গোধূলির ছায়াপথে-সব পেয়েছির হাটে by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী দেশবরেণ্য কলামিস্টদের মধ্যে একজন। লেখার আগে টেলিফোনটি সচল, লন্ডন শহরে অভিবাসী হওয়ার কারণে প্রয়োজন যন্ত্রটির। আরও আছে ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার। দেশ-বিদেশের দরকারি টেলিফোন নম্বর নোটবুকে, তাঁদের কাছে শুনে শুনে ছোটে তাঁর কলাম।
তাঁর ঝরঝরে হাতের কুড়কুড়ে কথাবৃষ্টি কার না ভালো লাগে।
ছোট কলামিস্টদের আছে ছোট সুবিধা। ঘর থেকে শুধু দুই পা ফেললেই কাগজওয়ালা চিৎকার করে ফিরছে, ‘কাগজ আছে, কাগজ’। দৈনিক কাগজ বেরোচ্ছে ঢাকা শহর থেকেই এক শ, অথচ ওর কাগজ-ক্ষুধার যেন শেষ নেই। তার কাছেই খবর। আছে রিকশাওয়ালা, গন্তব্যে পৌঁছে দেন না শুধু, ওইটুকু সময়ের মধ্যে দেশের হালহকিকত ও সংবাদ বিশ্লেষণ তাঁর কাছেই টাটকা। খবরটি কী, যা টেলিভিশনের সুভাষিত বক্তব্যে অনুপস্থিত, রেডিওর গাঢ় গলায় অবহেলিত, খবরের কাগজে পাওয়া যায় না, তা হলো মানুষ দুর্বিষহ যন্ত্রণায় কাতর। যন্ত্রণাটি ক্ষুধার, যন্ত্রণাটি বাজারে গিয়ে কোনো কিছু কিনতে না পারার যন্ত্রণা। তাদের একজনের কাছে শোনা: ‘আমাগো প্যাটে লাত্থি দিলে কেউ বাঁচতে পারব না। ঢাকা ছহরে আমরা আছি দছ লাখ, খালি গাড়ি দিয়া রাস্তা ভরলে চলব না, আমাগো জায়গা দিতে অইব। চাউল-ডাইল, তরিতরকারি এগুলি কিনমু কী দিয়া, মাল কই?’
ঠ্যালাওয়ালা। ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। আমার চেয়ে এক বছরের বড়, অর্থাৎ তাঁর বয়স ৭৫। বললেন, ‘আমাদের আর কোথায় গিয়ে ঠেলবেন? রাস্তা না বাড়িয়ে শুধু গাড়ি বাড়াচ্ছেন। গরিবদের না খাইয়ে শুধু নিজেরা বড়লোক হচ্ছেন। যেদিন আমরা ঠ্যালা দেব, সেদিন কোথায় যাবেন? দশ তালার জায়গায় বিশ তালা, তারপর ত্রিশ তালা, সেখানে গিয়েও শান্তি পাবেন না। আল্লার মাইর সেখানে গিয়েও আপনাদের তাড়া করবে। চাউল-ডাইল-তেল-নুন কোনোটাই সস্তা না। দিনে দিনে দাম বাড়ে। দেখার কেউ নাই।’
ফ্লাস্কের চা বিক্রেতা। বললাম, এই যে আপনি কলা-বিস্কিটসহ সকাল থেকে চা বিক্রি করছেন, আপনি কি একটা কলাও খেয়েছেন? উত্তর: ‘আমি খাইলে আমার পোলাপানরা কী খাইব? আমাগো কথা কি আপনারা ভাবেন, কেউ কি দুই কথা লেখেন? আমার দুই ছেলে ডায়রিয়ার ওষুধ খাইছে কলেরা হাসপাতাল থাইকা, [আইসিডিডিআরবি: লেখক] ওদের পেটের অসুখ ছিল না। এই ওষুধ খাওয়াইছে মিরপুর এলাকার সাড়ে এগারো নম্বরের লোকজনের ওপর, পরীক্ষাকরণের লাইগা। সমস্ত শরীর তাদের ফুইলা গেছে। দুই শ টাকার ওষুধ খাওয়াইছি। এখন জান যায়। শুনলাম, ভুল ওষুধ খাইয়াছে। ওদের ধরবে কেডা? দেশে আইন আছে? নাই। এর বেশি আমার কওনের কিছু নাই।’
পানওয়ালা, বিড়িওয়ালার কাছে খবর। হাটুরে, মাঠুরে, গাঁইয়ে, অগাঁইয়ে, সবার কথা বলতে গেলে আট টাকার মধ্যবিত্ত পাঠক অন্যদিকে ছুটবেন। তাই বলছি অন্য কথা।
ঢাকা শহরের বাজার চষে বেড়াই ছোট মাছের খোঁজে, ছোট কলামিস্টের বাড়তি সুবিধা। মাছুয়াদের কাছে পরিচিত ক্রেতা। বাড্ডার মাছুয়া বললেন, এই সরকারের ওপর আমি খুব খুশি। জিজ্ঞেস করলাম, এত খুশির কারণ কী? বললেন, এই প্রথম আমাদের কথা মনে কইরা সরকারে ইলেকট্রিক লাইট লাগাইছে মাছুয়াগো বাজারে। এইটা আগে কখনো হয় নাই। আরও যা বললেন তা শুনে আমি পুলকিত। ‘লেখাপড়ানের সুবিধার লাইগা সরকারে আমার পোলাপাইনের লাইগা টাকা দিছে, যাতে আমি তাগো লাইগা বই কিনা দিতে পারি।’
সব একসঙ্গে পাওয়া যাবে না। ‘সব পেয়েছির হাট’ বলে কিছু নেই। কিছু পাব, কিছু পাব না। লেখার সময় উল্টোটা নয়, ভালোটাও লেখা দরকার। আবার এমনও হয়, প্রশংসার খই ফুটিয়ে পুরস্কারের মালা গলায় তুলে নেওয়ার সময় ভাবি না সত্য-মিথ্যার প্রভেদ। মালাটা পেলেই হলো। সত্য প্রতারিত, মিথ্যা প্রশংসিত।
কাজের বুয়া নূরজাহান। বস্তি থেকে রোজ আসে পরিষ্কার করতে নাতি-নাতনি পরিবেষ্টিত দিনের জঞ্জাল। জিজ্ঞেস করলাম, কাল রাতের বৃষ্টির পর আজ সকালটা কেমন ঝকঝকে, তাই না?
রিকশাওয়ালা স্বামী জন্ডিসে ভুগছে তিন মাস। বলল, হ্যাঁ স্যার, ঘরে এক হাঁটু পানি, কাল সারা রাত ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।
রোজ সকালের মতো এসেছিল সকাল নয়টায়।
এক মিনিটও দেরি হয়নি তার।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্যিক, সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
ছোট কলামিস্টদের আছে ছোট সুবিধা। ঘর থেকে শুধু দুই পা ফেললেই কাগজওয়ালা চিৎকার করে ফিরছে, ‘কাগজ আছে, কাগজ’। দৈনিক কাগজ বেরোচ্ছে ঢাকা শহর থেকেই এক শ, অথচ ওর কাগজ-ক্ষুধার যেন শেষ নেই। তার কাছেই খবর। আছে রিকশাওয়ালা, গন্তব্যে পৌঁছে দেন না শুধু, ওইটুকু সময়ের মধ্যে দেশের হালহকিকত ও সংবাদ বিশ্লেষণ তাঁর কাছেই টাটকা। খবরটি কী, যা টেলিভিশনের সুভাষিত বক্তব্যে অনুপস্থিত, রেডিওর গাঢ় গলায় অবহেলিত, খবরের কাগজে পাওয়া যায় না, তা হলো মানুষ দুর্বিষহ যন্ত্রণায় কাতর। যন্ত্রণাটি ক্ষুধার, যন্ত্রণাটি বাজারে গিয়ে কোনো কিছু কিনতে না পারার যন্ত্রণা। তাদের একজনের কাছে শোনা: ‘আমাগো প্যাটে লাত্থি দিলে কেউ বাঁচতে পারব না। ঢাকা ছহরে আমরা আছি দছ লাখ, খালি গাড়ি দিয়া রাস্তা ভরলে চলব না, আমাগো জায়গা দিতে অইব। চাউল-ডাইল, তরিতরকারি এগুলি কিনমু কী দিয়া, মাল কই?’
ঠ্যালাওয়ালা। ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। আমার চেয়ে এক বছরের বড়, অর্থাৎ তাঁর বয়স ৭৫। বললেন, ‘আমাদের আর কোথায় গিয়ে ঠেলবেন? রাস্তা না বাড়িয়ে শুধু গাড়ি বাড়াচ্ছেন। গরিবদের না খাইয়ে শুধু নিজেরা বড়লোক হচ্ছেন। যেদিন আমরা ঠ্যালা দেব, সেদিন কোথায় যাবেন? দশ তালার জায়গায় বিশ তালা, তারপর ত্রিশ তালা, সেখানে গিয়েও শান্তি পাবেন না। আল্লার মাইর সেখানে গিয়েও আপনাদের তাড়া করবে। চাউল-ডাইল-তেল-নুন কোনোটাই সস্তা না। দিনে দিনে দাম বাড়ে। দেখার কেউ নাই।’
ফ্লাস্কের চা বিক্রেতা। বললাম, এই যে আপনি কলা-বিস্কিটসহ সকাল থেকে চা বিক্রি করছেন, আপনি কি একটা কলাও খেয়েছেন? উত্তর: ‘আমি খাইলে আমার পোলাপানরা কী খাইব? আমাগো কথা কি আপনারা ভাবেন, কেউ কি দুই কথা লেখেন? আমার দুই ছেলে ডায়রিয়ার ওষুধ খাইছে কলেরা হাসপাতাল থাইকা, [আইসিডিডিআরবি: লেখক] ওদের পেটের অসুখ ছিল না। এই ওষুধ খাওয়াইছে মিরপুর এলাকার সাড়ে এগারো নম্বরের লোকজনের ওপর, পরীক্ষাকরণের লাইগা। সমস্ত শরীর তাদের ফুইলা গেছে। দুই শ টাকার ওষুধ খাওয়াইছি। এখন জান যায়। শুনলাম, ভুল ওষুধ খাইয়াছে। ওদের ধরবে কেডা? দেশে আইন আছে? নাই। এর বেশি আমার কওনের কিছু নাই।’
পানওয়ালা, বিড়িওয়ালার কাছে খবর। হাটুরে, মাঠুরে, গাঁইয়ে, অগাঁইয়ে, সবার কথা বলতে গেলে আট টাকার মধ্যবিত্ত পাঠক অন্যদিকে ছুটবেন। তাই বলছি অন্য কথা।
ঢাকা শহরের বাজার চষে বেড়াই ছোট মাছের খোঁজে, ছোট কলামিস্টের বাড়তি সুবিধা। মাছুয়াদের কাছে পরিচিত ক্রেতা। বাড্ডার মাছুয়া বললেন, এই সরকারের ওপর আমি খুব খুশি। জিজ্ঞেস করলাম, এত খুশির কারণ কী? বললেন, এই প্রথম আমাদের কথা মনে কইরা সরকারে ইলেকট্রিক লাইট লাগাইছে মাছুয়াগো বাজারে। এইটা আগে কখনো হয় নাই। আরও যা বললেন তা শুনে আমি পুলকিত। ‘লেখাপড়ানের সুবিধার লাইগা সরকারে আমার পোলাপাইনের লাইগা টাকা দিছে, যাতে আমি তাগো লাইগা বই কিনা দিতে পারি।’
সব একসঙ্গে পাওয়া যাবে না। ‘সব পেয়েছির হাট’ বলে কিছু নেই। কিছু পাব, কিছু পাব না। লেখার সময় উল্টোটা নয়, ভালোটাও লেখা দরকার। আবার এমনও হয়, প্রশংসার খই ফুটিয়ে পুরস্কারের মালা গলায় তুলে নেওয়ার সময় ভাবি না সত্য-মিথ্যার প্রভেদ। মালাটা পেলেই হলো। সত্য প্রতারিত, মিথ্যা প্রশংসিত।
কাজের বুয়া নূরজাহান। বস্তি থেকে রোজ আসে পরিষ্কার করতে নাতি-নাতনি পরিবেষ্টিত দিনের জঞ্জাল। জিজ্ঞেস করলাম, কাল রাতের বৃষ্টির পর আজ সকালটা কেমন ঝকঝকে, তাই না?
রিকশাওয়ালা স্বামী জন্ডিসে ভুগছে তিন মাস। বলল, হ্যাঁ স্যার, ঘরে এক হাঁটু পানি, কাল সারা রাত ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।
রোজ সকালের মতো এসেছিল সকাল নয়টায়।
এক মিনিটও দেরি হয়নি তার।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্যিক, সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
No comments