অলীক শিহরণ by কে জি মোস্তফা
স্বপ্নে আমি পৃথিবীর সর্বত্রই বিচরণ করি। কিন্তু জন্মস্থান বা ছেলেবেলার কথা প্রায় ভুলেই গেছি। জীবনের চতুরঙ্গে হারিয়ে যাওয়া এক সবুজ প্রান্তর, যার সঙ্গে একাত্মতা খসে গেছে কবে। আজ আমি নির্দিষ্ট স্থান ও কালের মধ্যে যেন এক নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস।
জানুয়ারি ২০০৫। হঠাত্ একদিন মোবাইল বেজে উঠল। কে? জিজ্ঞেস করতেই বলল, ‘বাবলু’ বলছি। কোন বাবলু, কোথাকার বাবলু, ঠাহর করতে পারছি না। আমার আমতা-আমতা ভাব বুঝতে পেরে রসালো একটা গালি দিয়ে বলল, নোয়াখালী জেলাস্কুলে আমি তোর সহপাঠী ছিলাম। নাম আবদুর রহমান বাবলু। হঠাত্ কেমন রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। এমন অসামান্য বন্ধুবাত্সল্য দেখাই যায় না।
অর্ধশতাব্দী কিংবা তারও আগের কথা। স্মৃতি যেন অতীতের ফেলে রাখা আয়না। মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলা যায় না। মনের আয়নায় ভেসে উঠল কচি একখানি মুখ। সাল ১৯৫০। অজপাড়াগাঁ থেকে এসে ভর্তি হলাম নোয়াখালী জিলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে। শহুরে পরিবেশে আমার চেহারা ও পরিচ্ছদে আপাদমস্তক গ্রাম্যতা। জিলা স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্রই সরকারি কর্মকর্তাদের ছেলে। পরিপাটি বেশভূষা। আমাদের প্রতি কিছুটা উন্নাসিকতা। আবদুর রহমান বাবলু ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে প্রথম হয়ে উঠেছে। তার গরিমা আরও বেশি। সে জেলা জজের ছেলে। অন্য একজন ডি-এম সাহেবের ছেলে রফিকুল আলম, আরেকজন ডি-এসপির ছেলে আবদুল হান্নান।
যাই হোক, নতুন-পুরাতন মিলে ক্লাসে প্রায় ৩০/৩২ জন ছাত্র। নতুন ক্লাসে নতুন বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি অতিক্রান্ত, কিন্তু পড়াশোনায় কেউই মনোযোগী হচ্ছে না। হোমওয়ার্ক প্রায় শূন্য। আমি গরিব ঘরের সন্তান, তখনও নতুন বই কেনা হয়নি। ইতিহাসের স্যার শ্রদ্ধেয় শামসুল হক রেগেমেগে বললেন, আগামীকাল যারা পড়া পারবে না তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে। আমার জন্য এটা খুবই লজ্জার বিষয়, আমি মহসীন বৃত্তিপরীক্ষা দিয়েছি, মেধাবী বলে সুনাম রয়েছে। থাকতাম স্কুল থেকে প্রায় ৫ মাইল দূরবর্তী এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেদিন স্কুল ছুটির পর পথিমধ্যে এক সহপাঠীর বাড়িতে বসে তার বই থেকে পুরো চ্যাপ্টার লিখে ফেললাম। রাত জেগে মুখস্ত করলাম। পরদিন ক্লাসে আমি ছাড়া আর কেউই সঠিক পড়া বলতে পারেনি। স্যার খুশি হলেন। ফার্স্ট বয় বাবলুকে এক নম্বর ডেস্ক থেকে সরিয়ে সেখানে আমাকে বসালেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, স্যার ক্লাস থেকে চলে যেতেই বাবলু আমার খাতাপত্র ছুঁড়ে দিয়ে তার সিট দখল করল। অগত্যা আমি পেছনে গিয়েই বসলাম। পরম শত্রু প্রাণের বান্ধব এই সেই বাবলু। এরই মধ্যে এক দিন পিটি করার সময় হেডমাস্টার আবদুর রহিম স্যার প্রকাশ্যে খুশির খবর জানালেন, আমি মহসীন বৃত্তি লাভ করেছি। সেদিন থেকেই স্কুলের শিক্ষকদের এবং ওপর ও নিচের ক্লাসের সব ছাত্রের সুনজরে পড়ে গেলাম। এরই মধ্যে এসে গেল ত্রৈমাসিক পরীক্ষা। সে পরীক্ষার ফলাফলে আমার অবস্থান দ্বিতীয়, বাবলুর তৃতীয় স্থান এবং দশম শ্রেণী পর্যন্ত বরাবরই আমি দ্বিতীয় স্থান পেতাম। ওদের অবস্থান এদিক-সেদিক হয়ে যেত। যাই হোক ছোট্ট এক মনকষাকষির ভেতর দিয়ে যদিও পরিচয়-পরবর্তীকালে আমি আর বাবলু ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম।
নদীভাঙনের করালগ্রাসে বিলীন জিলা স্কুল তখন সোনাপুর কেরামতিয়া মাদ্রাসার একটি অংশে আশ্রয় পায়। উত্তাল মেঘনার অতলগর্ভে কবেই তলিয়ে গেছে নোয়াখালীর শান্তসুন্দর মনোরম জেলা শহরটি। প্রাচীন কোর্টবিল্ডিং নাকি পর্তুগিজ আমলে নির্মিত হয়েছিল। ভাঙন তখনও অব্যাহত। আমাদের স্কাউটলিডার ছিলেন (তথাকথিত আগরতলা মামলার আসামি শহীদ সার্জেন্ট) কাজী জহুরুল হক। তার নেতৃত্বে বেড়িবাঁধ নির্মাণে আমরা প্রায়ই মাটির বস্তা ফেলার কাজে অংশ নিতাম। আরেকজন স্কাউট লিডার ছিলেন সাবেক পিআইও বিশিষ্ট কথাশিল্পী আবদুর রহিম। একবার তাদের নেতৃত্বে পাহাড়তলীর মাধবকুণ্ডে শিক্ষা সফরে গিয়েছিলাম। পাহাড়ের শীর্ষদেশে ওঠার সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আজও ভুলিনি। যাই হোক, আমি আর বাবলু উত্তাল নদীর তীরঘেঁষে প্রায়ই হাঁটতে যেতাম। আদিগন্ত এক ঢেউয়ের রাজ্য। সুমেরু সমুদ্র থেকে যেন বঙ্গোপসাগরের ডাক বাজতো হাওয়ায় হাওয়ায়। নারকেল ঝিরিঝিরি পাতার সবুজের দারুচিনি দ্বীপের পাখিরা উড়ে আসত। আরও দূর সাগরের মৌসুমি বাতাসে ভেসে আসত গাঢ় আহ্বান—‘ডানামেলো, ডানামেলো সমুদ্র-যাযাবর’। ঝড়ের নেশায় কিন্তু পাখিদের ফেরার ইচ্ছে নেই। কালস্রোতে ভেসে গেছে কত কাল। সুদীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর পর আবদুর রহমান বাবলুর হঠাত্ আবির্ভাব! সে যেন কবে ডাক্তারি পাস করে লন্ডন চলে যায়। সেখানেই সপরিবারে স্থায়ী বসবাস। তার পৃথিবী এখন সাতরঙে ঝলমল। মাঝে মধ্যে দেশে বেড়াতে আসে। মোবাইলে কথা হলো। পরদিন প্রেসক্লাবে একসঙ্গে লাঞ্চ করব। দুজনেই আমরা এখন দাদা-নানা। পরস্পরকে আগের মতো চিনতে পারব কী! সময়ের ক্যান্সার তো খেয়ে ফেলে সব। আচমকা অতীতের বাঁকে লাগল একটা ঝাঁকুনি। সবুজ চত্বরে কয়েকটা গাছ, পুরনো একটা বেঞ্চ। চেনা সহচর বাবলু আর আমি কী সুন্দর বসে আছি পাশাপাশি। অনাদিকালের হৃদয় উত্স থেকে আজ সহসা দুজনে ভেসে এলাম যুগল আনন্দস্রোতে!
অর্ধশতাব্দী কিংবা তারও আগের কথা। স্মৃতি যেন অতীতের ফেলে রাখা আয়না। মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলা যায় না। মনের আয়নায় ভেসে উঠল কচি একখানি মুখ। সাল ১৯৫০। অজপাড়াগাঁ থেকে এসে ভর্তি হলাম নোয়াখালী জিলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে। শহুরে পরিবেশে আমার চেহারা ও পরিচ্ছদে আপাদমস্তক গ্রাম্যতা। জিলা স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্রই সরকারি কর্মকর্তাদের ছেলে। পরিপাটি বেশভূষা। আমাদের প্রতি কিছুটা উন্নাসিকতা। আবদুর রহমান বাবলু ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে প্রথম হয়ে উঠেছে। তার গরিমা আরও বেশি। সে জেলা জজের ছেলে। অন্য একজন ডি-এম সাহেবের ছেলে রফিকুল আলম, আরেকজন ডি-এসপির ছেলে আবদুল হান্নান।
যাই হোক, নতুন-পুরাতন মিলে ক্লাসে প্রায় ৩০/৩২ জন ছাত্র। নতুন ক্লাসে নতুন বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি অতিক্রান্ত, কিন্তু পড়াশোনায় কেউই মনোযোগী হচ্ছে না। হোমওয়ার্ক প্রায় শূন্য। আমি গরিব ঘরের সন্তান, তখনও নতুন বই কেনা হয়নি। ইতিহাসের স্যার শ্রদ্ধেয় শামসুল হক রেগেমেগে বললেন, আগামীকাল যারা পড়া পারবে না তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে। আমার জন্য এটা খুবই লজ্জার বিষয়, আমি মহসীন বৃত্তিপরীক্ষা দিয়েছি, মেধাবী বলে সুনাম রয়েছে। থাকতাম স্কুল থেকে প্রায় ৫ মাইল দূরবর্তী এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেদিন স্কুল ছুটির পর পথিমধ্যে এক সহপাঠীর বাড়িতে বসে তার বই থেকে পুরো চ্যাপ্টার লিখে ফেললাম। রাত জেগে মুখস্ত করলাম। পরদিন ক্লাসে আমি ছাড়া আর কেউই সঠিক পড়া বলতে পারেনি। স্যার খুশি হলেন। ফার্স্ট বয় বাবলুকে এক নম্বর ডেস্ক থেকে সরিয়ে সেখানে আমাকে বসালেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, স্যার ক্লাস থেকে চলে যেতেই বাবলু আমার খাতাপত্র ছুঁড়ে দিয়ে তার সিট দখল করল। অগত্যা আমি পেছনে গিয়েই বসলাম। পরম শত্রু প্রাণের বান্ধব এই সেই বাবলু। এরই মধ্যে এক দিন পিটি করার সময় হেডমাস্টার আবদুর রহিম স্যার প্রকাশ্যে খুশির খবর জানালেন, আমি মহসীন বৃত্তি লাভ করেছি। সেদিন থেকেই স্কুলের শিক্ষকদের এবং ওপর ও নিচের ক্লাসের সব ছাত্রের সুনজরে পড়ে গেলাম। এরই মধ্যে এসে গেল ত্রৈমাসিক পরীক্ষা। সে পরীক্ষার ফলাফলে আমার অবস্থান দ্বিতীয়, বাবলুর তৃতীয় স্থান এবং দশম শ্রেণী পর্যন্ত বরাবরই আমি দ্বিতীয় স্থান পেতাম। ওদের অবস্থান এদিক-সেদিক হয়ে যেত। যাই হোক ছোট্ট এক মনকষাকষির ভেতর দিয়ে যদিও পরিচয়-পরবর্তীকালে আমি আর বাবলু ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম।
নদীভাঙনের করালগ্রাসে বিলীন জিলা স্কুল তখন সোনাপুর কেরামতিয়া মাদ্রাসার একটি অংশে আশ্রয় পায়। উত্তাল মেঘনার অতলগর্ভে কবেই তলিয়ে গেছে নোয়াখালীর শান্তসুন্দর মনোরম জেলা শহরটি। প্রাচীন কোর্টবিল্ডিং নাকি পর্তুগিজ আমলে নির্মিত হয়েছিল। ভাঙন তখনও অব্যাহত। আমাদের স্কাউটলিডার ছিলেন (তথাকথিত আগরতলা মামলার আসামি শহীদ সার্জেন্ট) কাজী জহুরুল হক। তার নেতৃত্বে বেড়িবাঁধ নির্মাণে আমরা প্রায়ই মাটির বস্তা ফেলার কাজে অংশ নিতাম। আরেকজন স্কাউট লিডার ছিলেন সাবেক পিআইও বিশিষ্ট কথাশিল্পী আবদুর রহিম। একবার তাদের নেতৃত্বে পাহাড়তলীর মাধবকুণ্ডে শিক্ষা সফরে গিয়েছিলাম। পাহাড়ের শীর্ষদেশে ওঠার সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আজও ভুলিনি। যাই হোক, আমি আর বাবলু উত্তাল নদীর তীরঘেঁষে প্রায়ই হাঁটতে যেতাম। আদিগন্ত এক ঢেউয়ের রাজ্য। সুমেরু সমুদ্র থেকে যেন বঙ্গোপসাগরের ডাক বাজতো হাওয়ায় হাওয়ায়। নারকেল ঝিরিঝিরি পাতার সবুজের দারুচিনি দ্বীপের পাখিরা উড়ে আসত। আরও দূর সাগরের মৌসুমি বাতাসে ভেসে আসত গাঢ় আহ্বান—‘ডানামেলো, ডানামেলো সমুদ্র-যাযাবর’। ঝড়ের নেশায় কিন্তু পাখিদের ফেরার ইচ্ছে নেই। কালস্রোতে ভেসে গেছে কত কাল। সুদীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর পর আবদুর রহমান বাবলুর হঠাত্ আবির্ভাব! সে যেন কবে ডাক্তারি পাস করে লন্ডন চলে যায়। সেখানেই সপরিবারে স্থায়ী বসবাস। তার পৃথিবী এখন সাতরঙে ঝলমল। মাঝে মধ্যে দেশে বেড়াতে আসে। মোবাইলে কথা হলো। পরদিন প্রেসক্লাবে একসঙ্গে লাঞ্চ করব। দুজনেই আমরা এখন দাদা-নানা। পরস্পরকে আগের মতো চিনতে পারব কী! সময়ের ক্যান্সার তো খেয়ে ফেলে সব। আচমকা অতীতের বাঁকে লাগল একটা ঝাঁকুনি। সবুজ চত্বরে কয়েকটা গাছ, পুরনো একটা বেঞ্চ। চেনা সহচর বাবলু আর আমি কী সুন্দর বসে আছি পাশাপাশি। অনাদিকালের হৃদয় উত্স থেকে আজ সহসা দুজনে ভেসে এলাম যুগল আনন্দস্রোতে!
No comments