গাজীপুরে বনের ২০ বিঘা জমিতে দেয়াল তুলছে পৌরসভা! by শরীফ আহমেদ শামীম,
গাজীপুর শহরের ভুরুলিয়া এলাকায় বন বিভাগের প্রায় ২০ বিঘা জমি দখল করতে পাকা সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করছে গাজীপুর পৌরসভা। অভিযোগ উঠেছে, পৌরসভার নামে এ দখল প্রক্রিয়া চালাচ্ছে একটি প্রভাবশালী চক্র। ইতিমধ্যে জমির তিন পাশে প্রাচীর নির্মাণের জন্য কলাম ও গ্রেড ভিমের কাজ শেষ হয়েছে। এখন দ্রুত চলছে অন্য পাশের কাজ। শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট)
সীমানাপ্রাচীর সংলগ্ন ওই জমির বাজার মূল্য ৫০ কোটি টাকারও বেশি। জমিতে রয়েছে বন বিভাগের টাকায় লাগানো পাঁচ শতাধিক বড় আকাশমণি গাছ। প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করে ২৫ লাখ টাকা দামের ওই গাছসহ পুরো জমি দখল করে নেওয়া হচ্ছে। বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য একাব্বর হোসেন এমপি বলেছেন, এটা একটা গুরুতর অপরাধ। বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তা বলছেন, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ বন্ধের অনুরোধ উপেক্ষা করে কাজ করা হচ্ছে। দু-এক দিনের মধ্যে মামলা করা হবে।
গত সোমবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ১৩ জন শ্রমিক প্রাচীর নির্মাণের কাজ করছেন। কবিরুল হোসেন নামের এক শ্রমিক জানান, ঠিকাদার বাচ্চু মোল্লার কাজ করছেন তাঁরা। তবে পৌরসভার কোষাগারের ২০ লাখ টাকায় এ নির্মাণকাজের পুরো তদারক করছেন পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. জামাল উদ্দিন। কোন কলাম কোথায় বসবে, প্রাচীর ডানে না বামে যাবে_সব তিনিই ঠিক করে দিচ্ছেন। নির্মাণাধীন প্রাচীরের পশ্চিম পাশের বাসিন্দা আবদুল বাতেন সরকার বলেন, 'বনের জমিতে প্রাচীর নির্মাণ শুরু হলে এলাকার বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে ঢাকা বন বিভাগের রাজেন্দ্রপুর ফরেস্ট রেঞ্জের শালনা বিটের কর্মকর্তাকে জানানো হয়। তিনি দু-একবার ঘটনাস্থলে এসে এলাকার কাউন্সিলর মো. জামাল উদ্দিনের সঙ্গে আলোচনা করে গেছেন বলে শুনেছি। তবে কাজ বন্ধের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।'
স্থানীয় লোকজন জানায়, পৌরসভার নামে দখল-প্রক্রিয়া চললেও এর নেপথ্যে রয়েছেন কাউন্সিলর জামাল উদ্দিন ও শালনা ফরেস্ট বিটের সাবেক ডেপুটি রেঞ্জার তোসাদ্দেক হোসেন। বর্তমানে গাজীপুর মৌচাক বিটে কর্মরত তোসাদ্দেক দেড় বছর আগে শালনায় দায়িত্ব পালনের সময় ওই ২০ বিঘা জমি গ্রাস করার লক্ষ্যে সেখানে পৌরসভার ময়লা-আবর্জনা ফেলা শুরু হয়। সে সময় ময়লা ফেলার কাজে বাধা না দিয়ে বরং সহায়তা করেছিলেন তোসাদ্দেক। এক মাস আগে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ শুরু হলে তোসাদ্দেক হোসেন কয়েকবার এসে কাজ দেখে গেছেন। ঠিকাদার ও কাউন্সিলর জামাল উদ্দিনের সঙ্গে তাঁকে নানা পরামর্শ করতেও দেখা গেছে। ওই জমিতে হাউজিং প্রকল্প বানিয়ে প্লট বিক্রি করবেন বলেও গ্রামের বাসিন্দারা শুনেছে। তাদের অভিযোগ, এই জমি দখলে ঢাকার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অবনী ভূষণ ঠাকুর ও শালনার বিট কর্মকর্তা খলিলুর রহমানের প্রত্যক্ষ সহায়তা রয়েছে।
গাজীপুর পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র আবদুল করিম ওই জমি বন বিভাগের বলে স্বীকার করেন। তবে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, 'পৌরসভার ময়লা-আবর্জনা ওই স্থানে ফেলা হয়। দুর্গন্ধে আশপাশের মানুষের অসুবিধা হয়। তাই বাউন্ডারি করা হচ্ছে, যাতে দুর্গন্ধ না ছড়ায়।'
শালনা ফরেস্ট বিটের কর্মকর্তা খলিলুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, ভুরুলিয়া মৌজার সিএস ২৫০ ও ৭০২ এবং আরএস ৪৮০ ও ৪৭৯ নম্বর দাগের ওই জমির মালিক বন বিভাগ। ১৯৮৪ সালে বন বিভাগ ওই জমিতে আকাশমণি বাগান করেছিল। দখলে সহায়তার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, 'সীমানাপ্রাচীর করার খবর পেয়ে আমি জামাল কাউন্সিলরকে কাজ বন্ধের অনুরোধ করি। কিন্তু অনুরোধ উপেক্ষা করে কাজ করা হচ্ছে। কাজ বন্ধ করার মতো জনবল আমার নেই। ঘটনাটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। তাঁরা থানায় মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন। দু-এক দিনের মধ্যে মামলা করব।'
বনের জমি প্রকাশ্যে দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজেন্দ্রপুরের রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম রসুল বলেন, 'অভিযোগ পেয়ে আমি বিট কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ বন্ধ এবং থানায় জবরদখলের মামলা করার নির্দেশ দিয়েছি। আমি নিজে একাধিকবার গিয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়ে এসেছি। কিন্তু চলে আসার পর তারা আবার কাজ করছে। এ ঘটনায় বন আইনে একটি মামলাও করা হয়েছে।' তিনি বলেন, 'ঠিকাদার বাচ্চু মোল্লার লোক যুবলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান পরিচয়ে এক ব্যক্তি আমাকে মোবাইলে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেছে। গতকালও (গত রবিবার) ফোন করে বলেছে, হাত-পা ভেঙে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে।' জমি দখলে বিট কর্মকর্তার সহায়তার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এমন অভিযোগ আমিও শুনেছি।'
প্রাচীর নির্মাণকাজের তদারককারী অভিযুক্ত ওয়ার্ড কাউন্সিলর জামাল উদ্দিন বলেন, 'বিভিন্ন শিল্প-কারখানার মালিক ও ব্যক্তি বনের শত শত বিঘা জমি দখল করে রেখেছেন। বন বিভাগ সেগুলো দেখে না। বাধাও দেয় না। সাংবাদিকরাও সেসব লেখে না। এলাকার কিছু লোক কয়েক বছর আগে এ জমি বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাত করে দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। বিষয়টি জানতে পেরে আমরা সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে বেদখলের হাত থেকে কোটি কোটি টাকা মূল্যের সরকারি সম্পদ রক্ষা করেছি। বাইরে থেকে যাতে কেউ ময়লা ফেলতে বা বাইরে বের করতে না পারে, সে জন্যই এ প্রাচীর তৈরি করা হচ্ছে।' তিনি দাবি করেন, গাজীপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ জেলা উন্নয়ন কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও ঢাকার বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে জানিয়ে এবং তাঁদের সম্মতিতে টেন্ডার আহ্বান করেই বনের জমিতে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হচ্ছে। কাজ শুরু করার পর বিট কর্মকর্তা ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেছিলেন। কে যেন ১০ হাজার টাকা দিয়েছে। বাকি টাকার জন্য তিনি এখন বারবার কাজ বন্ধ করে দিতে চাইছেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, 'পৌরসভা ও জমি দুটোই সরকারের। তাহলে এটি জমি দখল হয় কিভাবে?'
যোগাযোগ করা হলে জেলা উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক কামাল উদ্দিন তালুকদার বলেন, 'এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত উন্নয়ন কমিটির সভায় নেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তা ছাড়া বনের জমি কাউকে দেওয়ার এখতিয়ারও কমিটির নেই।' তিনি বলেন, পৌরসভার টাকা দিয়ে বনের জমিতে কাজ করাও সরকারি বিধান অনুযায়ী গুরুতর অনিয়ম।'
ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হক পৌরসভার বনের জমি দখল করে বাউন্ডারি নির্মাণের বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কারো কথা হয়নি জানিয়ে বলেন, 'এসব বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা না করে পৌরসভার মেয়রকে জিজ্ঞেস করেন।' সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে এ ঘটনায় তাঁর কোনো দায়-দায়িত্ব আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এসব বিষয়ে আমি কোনো বক্তব্য দেব না।' পৌরসভার অর্থে মেয়র বন বিভাগের সরকারি জমি দখল করে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করতে পারেন কি না_ সাবেক মেয়র হিসেবে তাঁকে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, অনুমতি থাকলে পারবে, নচেৎ নয়।
ঢাকার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অবনী ভূষণ ঠাকুরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'খলিলুর রহমান দক্ষ বলেই দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে সেখানে পাঠিয়েছি। বনের জমি দখলের খবর সঠিক নয়।'
বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য একাব্বর হোসেন জানান, 'সরকারি গেজেটভুক্ত ও জমিতে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ করার বিধান নেই। কেউ করলে সেটা গুরুতর অপরাধ। বিষয়টি বনমন্ত্রীকে জানাব।'
No comments