কেমন আছ মা-৪০ বছর পর সনদ পেয়েছি ৯ হাজার টাকা দিয়ে-তীর্থবাসিনী শিকদার
বিজয়ের ৪০ বছর পূর্ণ হচ্ছে এই ডিসেম্বরে। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের মায়েরা কেমন আছেন, তা নিয়েই ধারাবাহিক এই আয়োজনআমার চার ছেলের মধ্যে অধীর শিকদার ছিল সবার বড়। আমার স্বামী দয়াল শিকদার পেশায় ছিলেন একজন মৎস্যজীবী। জমিজমা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। অনেক কষ্টে অধীরকে আইএ (এইচএসসি) পাস করিয়েছিলাম। সেই যোগ্যতা দিয়ে সে ঢাকায় একটি অফিসে সার্ভেয়ার পদে চাকরি করত।
১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, একদিন রাতে বাড়িতে এসে জানাল, ঢাকায় থাকার মতো অবস্থা নেই। মৌলভিরা যুবকদের ধরে নিয়ে রাজাকারে নাম লেখাচ্ছে। জীবন থাকতে রাজাকারে নাম লেখানো যাবে না। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে হবে। এ জন্য প্রশিক্ষণ নিতে ভারত যাবে।
ওর কথা শুনে আমি অনেক কান্নাকাটি করলাম; যেহেতু সে-ই আমার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও শিক্ষিত। এ ছাড়া তার উপার্জনেই সংসারের খরচ চলছে। এ কারণে তাকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বললাম। কিন্তু চারদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত হতে দেখে একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যায় অধীর। ওর বয়স তখন ২৫ কি ২৬ বছর। প্রশিক্ষণ নিয়ে আমাদের গ্রামে (মাগুরা সদর উপজেলার হাজিপুর) নিজেই একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলে। ওই সময় আমাদের এলাকায় বন্যা ছিল। চারদিকে থৈ থৈ পানি। অধীর মাঝেমধ্যে রাতের অন্ধকারে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করত।
নভেম্বরের শেষের দিকে হঠাৎ এক রাতে আমাদের সিংরোর বিলের পাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে সে উঠানে এসে আস্তে করে আমাকে ডেকে ওঠায়। আমি আলো জ্বালাতে গেলে আমাকে আলো জ্বালাতে দেয়নি। কারণ আলো জ্বলতে দেখলে রাজাকাররা পাকিস্তানি আর্মিদের নিয়ে বাড়ি ঘিরে ফেলবে। যে কারণে সেদিন অধীরের মুখ আমি দেখতে পাইনি। তবে খুব ভালো করে মনে আছে, আমাদের বাড়ির পূর্বদিকের ঘরের যে কক্ষে সে থাকত সেই কক্ষের বইয়ের তাকের নিচে দাঁড়িয়ে সে আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলল। সে সময় সে জানিয়েছিল_খুব তাড়াতাড়ি দেশ স্বাধীন হবে। আমি যেন তার বাবা ও ভাইদের সাবধানে রাখি। যাওয়ার সময় বাড়ির কাছের একটি গাবগাছের তলা থেকে হঠাৎ কী মনে করে অধীর ফিরে এল। আমাকে বলল_'দশটা টাকা দিতে পারবা মা?' আমি এতই হতভাগী, সেদিন ওকে দশটি টাকা দিতে পারিনি। কারণ আমাদের কাছে সে সময় কোনো টাকা ছিল না। আমি বুঝিনি সেই দেখাই শেষ দেখা হবে। তবে যাওয়ার সময় সে আমাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে গিয়েছিল। তার যাওয়ার দুই দিন পরেই ২৬ নভেম্বর সকালে আমাদের গ্রামের তজিবর এসে খবর দিল, ঝিনাইদহের শৈলকুপার কামান্নায় আরো ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে শহীদ হয়েছে আমার ছেলে অধীর। কোদালিয়া গ্রামের রাজাকার কমান্ডার সালাম কাজিসহ আরো অনেকের সহযোগিতায় ওই দিন ভোররাতে কামান্না গ্রামের মাধবকুণ্ডের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করে। আমি আমার ছেলের লাশটা পর্যন্ত দেখতে পারিনি। কারণ আমাদের এলাকার রাজাকাররা তখনো আমাদের অবরোধ করে রেখেছিল। দুই দিন পর আমার স্বামী, দুই ছেলে সুধির ও মোহন কামান্নায় গিয়ে অধীরদের কবর দেখে এসেছে।
ওদের মুখে শুনেছি, ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর গভীর রাতে অধীরসহ মাগুরার একদল মুক্তিযোদ্ধা পাশের শৈলকুপা উপজেলার কামান্না গ্রামে গিয়ে রাত যাপনের জন্য মাধবকুণ্ডু নামের ওই ব্যক্তির বাড়ির পরিত্যক্ত একটি টিনের ঘরে অবস্থান নেয়। তাদের এ অবস্থানের খবর স্থানীয় রাজাকাররা শৈলকুপা ও মাগুরায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে পেঁৗছে দেয়। খবর পেয়ে রাজাকার, আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় শৈলকুপা ও মাগুরা থেকে আসা পাকিস্তানি সেনারা ওই রাতে তাদের ওপর অতর্কিতে গুলি চালায়। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে ঘটনাস্থলেই অধীরসহ আলমগীর হোসেন, আলী হোসেন, কাদের, মোমিন, সলেমান, ওয়াহেদ, আজিজ, আকবর, রিয়াদ, শরীফুল, আলিউজ্জামান, মনিরুজ্জামান, মাছিম, রাজ্জাক, শহিদুল, আবদুর রাজ্জাক, কাওছার, সালেক, সেলিম, মতলেব, হোসেন আলী, খন্দকার রাশেদ, গোলজার, তাজুল ইসলাম, আনিসুর, গৌর ও অজ্ঞাত পরিচয়ের একজন_এই ২৮ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। তাদের অনেকেরই বাড়ি আমাদের গ্রামে।
পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা এলাকাবাসীর সহায়তায় কামান্না স্কুল মাঠের পাশে নদীর তীরে পাঁচটি গণকবরে তাদের সমাহিত করে। প্রতিবছর ২৬ নভেম্বর ওই দিনটিকে কামান্না দিবস হিসেবে ধরে আমাদের হাজিপুরে আলোচনা সভা ও মিলাদের আয়োজন করে মক্তিযোদ্ধারা। শহীদমাতা হিসেবে আমাদের ডেকে নিয়ে কোনো বছর একটি শাড়ি, কোনো বছর দুই-এক শ টাকা দেয়।
আজ স্বাধীনতার ৪০ বছর পার হয়েছে। আমি সরকারের কাছ থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর ২৭ হাজার টাকা ভাতা পাই; যার এক ভাগ আমি রাখি, অন্য দুই ভাগ বর্তমানে বেঁচে থাকা দুই ছেলে সুধির ও মোহনকে ভাগ করে দিই। আমার ছোট ছেলে মোহন পুলিশের সামান্য চাকরি করে। তাই দিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছে। আর মেজ ছেলে সুধির একেবারেই দরিদ্র অবস্থায় আছে। বাবার মতো বিল থেকে মাছ মেরে যা পায় তার সঙ্গে আমার দেওয়া তিন হাজার টাকা মিলিয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছে। ওদের দুই ভাইয়ের আলাদা সংসার। আমি কখনো সুধিরের সঙ্গে কখনো মোহনের সঙ্গে খাই। এই ভাতা ছাড়া আমাদের আর কোনো সম্বল নেই। চাষাবাদযোগ্য কোনো জমি নেই। বিলের মধ্যে অল্প একটু যে জমি আছে তা বেশির ভাগ সময় পানিতে তলিয়ে থাকে।
স্বাধীনতার পর থেকেই শুনছি, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য বাড়িঘর করে দেবে সরকার। ছেলেমেয়েদের চাকরি দেবে। আরো কত কিছু দেবে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আমার ছেলে অধীরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য আমার অন্য ছেলেরা ৪০ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও অফিসে ধরনা দিয়েছে। অবশেষে ৪০ বছর পর গত ৫ জুন মন্ত্রণালয় থেকে এই সনদ পেয়েছি। ছেলেদের কাছে শুনেছি, এ সার্টিফিকেট নিতে নাকি ৯ হাজার টাকা অফিস খরচ দিতে হয়েছে। রেখে দিয়েছি যদি আমার বংশের অন্য কেউ শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে কোনো সুযোগ-সুবিধা পায়। আমি তো এখন জীবনের শেষভাগে। বর্তমানে বয়স আশি বছরের বেশি। আমার স্বামী মারা গেছেন ২০০৪ সালে। আমি মারা গেলে আমার পরিবারের আর কেউ আমার ছেলের জন্য সরকারের দেওয়া ভাতা পাবে না। তখন আমার অন্য ছেলেদের কী হবে?
সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন আমার প্রতিবেশী কামান্নার যুদ্ধে শহীদ আমার ছেলের সহযোদ্ধা গৌরের পরিবারকে দেখি। যত দিন গৌরের মা বেঁচে ছিল, তত দিন সরকার থেকে পাওয়া কিছু ভাতা দিয়ে অন্য দুই ভাই কোনো রকমে জীবন যাপন করেছে। এখন গৌরের মা মারা যাওয়ায় সেই ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার ছেলেরা যা হোক বিভিন্ন অফিসে ঘুরে ঘুরে টাকার বিনিময়ে একটা সনদ জোগাড় করেছে, কিন্তু ওদের ভাগ্যে সেই সনদ পর্যন্ত জোটেনি। গৌরের ভাইদের দিন এখন চলে অত্যন্ত কষ্টে। কেননা দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী। অন্যজন দিনমজুর। যে কারণে এমনও দিন যায় যেদিন ওদের তিন বেলা খাবার জোটে না। এ কারণে আমি মনে করি সরকারের উচিত প্রতিটি শহীদ পরিবারের জন্য আজীবন সহযোগিতার ব্যবস্থা রাখা।
তীর্থবাসিনী শিকদার : মাগুরা সদর উপজেলার হাজিপুর গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অধীর শিকদারের মা। বয়স : ৮২ বছর।
অনুলিখন : শামীম খান (মাগুরা প্রতিনিধি)
ওর কথা শুনে আমি অনেক কান্নাকাটি করলাম; যেহেতু সে-ই আমার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও শিক্ষিত। এ ছাড়া তার উপার্জনেই সংসারের খরচ চলছে। এ কারণে তাকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বললাম। কিন্তু চারদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত হতে দেখে একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যায় অধীর। ওর বয়স তখন ২৫ কি ২৬ বছর। প্রশিক্ষণ নিয়ে আমাদের গ্রামে (মাগুরা সদর উপজেলার হাজিপুর) নিজেই একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলে। ওই সময় আমাদের এলাকায় বন্যা ছিল। চারদিকে থৈ থৈ পানি। অধীর মাঝেমধ্যে রাতের অন্ধকারে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করত।
নভেম্বরের শেষের দিকে হঠাৎ এক রাতে আমাদের সিংরোর বিলের পাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে সে উঠানে এসে আস্তে করে আমাকে ডেকে ওঠায়। আমি আলো জ্বালাতে গেলে আমাকে আলো জ্বালাতে দেয়নি। কারণ আলো জ্বলতে দেখলে রাজাকাররা পাকিস্তানি আর্মিদের নিয়ে বাড়ি ঘিরে ফেলবে। যে কারণে সেদিন অধীরের মুখ আমি দেখতে পাইনি। তবে খুব ভালো করে মনে আছে, আমাদের বাড়ির পূর্বদিকের ঘরের যে কক্ষে সে থাকত সেই কক্ষের বইয়ের তাকের নিচে দাঁড়িয়ে সে আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলল। সে সময় সে জানিয়েছিল_খুব তাড়াতাড়ি দেশ স্বাধীন হবে। আমি যেন তার বাবা ও ভাইদের সাবধানে রাখি। যাওয়ার সময় বাড়ির কাছের একটি গাবগাছের তলা থেকে হঠাৎ কী মনে করে অধীর ফিরে এল। আমাকে বলল_'দশটা টাকা দিতে পারবা মা?' আমি এতই হতভাগী, সেদিন ওকে দশটি টাকা দিতে পারিনি। কারণ আমাদের কাছে সে সময় কোনো টাকা ছিল না। আমি বুঝিনি সেই দেখাই শেষ দেখা হবে। তবে যাওয়ার সময় সে আমাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে গিয়েছিল। তার যাওয়ার দুই দিন পরেই ২৬ নভেম্বর সকালে আমাদের গ্রামের তজিবর এসে খবর দিল, ঝিনাইদহের শৈলকুপার কামান্নায় আরো ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে শহীদ হয়েছে আমার ছেলে অধীর। কোদালিয়া গ্রামের রাজাকার কমান্ডার সালাম কাজিসহ আরো অনেকের সহযোগিতায় ওই দিন ভোররাতে কামান্না গ্রামের মাধবকুণ্ডের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করে। আমি আমার ছেলের লাশটা পর্যন্ত দেখতে পারিনি। কারণ আমাদের এলাকার রাজাকাররা তখনো আমাদের অবরোধ করে রেখেছিল। দুই দিন পর আমার স্বামী, দুই ছেলে সুধির ও মোহন কামান্নায় গিয়ে অধীরদের কবর দেখে এসেছে।
ওদের মুখে শুনেছি, ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর গভীর রাতে অধীরসহ মাগুরার একদল মুক্তিযোদ্ধা পাশের শৈলকুপা উপজেলার কামান্না গ্রামে গিয়ে রাত যাপনের জন্য মাধবকুণ্ডু নামের ওই ব্যক্তির বাড়ির পরিত্যক্ত একটি টিনের ঘরে অবস্থান নেয়। তাদের এ অবস্থানের খবর স্থানীয় রাজাকাররা শৈলকুপা ও মাগুরায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে পেঁৗছে দেয়। খবর পেয়ে রাজাকার, আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় শৈলকুপা ও মাগুরা থেকে আসা পাকিস্তানি সেনারা ওই রাতে তাদের ওপর অতর্কিতে গুলি চালায়। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে ঘটনাস্থলেই অধীরসহ আলমগীর হোসেন, আলী হোসেন, কাদের, মোমিন, সলেমান, ওয়াহেদ, আজিজ, আকবর, রিয়াদ, শরীফুল, আলিউজ্জামান, মনিরুজ্জামান, মাছিম, রাজ্জাক, শহিদুল, আবদুর রাজ্জাক, কাওছার, সালেক, সেলিম, মতলেব, হোসেন আলী, খন্দকার রাশেদ, গোলজার, তাজুল ইসলাম, আনিসুর, গৌর ও অজ্ঞাত পরিচয়ের একজন_এই ২৮ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। তাদের অনেকেরই বাড়ি আমাদের গ্রামে।
পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা এলাকাবাসীর সহায়তায় কামান্না স্কুল মাঠের পাশে নদীর তীরে পাঁচটি গণকবরে তাদের সমাহিত করে। প্রতিবছর ২৬ নভেম্বর ওই দিনটিকে কামান্না দিবস হিসেবে ধরে আমাদের হাজিপুরে আলোচনা সভা ও মিলাদের আয়োজন করে মক্তিযোদ্ধারা। শহীদমাতা হিসেবে আমাদের ডেকে নিয়ে কোনো বছর একটি শাড়ি, কোনো বছর দুই-এক শ টাকা দেয়।
আজ স্বাধীনতার ৪০ বছর পার হয়েছে। আমি সরকারের কাছ থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর ২৭ হাজার টাকা ভাতা পাই; যার এক ভাগ আমি রাখি, অন্য দুই ভাগ বর্তমানে বেঁচে থাকা দুই ছেলে সুধির ও মোহনকে ভাগ করে দিই। আমার ছোট ছেলে মোহন পুলিশের সামান্য চাকরি করে। তাই দিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছে। আর মেজ ছেলে সুধির একেবারেই দরিদ্র অবস্থায় আছে। বাবার মতো বিল থেকে মাছ মেরে যা পায় তার সঙ্গে আমার দেওয়া তিন হাজার টাকা মিলিয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছে। ওদের দুই ভাইয়ের আলাদা সংসার। আমি কখনো সুধিরের সঙ্গে কখনো মোহনের সঙ্গে খাই। এই ভাতা ছাড়া আমাদের আর কোনো সম্বল নেই। চাষাবাদযোগ্য কোনো জমি নেই। বিলের মধ্যে অল্প একটু যে জমি আছে তা বেশির ভাগ সময় পানিতে তলিয়ে থাকে।
স্বাধীনতার পর থেকেই শুনছি, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য বাড়িঘর করে দেবে সরকার। ছেলেমেয়েদের চাকরি দেবে। আরো কত কিছু দেবে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আমার ছেলে অধীরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য আমার অন্য ছেলেরা ৪০ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও অফিসে ধরনা দিয়েছে। অবশেষে ৪০ বছর পর গত ৫ জুন মন্ত্রণালয় থেকে এই সনদ পেয়েছি। ছেলেদের কাছে শুনেছি, এ সার্টিফিকেট নিতে নাকি ৯ হাজার টাকা অফিস খরচ দিতে হয়েছে। রেখে দিয়েছি যদি আমার বংশের অন্য কেউ শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে কোনো সুযোগ-সুবিধা পায়। আমি তো এখন জীবনের শেষভাগে। বর্তমানে বয়স আশি বছরের বেশি। আমার স্বামী মারা গেছেন ২০০৪ সালে। আমি মারা গেলে আমার পরিবারের আর কেউ আমার ছেলের জন্য সরকারের দেওয়া ভাতা পাবে না। তখন আমার অন্য ছেলেদের কী হবে?
সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন আমার প্রতিবেশী কামান্নার যুদ্ধে শহীদ আমার ছেলের সহযোদ্ধা গৌরের পরিবারকে দেখি। যত দিন গৌরের মা বেঁচে ছিল, তত দিন সরকার থেকে পাওয়া কিছু ভাতা দিয়ে অন্য দুই ভাই কোনো রকমে জীবন যাপন করেছে। এখন গৌরের মা মারা যাওয়ায় সেই ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার ছেলেরা যা হোক বিভিন্ন অফিসে ঘুরে ঘুরে টাকার বিনিময়ে একটা সনদ জোগাড় করেছে, কিন্তু ওদের ভাগ্যে সেই সনদ পর্যন্ত জোটেনি। গৌরের ভাইদের দিন এখন চলে অত্যন্ত কষ্টে। কেননা দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী। অন্যজন দিনমজুর। যে কারণে এমনও দিন যায় যেদিন ওদের তিন বেলা খাবার জোটে না। এ কারণে আমি মনে করি সরকারের উচিত প্রতিটি শহীদ পরিবারের জন্য আজীবন সহযোগিতার ব্যবস্থা রাখা।
তীর্থবাসিনী শিকদার : মাগুরা সদর উপজেলার হাজিপুর গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অধীর শিকদারের মা। বয়স : ৮২ বছর।
অনুলিখন : শামীম খান (মাগুরা প্রতিনিধি)
No comments