মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করতে সাকার অস্বীকৃতি

কাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত ও চেম্বারে বসে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেওয়ার আদেশ প্রত্যাহার করতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আবেদনের ওপর আগামী ৫ ডিসেম্বর আদেশ দেবেন ট্রাইব্যুনাল। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে উন্মুক্ত বিচারের আয়োজনসহ সাতদফা দাবি বাস্তবায়ন করতে সাকা চৌধুরীর আবেদনের ওপরও এদিন আদেশ দেওয়া হবে।


এদিকে সংসদ অধিবেশন ও সংসদীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দেওয়ার অনুমতি চেয়ে করা আবেদন যথাযথ না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছেন।
এদিকে যুদ্ধাপরাধবিষয়ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূত স্টিফেন জে র‌্যাপের দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন সাকা চৌধুরী।
গতকাল বুধবার বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এজলাসে বসার পর ১০টা ৩৮ মিনিটে বিচার কাজ শুরু হয়। শুরুতেই প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ট্রাইব্যুনালে বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী আইনজীবী প্রত্যাহার করে নিজেই শুনানি শুরু করেছেন। তাঁর আইনজীবীদের নামে যে ওকালতনামা জমা দেওয়া আছে সে বিষয়ে আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী এখন একজন স্ট্রেট ডিফেন্স আইনজীবী নিয়োগ করার প্রশ্ন এসেছে। সাকা চৌধুরী যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন তাতে সময়ের অপচয় হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, মিডিয়া ট্রায়াল হচ্ছে এমনটি বোঝানোর চেষ্টা করছেন আসামি।
এরপর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সাকা চৌধুরীকে উদ্দেশ করে বলেন, 'মঙ্গলবার আপনি নিজে শুনানি করার জন্য একটি আবেদন করেছেন। তাতে আইনজীবী প্রতাহারের কোনো কথা নেই। আগে আবেদন সংশোধন করে আইনজীবীর ওকালতনামা বাতিল করা হয়েছে তা লিখুন।' এরপর ট্রাইব্যুনালের কথামত আবেদন সংশোধন করেন সাকা চৌধুরী।
এরপর সাকা চৌধুরীর সংসদে যোগ দেওয়ার জন্য সাদা কাগজে করা আবেদন খারিজ করে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। আদেশে বলা হয়, যেভাবে আবেদন করতে হয়, এটা সেভাবে করা হয়নি। এ ছাড়া এ আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার এ ট্রাইব্যুনালের নেই। তাই আবেদনটি খারিজ করা হলো।
এরপর সাকা চৌধুরী তাঁর বক্তব্য শুরু করেন এবং নিজেদের একাধিক আবেদনের ওপর দীর্ঘ বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, 'সংবিধান ও ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী সশস্ত্র, প্রতিরক্ষা ও সহযোগী বাহিনী এবং যুদ্ধবন্দি_এ চার ক্যাটাগরির ব্যক্তির বিচার হওয়ার কথা। কিন্তু ২০০৯ সালে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে তাতে একজন ব্যক্তি বা একদল ব্যক্তির বিচার করার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো। এ আইনের অধীন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলো। ট্রাইব্যুনাল বিধিমালা তৈরি করল। আইনের এ সংশোাধনী জায়েজ করতে এ বছর জুলাইয়ে সংবিধান সংশোধন করা হলো। অর্থাৎ অবৈধ সন্তানকে বৈধতা দিতেই এটা করা হয়েছে, যা সংবিধান অনুযায়ী বাতিলযোগ্য।'
সাকা চৌধুরী সংবিধানের ৪৪, ৪৭, ১১১ অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে বলেন, 'সংবিধান হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানে যা আছে তার বিপরীত কোনো আইন করা যাবে না। কিন্তু সরকার সেটা করেছে। সরকার সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে মৌলিক অধিকার নতুন করে সজ্ঞায়িত করেছে। নতুন ৭ক অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করলে তা হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতা।' তিনি আরো বলেন, 'সরকার আইন করে ও সংবিধান সংশোধন করেছে, আইন সচিব গেজেট প্রকাশ করেছেন, ট্রাইব্যুনাল বিচারিক কাজ পরিচালনা করে ও বিভিন্ন আদেশ দিয়েছে এবং আমি ট্রাইব্যুনালের আদেশ মান্য করেছি।' এসব কিছুকেই অবৈধ দাবি করে সাকা বলেন, সংশ্লিষ্ট সবাই রাষ্ট্রদোহিতা করেছেন এবং এ জন্য সবাই একই অপরাধে অপরাধী। তিনি আরো বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইন করে মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এখন প্রত্যেক নাগরিককে ট্রাইব্যুনালের নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরতে হবে। সাকা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বক্তব্য দিলে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে রাজনৈতিক বক্তব্য না দেওয়ার অনুরোধ করেন।
শুনানির একপর্যায়ে সাকা চৌধুরীকে বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করার আহ্বান জানিয়ে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, এত সময় নেই। জবাবে সাকা চৌধুরী বলেন, 'সময় সম্পর্কে আমি সচেতন। আমি পুরোপুরি সহযোগিতা করব। আমি ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা সম্পর্কে জানি। আমি এমন সংক্ষিপ্ত করব যে চেম্বারে বসেই আমার ফাঁসির আদেশ দিতে পারবেন। যেমনটি চেম্বারে বসে ফরমাল চার্জ আমলে নিয়েছেন।' তিনি আরো বলেন, "আমাকে গ্রেপ্তার করার পর হিন্দুস্থান মার্কা পত্রিকাগুলো লিখেছিল 'বিজয় দিবসের উপহার, সাকা চৌধুরী গ্রেপ্তার'। এবারও ১৬ ডিসেম্বরের আগে লিখবে 'বিজয় দিবসের উপহার, সাকা চৌধুরীর বিচার'।" তিনি বলেন, 'ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী চার্জ গঠন করার পর গ্রেপ্তার করতে পারবে। কিন্তু আগেই আমাকে গ্রেপ্তারের আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল, যা অবৈধ।'
সাকা চৌধুরী বলেন, আইনজীবীদের ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছে। আইনজীবী ও আত্মীয়স্বজনের সংখ্যা নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে। সীমিতসংখ্যক আইনজীবী (১০ জন) থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তিনি আরো বলেন, 'এটা অভ্যন্তরীণ ট্রাইব্যুনাল। তাই সবাইকে বিচার কাজ দেখার সুযোগ দিতে হবে। ট্রাইব্যুনাল সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। এটা হচ্ছে ক্যামেরা ট্রায়াল।' সাকা চৌধুরী বলেন, 'রাষ্ট্রপক্ষ ১১ মাস সময় পেয়েছে। আমাকেও ১১ মাস সময় দিতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধ বলতে সুনির্দিষ্টভাবে কী বুঝায় সেই সংজ্ঞা দিতে হবে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের ট্রাইব্যুনালে এসে বিচার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের সুযোগ দিতে হবে। ট্রাইব্যুনালে বিদেশি আইনজীবী আসতে বাধা দেওয়া যাবে না। এই বিচার কার্য সরাসরি মানুষের কাছে প্রচারের জন্য রেডিও-টেলিভিশনে সম্প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের স্বাক্ষর করা যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য যা যা চুক্তি রয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। দণ্ডবিধি অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিক তার অধিকার রক্ষায় যেসব আইনগত সুবিধা পায় তা আমাকে ভোগ করতে দিতে হবে এবং ফৌজদারি কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইন প্রয়োগ করতে দিতে হবে। অন্যথায় ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে অংশ নেওয়া সম্ভব হবে না।'
সাকা চৌধুরীর বক্তব্যের জবাব দেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম। তিনি বলেন, সাকা চৌধুরী যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তাঁর অধিকাংশই রাজনৈতিক বক্তব্য। তিনি সময় অপচয় করার জন্যই এটা করেছেন। তিনি বলেন, এ ট্রাইব্যুনাল ও হাইকোর্ট আগেই যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা নতুন করে তুলে আনা হয়েছে। তাঁর বক্তব্যের ভিত্তি নেই। তাই আবেদন খারিজ যোগ্য।

No comments

Powered by Blogger.