চরাচর-এমন দিন আর যেন না আসে by মো. জাহাঙ্গীর হোসেন

শিশুটি মায়ের কোলে পরম নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। আর মায়ের বাকি দুনিয়ার প্রতি নেই কোনো আগ্রহ। কেননা বিশ্বের সব কিছু তিনি আগলে রেখেছেন তাঁর বুকে। এমন সময় আচমকা এক তীব্র তাপে গায়ের চামড়া জ্বলতে শুরু করল। চামড়া পুড়ে লাল মাংসখণ্ডে পরিণত হলো তাঁর বুকের মানিক। নিজের দিকে নজর নেই, সন্তানকে বুকে চেপে বের হলেন রাস্তায়।


রাস্তায় বের হয়ে স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন_মরীচিকার মতো ঢেউ খেলানো এক তরঙ্গে বালু দিয়ে গড়া মূর্তির মতো পুরো শহর গুঁড়িয়ে মিশে গেল মাটিতে। জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হলো মা ও সন্তানের। এমন করে তাৎক্ষণিকভাবে মারা গেল ৬৬ হাজার লোক। পরে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল এক লাখ ৪০ হাজারে। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ডটা এমন করেই ঘটেছিল জাপানের হিরোশিমা শহরে। ৫ আগস্ট, ১৯৪৫ সালে 'মেজর জেমস অবি হপকিং' স্বাক্ষরিত নির্দেশনার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত হয় হিরোশিমা মিশন। এতে মোট সাতটি বিমান অংশ নেয়। কর্নেল পল ওয়াটারফিল্ড টিবেটস্ সেই পাইলট, যিনি 'লিটল বয়' নামক ইউরেনিয়াম বোমা 'এনালগ গে' নামক বিমানে করে স্থানীয় সময় রাত ২টা ৩০ মিনিটে তিনিয়ানর দ্বীপ থেকে যাত্রা করে এক হাজার ৭০০ মাইল পাড়ি দিয়ে হিরোশিমার আকাশে বয়ে নিয়ে যান। হিরোশিমার স্থানীয় সময় ৭টায় পর পর তিনবার সতর্ক সাইরেন বেজে ওঠে। আকাশে তখন চক্কর দিচ্ছিল কয়েকটি যু্দ্ধবিমান। কিছুক্ষণ পর আরো একটি বিমান এসে যুক্ত হলো এই বহরে। কিছুক্ষণ পর বিমানগুলো দূরে সরে যায়। ৭টা ৩০ মিনিটে বিপদমুক্তির সাইরেন বেজে উঠলে স্বস্তি পায় হিরোশিমাবাসী। ৭টা ৩০ মিনিটে ক্যাপ্টেন পর্সন্স কর্তৃক লিটল বয়ের গায়ে লাল প্লাগ সংযোজনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় চূড়ান্ত প্রস্তুতি। ৮টায় আবার ফিরে আসে তিনটি বিমান। আর ৮টা ১৫ মিনিটে হিরোশিমার আকাশে, মাটি থেকে প্রায় ছয় মাইল (৩১ হাজার ৬০০ ফুট) ওপর থেকে ২৬ বছর বয়সী মেজর ফেরেবি চূড়ান্ত নিক্ষেপের কাজটি সম্পন্ন করেন। নিক্ষেপের ৪৩ সেকেন্ড পর এক হাজার ৮৯০ ফুট ওপরে বিস্ফোরিত হলো লিটল বয়। শুধু লক্ষ মানুষের মৃত্যুই হলো না, মৃত্যু হলো মানবতার। বিশ্ব নির্বাক হয়ে দেখল মার্কিন ক্ষমতার চরম, নিকৃষ্টতম অপব্যবহার। ঘটনা এখানেই থেমে থাকল না, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের নির্দেশে এর মাত্র তিন দিন পর ৯ আগস্ট 'ফ্যাটম্যান' নামের আরেকটি বোমা নিক্ষেপ করা হয় জাপানের নাগাসাকি শহরে। এর নেতৃত্বে ছিলেন মার্কিন মেজর চার্লস সুইনি। নাগাসাকিতে তাৎক্ষণিকভাবে মারা যায় অন্তত ৭৪ হাজার অসহায় মানুষ। পরে এই সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ৩৫ হাজারে। নাগাসাকি আক্রমণের ছয় দিন পর ১৫ আগস্ট মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে জাপান। সফল হয় ম্যানহাটন প্রজেক্ট, যেখানে বীজ বোনা হয়েছিল অ্যাটম বোমা তৈরির। ম্যানহাটন প্রজেক্টে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে এক লাখ ৭৫ হাজার মানুষের পরিশ্রমে তৈরি হয়েছিল চারটি পারমাণবিক বোমা। যার মধ্যে ট্রিনিটি নামের প্রথম বোমাটি পরীক্ষামূলকভাবে নিক্ষেপ করা হয় নিউ মেঙ্েিকার আলামোগার্ডোর কাছে। আর লিটল বয় ও ফ্যাটম্যান নিক্ষেপ করা হয় যথাক্রমে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে। শেষ বোমাটি রেখে দেওয়া হয়েছিল আগস্টের শেষের দিকে জাপানের অন্য কোনো শহরে নিক্ষেপের জন্য। কিন্তু তার আগেই জাপান আত্মসমর্পণ করে আর সমাপ্তি হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। গতকাল সেই ভয়াবহ ৬ আগস্ট, হিরোশিমা দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হলো। মানবসভ্যতায় এমন দিবস আর যেন না আসে।
মো. জাহাঙ্গীর হোসেন

No comments

Powered by Blogger.