর দোকানের সামনে বারান্দায় এবং বাজারসংলগ্ন ফুটপাতে ভাসমান দোকানের সংখ্যা বাড়ছেই। ঢাকার গুলশানে কোনো কোনো ফুটপাতে বড় বড় নকশিকাঁথা নিয়মিত বিক্রি হয়। ফুটপাতসংলগ্ন বাড়ির বা মসজিদের রেলিংয়ে ছড়িয়ে রাখা হয় এগুলো সম্ভাব্য ক্রেতার নজরে পড়ার জন্য। মোট কথা, কাজের এবং আয়ের খোঁজে আছেন এ রকম মানুষের সংখ্যা দেশে এখন অনেক। সম্ভবত এ জন্যই গ্রামের বেকার শ্রমিকদের সাময়িক কর্মসংস্থানের জন্য সরকারকে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের দিকে যেতে হবে। তাছাড়া সাধারণ নির্বাচন যত কাছে আসতে থাকবে, ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক স্বার্থেই গ্রামে কর্মসংস্থান ও খাদ্য প্রদানের ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে সরকারকে।
এসব মিলিয়ে আমার মনে হচ্ছে, এ বছর থেকে শুরু করে আগামী তিন বছর সরকারকে বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি অব্যাহত রাখার কথা বিবেচনায় রাখতেই হবে। একই সঙ্গে দেশে ধান ও অন্যান্য খাদ্যের দাম যাতে একেবারে পড়ে না যায়, এ দেশের প্রাণশক্তি যে কৃষককুল, তাঁদের স্বার্থে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
খাদ্যে ভর্তুকি নিয়ে কিছু কথা উঠেছে। আপাতত প্রশ্নটা এ রকম�সরকার কত দূর পর্যন্ত খাদ্যভর্তুকি দেবে? সরকার কতটুকু ভর্তুকি দিতে পারবে? এর সরল উত্তর হতে পারে এ রকম�দেশের মানুষকে ক্ষুধার হাত থেকে বাঁচাতে যতটুকু খাদ্যভর্তুকি দেওয়া প্রয়োজন ততটাই দিতে হবে। একটু বেয়াড়াভাবে বললে বলা যায়, সরকারের লোকজন তো নিজের পকেট থেকে ভর্তুকি দেয় না, দেয় নাগরিকদের কাছ থেকে আদায় করা ট্যাক্স থেকে। সরকারের রাজস্ব আয় তো প্রতিবছরই বাড়ছে, কাজেই খাদ্যভর্তুকি দেওয়া সম্ভব। এর প্রত্যুত্তর দেওয়াও সম্ভব�বেশি ভর্তুকি দেওয়ার একটা ফল হবে বাজেটে ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, ঘাটতি বৃদ্ধি পাওয়া মানে সরকারের দেশি ও বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, আর এসব মেটাতে যদি নোট ছাপতে হয় তাহলে হবে মূদ্রাস্ফীতি।
কিন্তু এফএও এবং ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের মতে, বৈশ্বিক বাস্তবতা হলো গত কয়েক বছরে (মূলত ২০০৭ থেকে) খাদ্যশস্যের যে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে সারা দুনিয়ায় তা ভবিষ্যতে কিছুটা কমতে পারে, কিন্তু আগের অবস্থায় ফেরত যাবে না। এই হুঁশিয়ারি যদি সত্যে পরিণত হয় তাহলে খাদ্যমূল্যের প্রভাব অন্যান্য পণ্যের ওপর পড়বে, কাজেই মূল্যস্ফীতির চাপ থাকবে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার একটাই পথ, মানুষের আয় বাড়ানো। যেহেতু রাতারাতি আয় বাড়ে না সেহেতু প্রায় সব দেশেই রাষ্ট্র অসহায়, দুর্বল ও বেকার নাগরিকদের জীবন নিয়ে টিকে থাকার জন্য হয় ভাতা দেয়, নাহলে উৎপাদন বা মূল্য ভর্তুকি দেয়; এমনকি নগদ টাকায়। এ অবস্থায় খাদ্য ভর্তুকি দিলে আমরা অসদাচরণ করব না বা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করব না। আরেকটা বিষয়, কোনোভাবেই যেন কৃষি উন্নয়ন ও কৃষি গবেষণা খাতে সরকারের বরাদ্দ কমানো না হয়। ক্ষেত ও খামারেই নির্ভর করবে আমাদের আশু ভবিষ্যৎ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বোরো ফসলের প্রভাব ইতিমধ্যে চালের বাজারে পড়তে শুরু হয়েছে। মোটা চালের দাম ঢাকা শহরে ৩৩ টাকা কেজি পর্যন্ত নেমে এসেছে। মাস দুয়েক আগে এই চালের দামই হঠাৎ ৪০ টাকা কেজি পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। আর ৩৭-৩৮ টাকা কেজি তো ছিল অনেক দিন। বোরো ফসল ভালো হলে চালের দাম কমবে�কৃষি-অর্থনীতিবিদদের এই আশাবাদ বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে। তাঁদের ধন্যবাদ, আমরা স্বস্তি পাচ্ছি। সরকারও খুশি। কৃষকদের ঘরে খোরাকির ধান যত বেশি দিন থাকবে তাঁরাও পরবর্তী ফসলের চাষ করবেন ততটুকুই নির্ভার হয়ে। তবে এবার প্রচুর ধান হওয়া সত্ত্বেও সব চাষিই তাঁদের আনন্দ ধরে রাখতে পারেননি। কারণ, তাঁদের মধ্যে অনেকেই যাঁরা দাদন নিয়ে চাষ করেছিলেন, অর্থাৎ ঋণ করে মূলধন সংগ্রহ করে তার বদলে কম দামে ধান ফিরিয়ে দিয়ে সেই ঋণ শোধ করার প্রতিশ্র�তি দিয়েছিলেন, তাঁরা পর্যাপ্ত লাভ করতে পারলেন না। ভালো ধান থেকেও তাঁদের ভালো উপার্জন হলো না। আবার মোটা চালের ধানের দাম ফসল তোলার মৌসুমের শুরু থেকেই নিুগামী থাকায় সাধারণভাবে কৃষকদের গড়পড়তা আয় কম হয়েছে। কৃষকদের এই এক সমস্যা�ফসল যদি ভালো না হয় তাহলে বিক্রয় মূল্য চড়া থাকলেও বেচার মতো ধানের পরিমাণ হাতে প্রায় থাকেই না। এর ফলে কৃষির খরচ তোলা এবং খোরাকির ধান ধরে রাখা একেবারেই দুঃসাধ্য হয়ে যায়। আবার যদি খুব ভালো ফলন হয় তো ফসলের দাম এমনই কমে যায় যে লাভের অঙ্ক খুবই ছোট হয়ে যায়। সম্ভবত এ জন্যই আজকাল গ্রামে গেলে শোনা যায়, শুধু কৃষির আয় দিয়ে এখন আর কোনো কৃষক পরিবারের সারা বছর চলে না। সবারই দ্বিতীয় আয় হওয়ার উপায় বের করা এখন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এই তথ্যটি সরকারের নীতিনির্ধারক ও পরিকল্পনাবিদদের জন্য জেনে রাখা ও মনে রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) তার সর্বশেষ বার্তায় জানিয়েছে, চাল ছাড়া আর সব খাদ্যশস্যের দাম বর্তমান উচ্চ মাত্রায়ই থাকবে। তদুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আবহাওয়ার অনিশ্চয় আচরণের দরুন এগুলো সরবরাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যাচ্ছে না। তবে প্রধান চাল বিক্রেতা দেশগুলোতে এখনো রপ্তানিযোগ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে, যার ফলে চালের আন্তর্জাতিক মূল্য তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম থাকবে বলে আশা করা যায়। (সূত্র : ইন্টারনেট)। বাংলাদেশের জন্য এ খবরটা কিছুটা স্বস্তির।
বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে খাদ্যভাণ্ডারে মজুদ বাড়ানোর কাজ করছে। একটি সূত্রমতে, বাংলাদেশ সরকারের গুদামে বর্তমান মজুদ হচ্ছে চাল তিন লাখ ৩০ হাজার টন আর গম আছে দুই লাখ ৯৬ হাজার টন। সরকারের আমদানি করা খাদ্যশস্যের মধ্যে বন্দরে জাহাজ থেকে নামানোর অপেক্ষায় চাল রয়েছে দুই লাখ টন আর গম আছে এক লাখ ৩৯ হাজার টন। আরো আমদানির ব্যবস্থা হয়েছে তিন লাখ ৭০ হাজার টন চাল এবং দুই লাখ ৩৯ হাজার টন গম। এই চাল ও গম আসবে আগামী ছয় মাস ধরে। বাজারে বোরো ধানের সরবরাহ থাকা অবস্থায় সরকারের এই মজুদব্যবস্থা খারাপ নয়। একটু সতর্ক হয়ে এ মন্তব্য করলাম তিনটি কারণে, যথা�১. আমরা আমাদের জন্য খাদ্যশস্যের প্রকৃত চাহিদা কত তা এখনো সঠিকভাবে জানি না। দেশের জনসংখ্যা কত তা নিয়ে বিতর্ক আছে। সম্প্রতি যে আদমশুমারি হয়েছে তাতেও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়ার সম্ভাবনা কম এ জন্য যে গণনাকারীরা অনেক বাড়িতেই যাননি; ২. গুদাম ও বন্দরে জাহাজ মিলিয়ে সরকারের হাতে আছে ৯ লাখ ৬৫ হাজার টন চাল। আমাদের জনসংখ্যা যখন এখনকার চেয়ে কম ছিল, অর্থাৎ কয়েক বছর আগেও, সরকারের হাতে ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য রাখাটা �আবশ্যক� বলে ধরা হতো। মজুদ ৯ লাখ টনের নিচে নেমে গেলে আমদানির তোড়জোড় চলত। আর পাঁচ-ছয় লাখ টনে চলে গেলে তা দুশ্চিন্তার কারণ হতো; ৩. দেশের নিজস্ব উৎপাদন থেকে কত ধান-চাল শেষ পর্যন্ত বাজারে আসবে আমাদের সেটা জানা প্রয়োজন। কারণ, ব্যবসায়ীরা এখন কম দামে নতুন ধান কিনছেন বলে তাঁদের গুদামে জায়গা করার জন্যও মজুদ করা ধান-চাল কিছু হলেও বিক্রি করে দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এখন থেকে কিছুদিন পর তাঁরা বাজারে চাল সরবরাহের পরিমাণ কমিয়েও দিতে পারেন। অন্যদিকে কৃষকের ঘরে রক্ষিত খোরাকির ধান কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে খুচরা বাজারে চালের ক্রেতার সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং বাজারে চাহিদার চাপ বাড়বে। কাজেই সরকারকে সারাক্ষণ খবর রাখতে হবে আর হিসাব করতে হবে, কখন তার মজুদ থেকে চাল ও গম বাজারজাত করবে।
শুনতে পাই, গত শুকনো মৌসুমে অর্থাৎ গত শীত এবং শেষ হয়ে আসা এই গ্রীষ্মে সরকার নাকি বড় আকারে ওয়ার্কস প্রোগ্রাম, অর্থাৎ কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি হাতে নেয়নি। হতে পারে, আমরা ঢাকা ও অন্যান্য অনেক শহরে সকালেই যে জনস্রোত দেখি তা এ জন্য যে গ্রাম থেকে অনেক মানুষ শহরে শ্রমিকের কাজের খোঁজে আসেন। বিষয়টা সরকার অনুসন্ধান করে দেখতে পারে। রাজধানী ঢাকার বাজারগুলোতে, এমনকি যেগুলোকে বিপণিবিতান বলা হয় সেগুলোতেও বিভিন্ন দোকানে কর্মচারীর সংখ্যা যেন বেশি মনে হয়। আর দোকানের সামনে বারান্দায় এবং বাজারসংলগ্ন ফুটপাতে ভাসমান দোকানের সংখ্যা বাড়ছেই। ঢাকার গুলশানে কোনো কোনো ফুটপাতে বড় বড় নকশিকাঁথা নিয়মিত বিক্রি হয়। ফুটপাতসংলগ্ন বাড়ির বা মসজিদের রেলিংয়ে ছড়িয়ে রাখা হয় এগুলো সম্ভাব্য ক্রেতার নজরে পড়ার জন্য। মোট কথা, কাজের এবং আয়ের খোঁজে আছেন এ রকম মানুষের সংখ্যা দেশে এখন অনেক। সম্ভবত এ জন্যই গ্রামের বেকার শ্রমিকদের সাময়িক কর্মসংস্থানের জন্য সরকারকে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের দিকে যেতে হবে। তাছাড়া সাধারণ নির্বাচন যত কাছে আসতে থাকবে, ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক স্বার্থেই গ্রামে কর্মসংস্থান ও খাদ্য প্রদানের ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে সরকারকে।
এসব মিলিয়ে আমার মনে হচ্ছে, এ বছর থেকে শুরু করে আগামী তিন বছর সরকারকে বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি অব্যাহত রাখার কথা বিবেচনায় রাখতেই হবে। একই সঙ্গে দেশে ধান ও অন্যান্য খাদ্যের দাম যাতে একেবারে পড়ে না যায়, এ দেশের প্রাণশক্তি যে কৃষককুল, তাঁদের স্বার্থে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
খাদ্যে ভর্তুকি নিয়ে কিছু কথা উঠেছে। আপাতত প্রশ্নটা এ রকম�সরকার কত দূর পর্যন্ত খাদ্যভর্তুকি দেবে? সরকার কতটুকু ভর্তুকি দিতে পারবে? এর সরল উত্তর হতে পারে এ রকম�দেশের মানুষকে ক্ষুধার হাত থেকে বাঁচাতে যতটুকু খাদ্যভর্তুকি দেওয়া প্রয়োজন ততটাই দিতে হবে। একটু বেয়াড়াভাবে বললে বলা যায়, সরকারের লোকজন তো নিজের পকেট থেকে ভর্তুকি দেয় না, দেয় নাগরিকদের কাছ থেকে আদায় করা ট্যাক্স থেকে। সরকারের রাজস্ব আয় তো প্রতিবছরই বাড়ছে, কাজেই খাদ্যভর্তুকি দেওয়া সম্ভব। এর প্রত্যুত্তর দেওয়াও সম্ভব�বেশি ভর্তুকি দেওয়ার একটা ফল হবে বাজেটে ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, ঘাটতি বৃদ্ধি পাওয়া মানে সরকারের দেশি ও বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, আর এসব মেটাতে যদি নোট ছাপতে হয় তাহলে হবে মূদ্রাস্ফীতি।
কিন্তু এফএও এবং ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের মতে, বৈশ্বিক বাস্তবতা হলো গত কয়েক বছরে (মূলত ২০০৭ থেকে) খাদ্যশস্যের যে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে সারা দুনিয়ায় তা ভবিষ্যতে কিছুটা কমতে পারে, কিন্তু আগের অবস্থায় ফেরত যাবে না। এই হুঁশিয়ারি যদি সত্যে পরিণত হয় তাহলে খাদ্যমূল্যের প্রভাব অন্যান্য পণ্যের ওপর পড়বে, কাজেই মূল্যস্ফীতির চাপ থাকবে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার একটাই পথ, মানুষের আয় বাড়ানো। যেহেতু রাতারাতি আয় বাড়ে না সেহেতু প্রায় সব দেশেই রাষ্ট্র অসহায়, দুর্বল ও বেকার নাগরিকদের জীবন নিয়ে টিকে থাকার জন্য হয় ভাতা দেয়, নাহলে উৎপাদন বা মূল্য ভর্তুকি দেয়; এমনকি নগদ টাকায়। এ অবস্থায় খাদ্য ভর্তুকি দিলে আমরা অসদাচরণ করব না বা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করব না। আরেকটা বিষয়, কোনোভাবেই যেন কৃষি উন্নয়ন ও কৃষি গবেষণা খাতে সরকারের বরাদ্দ কমানো না হয়। ক্ষেত ও খামারেই নির্ভর করবে আমাদের আশু ভবিষ্যৎ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments