বিজ্ঞান গবেষণা-শীর্ষ দশে চীন ও ভারত, বাংলাদেশ কোথায়? by ফজলে রাব্বী চৌধুরী
ব্রিটেনের দি রয়্যাল সোসাইটি অব সায়েন্স কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান প্রভৃতির স্থলে নেতৃত্বে উঠে আসছে চীন, ভারত ও ব্রাজিলের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি ও ফ্রান্স বিশ্বব্যাপী গবেষণা খাতের মোট ৫৯ শতাংশ ব্যয় করে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বার্ষিক মোট বিজ্ঞানবিষয়ক প্রকাশনার ২০ শতাংশের মালিক।
কিন্তু ১৯৯৬-২০০৮ সালের মধ্যে তাদের এই অংশীদারি প্রায় এক-পঞ্চমাংশ কমে এসেছে। অন্যদিকে চীন প্রায় বার্ষিক ১৮ শতাংশ হারে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশের সংখ্যা বাড়িয়ে ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে।
বর্তমানে চীন বছরে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ১০০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে, যা তার জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ। ভারত ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতিবছর গড়ে তার জিডিপির ২ শতাংশ গবেষণা খাতে ব্যয় করছে। বছরে ৭ শতাংশ হারে গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা বাড়িয়ে ভারত ২০০৮ সালে (১৯৯৬ সালে ১৩তম) রাশিয়াকে সরিয়ে শীর্ষ দশে স্থান করে নিয়েছে। ব্রাজিল দ্রুত অগ্রসরমাণ অপর একটি দেশ। বিজ্ঞান গবেষণার প্রতিযোগিতায় আরেকটি উদীয়মান দেশ হলো দক্ষিণ কোরিয়া।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের মধ্যে তুরস্ক, অস্ট্রিয়া, গ্রিস ও পর্তুগালকেও দ্রুত অগ্রসরমাণ দেশ ধরা হচ্ছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইরান বিগত বছরগুলোতে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ঠিক কোন অবস্থানে আছে, তার প্রকাশিত তথ্য পাওয়া দুষ্কর। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণা একটি অন্যতম বৃহৎ ক্ষেত্র। উল্লিখিত অগ্রসরমাণ দেশগুলোর প্রকাশিত প্রবন্ধের একটি অন্যতম বৃহৎ অংশই হলো চিকিৎসাবিষয়ক। পাবমেড (PubMed) ডেটাবেইসকে ব্যবহার করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশের অবস্থান কিছু আন্দাজ করা যায়। এখানে উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত Peer reviewed জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধই শুধু PubMed সংরক্ষণ করে এবং স্বীকৃতি দেয়। ২০০৫-২০১০ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে দুই হাজার ৪৪৬টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পক্ষান্তরে, ভারত থেকে ৫৩ হাজার ৭১১টি এবং পাকিস্তান থেকে পাঁচ হাজার ১৬৪টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সার্কভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে ভারতের কাছাকাছি কোনো দেশেরই অবস্থান নেই। ক্রমাগত রাজনৈতিক অস্থিরতার পরও দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখেছে পাকিস্তান।
বাংলাদেশের মাত্র তিনটি চিকিৎসাবিষয়ক জার্নাল PubMed কর্তৃক স্বীকৃত। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল বুলেটিন, আইসিডিডিআরবি প্রকাশিত জার্নাল অব হেলথ, পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশন এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল জার্নাল। এর বাইরে আমাদের দেশে বেশ কিছু ভালো মানের মেডিকেল জার্নাল থাকলেও তা যথাযথ স্বীকৃতির অভাবে বৈশ্বিক গবেষণার মাপকাঠিতে আসতে পারছে না। বর্তমান সরকার দেশে বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়েছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হচ্ছে। সরকারের উচিত যেসব গবেষক এই গবেষণাগুলো করছেন, তাঁদের ওপর গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রবন্ধ আকারে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা দেওয়া এবং তা অবশ্যই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জার্নালে হতে হবে। শুধু চিকিৎসা গবেষণা নয়, যেকোনো ধরনের বিজ্ঞান গবেষণায় সরকারি অর্থ বরাদ্দ পেলে তা স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত।
চিকিৎসা-শিক্ষায় শিক্ষকদের পদোন্নতির অন্যতম মাপকাঠি হওয়া উচিত ওই শিক্ষকের প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা। পদোন্নতির নীতিমালায় বর্তমানে উল্লিখিত তিন থেকে পাঁচটির পরিবর্তে তা বাড়িয়ে পদভেদে ন্যূনতম দশের অধিক করা উচিত এবং তার দুই-তৃতীয়াংশ প্রকাশনায় উক্ত প্রার্থীকে অবশ্যই প্রথম লেখক (First Author) হতে হবে। আমাদের দেশে অন্য কারও লেখায় নিজের নাম জুড়ে দেওয়ার যে সংস্কৃতি চালু আছে, তা থেকে বের হয়ে আসার এটি একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। এ ছাড়া ওই প্রার্থীর প্রকাশনাগুলোর অন্তত ৫০ ভাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জার্নালে প্রকাশিত হতে হবে। প্রত্যেক সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপকদের অবশ্যই প্রতিবছর চিকিৎসা গবেষণায় প্রবন্ধ আকারে অবদান রাখার বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত।
ফজলে রাব্বী চৌধুরী: চিকিৎসক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
বর্তমানে চীন বছরে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ১০০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে, যা তার জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ। ভারত ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতিবছর গড়ে তার জিডিপির ২ শতাংশ গবেষণা খাতে ব্যয় করছে। বছরে ৭ শতাংশ হারে গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা বাড়িয়ে ভারত ২০০৮ সালে (১৯৯৬ সালে ১৩তম) রাশিয়াকে সরিয়ে শীর্ষ দশে স্থান করে নিয়েছে। ব্রাজিল দ্রুত অগ্রসরমাণ অপর একটি দেশ। বিজ্ঞান গবেষণার প্রতিযোগিতায় আরেকটি উদীয়মান দেশ হলো দক্ষিণ কোরিয়া।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের মধ্যে তুরস্ক, অস্ট্রিয়া, গ্রিস ও পর্তুগালকেও দ্রুত অগ্রসরমাণ দেশ ধরা হচ্ছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইরান বিগত বছরগুলোতে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ঠিক কোন অবস্থানে আছে, তার প্রকাশিত তথ্য পাওয়া দুষ্কর। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণা একটি অন্যতম বৃহৎ ক্ষেত্র। উল্লিখিত অগ্রসরমাণ দেশগুলোর প্রকাশিত প্রবন্ধের একটি অন্যতম বৃহৎ অংশই হলো চিকিৎসাবিষয়ক। পাবমেড (PubMed) ডেটাবেইসকে ব্যবহার করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশের অবস্থান কিছু আন্দাজ করা যায়। এখানে উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত Peer reviewed জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধই শুধু PubMed সংরক্ষণ করে এবং স্বীকৃতি দেয়। ২০০৫-২০১০ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে দুই হাজার ৪৪৬টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পক্ষান্তরে, ভারত থেকে ৫৩ হাজার ৭১১টি এবং পাকিস্তান থেকে পাঁচ হাজার ১৬৪টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সার্কভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে ভারতের কাছাকাছি কোনো দেশেরই অবস্থান নেই। ক্রমাগত রাজনৈতিক অস্থিরতার পরও দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখেছে পাকিস্তান।
বাংলাদেশের মাত্র তিনটি চিকিৎসাবিষয়ক জার্নাল PubMed কর্তৃক স্বীকৃত। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল বুলেটিন, আইসিডিডিআরবি প্রকাশিত জার্নাল অব হেলথ, পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশন এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল জার্নাল। এর বাইরে আমাদের দেশে বেশ কিছু ভালো মানের মেডিকেল জার্নাল থাকলেও তা যথাযথ স্বীকৃতির অভাবে বৈশ্বিক গবেষণার মাপকাঠিতে আসতে পারছে না। বর্তমান সরকার দেশে বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়েছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হচ্ছে। সরকারের উচিত যেসব গবেষক এই গবেষণাগুলো করছেন, তাঁদের ওপর গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রবন্ধ আকারে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা দেওয়া এবং তা অবশ্যই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জার্নালে হতে হবে। শুধু চিকিৎসা গবেষণা নয়, যেকোনো ধরনের বিজ্ঞান গবেষণায় সরকারি অর্থ বরাদ্দ পেলে তা স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত।
চিকিৎসা-শিক্ষায় শিক্ষকদের পদোন্নতির অন্যতম মাপকাঠি হওয়া উচিত ওই শিক্ষকের প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা। পদোন্নতির নীতিমালায় বর্তমানে উল্লিখিত তিন থেকে পাঁচটির পরিবর্তে তা বাড়িয়ে পদভেদে ন্যূনতম দশের অধিক করা উচিত এবং তার দুই-তৃতীয়াংশ প্রকাশনায় উক্ত প্রার্থীকে অবশ্যই প্রথম লেখক (First Author) হতে হবে। আমাদের দেশে অন্য কারও লেখায় নিজের নাম জুড়ে দেওয়ার যে সংস্কৃতি চালু আছে, তা থেকে বের হয়ে আসার এটি একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। এ ছাড়া ওই প্রার্থীর প্রকাশনাগুলোর অন্তত ৫০ ভাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জার্নালে প্রকাশিত হতে হবে। প্রত্যেক সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপকদের অবশ্যই প্রতিবছর চিকিৎসা গবেষণায় প্রবন্ধ আকারে অবদান রাখার বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত।
ফজলে রাব্বী চৌধুরী: চিকিৎসক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
No comments