মিয়ানমার-এশিয়ায় নতুন খেলোয়াড় by বার্টিল লিন্টনার
১৩ জানুয়ারি ২০০ রাজবন্দীকে মুক্তি দেওয়ার পরপরই ওয়াশিংটন জানাল, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূত পাঠাতে প্রস্তুত। ১৯৮৮ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভে গুলি করে হাজারের বেশি মানুষ হত্যা করে। দুই বছর পরের নির্বাচনে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির বিপুল বিজয় বাতিল করে দেয়।
তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের কঠোর সমালোচক। হালে তারা দেশটির সামরিক শাসক এবং এর বণিককুলের ওপর বাণিজ্যিক ও আর্থিক অবরোধ জারি করে।
গত ডিসেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন মিয়ানমার সফর করেন। এটা ছিল গত ৫০ বছরের মধ্যে কোনো প্রথম সারির মার্কিন কর্মকর্তার মিয়ানমার সফর। হিলারি তাঁর ভাষায় সাবেক জেনারেল প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সরকারের ‘গণতান্ত্রিক সংস্কারের’ প্রশংসাও করেন। গণতন্ত্রপন্থী নেতা অং সান সু চির সঙ্গে দেখা করে তিনি বলেন, গণতন্ত্রের পথে মিয়ানমারের যাত্রা উৎসাহব্যঞ্জক।
কিন্তু ধুলো থিতিয়ে এলে বোঝা যাচ্ছে, মিয়ানমারের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার যুক্তরাষ্ট্রের উৎসাহের আসল বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্র এশিয়াকে ঘিরে নতুন এক সামরিক নীতি নিয়ে মনোযোগী হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য সেই রক্ত ঝরানো অভ্যুত্থানের মাস খানেক পর মিয়ানমারে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্টন লেভিন ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছিলেন, ‘যেহেতু মিয়ানমারে আমেরিকার সেনাঘাঁটি নেই এবং দেশটির কৌশলগত সামরিক গুরুত্বও সামান্য, সেহেতু এর ব্যাপারে আমেরিকা নীতিকথা শোনাতে কার্পণ্য করছে না।’ তিনিই ছিলেন মিয়ানমারে শেষ মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
পরের সময়গুলোতে মিয়ানমার চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলে। মিয়ানমারের কাছের প্রতিবেশী ভারত চীনের পরিকল্পনামাফিক ভারত সাগরমুখী গ্যাস ও পাইপলাইন এবং এর নিরাপত্তার জন্য সম্ভাব্য নিরাপত্তা-ছাতার বিষয়ে উদাসীন থাকতে পারেনি। সম্ভবত আরও উদ্বেগের বিষয় ছিল উত্তর কোরিয়ার সুড়ঙ্গ নির্মাণ ও মিসাইল বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি। উত্তর কোরিয়ার সহায়তায় নির্মিত বার্মিজ মিসাইল এ অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।
অতএব, এটাই যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বদল এবং রাষ্ট্রদূত পাঠানোর স্বর্ণসময়। বিনিময়ে মিয়ানমার কী পেতে পারে, সেটা অনুমানের বিষয়। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহায়তার কথা বলা হয়েছে।
মিয়ানমার এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খেলতে আগ্রহী। প্রথম এটা দৃশ্যমান হয় গত বছরের ৩০ সেপ্টম্বর, যখন প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন চীনের সহায়তায় ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য একটি বাঁধ প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করে। চীন মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের মামলা করার হুমকি দিলেও কী ঘটে, তা দেখার কৌশল নিয়েছে। চীন সম্ভবত বাঁধ নিয়ে বিবাদে তেল-গ্যাসের পাইপলাইন প্রকল্প ভেস্তে যেতে দিতে চায় না। গত কয়েক বছরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মধ্যে চীনের ওপর অতি নির্ভরশীলতার প্রতি বিরূপতা দেখা গিয়েছে। এটাও ভোলার নয় যে, ষাটের দশকে চীন মিয়ানমারের বিদ্রোহী কমিউনিস্ট পার্টিকে বিপুল সহায়তা দিয়েছিল। হাল আমলে মিয়ানমারের স্থানীয় বাণিজ্যে চীনের প্রাধান্য, ক্রমবর্ধমানভাবে চীনাদের অভিবাসন এবং মিয়ানমারের জমির মালিক হওয়ার বিষয়টা ঘিরেও বার্মিজ জাতীয়তাবাদ চাঙা হচ্ছে। এসব ঘটনায় মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভক্তির ঝুঁকিও বাড়ছে।
এসব কারণেই থেইন সেইনের সঙ্গে হিলারির বৈঠকের প্রথম প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক। ‘সংস্কার চলতে থাকলে’, হিলারি আশা করেন যে, মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্কও বজায় থাকবে। পাশাপাশি তিনি বাদবাকি রাজবন্দীদের মুক্তি, সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা বন্ধ এবং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক বাতিলের ওপর জোর দেন। এত বছর ধরে ‘সিমেন্ট’ ও ‘সাধারণ মালপত্রের’ বিনিময়ে চাল দিয়ে মিয়ানমার উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু কার্যত উত্তর কোরিয়া মিয়ানমারে সমরাস্ত্র সরবরাহ করে আসছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ বাংকার নির্মাণ এবং স্কাড মিসাইল স্থাপনের কাজে উত্তর কোরীয় বিশেষজ্ঞরা সেখানে নিয়োজিত।
যা হোক, চীনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে এবং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বন্ধ করার বিনিময়ে মিয়ানমারের শাসকেরা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অর্থ-প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ সহযোগিতা চান। একই সঙ্গে মিয়ানমারের শাসককুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠদের ওপর জর্জ বুশ প্রশাসনের দেওয়া বাণিজ্যিক অবরোধের অপসারণও তাঁদের চাওয়া।
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ও শক্তিশালী সামরিক কর্তারা অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুখ মিষ্টি করার কৌশলও নিয়েছেন— ইউরোপীয় অবরোধটা যদিও অনেক নমনীয়। এ লক্ষ্যেই তাঁরা সম্প্রতি বন্দী মুক্তির পাশাপাশি ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ কিছুটা আলগা করেছেন। এই সরকার অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসিকেও এপ্রিলে অনুষ্ঠেয় উপনির্বাচনে অংশ নিতে রাজি করিয়েছে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, সামরিক শাসকেরা অং সান সু চিকে গণতন্ত্রের প্রতিমার আসন থেকে সরাতে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থার অংশ করে নিতে বেশি আগ্রহী।
তবে মিয়ানমারের পক্ষে চীনের দিকে একেবারে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়ানো কঠিন হবে। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তো অনেক দূরের দেশ। বর্তমান শাসনব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি টিকে থাকা কিংবা দৈনন্দিন ব্যাপার ও অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে পশ্চিমা শক্তির গুরুত্ব চীনের থেকে অনেক কম। চীন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিয়ানমারের এই নতুন মধুচন্দ্রিমার কোনো প্রতিক্রিয়া করেনি। তবে পরিস্থিতির বদল এটাই যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মিয়ানমার আর ‘সামান্য সামরিক গুরুত্বসম্পন্ন’ দেশ হয়ে নেই। আসলে উল্টোটাই ঘটছে। মিয়ানমার দিনকে দিন বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছে। মিয়ানমার হলো আরেকটি কেন্দ্র, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের স্বার্থ সংঘাতে লিপ্ত।
ভারতের আউটলুক থেকে নেওয়া, সংক্ষেপিত অনুবাদ।
বার্টিল লিন্টনার: থাইল্যান্ডভিত্তিক সুইডিশ সাংবাদিক।
No comments