মসিয়ঁ, আগুটি হালাল by কাজী জহিরুল ইসলাম
রাস্তার অবস্থা ভীষণ খারাপ। গাড়ি কখনও লাফিয়ে তিন-চার ফুট উপরে উঠে যাচ্ছে। ঠিকমত বসে থাকাই মুশকিল। এরই মধ্যে আমি কয়েকবার টাল সামলাতে না পেরে লাফিয়ে উঠে গাড়ির সিলিংয়ে ধাক্কা খেয়ে মাথায় আঘাত পেলাম। দু’পাশে সেই একই দৃশ্য, কাজু বাদাম, মেহগনি আর তুলা গাছের সারি।
কোথাও কোথাও বেশ ঝাঁকড়া আম গাছের জঙ্গলও চোখে পড়ছে। আর ন্যাড়া পেঁপে গাছের সারি আছে সর্বত্রই। ফসলের কোনো মাঠ দেখছি না। ল্যান্ডস্ক্যাপ যদিও পাহাড়ি, এখানেও নিশ্চয়ই কিছু চাষ করা যায়। ভেন্নাপাতার মতো এক ধরনের গাছ দেখছি, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম এগুলো জংলা গাছ, পরে আহমেদুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এগুলো কাসাবার ক্ষেত। এই গাছগুলোর শেকড়ই হচ্ছে আইভরিয়ানদের প্রধান খাবার, কাসাবা। এখানকার মানুষের দ্বিতীয় প্রধান খাবার হলো জংলী কলা, যার ইংরেজি নাম প্লান্টেইন। আমি কিন্তু কোথাও প্লান্টেইনের জঙ্গল দেখতে পাচ্ছি না। দেশের উত্তরাংশ খুবই শুষ্ক, হয়তো কলার অরণ্যগুলো দক্ষিণাংশে থেকে থাকবে।
আঁকা-বাঁকা সর্পিল কিন্তু খুবই প্রশস্ত মেঠো সড়কে গাড়ি চালাতে চালাতে এক সময় এসে পৌঁছলাম করোগো টিম সাইটের অফিসে। চৌদ্দ ইউএন পোল আর দশ মিলিটারি অবজার্ভার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। টাকা বিতরণ করতে বেশিক্ষণ লাগল না। মিশনের অর্থ ব্যবস্থাপনাটি বেশ গোছানা এবং সহজ। প্রত্যেকের নামে নামে খাম তৈরি করা আছে। আমার কাজ হলো, নাম ডেকে তার হাতে খামটি তুলে দেয়া। খামের ভেতরে কি আছে, না আছে, আমার দেখার দরকার নেই। টাকা কম-বেশি হলে সে ক্যাশিয়ারকে রিপোর্ট করবে, সেই ঝামেলা ক্যাশিয়ার সামলাবে। বারোটার কাছাকাছি বাজে। প্রচণ্ড গরম পড়েছে। এসি রুম থেকে বেরিয়েই কুল কুল করে ঘামতে শুরু করেছি। আকাশে তীব্র রোদ। দূরের পাহাড় অরণ্য প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়ছে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ভেজা কাচের ভেতর দিয়ে কিংবা আগুনের আঁচের ভেতর দিয়ে তাকালে দৃশ্যগুলো যেমন ঘোলা লাগে আর দুলতে থাকে সেই রকম লাগছে। আমি তাড়া দিচ্ছি জলদি গাড়িতে ওঠার জন্য। কিন্তু যিনি আমাকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে এসেছেন, তিনি লাপাত্তা। টাকা পাওয়ার আগে সবাই আমাকে ঘিরে রেখেছিল, এখন আমি কারও টিকির সন্ধানও পাচ্ছি না। গরমে, অস্বস্তিতে মেজাজ খিচে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর এক কালো পুলিশ, সেনেগালিজ, একটি থালা ভর্তি পোড়া মাংস আর লম্বা এক বাগেজ নিয়ে এলো।
স্যার, আপনি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত, এগুলো খেয়ে তারপর রওনা দিন।
লোকটির আতিথেয়তায় বুনো ভাব থাকলেও আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ হলাম। ওকে না করতে পারলাম না। সত্যি কথা বলতে কি ক্ষুধায় আমারও পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছে। সেই কাকভোরে বেরিয়েছি, বাসা থেকে ঠিকমত কিছু খেয়েও আসতে পারিনি।
আমি সম্মতিসূচক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালে সে আমাকে টাকা বিতরণের ঘরটিতেই নিয়ে গেল। আমি মাংসের থালা আর বাঁশের মতো লম্বা, চিকন এবং কাঠের মতো শক্ত ব্রেড বাগেজ নিয়ে বসে পড়লে ও ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে গেল। যত ক্ষিপ্রতায় গিয়েছিল তার চেয়ে অধিক ক্ষিপ্রতায় ফিরে এসে আধা বোতল আওয়া ওক কাঠের টেবিলের ওপর রাখল। আমি ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম। ও জানালো, মাতালা।
মাতালা, খাবারের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এখানে কি কোক পাওয়া যাবে?
আমি আসলে আধা বোতল পানিটা ধরতে চাচ্ছি না। কারণ আমি নিশ্চিত যে, বাকি অর্ধেকটা পানি ওরা মুখ লগিয়ে খেয়েছে।
মাতালা মনে হয় ইংরেজি কিছুটা বোঝে কিন্তু বলতে পারে না। তাই আমার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়েই বেরিয়ে গেল। পোড়া মাংস হলেও খেতে খুব দারুণ লাগছে। সঙ্গে পিঁয়াজকুঁচি আর টমেটো থাকাতে খুব রুচিসম্মত হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে মাতালা বোঝাতে পারল যে, কোক দেয়া সম্ভব হবে না। হঠাত্ মনে হলো কিসের মাংস খাচ্ছি, ওকে একবার জিজ্ঞেস করা দরকার। মাতালা মুসলমান কাজেই শুয়োর হবে না, এটা আমি নিশ্চিত। যা-ই হোক হালাল মাংসই হবে, হয়তো হাইজেনিক না হতে পারে।
মাতালা বলল, আগুটি।
ওরা কি গরুকে আগুটি বলে, নাকি খাসি? আমি কাউ, বিফ, মাটন, গোট, শিপ কত কিছু বলছি, মাতালা কিছুই বুঝতে পারছে না। শেষে আমি গরুর মতো হাম্বা ডাক দিয়ে দেখালে ও মাথা নেড়ে জানালো ‘না’। এবার আমি ছাগল সাজলাম। এবারও একই জবাব, ‘না’। আমি কিন্তু এবার বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। মনে মনে আল্লাহকে ডেকে এবার ভেড়া সাজলাম। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। একই উত্তর। তাহলে কি মুরগি? মাংসগুলো বেশ ছোট ছোট করে কাটা। কিন্তু মুরগির মাংসের রং তো এরকম হয় না। অবশ্য পোড়ানো মাংসের রং বোঝা মুশকিল। আমি কিন্তু এরই মধ্যে খাওয়া থামিয়ে দিয়েছি। আমি বেশ বিরক্ত হয়েছি মাতালার ওপর; এটা ও বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরে একটি কাগজ আর কলম এনে আগুটির ছবি এঁকে দেখালো আমাকে। ও এটা কি আঁঁকল? এতো ইঁদুরের মতো ছবি। পেছনে লম্বা, সরু লেজ। আমি অতিদ্রুত বিশাল কামরাটির এক কোণে, কারও একজনের, ডেস্কটপটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। সরাসরি গুগুল সার্চ ইঞ্জিনে গিয়ে মাতালাকে বললাম, আগুটি বানান কর। গুগুল ইমেজে এজিইউটিআই বর্ণগুলো লিখে সার্চ চাপ দিতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল বড়সড় ইঁদুরের ছবি, অনেকটা খরগোশের মতো দেখতে। মাতালাকে টান মেরে স্ক্রিনের ওপর ওর মাথাটা এনে বললাম, এই জিনিসের মাংস? ও ওপর নিচ মাথা দুলিয়ে বললো, উই উই।
মাই গড! আমি ইঁদুর খেয়েছি? সঙ্গে সঙ্গে নাড়ি-ভুড়ি উল্টে বমি আসতে লাগল। আমি ওয়াক ওয়াক শুরু করে দিলাম। মাতালা আমার পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে বলছে, মেসিও ইসলাম, হালাল, আগুটি হালাল।
রাখ তোর আগুটি হালাল!
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার কাছেই হড়হড় করে বমি করে দিলাম। তারপর ভেতরে ঢুকে যে পানি ছোব না ভেবেছিলাম, সেই পানি ঢক ঢক করে খেলাম, কুলি করলাম।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
আঁকা-বাঁকা সর্পিল কিন্তু খুবই প্রশস্ত মেঠো সড়কে গাড়ি চালাতে চালাতে এক সময় এসে পৌঁছলাম করোগো টিম সাইটের অফিসে। চৌদ্দ ইউএন পোল আর দশ মিলিটারি অবজার্ভার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। টাকা বিতরণ করতে বেশিক্ষণ লাগল না। মিশনের অর্থ ব্যবস্থাপনাটি বেশ গোছানা এবং সহজ। প্রত্যেকের নামে নামে খাম তৈরি করা আছে। আমার কাজ হলো, নাম ডেকে তার হাতে খামটি তুলে দেয়া। খামের ভেতরে কি আছে, না আছে, আমার দেখার দরকার নেই। টাকা কম-বেশি হলে সে ক্যাশিয়ারকে রিপোর্ট করবে, সেই ঝামেলা ক্যাশিয়ার সামলাবে। বারোটার কাছাকাছি বাজে। প্রচণ্ড গরম পড়েছে। এসি রুম থেকে বেরিয়েই কুল কুল করে ঘামতে শুরু করেছি। আকাশে তীব্র রোদ। দূরের পাহাড় অরণ্য প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়ছে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ভেজা কাচের ভেতর দিয়ে কিংবা আগুনের আঁচের ভেতর দিয়ে তাকালে দৃশ্যগুলো যেমন ঘোলা লাগে আর দুলতে থাকে সেই রকম লাগছে। আমি তাড়া দিচ্ছি জলদি গাড়িতে ওঠার জন্য। কিন্তু যিনি আমাকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে এসেছেন, তিনি লাপাত্তা। টাকা পাওয়ার আগে সবাই আমাকে ঘিরে রেখেছিল, এখন আমি কারও টিকির সন্ধানও পাচ্ছি না। গরমে, অস্বস্তিতে মেজাজ খিচে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর এক কালো পুলিশ, সেনেগালিজ, একটি থালা ভর্তি পোড়া মাংস আর লম্বা এক বাগেজ নিয়ে এলো।
স্যার, আপনি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত, এগুলো খেয়ে তারপর রওনা দিন।
লোকটির আতিথেয়তায় বুনো ভাব থাকলেও আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ হলাম। ওকে না করতে পারলাম না। সত্যি কথা বলতে কি ক্ষুধায় আমারও পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছে। সেই কাকভোরে বেরিয়েছি, বাসা থেকে ঠিকমত কিছু খেয়েও আসতে পারিনি।
আমি সম্মতিসূচক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালে সে আমাকে টাকা বিতরণের ঘরটিতেই নিয়ে গেল। আমি মাংসের থালা আর বাঁশের মতো লম্বা, চিকন এবং কাঠের মতো শক্ত ব্রেড বাগেজ নিয়ে বসে পড়লে ও ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে গেল। যত ক্ষিপ্রতায় গিয়েছিল তার চেয়ে অধিক ক্ষিপ্রতায় ফিরে এসে আধা বোতল আওয়া ওক কাঠের টেবিলের ওপর রাখল। আমি ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম। ও জানালো, মাতালা।
মাতালা, খাবারের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এখানে কি কোক পাওয়া যাবে?
আমি আসলে আধা বোতল পানিটা ধরতে চাচ্ছি না। কারণ আমি নিশ্চিত যে, বাকি অর্ধেকটা পানি ওরা মুখ লগিয়ে খেয়েছে।
মাতালা মনে হয় ইংরেজি কিছুটা বোঝে কিন্তু বলতে পারে না। তাই আমার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়েই বেরিয়ে গেল। পোড়া মাংস হলেও খেতে খুব দারুণ লাগছে। সঙ্গে পিঁয়াজকুঁচি আর টমেটো থাকাতে খুব রুচিসম্মত হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে মাতালা বোঝাতে পারল যে, কোক দেয়া সম্ভব হবে না। হঠাত্ মনে হলো কিসের মাংস খাচ্ছি, ওকে একবার জিজ্ঞেস করা দরকার। মাতালা মুসলমান কাজেই শুয়োর হবে না, এটা আমি নিশ্চিত। যা-ই হোক হালাল মাংসই হবে, হয়তো হাইজেনিক না হতে পারে।
মাতালা বলল, আগুটি।
ওরা কি গরুকে আগুটি বলে, নাকি খাসি? আমি কাউ, বিফ, মাটন, গোট, শিপ কত কিছু বলছি, মাতালা কিছুই বুঝতে পারছে না। শেষে আমি গরুর মতো হাম্বা ডাক দিয়ে দেখালে ও মাথা নেড়ে জানালো ‘না’। এবার আমি ছাগল সাজলাম। এবারও একই জবাব, ‘না’। আমি কিন্তু এবার বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। মনে মনে আল্লাহকে ডেকে এবার ভেড়া সাজলাম। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। একই উত্তর। তাহলে কি মুরগি? মাংসগুলো বেশ ছোট ছোট করে কাটা। কিন্তু মুরগির মাংসের রং তো এরকম হয় না। অবশ্য পোড়ানো মাংসের রং বোঝা মুশকিল। আমি কিন্তু এরই মধ্যে খাওয়া থামিয়ে দিয়েছি। আমি বেশ বিরক্ত হয়েছি মাতালার ওপর; এটা ও বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরে একটি কাগজ আর কলম এনে আগুটির ছবি এঁকে দেখালো আমাকে। ও এটা কি আঁঁকল? এতো ইঁদুরের মতো ছবি। পেছনে লম্বা, সরু লেজ। আমি অতিদ্রুত বিশাল কামরাটির এক কোণে, কারও একজনের, ডেস্কটপটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। সরাসরি গুগুল সার্চ ইঞ্জিনে গিয়ে মাতালাকে বললাম, আগুটি বানান কর। গুগুল ইমেজে এজিইউটিআই বর্ণগুলো লিখে সার্চ চাপ দিতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল বড়সড় ইঁদুরের ছবি, অনেকটা খরগোশের মতো দেখতে। মাতালাকে টান মেরে স্ক্রিনের ওপর ওর মাথাটা এনে বললাম, এই জিনিসের মাংস? ও ওপর নিচ মাথা দুলিয়ে বললো, উই উই।
মাই গড! আমি ইঁদুর খেয়েছি? সঙ্গে সঙ্গে নাড়ি-ভুড়ি উল্টে বমি আসতে লাগল। আমি ওয়াক ওয়াক শুরু করে দিলাম। মাতালা আমার পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে বলছে, মেসিও ইসলাম, হালাল, আগুটি হালাল।
রাখ তোর আগুটি হালাল!
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার কাছেই হড়হড় করে বমি করে দিলাম। তারপর ভেতরে ঢুকে যে পানি ছোব না ভেবেছিলাম, সেই পানি ঢক ঢক করে খেলাম, কুলি করলাম।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
No comments