অগ্নিদগ্ধ সত্য by রেজোয়ান সিদ্দিকী
শুধু নগর নয়, গ্রামে-গঞ্জেও ভোরবেলা পত্রিকা চাই নাগরিকদের। খবরের জন্য পত্রিকা চাই, আনন্দ-বিনোদনের জন্য পত্রিকা চাই, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের জন্য পত্রিকা চাই। শহর-নগরের হকাররা ভোরবেলা দরজার নিচ দিয়ে পত্রিকা ঠেলে দিয়ে যায়।
গ্রামে গ্রামে চায়ের দোকানেও পত্রিকা রাখা হয় গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য। একেক টি-স্টলে একেক কাগজ। খবর-তৃষিত মানুষরা দোকানে দোকানে বসে খবর পড়েন। কিংবা একজন পড়েন শব্দ করে, দশজন শোনেন। খবরের উত্স এখন অনেক। রেডিও, টিভি, স্যাটেলাইট টিভি, এমন কি মোবাইল ফোন। এসব আসার পর অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন যে, ওসব উেসর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে খবরের কাগজ টিকতে পারবে তো? কিন্তু সে আশঙ্কা সত্য হয়নি। শিক্ষা যত বাড়ছে, খবরের কাগজের চাহিদাও তত বাড়ছে, কমেনি। দেশে পত্রিকার সংখ্যা বাড়ছে। সাংবাদিকের সংখ্যাও বাড়ছে। পেশাজীবী হিসেবে সাংবাদিকরা এখন কম বড় কম্যুনিটি নয়।
সাংবাদিকতা পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশার একটি। এই পেশায় রয়েছে মৃত্যুভয়, নিরাপত্তার ভয়, আক্রান্ত হওয়ার ভয়। কারণ, সংবাদপত্র বা সাংবাদিক সত্য প্রকাশ করে থাকেন। সত্য সবার জন্য মধুর নয়। বিশেষ করে কোনো সত্য যদি ক্ষমতাধরদের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়, তখন সংবাদপত্র ও সাংবাদিক বিপন্ন হয়ে পড়েন। সে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হতে পারেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, চোর-বদমাশ-মাস্তান-খুনি। তখন সংবাদপত্র ও সাংবাদিক আক্রমণের শিকার হন। সাংবাদিক হত্যা, সাংবাদিকের হাত-পা ভেঙে দেয়া, মারধর করা, হুমকি-ধামকি-হামলা তখন অবধারিত হয়ে ওঠে। নাগরিকরা এতে বিপন্ন বোধ করেন বটে, তবে তাদের করার কিছুই থাকে না।
সাংবাদিকদের দাবি, যদি তাদের লেখায় কোথাও ভুল হয়ে যায়, তবে লিখেই তার প্রতিবাদ করুন। বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবাদ যথাযথ গুরুত্ব সহকারে ছাপতে সাংবাদিকরা বাধ্য। কিন্তু সত্য প্রকাশে আতঙ্কিত প্রভাবশালীরা সে পথে সাধারণত অগ্রসর হন না। তারা হামলা-হুমকি-নির্যাতন করে আগুন জ্বালিয়ে দেন।
গত ১৭ ডিসেম্বর দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা প্রভাবশালীদের মনোপুত নয় এমন এক খবর ছেপে হুমকি-ধামকি-হামলা-মামলার শিকার হয়েছে। সে খবরের শিরোনাম ছিল ‘তৌফিক-ই-এলাহী ও জয়ের বিরুদ্ধে ৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ নেয়ার অভিযোগ’/শেভরনকে বিনা টেন্ডারে ৩৭০ কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দিতে উেকাচ গ্রহণের বিষয়ে তদন্ত করছে মন্ত্রণালয়।’ ব্যস। তৌফিক-ই-এলাহী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা, জয় শেখ হাসিনার পুত্র। ফলে আমার দেশ ও এর সম্পাদককে কে কত জোর গলায় হুমকি দিতে পারেন, আওয়ামী মহলে তার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। আওয়ামী মন্ত্রীরা জানিয়ে দিয়েছেন, আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদককে তারা জনতার আদালতে বিচার করবেন এবং তাকে রাস্তায় বের হতে দেয়া হবে না।
আওয়ামী সমর্থকরা জেলায় জেলায় পত্রিকা সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছেন, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে। আমরা নাগরিকরা সীমাহীন আতঙ্কে সে দৃশ্য অবলোকন করছি। আর এই ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডে আতঙ্কিত হচ্ছি। ইতোমধ্যে পত্রিকার সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের ওপরও হামলা চালানো হয়েছে। আমরা পত্রিকার পাঠকরা অবগত আছি যে, আমার দেশ রিপোর্টটি হাওয়া থেকে বানায়নি। পেট্রোবাংলা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে জনৈক আবু সিদ্দিক প্রধানমন্ত্রী বরাবর অভিযোগটি উত্থাপন করেছেন লিখিতভাবে। তার ভিত্তিতেই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেছেন, ওটি ছিল একটি উড়ো চিঠি। তবে উড়ো চিঠি হলেও তার গুরুত্ব নিশ্চয়ই ছিল। তাই বিষয়টি পেট্রোবাংলাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পেট্রোবাংলা তদন্ত নির্দেশের জবাবে বলেছে, ‘বিষয়টির সঙ্গে সরকারের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ জড়িত এবং বিষয়টি স্পর্শকাতর বিধায় তদন্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগেই তদন্ত হোক। এ ব্যাপারে পেট্রোবাংলা সব ধরনের সহযোগিতা করবে।’ তদন্ত হচ্ছে। খবর সেটুকুই। চিঠিটির যদি কোনো গুরুত্বই না থাকত, তাহলে তদন্ত করা হবে কেন। এর আগে নাইকো দুর্নীতি মামলায় তৌফিক-ই-এলাহী জেল খেটে এসেছেন।
আমরা নাগরিক পাঠকরা দর্শকের সারিতে আতঙ্কিত ফ্যাসিবাদের উত্থান দেখে। আরও দেখলাম সুবেশী তরুণ-যুবকরা বেশ পোজ দিয়ে আমার দেশ পত্রিকার কপি পুড়িয়ে দিচ্ছে। কেবলই দলের নেতাদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা। সে চেষ্টার অংশ হিসেবে পত্রিকার কপিতে আগুন দিয়ে উল্লাস। ভাবতে কষ্ট লাগে। এভাবে সত্যের বিনাশ ঘটানো যায়? এভাবে একটি সত্যকে ধ্বংস করে দেয়া যায়? যায় না। আমরা নাগরিকরা বুঝি এতে সত্য আরও পোক্ত হয়। অধিকাংশ নাগরিক কেবলই সেই সত্যের সন্ধান করে চলেছি।
মানুষ সত্য প্রকাশ করতে চায়, কেননা মানুষ মূলত অস্তিত্ববাদী। কিন্তু সর্বস্তরে সত্যের বিরুদ্ধে সরকারের ফ্যাসিবাদী অবস্থানে ব্যক্তি নাগরিক শঙ্কিত। পত্রিকার নিজস্ব শক্তি আছে। তার পাঠক-শক্তি আছে। তার পাশে দাঁড়াবার লোক আছে। কিন্তু ব্যক্তি নাগরিকের কোনো সংঘশক্তি নেই। ফলে সত্য প্রকাশে তার হৃদয় আকুলি-বিকুলি করে। কোথাও না পারলে শেষ পর্যন্ত সে পত্রিকার আশ্রয় নেয়। সত্য প্রকাশ করে। পত্রিকায় আগুন দিয়ে তবে কি সরকার সে সত্যকে অগ্নিদগ্ধ করে মারতে চায়? নাগরিক প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
সাংবাদিকতা পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশার একটি। এই পেশায় রয়েছে মৃত্যুভয়, নিরাপত্তার ভয়, আক্রান্ত হওয়ার ভয়। কারণ, সংবাদপত্র বা সাংবাদিক সত্য প্রকাশ করে থাকেন। সত্য সবার জন্য মধুর নয়। বিশেষ করে কোনো সত্য যদি ক্ষমতাধরদের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়, তখন সংবাদপত্র ও সাংবাদিক বিপন্ন হয়ে পড়েন। সে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হতে পারেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, চোর-বদমাশ-মাস্তান-খুনি। তখন সংবাদপত্র ও সাংবাদিক আক্রমণের শিকার হন। সাংবাদিক হত্যা, সাংবাদিকের হাত-পা ভেঙে দেয়া, মারধর করা, হুমকি-ধামকি-হামলা তখন অবধারিত হয়ে ওঠে। নাগরিকরা এতে বিপন্ন বোধ করেন বটে, তবে তাদের করার কিছুই থাকে না।
সাংবাদিকদের দাবি, যদি তাদের লেখায় কোথাও ভুল হয়ে যায়, তবে লিখেই তার প্রতিবাদ করুন। বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবাদ যথাযথ গুরুত্ব সহকারে ছাপতে সাংবাদিকরা বাধ্য। কিন্তু সত্য প্রকাশে আতঙ্কিত প্রভাবশালীরা সে পথে সাধারণত অগ্রসর হন না। তারা হামলা-হুমকি-নির্যাতন করে আগুন জ্বালিয়ে দেন।
গত ১৭ ডিসেম্বর দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা প্রভাবশালীদের মনোপুত নয় এমন এক খবর ছেপে হুমকি-ধামকি-হামলা-মামলার শিকার হয়েছে। সে খবরের শিরোনাম ছিল ‘তৌফিক-ই-এলাহী ও জয়ের বিরুদ্ধে ৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ নেয়ার অভিযোগ’/শেভরনকে বিনা টেন্ডারে ৩৭০ কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দিতে উেকাচ গ্রহণের বিষয়ে তদন্ত করছে মন্ত্রণালয়।’ ব্যস। তৌফিক-ই-এলাহী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা, জয় শেখ হাসিনার পুত্র। ফলে আমার দেশ ও এর সম্পাদককে কে কত জোর গলায় হুমকি দিতে পারেন, আওয়ামী মহলে তার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। আওয়ামী মন্ত্রীরা জানিয়ে দিয়েছেন, আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদককে তারা জনতার আদালতে বিচার করবেন এবং তাকে রাস্তায় বের হতে দেয়া হবে না।
আওয়ামী সমর্থকরা জেলায় জেলায় পত্রিকা সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছেন, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে। আমরা নাগরিকরা সীমাহীন আতঙ্কে সে দৃশ্য অবলোকন করছি। আর এই ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডে আতঙ্কিত হচ্ছি। ইতোমধ্যে পত্রিকার সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের ওপরও হামলা চালানো হয়েছে। আমরা পত্রিকার পাঠকরা অবগত আছি যে, আমার দেশ রিপোর্টটি হাওয়া থেকে বানায়নি। পেট্রোবাংলা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে জনৈক আবু সিদ্দিক প্রধানমন্ত্রী বরাবর অভিযোগটি উত্থাপন করেছেন লিখিতভাবে। তার ভিত্তিতেই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেছেন, ওটি ছিল একটি উড়ো চিঠি। তবে উড়ো চিঠি হলেও তার গুরুত্ব নিশ্চয়ই ছিল। তাই বিষয়টি পেট্রোবাংলাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পেট্রোবাংলা তদন্ত নির্দেশের জবাবে বলেছে, ‘বিষয়টির সঙ্গে সরকারের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ জড়িত এবং বিষয়টি স্পর্শকাতর বিধায় তদন্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগেই তদন্ত হোক। এ ব্যাপারে পেট্রোবাংলা সব ধরনের সহযোগিতা করবে।’ তদন্ত হচ্ছে। খবর সেটুকুই। চিঠিটির যদি কোনো গুরুত্বই না থাকত, তাহলে তদন্ত করা হবে কেন। এর আগে নাইকো দুর্নীতি মামলায় তৌফিক-ই-এলাহী জেল খেটে এসেছেন।
আমরা নাগরিক পাঠকরা দর্শকের সারিতে আতঙ্কিত ফ্যাসিবাদের উত্থান দেখে। আরও দেখলাম সুবেশী তরুণ-যুবকরা বেশ পোজ দিয়ে আমার দেশ পত্রিকার কপি পুড়িয়ে দিচ্ছে। কেবলই দলের নেতাদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা। সে চেষ্টার অংশ হিসেবে পত্রিকার কপিতে আগুন দিয়ে উল্লাস। ভাবতে কষ্ট লাগে। এভাবে সত্যের বিনাশ ঘটানো যায়? এভাবে একটি সত্যকে ধ্বংস করে দেয়া যায়? যায় না। আমরা নাগরিকরা বুঝি এতে সত্য আরও পোক্ত হয়। অধিকাংশ নাগরিক কেবলই সেই সত্যের সন্ধান করে চলেছি।
মানুষ সত্য প্রকাশ করতে চায়, কেননা মানুষ মূলত অস্তিত্ববাদী। কিন্তু সর্বস্তরে সত্যের বিরুদ্ধে সরকারের ফ্যাসিবাদী অবস্থানে ব্যক্তি নাগরিক শঙ্কিত। পত্রিকার নিজস্ব শক্তি আছে। তার পাঠক-শক্তি আছে। তার পাশে দাঁড়াবার লোক আছে। কিন্তু ব্যক্তি নাগরিকের কোনো সংঘশক্তি নেই। ফলে সত্য প্রকাশে তার হৃদয় আকুলি-বিকুলি করে। কোথাও না পারলে শেষ পর্যন্ত সে পত্রিকার আশ্রয় নেয়। সত্য প্রকাশ করে। পত্রিকায় আগুন দিয়ে তবে কি সরকার সে সত্যকে অগ্নিদগ্ধ করে মারতে চায়? নাগরিক প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
পতাকাপ্রীতির প্রকাশ
গত কয়েক বছর ধরে ফ্যাশনের বাজারে পতাকা পোশাক হয়ে এসেছে। শাড়ি-ব্লাউজে পতাকার প্রতিচ্ছবি। শার্ট-প্যান্টে পতাকা। পাঞ্জাবি-পাজামায় পতাকার আদল। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে, টিভিতে অ্যাড দিয়ে ফ্যাশন হাউসগুলো জানান দিয়েছে, তারা স্বাধীনতা ফ্যাশনের আয়োজন করেছে। শিশু-তরুণীরা গালে পতাকার অস্থায়ী টাট্টু লাগিয়েছে। ছোট ছোট পতাকা দেদারসে বিক্রি হয়েছে। এসব চলছিল অনেকদিন ধরে। তবে পোশাক জুড়ে পতাকার আদল নগরে নতুন বৈকি!
আমার কাছে স্বাধীনতা এক চেতনা ও অর্জনের নাম। এক অসম সাহসিকতা আর লড়াইয়ের নাম। যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের পাশে ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে হারানোর নাম। জীবন বাজি রাখার নাম। মৃত্যুভয় ভুলে যাওয়ার নাম। আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ একজন দরিদ্র মানুষের একমাত্র সম্বল মুরগিটি জবাই করে ভালোবেসে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ানোর নাম। আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ মসজিদে মসজিদে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের জন্য দোয়া কামনার নাম। আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ দু’ হাত তুলে আমার শ্মশ্রুমণ্ডিত পিতার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খোদার কাছে ফরিয়াদ করার নাম। আমার তখন আঠারো বছর এক মাস বয়স। যুদ্ধে যাওয়ার ছিল শ্রেষ্ঠ সময়।
কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ কী? স্বাধীনতা কী? দেখার বড় কৌতূহল হলো। তাই ১৬ ডিসেম্বর আমিও উত্সবের নগরীতে পথে নেমেছিলাম। রাস্তায় বের হয়ে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। ‘শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের শরীর জুড়ে পতাকার রং। দালান-কোঠায় উড়ছে পতাকা। পোশাকে পতাকা। গালে পতাকা। কপালে পতাকা। ডানায় পতাকা। হাতে উত্তোলিত পতাকা। গাড়ির সামনের বনেট পতাকায় ঢাকা। কিন্তু বিভ্রান্তিতে ভুগতে হলো গাড়ির ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডগুলোতে মন্ত্রীদের মতো পতাকা লাগিয়ে চলছে অনেকে। কে যান? মন্ত্রী না মন্ত্রীতুল্য কেউ? সেটা কল্পনা করাও কঠিন ছিল। এবারের বিজয় দিবসে ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’ ছিলাম। মন্ত্রী আর পাবলিকে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সবার গাড়িতে ছিল জাতীয় পতাকা।
যারা তাদের গাড়িতে পতাকা তুলেছিলেন, বা এখনও আছে, তারা পতাকা আইন কাকে বলে, জানেন না। কিংবা জেনেও উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু তাদেরও জানানো দরকার আছে যে, কে গাড়িতে পতাকা তুলতে পারেন, কে পারে না। পতাকা স্বাধীনতার প্রতীক। তার যথেচ্ছ ব্যবহার সঠিক নয়। অন্য সময় দেখেছি, পতাকার যথেচ্ছ ব্যবহারে পুলিশ বাধা দিয়েছে। এবার তেমন ঘটনা চোখে পড়েনি।
তবু নাগরিকদের এই পতাকাপ্রীতি অনেকখানি আশার সঞ্চার করেছে। স্বাধীনতার প্রতি তাদের ভালোবাসা আমাদের আন্দোলিত করেছে। শিশুদের হাতে হাতে ছোট্ট কাঠির মধ্যে কাগজের পতাকা হৃদয় আন্দোলিত করেছে। এরাও ভবিষ্যতে এই পতাকার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে শরিক হবে। অক্ষুণ্ন রাখবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কিন্তু এর সঙ্গে যা দরকার তা হলো, ভবিষ্যত্ বংশধরদের জাতি হিসেবে গৌরব বোধ করার শিক্ষা। আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, ইতিহাস তাদের ভালো করে জানান দেয়ার ব্যবস্থা। শিক্ষার ভেতরে তা প্রোথিত করে দেয়ার চেষ্টা। এ অভাব দূর করার ব্যবস্থা কে নেবে?
গত কয়েক বছর ধরে ফ্যাশনের বাজারে পতাকা পোশাক হয়ে এসেছে। শাড়ি-ব্লাউজে পতাকার প্রতিচ্ছবি। শার্ট-প্যান্টে পতাকা। পাঞ্জাবি-পাজামায় পতাকার আদল। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে, টিভিতে অ্যাড দিয়ে ফ্যাশন হাউসগুলো জানান দিয়েছে, তারা স্বাধীনতা ফ্যাশনের আয়োজন করেছে। শিশু-তরুণীরা গালে পতাকার অস্থায়ী টাট্টু লাগিয়েছে। ছোট ছোট পতাকা দেদারসে বিক্রি হয়েছে। এসব চলছিল অনেকদিন ধরে। তবে পোশাক জুড়ে পতাকার আদল নগরে নতুন বৈকি!
আমার কাছে স্বাধীনতা এক চেতনা ও অর্জনের নাম। এক অসম সাহসিকতা আর লড়াইয়ের নাম। যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের পাশে ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে হারানোর নাম। জীবন বাজি রাখার নাম। মৃত্যুভয় ভুলে যাওয়ার নাম। আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ একজন দরিদ্র মানুষের একমাত্র সম্বল মুরগিটি জবাই করে ভালোবেসে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ানোর নাম। আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ মসজিদে মসজিদে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের জন্য দোয়া কামনার নাম। আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ দু’ হাত তুলে আমার শ্মশ্রুমণ্ডিত পিতার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খোদার কাছে ফরিয়াদ করার নাম। আমার তখন আঠারো বছর এক মাস বয়স। যুদ্ধে যাওয়ার ছিল শ্রেষ্ঠ সময়।
কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ কী? স্বাধীনতা কী? দেখার বড় কৌতূহল হলো। তাই ১৬ ডিসেম্বর আমিও উত্সবের নগরীতে পথে নেমেছিলাম। রাস্তায় বের হয়ে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। ‘শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের শরীর জুড়ে পতাকার রং। দালান-কোঠায় উড়ছে পতাকা। পোশাকে পতাকা। গালে পতাকা। কপালে পতাকা। ডানায় পতাকা। হাতে উত্তোলিত পতাকা। গাড়ির সামনের বনেট পতাকায় ঢাকা। কিন্তু বিভ্রান্তিতে ভুগতে হলো গাড়ির ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডগুলোতে মন্ত্রীদের মতো পতাকা লাগিয়ে চলছে অনেকে। কে যান? মন্ত্রী না মন্ত্রীতুল্য কেউ? সেটা কল্পনা করাও কঠিন ছিল। এবারের বিজয় দিবসে ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’ ছিলাম। মন্ত্রী আর পাবলিকে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সবার গাড়িতে ছিল জাতীয় পতাকা।
যারা তাদের গাড়িতে পতাকা তুলেছিলেন, বা এখনও আছে, তারা পতাকা আইন কাকে বলে, জানেন না। কিংবা জেনেও উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু তাদেরও জানানো দরকার আছে যে, কে গাড়িতে পতাকা তুলতে পারেন, কে পারে না। পতাকা স্বাধীনতার প্রতীক। তার যথেচ্ছ ব্যবহার সঠিক নয়। অন্য সময় দেখেছি, পতাকার যথেচ্ছ ব্যবহারে পুলিশ বাধা দিয়েছে। এবার তেমন ঘটনা চোখে পড়েনি।
তবু নাগরিকদের এই পতাকাপ্রীতি অনেকখানি আশার সঞ্চার করেছে। স্বাধীনতার প্রতি তাদের ভালোবাসা আমাদের আন্দোলিত করেছে। শিশুদের হাতে হাতে ছোট্ট কাঠির মধ্যে কাগজের পতাকা হৃদয় আন্দোলিত করেছে। এরাও ভবিষ্যতে এই পতাকার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে শরিক হবে। অক্ষুণ্ন রাখবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কিন্তু এর সঙ্গে যা দরকার তা হলো, ভবিষ্যত্ বংশধরদের জাতি হিসেবে গৌরব বোধ করার শিক্ষা। আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, ইতিহাস তাদের ভালো করে জানান দেয়ার ব্যবস্থা। শিক্ষার ভেতরে তা প্রোথিত করে দেয়ার চেষ্টা। এ অভাব দূর করার ব্যবস্থা কে নেবে?
মধ্যরাতে র্যাবের গাড়ি
শীতের মধ্যরাতে বারান্দায় দাঁড়াই। সবকিছু নিঝুম। বাতাস নেই। গাছের পাতাও নড়ে না। একটি কুকুর ধীরপায়ে হেঁটে যায়। একটি রিকশা যাত্রীবিহীন। দ্রুত চলে একটি গাড়ি। আর সব সুনসান। কাকের ডাকও থেমে গেছে অনেক আগে। তারপর ধীরগতিতে সন্তর্পণে এগিয়ে আসে র্যাবের (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন) সামনে দু’ জন, পেছনে চারজন র্যাব সদস্য। বুকের রক্ত ছলাত্ করে ওঠে।
র্যাব কি তেমনই আছে। র্যাব গঠনের পর একদিন ক্ষৌরকারের দোকানে অপেক্ষায় আছি। চুল কাটাচ্ছিল একটি ছোট্ট শিশু। ক্ষৌরকার তাকে বারবার বলছিল, তোমাকে সালমান খান ছাঁট দিয়ে দেই? শিশুটি কিছুতেই রাজি নয়। তার এক দাবি তাকে র্যাবের মতো ছাঁট দিয়ে দিতে হবে। ক্ষৌরকার বলছিল, র্যাব তো কালো কাপড় দিয়ে মাথা বেঁধে রাখে। তার ছাঁট তো দেখা যায় না। শিশুটি বলল, কিন্তু আমি দেখেছি। আমাদের স্কুলের সামনে একদিন এক র্যাব ওই কালো কাপড় খুলে আবার বেঁধেছিল। আমি দেখে ফেলেছি। সে ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে দেখাল, পেছন দিকটা হবে এমন। চিপস দেখিয়ে বলল, এখানে চুল হবে ছোট, সামনেও ছোট। ক্ষৌরকার তার বর্ণনামত র্যাব ছাঁট দিতে শুরু করল।
অর্থাত্ শুরুতে সাধারণ মানুষের কাছে তো বটেই, শিশুদের কাছেও র্যাব হয়ে উঠেছিল আদর্শ বাহিনী-অপরাধীদের যম। কিন্তু এখন অপরাধ দমন তো পরের কথা কোনো কোনো র্যাব সদস্য এখন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে এই বাহিনীর সুনাম আর আগের মতো নেই। র্যাব এখন এক আতঙ্কের নাম।
সরকার যে পাইকারি হারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে ক্রসফায়ারের নামে, তাতে ব্যবহার করা হচ্ছে র্যাবকে। ফলে এখন র্যাব-এর কথা ভাবলেই ক্রসফায়ারের আতঙ্কে ভীত হয়ে উঠতে হয়। মধ্যরাতে সন্তর্পণে র্যাবের গাড়ি চলতে দেখে কোনো অপরাধী ধরা পড়ছে মনে হলো না। মনে হলো, আজ রাতে কোন মায়ের কোল খালি করে কাকে যে তুলে নিয়ে যাবে। কাল হয়তো তার লাশ পাওয়া যাবে আশপাশে কোথাও। সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা দেয়া হবে ক্রসফায়ারে মারা গেছে অমুক সন্ত্রাসী।
আমরা নাগরিকরা পত্রিকা পড়ে তাকে সন্ত্রাসী বলে জানব। কিন্তু ভাগ্যাহত ওই ব্যক্তি প্রকৃতই সন্ত্রাসী ছিল, নাকি সজ্জন ছিল সেটা কোনো দিন জানা হবে না। সভ্য সমাজে বিচারবহির্ভূত এই হত্যাকাণ্ড কি চলতেই থাকবে?
শীতের মধ্যরাতে বারান্দায় দাঁড়াই। সবকিছু নিঝুম। বাতাস নেই। গাছের পাতাও নড়ে না। একটি কুকুর ধীরপায়ে হেঁটে যায়। একটি রিকশা যাত্রীবিহীন। দ্রুত চলে একটি গাড়ি। আর সব সুনসান। কাকের ডাকও থেমে গেছে অনেক আগে। তারপর ধীরগতিতে সন্তর্পণে এগিয়ে আসে র্যাবের (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন) সামনে দু’ জন, পেছনে চারজন র্যাব সদস্য। বুকের রক্ত ছলাত্ করে ওঠে।
র্যাব কি তেমনই আছে। র্যাব গঠনের পর একদিন ক্ষৌরকারের দোকানে অপেক্ষায় আছি। চুল কাটাচ্ছিল একটি ছোট্ট শিশু। ক্ষৌরকার তাকে বারবার বলছিল, তোমাকে সালমান খান ছাঁট দিয়ে দেই? শিশুটি কিছুতেই রাজি নয়। তার এক দাবি তাকে র্যাবের মতো ছাঁট দিয়ে দিতে হবে। ক্ষৌরকার বলছিল, র্যাব তো কালো কাপড় দিয়ে মাথা বেঁধে রাখে। তার ছাঁট তো দেখা যায় না। শিশুটি বলল, কিন্তু আমি দেখেছি। আমাদের স্কুলের সামনে একদিন এক র্যাব ওই কালো কাপড় খুলে আবার বেঁধেছিল। আমি দেখে ফেলেছি। সে ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে দেখাল, পেছন দিকটা হবে এমন। চিপস দেখিয়ে বলল, এখানে চুল হবে ছোট, সামনেও ছোট। ক্ষৌরকার তার বর্ণনামত র্যাব ছাঁট দিতে শুরু করল।
অর্থাত্ শুরুতে সাধারণ মানুষের কাছে তো বটেই, শিশুদের কাছেও র্যাব হয়ে উঠেছিল আদর্শ বাহিনী-অপরাধীদের যম। কিন্তু এখন অপরাধ দমন তো পরের কথা কোনো কোনো র্যাব সদস্য এখন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে এই বাহিনীর সুনাম আর আগের মতো নেই। র্যাব এখন এক আতঙ্কের নাম।
সরকার যে পাইকারি হারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে ক্রসফায়ারের নামে, তাতে ব্যবহার করা হচ্ছে র্যাবকে। ফলে এখন র্যাব-এর কথা ভাবলেই ক্রসফায়ারের আতঙ্কে ভীত হয়ে উঠতে হয়। মধ্যরাতে সন্তর্পণে র্যাবের গাড়ি চলতে দেখে কোনো অপরাধী ধরা পড়ছে মনে হলো না। মনে হলো, আজ রাতে কোন মায়ের কোল খালি করে কাকে যে তুলে নিয়ে যাবে। কাল হয়তো তার লাশ পাওয়া যাবে আশপাশে কোথাও। সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা দেয়া হবে ক্রসফায়ারে মারা গেছে অমুক সন্ত্রাসী।
আমরা নাগরিকরা পত্রিকা পড়ে তাকে সন্ত্রাসী বলে জানব। কিন্তু ভাগ্যাহত ওই ব্যক্তি প্রকৃতই সন্ত্রাসী ছিল, নাকি সজ্জন ছিল সেটা কোনো দিন জানা হবে না। সভ্য সমাজে বিচারবহির্ভূত এই হত্যাকাণ্ড কি চলতেই থাকবে?
ফুটনোট
একটি দোয়েল ছানা কী কারণে উড়ে এসে আমাদের রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল। সে আর যায় না। আমার ছোট ছেলে দোয়েল ছানাটিকে ধরে নিয়ে এলো, ‘বলল, এর লেজের পালকগুলো তো নেই। আমি বললাম, উড়ে যখন এসেছে, তাহলে বারান্দায় ছেড়ে দাও দেয়ালের ওপর। উড়ে যেতে পারবে। আমার ছেলে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই পাখিটি উড়াল দেয়ার চেষ্টা করে ধপ করে নিচে পড়ে গেল। তারপর গুটিসুটি মেরে থাকল ছোট্ট একটা গাছের আড়ালে। আমার ভয় হলো, হয়তো কোনো কাক পাখিটিকে হত্যা করবে। আমি বাগান পর্যন্ত যেতে না যেতেই একটি দাঁড় ছোঁ মেরে পাখিটাকে নিয়ে গাছের ডালে বসে খেতে শুরু করে দিল। তাকে রক্ষা করা আমার আর হয়ে উঠল না।
একটি দোয়েল ছানা কী কারণে উড়ে এসে আমাদের রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল। সে আর যায় না। আমার ছোট ছেলে দোয়েল ছানাটিকে ধরে নিয়ে এলো, ‘বলল, এর লেজের পালকগুলো তো নেই। আমি বললাম, উড়ে যখন এসেছে, তাহলে বারান্দায় ছেড়ে দাও দেয়ালের ওপর। উড়ে যেতে পারবে। আমার ছেলে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই পাখিটি উড়াল দেয়ার চেষ্টা করে ধপ করে নিচে পড়ে গেল। তারপর গুটিসুটি মেরে থাকল ছোট্ট একটা গাছের আড়ালে। আমার ভয় হলো, হয়তো কোনো কাক পাখিটিকে হত্যা করবে। আমি বাগান পর্যন্ত যেতে না যেতেই একটি দাঁড় ছোঁ মেরে পাখিটাকে নিয়ে গাছের ডালে বসে খেতে শুরু করে দিল। তাকে রক্ষা করা আমার আর হয়ে উঠল না।
No comments