চারদিক-স্মৃতির আয়নায় আমার স্কুল
একটা স্কুলকে চেনা যায় তার ছাত্র ও শিক্ষকদের দেখে। ঠিক যেমন করে একজন মানুষকে চেনা যায় তার বন্ধুদের দেখে। ঢাকা থেকে দূরবর্তী নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার সান্দিকোনা হাইস্কুলে (বর্তমানে কলেজিয়েট স্কুল) যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের অনেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ পৃথিবীর বহু নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা এমনকি শিক্ষকতা করেছেন এবং করছেন।
এ স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অত্যন্ত উঁচুমানের মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছেন।
আমি এ স্কুলের অন্তত দুজন প্রাক্তন ছাত্রের নাম উল্লেখ করা এখানে জরুরি মনে করি। তাঁদের একজন পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো মুজিব রাহমান। আরেকজন জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেসকোর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বিকাশচন্দ্র সান্যাল।
মুজিব রাহমান সান্দিকোনা হাইস্কুল থেকে ১৯৭৬ সালে এসএসসি এবং পরে আনন্দমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তী পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসি বিষয়ে তিনি অনার্সসহ মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৯২ সালে বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানকার রচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে হার্ভার্ডের প্রখ্যাত ডানা ফার্বার ক্যানসার ইনস্টিটিউটে দীর্ঘ সময় রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেন। তাঁর সমপর্যায়ের নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী বা গবেষক এ সময়ে শুধু বালাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও খুব বেশি নেই।
পড়াশোনা ও কর্মসূত্রে আমাদের প্রিয় মুজিব ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রচেস্টার এবং বিশেষ করে গবেষণার জন্য দীর্ঘকাল হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার পরও সান্দিকোনা হাইস্কুলের অরুণ স্যার (অরুণচন্দ্র রাহা) হচ্ছেন তাঁর দেখা ও জানামতে সেরা শিক্ষক। পৃথিবীজুড়ে এত কিছু দেখার পরও মুজিব ভাইয়ের মতো বিজ্ঞানীর চোখে কেন আমাদের অরুণ স্যার এত বড় মাপের শিক্ষক?
আমাদের অরুণ স্যার শিক্ষাদানের কলাকৌশল, বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও সমন্বয় এবং বিতরণের মাধ্যমে ছাত্রদের সহজাত মেধাকে আরও ধারালো, ঝকঝকে ও প্রাণবন্ত করে তোলার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতার অধিকারী। কিন্তু আমার মনে হয়, মুজিব ভাই অরুণ স্যারের মধ্যে তাঁর দক্ষতার চেয়ে ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করার যে গুণ সে জন্যই তাঁকে একজন মহান শিক্ষক মনে করেন। একজন সেরা ছাত্রের পক্ষে তার সেরা শিক্ষকের অবদান মূল্যায়নের জন্য এর চেয়ে সুন্দর স্বীকৃতি আর কী হতে পারে! অরুণ স্যারকে নিয়ে স্মৃতির পাতা ওল্টাতে গেলে এর বাইরে যা মনে পড়ে তা হলো তার অসাধারণ সংস্কৃতিপ্রেম। তাঁর পরিকল্পনা ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো হতো, সেগুলো ছিল অতুলনীয়।
তবে সান্দিকোনা হাইস্কুলে ওই একজন শিক্ষক শুধু নন, এ মুহূর্তে আমার আরও যাঁদের নাম মনে পড়ছে তাঁদের মধ্যে আছেন খোরশেদ আলম স্যার, খলিল স্যার, হান্নান স্যার, রাশিদ স্যার, রইছ উদ্দিন স্যার এবং সিরাজুল ইসলাম স্যার। মুজিব ভাইয়ের মতো আমিও মনে করি, আমাদের সময়ে ওই স্কুলের যাঁরা শিক্ষক ছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই খুব উন্নত মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন ছিলেন। পাঠ্য বিষয়টি ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, অসাম্প্রদায়িক, সংবেদনশীল ও সহূদয় মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে তাঁরা যেমন যত্নবান ও সচেষ্ট ছিলেন তেমনি ছিলেন অনুসরণীয় মমত্বশীল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
সান্দিকোনা হাইস্কুলের আরেকজন প্রাক্তন ছাত্র, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেসকোর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ইন আফ্রিকার ভাইস-চেয়ারপারসন বিকাশচন্দ্র সান্যালের কথাও একইভাবে সমান গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা দরকার। এর আগে তিনি ইউনেসকোর মহাপরিচালকের সিনিয়র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী ড. সান্যাল ইউনেসকোর হয়ে গবেষণা, নীতিনির্ধারণ ও উন্নয়নমূলক কাজে বলতে গেলে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ ভ্রমণ করেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাসম্পন্ন জার্নালে তাঁর প্রচুর গবেষণামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং বইপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
আমাদের সান্দিকোনা হাইস্কুলের ১০০ বছর পূর্ণ হয়েছে জানুয়ারি মাসে। স্কুলটির শতবর্ষ উদ্যাপনের জন্য স্কুলপ্রাঙ্গণে আগামী মাসে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে অনুষ্ঠেয় কর্মসূচিকে সফল ও সুন্দর করে তোলার জন্য ঢাকাসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা প্রাক্তন ছাত্ররা ফেসবুক ও ই-মেইলের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। প্যারিস থেকে বিকাশ সান্যাল বাংলাদেশে এসে এই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। বাংলাদেশ-ভারত ছাড়াও ইউরোপ-আমেরিকা, জাপান, কানাডা-অস্ট্রেলিয়াসহ আরও বহু দেশ থেকে এ সম্পর্কে অনেকে খোঁজখবর নিয়েছেন, শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
শিক্ষকদের সহানুভূতি ও ভালোবাসার অভাবের কারণে দুর্বল শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষণীয় বিষয় বুঝতে পারে না এবং মেধা বিকাশের যত সমস্যা তার ৬৪ শতাংশই হয় শিক্ষকদের মায়া অথবা ভালোবাসার অভাবে। সান্দিকোনা হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের আর যা-ই হোক, এ ধরনের কোনো সমস্যা ছিল না। নবীন শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেই যত্ন ও সহানুভূতি তাঁরা ওখানে যথেষ্টই পেয়েছিলেন।
এম এ কাশেম
No comments