অধিক সন্ন্যাসে গাঁজন নষ্ট by দাউদ হোসাইন রনি

কটা চমৎকার বিনোদনমূলক ছবি হতে পারত 'কিং খান'। হতে হতেও হলো না। প্রচার-প্রপাগাণ্ডায় 'হলিউড প্রযুক্তি'র বুলি আউড়িয়ে দর্শকের আগ্রহ হয়ত বাড়ানো গেছে, কিন্তু দর্শকের ইজ্জত কি রাখা গেছে? এ রকম শিশুতোষ এবং অপরিপক্ক টেকনোলজির ব্যবহার কখনো কোনো সিনেমায় দেখেছি বলে মনে পড়ে না। হলিউডের ছবি তো দূরের কথা, পাশের দেশ ভারতের প্রাদেশিক ছবিতেও এমন 'কীর্তি'র দেখা মেলে না।


অবশ্য এক দশক আগের হিন্দি সিরিয়ালে এমনটা দেখা যেত। নায়িকাকে হয়ত কেউ একবার চড় মারল, আর সেটাকে টেনে টেনে দেখানো হতো ১০ বার! এখানে শাকিব ভিলেনকে লাথি মারতে যান, মারার আগে কয়েকবার পা ওঠান আর নামান, শেষে একবার লাথিটা মারেন। যেন পুরনো মোটরসাইকেলে চড়ার আগে গিয়ার নিচ্ছেন। মারামারির সময় দৌড়ে যাচ্ছেন শাকিব, আর তাঁর পায়ের তলায় বিল্ডিংয়ের ছাদ ফেটে চৌচির! কখনো তাঁর চোখ লাল হয়ে ওঠে, অনেকটা চৌরাস্তার মোড়ে থাকা সিগন্যাল বাতির মতো। কিন্তু এসব দৃশ্যগুলোও চোখে লাগে না, যদি প্রযুক্তির ব্যবহারটা যথাযথ হয়। শাকিবের কেরামতি দেখে মিশা সওদাগরের চোখ গর্তে ঢুকে যায়। গর্তে ঢুকে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখলে বাচ্চারাও হেসে ফেলবে। কারণ কার্টুন ছবিতে এর চেয়ে বড় কেরামতি দেখে তারা অভ্যস্ত, বেশির ভাগ সময়ই গুরুগম্ভীর চোখে হজম করে বাচ্চারা। ভয়ে যদি মিশার চোখ মার্বেলের মতো বেরিয়ে আসত, আর সেটা যদি হলিউড থেকে প্রশিক্ষিত [!] পরিচালক দেখাতে পারতেন, তবুও রক্ষা ছিল। আসল কথা হচ্ছে, এ ছবিতে এই অযাচিত টেকনোলজির কোনো দরকারই ছিল না। এগুলো ছাড়াই বেশ এন্টারটেইনিং মুভি 'কিং খান'। চিত্রনাট্য, সংলাপে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। 'অধিক সন্ন্যাসে গাঁজন নষ্ট' বলে একটা প্রবাদ আছে বাংলায়। এই ছবির বেলায় প্রবাদ বাক্যটা একেবারে পারফেক্ট।
শাকিব একজন মোটর মেকানিক। অন্য আর আট-দশটা ছবিতে যেমন হয় আর কি। একদিন নষ্ট গাড়ি নিয়ে অপু এলেন গ্যারেজে। শাকিবের গ্যারেজ-কর্মী কাবিলা বললেন, 'ওস্তাদ, এক খান আইটেম আইছে'। শাকিব না তাকিয়েই বললেন, 'বডি কেমন?' 'হেডলাইট কেমন?' 'বাম্পার কেমন?' কাবিলা অপুর শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গের বর্ণনা ধারাবাহিকভাবে দিলেন একেবারে মেকানিক ভাষায়। এবার বুঝুন, কেমন করিৎকর্মা মেকানিক শাকিব। যিনি গাড়ির ইঞ্জিনের খবর না নিয়ে হেডলাইট আর বাম্পার নিয়ে পড়ে থাকেন! ঠগ, প্রতারক মিশা সওদাগর হলেন কিং খান। বিশাল ধন-সম্পত্তির মালিক। মিমোর সঙ্গে একদিন উকিল কাজী হায়াতের কাছে গিয়ে রাকেশরূপী শাকিব একটা ফাইলে তাঁর ছোটবেলার ছবি দেখে জানলেন তিনিই আসল কিং খান। ছোটবেলায় বাড়ির চাকরের সঙ্গে আঁতাত করে মিশার বাবা সাদেক বাচ্চু খুন করেছিলেন শাকিবের মা সুচরিতাকে। খুনের অপরাধে শাকিবের সৎ-বাবা উজ্জ্বলকে হাজতবাস করতে হয়। ওই সময় সাদেক বাচ্চু কাপড়ের ট্র্যাংকে ভরে ছোট্ট শাকিবকে ব্রিজের ওপর থেকে নদীতে ফেলে দেন। আর্কিমিডিসের সূত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ট্র্যাংকটি নদীতে ভেসে ভেসে মধ্যরাতে হাজির হলো এতিমখানার এক হুজুরের কাছে। হুজুর 'কিং খান'-এর নাম দিলেন রাকেশ। গল্প যখন জমে উঠবে, ঠিক তখনই বেলুনের হাওয়া বেরিয়ে গেল। অর্থাৎ চিত্রনাট্যের গতি থেমে গেল। শাকিব মামলা করা মাত্রই আদালত মিশাকে নোটিশ দিল বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার। পরাক্রমশালী মিশা [অন্তত গল্পে তাঁকে যেভাবে দেখানো হয়েছে] লেজ তুলে পালালেন। মোটর মেকানিক এক দিনের নোটিশে স্যুট-টাই পরে 'ফিল্মি বড়লোক' হয়ে গেলেন! অবশেষে নায়ককে ভিলেনের গোডাউনে যেতে হলো, অর্থাৎ ছবির শেষ দৃশ্য। উজ্জ্বল, অপুদের দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে মিশা দুটি কম্পিউটার নিয়ে বসেছেন। শাকিবের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে মিশা বললেন, অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তাঁর অ্যাকাউন্টে ৪০ কোটি টাকার [এফডিআর] ট্রান্সফার করতে। এই হলো আধুনিক পরিচালকের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার! অথচ, এটা বুঝলেন না, ফিঙ্ড ডিপোজিটের টাকা অনলাইনে ট্রান্সফার করার কোনো সিস্টেমই নাই!
ছবির দুই নায়িকা। দুজনকেই অলংকার বানিয়ে রাখলেন পরিচালক। এ দুটি চরিত্র না থাকলে ছবির মূল গল্পের খুব একটা হেরফের হতো না। তবে অপুর চাইতে মিমোর চরিত্রের দৈর্ঘ্য বেশ বড়। অপু খুবই সাবলীল অভিনয় করেছেন। নতুন হিসেবে মিমো ভালোই করেছেন। পরিচালকের অঙ্গুলি হেলনে তাঁকে অকালেই প্রাণ হারাতে হলো। তাও আবার পুলিশের গুলিতে। ১০ হাত দূরে থাকা আসামিকে পুলিশ কোমরে গুলি করেন কোন যুক্তিতে! শাকিবকে এই ছবিতে ফর্মে পাওয়া যায়নি। দুটি গান ভালো। একটি গানের কথা এবং সুর কিছুই বোঝা যায়নি। উজ্জ্বল এবং মিশা সওদাগরের মেকআপ দৃষ্টিকটূ। অ্যাকশন দৃশ্যের শব্দ এখনো আদিম যুগের।
গল্পে প্রত্যেকটি চরিত্রের প্রবেশ বেশ আকর্ষণীয়। বিরতির আগ পর্যন্ত চিত্রনাট্য বেশ টান টান। পরিচালকের মুখে যতই হলিউডের গুণগান শোনা যাক না কেন, নির্মাণে তিনি অন্ধের মতো দক্ষিণ ভারতীয় রীতি ফলো করেছেন। চরিত্রবিন্যাস থেকে শুরু করে চিত্রায়ণ, সব কিছুতেই দক্ষিণী ছাপ। পরিচালকের আগের ছবিগুলোর যা রেকর্ড, তাতে এ ছবির দিকে অভিযোগের আঙুল তুললে দোষের হবে কি?

No comments

Powered by Blogger.