প্রাথমিক শিক্ষা-পাঠদান ও পরীক্ষা বিষয়ক ভাবনা by মোঃ সাখাওয়াৎ হোসেন
সরকার শিশুর সামনে সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে, শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য অনুকূল পরিবেশ রচনা করবে। যাতে সে দেশ ও জাতির জন্য সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত পরীক্ষা পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা অথবা পাঠ্যপুস্তকের অনুশীলন, নোটবই বর্জন এবং মানবিক আচরণের জন্য শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের নিমিত্ত পৃথক নম্বরের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে,
যার দ্বারা শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীর দৈনন্দিন কাজকর্ম ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করে সঠিক মূল্যায়নে সমর্থ হবেন
স্বাধীনতা লাভের পরপরই দেশের চাহিদা ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের কথা বিবেচনা করে সরকার কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করে। কমিশন ১৯৭৪ সালে একটি রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুন্দর ও স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া হয়। রিপোর্টে বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো একজন দেশপ্রেমিক, নৈতিক গুণসম্পন্ন, অনুসন্ধিৎসু ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিক তৈরি করা।
শিশুরা যাতে প্রাথমিক স্তরে যথাযথ শিক্ষা অর্জন করতে পারে তার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষকদের সহযোগিতা। এ যোগ্যতা অর্জনে পরিবার ও সামাজিক পরিবেশের দায়িত্বও কম নয়। প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা প্রাথমিক স্তরের লক্ষ্য ও প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম বলেই ধরে নেওয়া যায়। তবে সততা, নৈতিকতা, দেশপ্রেম, মানবতাবোধ এই সম্পর্কিত জ্ঞান ও অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য আরও অধিক গুরুত্ব দেওয়ার অবকাশ রয়েছে বলে অভিজ্ঞজনরা মনে করেন।
একজন শিশু উলিল্গখিত গুণাবলি অর্জন করল কি-না অর্থাৎ প্রাথমিক স্তরের জন্য নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করল কি-না এর জন্য যে পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত আছে তা কতটা যথার্থ এ বিষয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন। একজন শিশু বাংলা ভাষা, ইংরেজি ভাষা, গণিত, সমাজ ও বিজ্ঞান, ধর্ম, শারীরিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা এবং সঙ্গীত বিষয়ে কতটা দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে তা এ প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে ধারণা পাওয়া সম্ভব হলেও সততা, ন্যায়বোধ, শৃঙ্খলাবোধ, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ, অধিকার, কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্বন্ধে কতটা সচেতন হয়েছে তা জানা একেবারে অসম্ভব বলেই প্রতীয়মান হয়। এক ব্যক্তির সব শিক্ষা ও দক্ষতাকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার জন্য সততা, দেশপ্রেম, মানবতাবোধ, ন্যায়বোধ, শৃঙ্খলাবোধ প্রভৃতি গুণাবলি অর্জন করা অত্যাবশ্যক। সুতরাং এসব গুণ অর্জনে শিক্ষকের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনিভাবে শিশুর আচরণ পর্যবেক্ষণ করাও অনস্বীকার্য। এ ক্ষেত্রে বছরের তিনটি পরীক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকের হাতে কিছু নম্বর রাখা প্রয়োজন। যা দিয়ে শিক্ষক একজন ছাত্রের এসব গুণ মূল্যায়ন করবেন।
বর্তমানে আমাদের সমাজে যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তা থেকে শিশুরাও রেহাই পায়নি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলেও প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অন্য যেসব বিদ্যালয় রয়েছে তাতে ভর্তি হতে গেলে শেখাপড়া না শিখে শিশুকে লেখাপড়া গলাধঃকরণ করতে হয় এবং ভর্তি হওয়ার পর তার পিঠে যে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাতে সে আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ফোরামে তার বক্তৃতায় ক্ষোভের সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন। একদিকে পাঠ্যপুস্তকের বোঝা, অন্যদিকে সহশিক্ষা কার্যক্রমের বাড়াবাড়ি এত অধিক থাকে যে, একটি শিশু নিজের মতো করে হাসতে, খেলতে, বিশ্রাম নিতে ও ভাবতে ফুরসত পায় না। যে শিশুটি মানুষ হওয়ার জন্য বিদ্যালয়ে যায় সমাজের এই নিদারুণ প্রতিযোগিতায় পড়ে সে মানুষ না হয়ে একটি যন্ত্রে পরিণত হয়।
ইদানীং শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি নিয়ে শিক্ষার সঙ্গে সংশিল্গষ্ট সবাই কমবেশি চিন্তিত। তাই এই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তুলে দেওয়া হয়েছে প্রাথমিক বৃত্তির জন্য পৃথক পরীক্ষা পদ্ধতি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, সরকারের এহ মহতী উদ্যোগ মাঠে মারা যেতে বসেছে। বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে বাস্তবে যা পাওয়া যায় তা হলো, এই শিশুরা তৃতীয় শ্রেণী থেকেই নোট ও গাইডবইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। এ কাজে সহযোগিতা করছেন কিছু শিক্ষক ও অতিমাত্রায় মুনাফালোভী প্রকাশনা সংস্থা। বিদ্যালয় পরিদর্শনে গেলে দেখা যায়, শিশুর কাছে বিভিন্ন নামের গাইডবই। গাইডগুলোর নামের সঙ্গে লেখা থাকে_ একের ভিতরে দুই, একের ভিতরে তিন, একের ভিতরে চার, একের ভিতরে পাঁচ, এমনকি একের ভিতরে সব। সরকার প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে পুস্তক সরবরাহ করলেও এর সুফল গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র অভিভাবক ভোগ করতে পারছেন না। তাকে তিন থেকে চারশ' টাকা খরচ করে শিশুকে গাইডবই কিনে দিতে হচ্ছে। এটি একদিকে যেমন অভিভাবকের জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ, অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মুখস্থ করে, জ্ঞান লাভ হচ্ছে না। ফলে অধিক নম্বর পেয়ে ভালো গ্রেডে পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে এমন দাবি করার সুযোগ কোথায়?
প্রাথমিক স্তরে নোটবইয়ের দৌরাত্ম্য সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয় পঞ্চম শ্রেণীতে। পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা থাকায় এবং এ পরীক্ষার মাধ্যমে বৃত্তি নির্ধারিত হওয়ায় বছরের শুরু থেকেই নির্ধারিত প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করার কাজে শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক ও পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা তো আছেই, এ ছাড়াও অধিক নম্বরের নিশ্চয়তার আশায় একাধিক মডেল টেস্ট নেওয়া হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা মূল পাঠ্যপুস্তক পড়ার আর সুযোগ পায় না। উদাহরণ সহকারে বলা যায়, পঞ্চম শ্রেণীর পরিবেশ পরিচিতি সমাজ বইয়ের পঞ্চদশ অধ্যায়ের শিরোনাম 'আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস'। শিক্ষার্থীরা যদি এই অধ্যায়টি সম্পূর্ণ পড়ে তাহলে তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান, বীরশ্রেষ্ঠদের অবদান ইত্যাদি জানতে পারবে এবং তাদের অবদানের কথা ভেবে শিক্ষার্থীর অন্তর অবশ্যই দেশপ্রেমে আপল্গুত হবে। তার মধ্যে জাগরিত হবে এক ধরনের বীরত্ববোধ। শিক্ষার্থী ভাববে পরিণত বয়সে সেও বঙ্গবন্ধুর মতো অথবা বীরশ্রেষ্ঠদের মতো মহান হবে। কিন্তু যদি তাকে প্রশ্ন দেওয়া হয়, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ কোন স্থানে দিয়েছিলেন অথবা মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ কতজন, তাদের নাম ও পদবি কী এবং শিক্ষার্থী যদি এর উত্তর মুখস্থ করে, তাহলে তার শুধু কিছু তথ্য জানাই সার হবে। প্রকৃত জ্ঞান অর্জন হবে না। শিশুরা তাদের বয়সের তুলনায় অনেক বেশি তথ্যসমৃৃদ্ধ হচ্ছে কিন্তু মানবিক গুণাবলি বিকাশের পথ পাচ্ছে না। শিশুকে ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এত অধিক তথ্যসমৃদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন বলে মনে হয় না। তাকে বাস্তব জ্ঞান অধিক পরিমাণে দেওয়া প্রয়োজন। যেমন_ বড়দের সঙ্গে কী আচরণ করবে, ছোটদের সঙ্গে কী আচরণ করবে, প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে তার কী কী কাজ করতে হবে, কীভাবে সে রাস্তা পার হবে কিংবা কীভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে এসব শেখানো।
শিক্ষার মূল লক্ষ্যই হলো শিশু আচরণে প্রত্যাশিত পরিবর্তন সাধন। শুধু তথ্যস্মৃতিতে ধারণ করাই নয়। শিশু শিখবে ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য। সরকার শিশুর সামনে সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে, শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য অনুকূল পরিবেশ রচনা করবে। যাতে সে দেশ ও জাতির জন্য সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত পরীক্ষা পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা অথবা পাঠ্যপুস্তকের অনুশীলন, নোটবই বর্জন এবং মানবিক আচরণের জন্য শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের নিমিত্ত পৃথক নম্বরের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে, যার দ্বারা শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীর দৈনন্দিন কাজকর্ম ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করে সঠিক মূল্যায়নে সমর্থ হবেন। শুধু নম্বরপ্রাপ্তির ওপর গুরুত্ব দিলে চলবে না, মানবিক গুণাবলির মূল্যায়ন থাকতে হবে। সহপাঠ শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে বিদ্যালয়ে চারু ও কারুকলা, খেলাধুলা বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার জন্য পৃথক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। পড়ার চাপ কমিয়ে মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীলতা বিকাশের দিকে অধিক দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। এ কথা বিস্মৃত হলে চলবে না যে, লেখা ও পড়ার চাইতে মানুষ হওয়ার গুরুত্ব সর্বাগ্রে। অধিক নম্বর পাওয়ার এই প্রতিযোগিতা রহিত করে যত শিগগির মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া যাবে তা দেশ ও জাতির জন্য ততই মঙ্গল।
মোঃ সাখাওয়াৎ হোসেন : উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ডুমুরিয়া, খুলনা
স্বাধীনতা লাভের পরপরই দেশের চাহিদা ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের কথা বিবেচনা করে সরকার কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করে। কমিশন ১৯৭৪ সালে একটি রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুন্দর ও স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া হয়। রিপোর্টে বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো একজন দেশপ্রেমিক, নৈতিক গুণসম্পন্ন, অনুসন্ধিৎসু ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিক তৈরি করা।
শিশুরা যাতে প্রাথমিক স্তরে যথাযথ শিক্ষা অর্জন করতে পারে তার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষকদের সহযোগিতা। এ যোগ্যতা অর্জনে পরিবার ও সামাজিক পরিবেশের দায়িত্বও কম নয়। প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা প্রাথমিক স্তরের লক্ষ্য ও প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম বলেই ধরে নেওয়া যায়। তবে সততা, নৈতিকতা, দেশপ্রেম, মানবতাবোধ এই সম্পর্কিত জ্ঞান ও অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য আরও অধিক গুরুত্ব দেওয়ার অবকাশ রয়েছে বলে অভিজ্ঞজনরা মনে করেন।
একজন শিশু উলিল্গখিত গুণাবলি অর্জন করল কি-না অর্থাৎ প্রাথমিক স্তরের জন্য নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করল কি-না এর জন্য যে পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত আছে তা কতটা যথার্থ এ বিষয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন। একজন শিশু বাংলা ভাষা, ইংরেজি ভাষা, গণিত, সমাজ ও বিজ্ঞান, ধর্ম, শারীরিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা এবং সঙ্গীত বিষয়ে কতটা দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে তা এ প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে ধারণা পাওয়া সম্ভব হলেও সততা, ন্যায়বোধ, শৃঙ্খলাবোধ, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ, অধিকার, কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্বন্ধে কতটা সচেতন হয়েছে তা জানা একেবারে অসম্ভব বলেই প্রতীয়মান হয়। এক ব্যক্তির সব শিক্ষা ও দক্ষতাকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার জন্য সততা, দেশপ্রেম, মানবতাবোধ, ন্যায়বোধ, শৃঙ্খলাবোধ প্রভৃতি গুণাবলি অর্জন করা অত্যাবশ্যক। সুতরাং এসব গুণ অর্জনে শিক্ষকের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনিভাবে শিশুর আচরণ পর্যবেক্ষণ করাও অনস্বীকার্য। এ ক্ষেত্রে বছরের তিনটি পরীক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকের হাতে কিছু নম্বর রাখা প্রয়োজন। যা দিয়ে শিক্ষক একজন ছাত্রের এসব গুণ মূল্যায়ন করবেন।
বর্তমানে আমাদের সমাজে যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তা থেকে শিশুরাও রেহাই পায়নি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলেও প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অন্য যেসব বিদ্যালয় রয়েছে তাতে ভর্তি হতে গেলে শেখাপড়া না শিখে শিশুকে লেখাপড়া গলাধঃকরণ করতে হয় এবং ভর্তি হওয়ার পর তার পিঠে যে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাতে সে আর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ফোরামে তার বক্তৃতায় ক্ষোভের সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন। একদিকে পাঠ্যপুস্তকের বোঝা, অন্যদিকে সহশিক্ষা কার্যক্রমের বাড়াবাড়ি এত অধিক থাকে যে, একটি শিশু নিজের মতো করে হাসতে, খেলতে, বিশ্রাম নিতে ও ভাবতে ফুরসত পায় না। যে শিশুটি মানুষ হওয়ার জন্য বিদ্যালয়ে যায় সমাজের এই নিদারুণ প্রতিযোগিতায় পড়ে সে মানুষ না হয়ে একটি যন্ত্রে পরিণত হয়।
ইদানীং শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি নিয়ে শিক্ষার সঙ্গে সংশিল্গষ্ট সবাই কমবেশি চিন্তিত। তাই এই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তুলে দেওয়া হয়েছে প্রাথমিক বৃত্তির জন্য পৃথক পরীক্ষা পদ্ধতি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, সরকারের এহ মহতী উদ্যোগ মাঠে মারা যেতে বসেছে। বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে বাস্তবে যা পাওয়া যায় তা হলো, এই শিশুরা তৃতীয় শ্রেণী থেকেই নোট ও গাইডবইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। এ কাজে সহযোগিতা করছেন কিছু শিক্ষক ও অতিমাত্রায় মুনাফালোভী প্রকাশনা সংস্থা। বিদ্যালয় পরিদর্শনে গেলে দেখা যায়, শিশুর কাছে বিভিন্ন নামের গাইডবই। গাইডগুলোর নামের সঙ্গে লেখা থাকে_ একের ভিতরে দুই, একের ভিতরে তিন, একের ভিতরে চার, একের ভিতরে পাঁচ, এমনকি একের ভিতরে সব। সরকার প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে পুস্তক সরবরাহ করলেও এর সুফল গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র অভিভাবক ভোগ করতে পারছেন না। তাকে তিন থেকে চারশ' টাকা খরচ করে শিশুকে গাইডবই কিনে দিতে হচ্ছে। এটি একদিকে যেমন অভিভাবকের জন্য আর্থিক ক্ষতির কারণ, অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মুখস্থ করে, জ্ঞান লাভ হচ্ছে না। ফলে অধিক নম্বর পেয়ে ভালো গ্রেডে পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে এমন দাবি করার সুযোগ কোথায়?
প্রাথমিক স্তরে নোটবইয়ের দৌরাত্ম্য সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয় পঞ্চম শ্রেণীতে। পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা থাকায় এবং এ পরীক্ষার মাধ্যমে বৃত্তি নির্ধারিত হওয়ায় বছরের শুরু থেকেই নির্ধারিত প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করার কাজে শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক ও পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা তো আছেই, এ ছাড়াও অধিক নম্বরের নিশ্চয়তার আশায় একাধিক মডেল টেস্ট নেওয়া হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা মূল পাঠ্যপুস্তক পড়ার আর সুযোগ পায় না। উদাহরণ সহকারে বলা যায়, পঞ্চম শ্রেণীর পরিবেশ পরিচিতি সমাজ বইয়ের পঞ্চদশ অধ্যায়ের শিরোনাম 'আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস'। শিক্ষার্থীরা যদি এই অধ্যায়টি সম্পূর্ণ পড়ে তাহলে তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান, বীরশ্রেষ্ঠদের অবদান ইত্যাদি জানতে পারবে এবং তাদের অবদানের কথা ভেবে শিক্ষার্থীর অন্তর অবশ্যই দেশপ্রেমে আপল্গুত হবে। তার মধ্যে জাগরিত হবে এক ধরনের বীরত্ববোধ। শিক্ষার্থী ভাববে পরিণত বয়সে সেও বঙ্গবন্ধুর মতো অথবা বীরশ্রেষ্ঠদের মতো মহান হবে। কিন্তু যদি তাকে প্রশ্ন দেওয়া হয়, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ কোন স্থানে দিয়েছিলেন অথবা মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ কতজন, তাদের নাম ও পদবি কী এবং শিক্ষার্থী যদি এর উত্তর মুখস্থ করে, তাহলে তার শুধু কিছু তথ্য জানাই সার হবে। প্রকৃত জ্ঞান অর্জন হবে না। শিশুরা তাদের বয়সের তুলনায় অনেক বেশি তথ্যসমৃৃদ্ধ হচ্ছে কিন্তু মানবিক গুণাবলি বিকাশের পথ পাচ্ছে না। শিশুকে ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এত অধিক তথ্যসমৃদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন বলে মনে হয় না। তাকে বাস্তব জ্ঞান অধিক পরিমাণে দেওয়া প্রয়োজন। যেমন_ বড়দের সঙ্গে কী আচরণ করবে, ছোটদের সঙ্গে কী আচরণ করবে, প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে তার কী কী কাজ করতে হবে, কীভাবে সে রাস্তা পার হবে কিংবা কীভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে এসব শেখানো।
শিক্ষার মূল লক্ষ্যই হলো শিশু আচরণে প্রত্যাশিত পরিবর্তন সাধন। শুধু তথ্যস্মৃতিতে ধারণ করাই নয়। শিশু শিখবে ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য। সরকার শিশুর সামনে সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে, শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য অনুকূল পরিবেশ রচনা করবে। যাতে সে দেশ ও জাতির জন্য সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত পরীক্ষা পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা অথবা পাঠ্যপুস্তকের অনুশীলন, নোটবই বর্জন এবং মানবিক আচরণের জন্য শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের নিমিত্ত পৃথক নম্বরের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে, যার দ্বারা শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীর দৈনন্দিন কাজকর্ম ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করে সঠিক মূল্যায়নে সমর্থ হবেন। শুধু নম্বরপ্রাপ্তির ওপর গুরুত্ব দিলে চলবে না, মানবিক গুণাবলির মূল্যায়ন থাকতে হবে। সহপাঠ শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে বিদ্যালয়ে চারু ও কারুকলা, খেলাধুলা বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার জন্য পৃথক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। পড়ার চাপ কমিয়ে মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীলতা বিকাশের দিকে অধিক দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। এ কথা বিস্মৃত হলে চলবে না যে, লেখা ও পড়ার চাইতে মানুষ হওয়ার গুরুত্ব সর্বাগ্রে। অধিক নম্বর পাওয়ার এই প্রতিযোগিতা রহিত করে যত শিগগির মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া যাবে তা দেশ ও জাতির জন্য ততই মঙ্গল।
মোঃ সাখাওয়াৎ হোসেন : উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ডুমুরিয়া, খুলনা
No comments