ঋত্বিক ঘটক ও গণমানুষের কথা by কামরুজ্জামান মিলু
ঋত্বিক কুমার ঘটকের ৮৬তম জন্মদিন ছিল গত ২৪ নভেম্বর। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজন করেছিল সপ্তাহব্যাপী তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর। এ উৎসব নিয়ে লিখেছেন কামরুজ্জামান মিলু।উপমহাদেশের চলচ্চিত্রকার হিসেবে যে কয়জনের নাম সবার মুখে ও স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, ঋত্বিক ঘটক তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন চলচ্চিত্র দর্শকপ্রেমীর কাছে তাঁর পরিচালিত ছবিগুলো একেকটি ইতিহাস হয়ে আছে।
তিনি চলচ্চিত্রকার, গল্পকার, নাট্যকার এবং অভিনেতাসহ দৃশ্যশিল্পের প্রায় সব রূপেই ছিলেন এক মহামানব। ১৮ নভেম্বর থেকে ঘটকের চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল শিল্পকলা একাডেমী। অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী দিনে উপস্থিত ছিলেন অভিনেত্রী ও সংসদ সদস্য সারাহ বেগম কবরী এবং শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। প্রতিদিন দুটি করে চলচ্চিত্র দেখানো হয়। প্রথমটি বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং দ্বিতীয়টি সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁর পরিচালনায় মোট ৯টি চলচ্চিত্র দেখানো হয়। উৎসবের শুরুর দিন থেকেই ঋত্বিক ঘটকের সব চলচ্চিত্র দেখার জন্য প্রতিদিন দর্শকরা ভিড় করে এবং চলচ্চিত্রগুলো উপভোগ করে। প্রদর্শনী চলাকালে এক দর্শক (শহীদুল ইসলাম সজীব) বলেন, 'সব সময় ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রগুলো বাসায় বসে কম্পিউটারে বা সিডিতে দেখতাম। এবারই প্রথম বড় পর্দায় দেখার সুযোগ মিলেছে। এ জন্য আমি অনেক আনন্দিত।' তাঁর প্রায় সব ছবিতেই সাধারণ মানুষের জীবনের গল্প, চাওয়া এবং অধিকারের স্পর্শ থাকত। মানুষের জন্যই ছিল তাঁর প্রেম ও ভালোবাসা।
ঋত্বিকের জন্ম ১৯৫২ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার ঋষিকেশ দাশ লেনে। মাত্র অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায়ই শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। রাজশাহী কলেজে পড়া অবস্থায় নাটক শুরু করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরপর তিনি কিছু নাটকও লিখেছেন। তাঁর লেখা নাটকগুলোর মধ্যে ছিল 'জ্বালা', 'অফিসার', 'দলিল', 'সাঁকো' এবং 'সেই মেয়ে'। এর মধ্যে 'দলিল' নাটকটি ১৯৫৩ সালে গণনাট্য সংঘের সর্বভারতীয় বোম্বে সম্মেলনে প্রথম পুরস্কার জিতেছিল।
ওই সময়কার প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক বিমল রায়ের সহকারী হিসেবে সেলুলয়েডের জগতে প্রবেশ ঘটে তাঁর।
ঋত্বিকের প্রথম সৃষ্টি 'নাগরিক'। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় ছবিটি মুক্তি পায়নি। মূলত চলচ্চিত্রটি ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বাংলার জীবনযন্ত্রণায় প্রথম বস্তুনিষ্ঠ একটি শিল্পরূপ। এরপর ১৯৫৭ সালে নির্মিত হয় ঋত্বিকের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র 'অযান্ত্রিক'। এরপর ঋত্বিক অসাধারণ তিনটি গল্প নিয়ে নির্মাণ করেন তিনটি চলচ্চিত্র_'মেঘে ঢাকা তারা', 'কোমল গান্ধার' এবং 'সুবর্ণরেখা'। শক্তিপদ রাজগুরুর কাহিনী অবলম্বনে 'মেঘে ঢাকা তারা' যেন অসীম অন্ধকারে আলোর পথ এবং বাঁচতে চাওয়ার ছবি। 'কোমল গান্ধার' ছবিতেও উঠে এসেছে সেই একই সুর-জীবনের জয়গান। দেশভাগ-উদ্বাস্তু-ছেলেমেয়েদের নিয়ে নির্মিত নাটকের দলেও ভাগাভাগি। একদল ক্লাসিক নাটকের পক্ষে, অন্যদল চায় বাস্তবের মঞ্চরূপ। ছবিটিতে ব্যবহৃত হয়েছে দ্রুতগতি, উচ্চ শব্দের চিৎকার, বাফার। এগুলো সেই সময়কার দর্শকদের এক নতুন চিত্র ব্যাকরণের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।
'সুবর্ণরেখা'র বিষয়বস্তুও ছিল উদ্বাস্তু জীবনের গল্প। ঈশ্বর, সীতা, অভিরাম_সব চরিত্রই যেন সেই সংগ্রামের এক ক্লান্ত যোদ্ধা। অভিরাম, সীতা হার মানলেও গল্পের শেষে ঈশ্বরচন্দ্র সামনে এগিয়ে যান নতুন এক ভোরের উদ্দেশে। সঙ্গে নিয়ে যান গীতার ছেলে বেণুকে।
১৯৬৫ সালে সুবর্ণরেখা মুক্তির পর আট বছরের বিরতি নেন ঋত্বিক। এরপর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে এসে নির্মাণ করেন তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'তিতাস একটি নদীর নাম'। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ধ্রুপদ উপন্যাস থেকে নেওয়া এ ছবিটি পেয়েছিল ব্যাপক প্রশংসা। এরপর ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ঋত্বিকের শেষ ছবি 'যুক্তিতক্ক আর গপ্পো'। কাহিনীর ছলে তিনি নিজের কথা বলে গেছেন এ ছবিতে। ছবিটিতে নিজের রাজনৈতিক মতবাদকেও দ্বিধাহীনভাবে প্রকাশ করেছেন। এরপর অনেক দিন তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন মানসিক হাসপাতালে। এরপর চলচ্চিত্রের এই মহামানবের মৃত্যু ঘটে। শিল্পকলায় আয়োজিত প্রদর্শনীর প্রথম দিন থেকে ২৪ নভেম্বর শেষ দিন পর্যন্ত দর্শকদের আনাগোনা ও ভিড় প্রমাণ করে, ঋত্বিক এখনো মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন।
No comments