সাদাকালো-কিছু হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও দ্রুত সুবিচার প্রয়োজন by আহমদ রফিক
খুন, তদন্ত, বিচার ইত্যাদি নিয়ে রাজনীতিমনস্ক সমাজ (এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সাধারণ মানুষ) এবং সংবাদপত্র মহলে তোলপাড়, চলছে বিস্তর লেখালেখি। অমীমাংসিত বিচার বা বিচারের নামে অবিচার নিয়েও কথা কম নয়, এমনকি স্বনামখ্যাত বিদেশি সাংবাদিক পর্যন্ত অকুস্থলে হাজির।
এর মধ্যে সরকারের জনৈক প্রভাবশালী মন্ত্রীর বক্তব্য চমকিত হওয়ার মতো। গণতন্ত্রী পার্টির প্রয়াত সভাপতি নুরুল ইসলাম হত্যার বিচারের দাবিতে 'স্বপ্নপুরী হাউজিং' (যেখানে তিনি থাকতেন) সোসাইটির সামনে প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধনের আয়োজন করে সম্প্রতি গঠিত নাগরিক কমিটি।
এ অনুষ্ঠানে রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী এবং একাধিক ছাত্র ও নারীসংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বলা যায়, একটি সুসংগঠিত ও প্রতিনিধিত্বশীল জমায়েত। এখানেই বর্তমান সরকারের স্থানীয় সরকার (এলজিআরডি) মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নুরুল ইসলামের মৃত্যু নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। তাঁকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।' (সূত্র : প্রথম আলো)।
শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড (সঙ্গে পুত্র তমোহর) প্রসঙ্গে (হ্যাঁ, এটা হত্যাকাণ্ড বলেই মনে করেন অনেকে) দীর্ঘদিন পর একজন বিশিষ্ট মন্ত্রী ও দলনেতার মুখে সুস্পষ্ট এ ঘোষণা সবার জন্যই স্বস্তির কারণ হবে। কারণ সবাই চায় এ দেশে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হোক, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোক। প্রসঙ্গত বলি, বর্তমান সরকার ও সরকারি দলের দু-একজন নেতার মুখে মাঝেমধ্যে কিছু ন্যায়সংগত বিস্ফোরক মন্তব্য শোনা যায়, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটায়। সৈয়দ আশরাফ তাঁদের একজন।
স্বস্তির মধ্যেও কিছু প্রশ্ন মাথাচাড়া দেয়; যেমন_এ ঘোষণা এত দিন পর কেন? এখন কি প্রয়োজনীয় আলামত মিলবে? ঘটনার পর, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরই বহুল আলোচিত এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা হয়নি কেন?
প্রয়াত মানুষটির পরিবার ও স্বজন-সতীর্থদের পক্ষ থেকে তখনই বলা হয়েছিল, এ মৃত্য দুর্ঘটনাজনিত (শর্টসার্কিট) নয়, এটা নাশকতামূলক। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য টেলিফোনে হুমকি-ধমকি তার প্রমাণ। তদন্তদল এসব কথা আমলে নিয়েছিল কি? কিংবা সরকারের বিশিষ্টজন? গণতন্ত্রী পার্টি তো তাদের সমমনা দল।
সেই সঙ্গে জানতে ইচ্ছা করে, গণতন্ত্রী পার্টিই বা এ ঘটনার সঠিক তদন্ত, অনুসন্ধান ইত্যাদি বিষয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট স্তরে কতটা দৌড়ঝাঁপ করেছে? এমন অনেক প্রশ্ন সংগত কারণে সামনে এসে দাঁড়ায়। যা-ই হোক, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এখন বলছেন, 'নুরুল ইসলাম ভাইয়ের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত বিচার দাবি করে যাব। বিচার আমরা আদায় করে নেব।' আমরা ধরে নেব, তাঁর বক্তব্য কথার কথা নয়, যা রাজনৈতিক বক্তৃতায় অনেক সময় বলা হয়ে থাকে। এ বক্তব্য সদিচ্ছাপ্রসূত বলেই আমরা মনে করব। তাই মন্ত্রী মহোদয়ের সদিচ্ছার জন্য তাঁকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। তবে কথা থাকে যে এ বিষয়ে মন্ত্রীর পক্ষ থেকে দাবির প্রয়োজন হবে কেন? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তো তাদের সরকারেরই অন্তর্গত। তারা সঠিক পদক্ষেপ নিলে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে তা তদারক করলে তদন্তকাজ যথাসময়ে সঠিকভাবে সম্পন্ন হতে পারে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, গণতন্ত্রী পার্টি যেহেতু মহাজোটের সমমানসিকতার, সে ক্ষেত্রে তারা কি আগে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বা অনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি তুলেছিল? এ কাজটা সংসদ সদস্য রুবি রহমানের জন্যও সহজ ছিল। জানি না, তাঁরা এদিক থেকে কতটা তৎপর ছিলেন।
যদি থাকেন, তাহলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর বর্তমান ইতিবাচক ঘোষণা বা সেই লক্ষ্যে সম্ভাব্য তৎপরতা আরো আগে শুরু হতে পারত, সে জন্য দুই বছর অপেক্ষা করতে হতো না; অবশ্য যদি প্রশাসনযন্ত্র সঠিকভাবে চলত। আমরা এখনো ভেবে পাই না, বিশেষ করে বর্তমানে মন্ত্রী মহোদয়ের দৃঢ় ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে, কেন দুটি বছর টানাপড়েনে শেষ হলো। আজকে যাঁরা সদিচ্ছায় মুক্তকণ্ঠ, তাঁরা কেন তখন বিষয়টির সুষ্ঠু সমাপনের চেষ্টা চালাননি?
হঠাৎ করেই যেন ঘুম ভেঙে কিছু একটা করে ফেলার জন্য তৎপর হয়ে ওঠা। কথাগুলো বলছি এ জন্য যে এই মানববন্ধন কর্মসূচির ঠিক একই দিনে প্রয়াত শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলামের মেয়ে মৌটুসি ইসলামের একটি লেখা ছাপা হয়েছে প্রথম আলোতে_শিরোনাম 'বাবা হত্যারহস্য ভাই হত্যার বিচার'। এ লেখায়ও পিতা-ভ্রাতা হত্যার সুবিচার চাওয়া হয়েছে।
আর এতে পূর্বকথিত ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে, যা সে সময় অর্থাৎ ২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ঘটনার পরবর্তী সময়ে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগিয়েছিল যে সংযোগবিচ্ছিন্ন ফ্রিজ থেকে শর্টসার্কিটে আগুন ধরতে পারে কিভাবে? বিশেষ করে 'ফ্রিজের পেছনে গ্যাস-সিলিন্ডার যেখানে অক্ষত'। গোটা বিষয় নিয়ে তখন রাজনৈতিক মহলে অনেক আলোচনা হয়েছে। তবু তদন্ত সঠিক পথ ধরেনি, কিংবা বলা যায়, ধরতে ধরতেও ভিন্ন পথে চলে গেছে। কিন্তু কেন? অথচ প্রাথমিক প্রতিবেদনে এমন কিছু বক্তব্য ছিল, যা নাশকতার পক্ষে যায়।
কিন্তু যে কারণেই হোক, তদন্ত ওই সম্ভাবনার দিকে যায়নি অথবা গেলেও তা গভীরভাবে তলিয়ে দেখা হয়নি। সংগত কারণে যেসব প্রশ্ন কারো লেখায় বা আলোচনায় উঠে এসেছিল, তার কিছু মৌটুসির লেখায় প্রশ্নরূপে উত্থাপিত; যেমন_টেলিফোনে হত্যার হুমকি, ফ্রিজের ভেতরে দুটি বিষাক্ত রাসায়নিক 'আরসাইন' ও 'আরশিয়াম'-এর উপস্থিতি, যা মৃত্যর কারণ হতে পারে। আমাদেরও প্রশ্ন, ফ্রিজে বিষাক্ত রাসায়নিক কে রেখেছে? এত বড় একটা তদন্তের উপাদান কি উপেক্ষা করা হয়েছে?
পূর্বোক্ত জমায়েত, দাবি ও ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশা করব, শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলামের মৃত্যুর সঠিক কারণ তদন্তে উদ্ঘাটিত হবে এবং সন্তানসহ তাঁর মৃত্যুর যথার্থ বিচার নিশ্চিত হবে। প্রসঙ্গত বলতে হয়, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে এমন অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যেগুলোর তদন্তে অপরাধীর সন্ধান মেলেনি, সুবিচার তো দূরের কথা। অথচ দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে তদন্ত সম্পন্ন হলে প্রায় সব ক্ষেত্রেই হত্যারহস্য উদ্ঘাটিত হয় এবং অপরাধী তার অপরাধের জন্য শাস্তি পেয়ে থাকে।
এমন বহু ঘটনার একটি প্রসঙ্গতই উল্লেখ করছি। যশোরের সাংবাদিক শামছুর রহমানের হত্যারহস্য আজো উদ্ঘাটিত হয়নি, অপরাধীও শনাক্ত হয়নি। অথচ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজ থেকে ১১ বছর আগে ১৬ জুলাই ২০০০ অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান অকুতোভয় ওই সাংবাদিক। আততায়ী অজ্ঞাতপরিচয় হলেও তখনকার লেখালেখিতে এবং বিশেষ চক্র থেকে তাঁকে টেলিফোনে হত্যার হুমকি, এমনকি তাঁর কিছু অনুসন্ধান বন্ধ রাখতে নির্দেশ ইত্যাদি সূত্র মোটা দাগেরই ছিল। আততায়ীচক্র একেবারে অজ্ঞাত তা বলা হয়তো ঠিক নয়।
তৎকালীন দৈনিক বাংলা সম্পাদকের কাছ থেকে এসব শোনা এবং সেই সূত্রে সাংবাদিক শামছুর রহমানকে জানা। ওদের কাছে 'কেবল' ডাকনামে অন্তরঙ্গ এ সাংবাদিক সত্যই ছিলেন নির্ভীক এবং সৎ সাংবাদিকতার আদর্শে ও কর্মে নিবেদিতপ্রাণ। আর সে জন্যই কিনা সমাজের পাপীচক্রের হাতে তাঁকে প্রাণ দিতে হলো।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান শামছুর রহমান সম্ভবত বাবার আদর্শ রক্ত বহন ও লালন করেছিলেন। তাই চোরাচালানিচক্র এবং মাদক ও নারী-শিশু পাচারকারীচক্রের শাসানি সত্ত্বেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিপজ্জনক পথ থেকে, এককথায় সত্যের পথ থেকে সরে আসেননি তিনি। ন্যায়নীতি ও নৈতিকতার দায় থেক পিছু হটেননি। যত দূর জানি, সাংবাদিকমহলে তাঁর ঘনিষ্ঠজন কেউ কেউ তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছিল, তাঁর ওই কাজের পথটা খুবই বিপজ্জনক।
কিন্তু জীবনের নিরাপত্তাহীনতা বা প্রাণনাশের হুমকি সত্ত্বেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ থেকে, পেশাগত দায়বদ্ধতা থেকে সরে আসতে পারেননি শামছুর রহমান। সাংবাদিকতার বিপজ্জনক পথেই বিচরণ করেছেন তিনি এবং সে জন্য বিশ্বের একাধিক শহীদ সাংবাদিকের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়ানো শামছুর রহমান। পেশাগত সততা ও নিষ্ঠা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে আততায়ীর নিষ্ঠুর গুলির শিকার শামছুর রহমান। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও তাঁর হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের তালিকা তৈরি এবং তদন্তকাজ বিশেষ ব্যবস্থায় সম্পন্ন করার মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করে তাদের বিচারের সম্মুখীন করার নৈতিক দায় থেকে মুক্ত হোন। দেশের প্রতিটি নাগরিক তথা জনগণের নিরাপত্তা ও সুবিচার নিশ্চিত করার দায় সব গণতান্ত্রিক সরকারেরই।
আমরা বলতে চাই না 'বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।' আর সে জন্যই আমাদের প্রত্যাশা, সরকার সাংবাদিক হত্যা, রাজনীতিক হত্যার মতো সমাজের বিভিন্ন স্তরে সংঘটিত বহুল আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্ত কার্যক্রম নতুন করে শুরু করবে, সুবিচার নিশ্চিত করবে। দরকার মনে করলে বিশেষ তদন্তবাহিনী গঠন করবে।
আমাদের দাবি আরো এ জন্য যে ইতিমধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তকাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ হওয়ার ফলে সুবিচার নিশ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে কর্নেল তাহেরের প্রতি সংঘটিত অন্যায়েরও সুবিচার সম্পন্ন হয়েছে। একে একে অন্য গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোও সরকারের হাতে তুলে নেওয়া উচিত এবং তা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। তাহলে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দায় সমাপনের কাজটা সরকার সঠিকভাবে করতে পারবে। পাশাপাশি একাধিক খুনের মামলায় দণ্ডিত আসামিকে ক্ষমা কতটা যুক্তিসংগত, তাও বিবেচনায় রাখা উচিত এ জন্য যে তাতে মুক্ত খুনি অনেক সময়ই সমাজের জন্য নতুন করে সন্ত্রাসের আতঙ্ক সৃষ্টি করে থাকে এবং তা অপরাধীর শাস্তি না হওয়ার কারণে।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক
প্রাবন্ধিক ও কবি
এ অনুষ্ঠানে রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী এবং একাধিক ছাত্র ও নারীসংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বলা যায়, একটি সুসংগঠিত ও প্রতিনিধিত্বশীল জমায়েত। এখানেই বর্তমান সরকারের স্থানীয় সরকার (এলজিআরডি) মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নুরুল ইসলামের মৃত্যু নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। তাঁকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।' (সূত্র : প্রথম আলো)।
শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড (সঙ্গে পুত্র তমোহর) প্রসঙ্গে (হ্যাঁ, এটা হত্যাকাণ্ড বলেই মনে করেন অনেকে) দীর্ঘদিন পর একজন বিশিষ্ট মন্ত্রী ও দলনেতার মুখে সুস্পষ্ট এ ঘোষণা সবার জন্যই স্বস্তির কারণ হবে। কারণ সবাই চায় এ দেশে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হোক, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোক। প্রসঙ্গত বলি, বর্তমান সরকার ও সরকারি দলের দু-একজন নেতার মুখে মাঝেমধ্যে কিছু ন্যায়সংগত বিস্ফোরক মন্তব্য শোনা যায়, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটায়। সৈয়দ আশরাফ তাঁদের একজন।
স্বস্তির মধ্যেও কিছু প্রশ্ন মাথাচাড়া দেয়; যেমন_এ ঘোষণা এত দিন পর কেন? এখন কি প্রয়োজনীয় আলামত মিলবে? ঘটনার পর, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরই বহুল আলোচিত এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা হয়নি কেন?
প্রয়াত মানুষটির পরিবার ও স্বজন-সতীর্থদের পক্ষ থেকে তখনই বলা হয়েছিল, এ মৃত্য দুর্ঘটনাজনিত (শর্টসার্কিট) নয়, এটা নাশকতামূলক। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য টেলিফোনে হুমকি-ধমকি তার প্রমাণ। তদন্তদল এসব কথা আমলে নিয়েছিল কি? কিংবা সরকারের বিশিষ্টজন? গণতন্ত্রী পার্টি তো তাদের সমমনা দল।
সেই সঙ্গে জানতে ইচ্ছা করে, গণতন্ত্রী পার্টিই বা এ ঘটনার সঠিক তদন্ত, অনুসন্ধান ইত্যাদি বিষয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট স্তরে কতটা দৌড়ঝাঁপ করেছে? এমন অনেক প্রশ্ন সংগত কারণে সামনে এসে দাঁড়ায়। যা-ই হোক, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এখন বলছেন, 'নুরুল ইসলাম ভাইয়ের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত বিচার দাবি করে যাব। বিচার আমরা আদায় করে নেব।' আমরা ধরে নেব, তাঁর বক্তব্য কথার কথা নয়, যা রাজনৈতিক বক্তৃতায় অনেক সময় বলা হয়ে থাকে। এ বক্তব্য সদিচ্ছাপ্রসূত বলেই আমরা মনে করব। তাই মন্ত্রী মহোদয়ের সদিচ্ছার জন্য তাঁকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। তবে কথা থাকে যে এ বিষয়ে মন্ত্রীর পক্ষ থেকে দাবির প্রয়োজন হবে কেন? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তো তাদের সরকারেরই অন্তর্গত। তারা সঠিক পদক্ষেপ নিলে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে তা তদারক করলে তদন্তকাজ যথাসময়ে সঠিকভাবে সম্পন্ন হতে পারে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, গণতন্ত্রী পার্টি যেহেতু মহাজোটের সমমানসিকতার, সে ক্ষেত্রে তারা কি আগে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বা অনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি তুলেছিল? এ কাজটা সংসদ সদস্য রুবি রহমানের জন্যও সহজ ছিল। জানি না, তাঁরা এদিক থেকে কতটা তৎপর ছিলেন।
যদি থাকেন, তাহলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর বর্তমান ইতিবাচক ঘোষণা বা সেই লক্ষ্যে সম্ভাব্য তৎপরতা আরো আগে শুরু হতে পারত, সে জন্য দুই বছর অপেক্ষা করতে হতো না; অবশ্য যদি প্রশাসনযন্ত্র সঠিকভাবে চলত। আমরা এখনো ভেবে পাই না, বিশেষ করে বর্তমানে মন্ত্রী মহোদয়ের দৃঢ় ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে, কেন দুটি বছর টানাপড়েনে শেষ হলো। আজকে যাঁরা সদিচ্ছায় মুক্তকণ্ঠ, তাঁরা কেন তখন বিষয়টির সুষ্ঠু সমাপনের চেষ্টা চালাননি?
হঠাৎ করেই যেন ঘুম ভেঙে কিছু একটা করে ফেলার জন্য তৎপর হয়ে ওঠা। কথাগুলো বলছি এ জন্য যে এই মানববন্ধন কর্মসূচির ঠিক একই দিনে প্রয়াত শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলামের মেয়ে মৌটুসি ইসলামের একটি লেখা ছাপা হয়েছে প্রথম আলোতে_শিরোনাম 'বাবা হত্যারহস্য ভাই হত্যার বিচার'। এ লেখায়ও পিতা-ভ্রাতা হত্যার সুবিচার চাওয়া হয়েছে।
আর এতে পূর্বকথিত ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে, যা সে সময় অর্থাৎ ২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ঘটনার পরবর্তী সময়ে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগিয়েছিল যে সংযোগবিচ্ছিন্ন ফ্রিজ থেকে শর্টসার্কিটে আগুন ধরতে পারে কিভাবে? বিশেষ করে 'ফ্রিজের পেছনে গ্যাস-সিলিন্ডার যেখানে অক্ষত'। গোটা বিষয় নিয়ে তখন রাজনৈতিক মহলে অনেক আলোচনা হয়েছে। তবু তদন্ত সঠিক পথ ধরেনি, কিংবা বলা যায়, ধরতে ধরতেও ভিন্ন পথে চলে গেছে। কিন্তু কেন? অথচ প্রাথমিক প্রতিবেদনে এমন কিছু বক্তব্য ছিল, যা নাশকতার পক্ষে যায়।
কিন্তু যে কারণেই হোক, তদন্ত ওই সম্ভাবনার দিকে যায়নি অথবা গেলেও তা গভীরভাবে তলিয়ে দেখা হয়নি। সংগত কারণে যেসব প্রশ্ন কারো লেখায় বা আলোচনায় উঠে এসেছিল, তার কিছু মৌটুসির লেখায় প্রশ্নরূপে উত্থাপিত; যেমন_টেলিফোনে হত্যার হুমকি, ফ্রিজের ভেতরে দুটি বিষাক্ত রাসায়নিক 'আরসাইন' ও 'আরশিয়াম'-এর উপস্থিতি, যা মৃত্যর কারণ হতে পারে। আমাদেরও প্রশ্ন, ফ্রিজে বিষাক্ত রাসায়নিক কে রেখেছে? এত বড় একটা তদন্তের উপাদান কি উপেক্ষা করা হয়েছে?
পূর্বোক্ত জমায়েত, দাবি ও ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশা করব, শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলামের মৃত্যুর সঠিক কারণ তদন্তে উদ্ঘাটিত হবে এবং সন্তানসহ তাঁর মৃত্যুর যথার্থ বিচার নিশ্চিত হবে। প্রসঙ্গত বলতে হয়, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে এমন অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যেগুলোর তদন্তে অপরাধীর সন্ধান মেলেনি, সুবিচার তো দূরের কথা। অথচ দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে তদন্ত সম্পন্ন হলে প্রায় সব ক্ষেত্রেই হত্যারহস্য উদ্ঘাটিত হয় এবং অপরাধী তার অপরাধের জন্য শাস্তি পেয়ে থাকে।
এমন বহু ঘটনার একটি প্রসঙ্গতই উল্লেখ করছি। যশোরের সাংবাদিক শামছুর রহমানের হত্যারহস্য আজো উদ্ঘাটিত হয়নি, অপরাধীও শনাক্ত হয়নি। অথচ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজ থেকে ১১ বছর আগে ১৬ জুলাই ২০০০ অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান অকুতোভয় ওই সাংবাদিক। আততায়ী অজ্ঞাতপরিচয় হলেও তখনকার লেখালেখিতে এবং বিশেষ চক্র থেকে তাঁকে টেলিফোনে হত্যার হুমকি, এমনকি তাঁর কিছু অনুসন্ধান বন্ধ রাখতে নির্দেশ ইত্যাদি সূত্র মোটা দাগেরই ছিল। আততায়ীচক্র একেবারে অজ্ঞাত তা বলা হয়তো ঠিক নয়।
তৎকালীন দৈনিক বাংলা সম্পাদকের কাছ থেকে এসব শোনা এবং সেই সূত্রে সাংবাদিক শামছুর রহমানকে জানা। ওদের কাছে 'কেবল' ডাকনামে অন্তরঙ্গ এ সাংবাদিক সত্যই ছিলেন নির্ভীক এবং সৎ সাংবাদিকতার আদর্শে ও কর্মে নিবেদিতপ্রাণ। আর সে জন্যই কিনা সমাজের পাপীচক্রের হাতে তাঁকে প্রাণ দিতে হলো।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান শামছুর রহমান সম্ভবত বাবার আদর্শ রক্ত বহন ও লালন করেছিলেন। তাই চোরাচালানিচক্র এবং মাদক ও নারী-শিশু পাচারকারীচক্রের শাসানি সত্ত্বেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিপজ্জনক পথ থেকে, এককথায় সত্যের পথ থেকে সরে আসেননি তিনি। ন্যায়নীতি ও নৈতিকতার দায় থেক পিছু হটেননি। যত দূর জানি, সাংবাদিকমহলে তাঁর ঘনিষ্ঠজন কেউ কেউ তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছিল, তাঁর ওই কাজের পথটা খুবই বিপজ্জনক।
কিন্তু জীবনের নিরাপত্তাহীনতা বা প্রাণনাশের হুমকি সত্ত্বেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ থেকে, পেশাগত দায়বদ্ধতা থেকে সরে আসতে পারেননি শামছুর রহমান। সাংবাদিকতার বিপজ্জনক পথেই বিচরণ করেছেন তিনি এবং সে জন্য বিশ্বের একাধিক শহীদ সাংবাদিকের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়ানো শামছুর রহমান। পেশাগত সততা ও নিষ্ঠা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে আততায়ীর নিষ্ঠুর গুলির শিকার শামছুর রহমান। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও তাঁর হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের তালিকা তৈরি এবং তদন্তকাজ বিশেষ ব্যবস্থায় সম্পন্ন করার মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করে তাদের বিচারের সম্মুখীন করার নৈতিক দায় থেকে মুক্ত হোন। দেশের প্রতিটি নাগরিক তথা জনগণের নিরাপত্তা ও সুবিচার নিশ্চিত করার দায় সব গণতান্ত্রিক সরকারেরই।
আমরা বলতে চাই না 'বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।' আর সে জন্যই আমাদের প্রত্যাশা, সরকার সাংবাদিক হত্যা, রাজনীতিক হত্যার মতো সমাজের বিভিন্ন স্তরে সংঘটিত বহুল আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্ত কার্যক্রম নতুন করে শুরু করবে, সুবিচার নিশ্চিত করবে। দরকার মনে করলে বিশেষ তদন্তবাহিনী গঠন করবে।
আমাদের দাবি আরো এ জন্য যে ইতিমধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তকাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ হওয়ার ফলে সুবিচার নিশ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে কর্নেল তাহেরের প্রতি সংঘটিত অন্যায়েরও সুবিচার সম্পন্ন হয়েছে। একে একে অন্য গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোও সরকারের হাতে তুলে নেওয়া উচিত এবং তা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। তাহলে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দায় সমাপনের কাজটা সরকার সঠিকভাবে করতে পারবে। পাশাপাশি একাধিক খুনের মামলায় দণ্ডিত আসামিকে ক্ষমা কতটা যুক্তিসংগত, তাও বিবেচনায় রাখা উচিত এ জন্য যে তাতে মুক্ত খুনি অনেক সময়ই সমাজের জন্য নতুন করে সন্ত্রাসের আতঙ্ক সৃষ্টি করে থাকে এবং তা অপরাধীর শাস্তি না হওয়ার কারণে।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক
প্রাবন্ধিক ও কবি
No comments