কণ্ঠস্বর-চাই সত্যের উদ্ঘাটন by রাহাত খান
রোডমার্চের নামে এই গাড়ি প্রদর্শনী নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে বিএনপির রাজনৈতিক আন্তরিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠা বিচিত্র নয়। বিষয়টি রোডমার্চ হলে নেত্রী খালেদা জিয়া এবং তার দলের গুটিকয়েক বয়স্ক ও অসুস্থ লোকের জন্য কয়েকটি গাড়ি থাকতেই পারে। কিন্তু কয়েক হাজার গাড়ি নিয়ে রাজনীতির নামে ওই মোটর প্রদর্শনী কতটা কাম্য ও রাজনীতিসুলভ_ তা প্রশ্নাতীত নয়
প্রথমেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পদে বৃত হওয়ার জন্য ওবায়দুল কাদের, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং ড. হাছান মাহমুদকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে লেখাটি শুরু করছি।
দেশে এখন শীর্ষ আলোচনায় রয়েছে তিনটি ইস্যু। এক. খুলনাগামী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার রোডমার্চ; দুই. ভারতে সিলেটের অনতিদূরে টিপাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রসঙ্গ; তিন. ঐতিহ্যবাহী ঢাকা নগরীকে দু'ভাগে বিভক্ত করার সরকারি পদক্ষেপ। এ তিনটি প্রসঙ্গেই দেশের সুশীল সমাজ, রাজনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা সভা-সমিতি ও সংবাদপত্রে বিবৃতি, আলোচনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তাদের ধ্যান-ধারণা ব্যক্ত করে চলেছেন। প্রথমে বলে নিই, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাকার ক্ষতিকর রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে সরে এসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কল্যাণকর ও শুভ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বিএনপি। হরতাল ইত্যাদির বিকল্প হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে রোডমার্চ ও দেশের নানা স্থানে শান্তিপূর্ণ গণসংযোগ। অতীতের বিএনপি-আওয়ামী লীগের রাজনীতির চেয়ে রোডমার্চ ও গণসংযোগের রাজনীতি সর্বাংশেই অত্যন্ত ইতিবাচক। বিএনপি নেতৃত্ব এবং বিএনপি রাজনীতির কর্ণধার খালেদা জিয়াকে এ জন্য প্রশংসা ও সাধুবাদ জানাই। গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটি ইতিবাচক পন্থা অবলম্বনে বাংলাদেশে তারা একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
রোডমার্চ বিএনপির রাজনীতিকে জনগণের সঙ্গে গাঢ় সংযোগ স্থাপনে এবং ক্ষমতাসীন সরকারের 'সীমাহীন' ব্যর্থতা জনগণের কাছে তুলে ধরার একটি অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তবে বিএনপির রোডমার্চ বহুলাংশে কার শো বা গাড়ি প্রদর্শনী হয়ে দাঁড়াচ্ছে কি-না এই প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়েছে ইতিমধ্যেই। গত ২৬ নভেম্বর খুলনাগামী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার রোডমার্চের একটি ছবি ছাপা হয়েছে ইংরেজি ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায়। ছবিতে দেখা যায়, রোডমার্চে সামান্যসংখ্যক লোক এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তবে রাস্তাজুড়েই গাড়ি আর গাড়ি। গাড়ির বহরে বেশিরভাগ দামি জিপ কিংবা মাইক্রোবাস। রোডমার্চের নামে এই গাড়ি প্রদর্শনী নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে বিএনপির রাজনৈতিক আন্তরিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠা বিচিত্র নয়। বিষয়টি রোডমার্চ হলে নেত্রী খালেদা জিয়া এবং তার দলের গুটিকয়েক বয়স্ক ও অসুস্থ লোকের জন্য কয়েকটি গাড়ি থাকতেই পারে। কিন্তু কয়েক হাজার গাড়ি নিয়ে রাজনীতির নামে ওই মোটর প্রদর্শনী কতটা কাম্য ও রাজনীতিসুলভ_ তা প্রশ্নাতীত নয় বলে অনেকে মনে করেন।
প্রতিবেশী ভারতে বিজেপি নেতা এল কে আদভানি সম্প্রতি গণসংযোগমূলক একটি লোকযাত্রা সম্পন্ন করেছেন। গেছেন তিনি ভারতের বহু স্থানে। কিন্তু রথের মতো একটি মাত্র বাহন ছাড়া তার লোকযাত্রায় আর কোনো গাড়ি দেখা যায়নি। আদভানির বয়স এখন ৮৪ বছর। গণসংযোগে নেমে একটি বাহন তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে ব্যবহার করতেই পারেন, সেটাই তিনি করেছেন। দেশের সব লোককে লোকযাত্রায় শামিল করার চেষ্টা তিনি করেননি। একেক জায়গায় কিছু লোক লোকযাত্রা অভিযান থেকে সরে গেছে, আবার সেই জায়গা থেকে কিছু লোক আদভানির মিছিলে যোগ দিয়েছে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তার সার্বক্ষণিক মিছিলটি বরাবর বেশ বড়ই ছিল।
অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, রোডমার্চের নামে মোটর-জিপ গাড়ির প্রদর্শনী রাজনীতিতে পেশিশক্তিরই যেন নামান্তর। শত শত মোটরসাইকেল ও গাড়ির বহর নিয়ে নেতানেত্রীকে গন্তব্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিচিত্র পন্থা বের করার কৃতিত্ব অবশ্য বিএনপিরই এবং বিএনপির যুবদল ও ছাত্রদলের সোনার ছেলেরাই বিএনপির ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'হোন্ডা-গুণ্ডা' পন্থার আবিষ্কর্তা ও প্রয়োগকারী হিসেবে পরিগণিত। রোডমার্চের নামে খালেদা জিয়ার কার-জিপবহরের বিশাল প্রদর্শনী সেই 'হোন্ডা-গুণ্ডা'র বিষয়টিই যেন মনে করিয়ে দেয়।
খুলনায় খালেদা জিয়া বিশাল জনসভা করেছেন। দেশের রাজনীতিসচেতন মানুষ রাজনীতিতে সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চান বৈকি। সেই হিসাবে বিএনপি এবং খালেদা জিয়া যে দেশের আরেক বড় দল আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দিতে চেষ্টা করবেন, সেটা খুবই সঙ্গত এবং স্বাভাবিক। দেশের ইতিবাচক রাজনীতির ক্ষেত্রেও সেটা একটা কাম্য বিষয়। তবে সত্যের খাতিরে বলতে হয়, বিশাল জনসভা সবসময়ই বিশাল জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য দেয় না। কথাটা আওয়ামী লীগ-বিএনপি, জাতীয় পার্টি ইত্যাদি সব দলের জন্যই প্রযোজ্য। রাজনৈতিক নেতারা দেশটা কীভাবে চালাবেন তা জানতেই রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যায় সর্বস্তরের লোকজন। সে ক্ষেত্রে বড় নেতানেত্রীর জনসভা তো বিশাল বা সমুদ্র-বিশাল হয়ে উঠতেই পারে। তবে রাজনীতিবিদরা যেন দয়া করে মনে রাখেন, শুধু ক্রোধ জাহির করলে কিংবা জনগণকে বড় বড় আশ্বাস দিলে অথবা সরকার সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ বললেই জনগণ তা গ্রহণ বা বিশ্বাস করবে না! যিনি বা যারা এসব কথা বলছেন শাসন-ক্ষমতায় থাকার সময় জনগণের জন্য তারা কী করেছেন আর নিজের জন্য, নিজের আত্মজের জন্য, আত্মীয়স্বজন এবং দলের লোকদের আখের গোছানোর জন্য ক্ষমতার কতটা অপব্যবহার তারা করেছেন এসব প্রশ্নও কিন্তু জনগণ মনে মনে পোষণ করে। শুধু গর্জন করলেই বর্ষণ হয় না। বিএনপি এবং খালেদা জিয়ার নিজেদের স্বার্থেই কথাগুলো স্মরণ রাখা উচিত।
বেশিদিন তো নয়, মাত্র তিন বছর আগে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় ছিল। এই ক'বছরে হাওয়া ভবনের কথা কিন্তু লোকে ভুলে যায়নি। ভুলে যায়নি জঙ্গি উত্থানের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দানের কথা। বাংলাভাই, শায়খ আবদুর রহমান গং তো গত জোট সরকারেরই সৃষ্টি। বিদেশি শক্তির চাপে শায়খ আবদুর রহমান, বাংলাভাইসহ ৬ জঙ্গিকে ফাঁসি দিতে বিএনপি জোট সরকার বাধ্য হয়েছিল বটে। তবে এরপরও সেই আমলে গোপনে ও প্রকাশ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গি উত্থান থেমে থাকেনি। লস্কর-ই-তৈয়বা, হুজি, জয়শ-ই-মোহাম্মদ প্রভৃতি বিদেশি জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশে তাদের শিকড় তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে নির্ভয়ে এবং নির্বিবাদে। জঙ্গি নেতারা বাংলাদেশে নির্ভয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে। দুবাইয়ে সন্ত্রাসী নেতা দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে প্রকাশ্যে বৈঠক হয়েছিল কার? এরপরও বিএনপি স্বপ্ন দেখে জঙ্গি উত্থান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, শামস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টার, মঞ্জুরুল ইমাম প্রমুখের হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারী বলে কথিত সেই নেপথ্য খলনায়ক হবেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী! বাংলাদেশে ভেড়া-ছাগল নয়, মানুষ বাস করে।
মনে হতেই পারে বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে বড় বেশি রূঢ় ও কঠোর-কঠিন কথা বলছি! কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, যারা সত্যের পক্ষে তারা আমার এই উপস্থাপনাকে সত্য বলেই গ্রহণ করবেন। সুশীল সমাজও নিশ্চয় মাত্র তিন বছর আগের বিএনপি-জামায়াতের জঙ্গি উত্থানে পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথেচ্ছ লুটপাট, হাজার হাজার কোটি ডলার বিদেশে পাচার, পিএসসি, ইসি, বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্র, দুর্নীতি দমন কমিশন প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দলীয়করণের কথা ভুলে যায়নি। ভুলে যাওয়া উচিত নয়, বিএনপি ১৯৯১-১৯৯৬ পর্বে একবার এবং জামায়াতকে নিয়ে ২০০১-২০০৬ সময় পর্বে দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় গিয়ে দুই আমলেই এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎও উৎপাদন করেনি। ভাবতে ইচ্ছা হয়, এটা কি ইচ্ছাকৃত? তা নইলে এমনটা হয় কেন এবং কীভাবে? গরিব, উন্নয়নশীল দেশে উন্নয়নের প্রথম শর্ত বিদ্যুৎ। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ বা অবহেলিত করে রাখার অর্থ দেশকে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে নিক্ষেপ করা তথা ব্যর্থ রাষ্ট্র বা ফেইলড স্টেট হওয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া। দু'বারই কেন বিএনপি এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা নেয়নি_ এই রহস্যপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেশবাসীকে বিএনপির দেওয়া উচিত রাজনৈতিক স্বচ্ছতার কারণে। বর্তমান সরকারকে 'সর্বক্ষেত্রে' ব্যর্থ বলার আগে আরও কিছু প্রশ্নের ব্যাখ্যা হওয়া নিতান্তই দরকার। জবাব দিতে হবে, বিগত আমলে দেশকে দুর্নীতির স্বর্গ করে তোলা হয়েছিল কি-না? জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটানো ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছিল কি-না। আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা, বিদ্যুৎ উৎপাদন একেবারেই বন্ধ করে 'খাম্বা' শিল্পের প্রসার ঘটানো_ এগুলোই-বা কেন এবং কিসের কারণে? কাউকে গালমন্দ ও ব্যর্থ বলার আগে বিএনপি এবং দলীয়প্রধান খালেদা জিয়ার উচিত তার রোডমার্চ এবং অন্যান্য জনসভায় এসব প্রশ্ন ও অভিযোগের জবাব দেওয়া। তাহলে বুঝব খালেদা জিয়া জনগণকে মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছেন না। তাহলে বুঝব, জঙ্গি উত্থানে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে এবং বাংলাদেশকে জামায়াতের কাঙ্ক্ষিত দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করার গোপন অভিলাষ তাদের নেই। ছিল না কোনোদিন।
আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা অবশ্যই আছে। রাস্তাঘাটের মেরামতকে এখন পর্যন্ত তারা ততটা গুরুত্ব দেয়নি। ভুক্তভোগী মানুষ এই ব্যর্থতা নিয়ে বলাবলি করে। আওয়ামী লীগের গ্রামকেন্দ্রিক বহু সাফল্য এই বলাবলির মধ্যে ম্লান হয়ে যায়। ঢাকার উড়াল সেতু, মেট্রো রেল এবং প্রশাসন ও অন্যান্য স্তরে বিরাজমান দুর্নীতি রোধের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাও বলতে গেলে নেওয়া হয়নি। দুদক দুর্নীতি দমনে বিএনপি আমলের মতোই দুর্বল এবং অকার্যকর। এ ছাড়া শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে না পারা_ এসবই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা বৈকি।
তবে এরপরও গত তিন বছরে মহাজোট সরকারের সাফল্য মোটেও তুচ্ছ নয়। আগের আমলে সৃষ্ট পাহাড়-প্রমাণ বিদ্যুৎ সংকটের সুরাহা তারা অনেকটা করে ফেলেছে। ২০১৪ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বাংশে না হলেও বহুলাংশে তারা যে সফল হবে অনেকের মতো আমিও সেটা বিশ্বাস করি। দেশ শাসনে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সেরা সাফল্য দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। আইন লঙ্ঘনকারী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ কিংবা ছাত্রলীগের হলেও তাকে বা তাদের সবাইকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনের হাতে সোপর্দ হতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনমনীয় ও আপসহীন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দুই স্বৈরশাসক ও বিএনপি শাসক দলের আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে তেমন দেখা যায়নি। বরং বিপরীতটাই দেখা গেছে। ২০০১-০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে বগুড়ার এক লোক চাল কেনা বাবদ রাষ্ট্রের ৪০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিল। আইনের হাতে ওই দলীয় তস্করকে তুলে না দিয়ে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ছেলে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সেই সহযোগীকে ডেকে আনিয়ে সামান্য মৌখিক তিরস্কার করে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই হলো দলীয় লোকের দুর্নীতির বিচার। এ রকম দৃষ্টান্ত চাইলে হাজার হাজার তুলে ধরা যায়।
আওয়ামী লীগের বর্তমান শাসনামলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কাজ যে চলছে, এটা স্বীকার না করে গত্যন্তর নেই। এটা নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের একটি বড় এবং উল্লেখযোগ্য সাফল্য। গ্রামীণ অর্থনীতি আগের যে কোনো আমলের চেয়ে চাঙ্গা। নানা স্থানে রাস্তাঘাটের বেহাল দশা ছাড়া সরকারের বিপক্ষে তাদের তেমন কোনো অভিযোগ নেই। এ ছাড়া শিল্প-বাণিজ্যের সূচকও মোটামুটি ইতিবাচক। রফতানির পরিমাণ বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও বাড়ছে। বাড়ছে কর্মসংস্থানের পরিধি। এসবই বর্তমান সরকারের সাফল্যের মধ্যে পড়ে। স্বাধীনতার পক্ষের একজন সমর্থক এবং হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বলি, আওয়ামী লীগ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য মোটামুটি স্থিতিশীল রাখতে পারলে, শেয়ার মার্কেটে কয়েকজন ব্যবসায়ীর কারসাজি বন্ধ করে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা নিয়ে মার্কেট মোটামুটি স্থিতিশীল রাখতে পারলে, দু'বছরে উড়াল সেতু ও মেট্রো রেল নির্মাণ সম্পন্ন করতে পারলে, পদ্মা সেতুর কাজ অন্তত ৪০ ভাগ সম্পন্ন করতে পারলে কোনো তর্জন-গর্জনই আওয়ামী লীগের পরবর্তী দফায় ক্ষমতায় যাওয়া রোধ করতে পারবে না। মানুষ তো দেখছে, আওয়ামী লীগ দেশের প্রধান সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে_ বিএনপি কিংবা বিএনপি-জামায়াতের আমলে সেই ধরনের কোনো চেষ্টা বা পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
আসা যাক ভিন্ন প্রসঙ্গে। ঢাকাকে প্রশাসনিক সুবিধার্থে ও নাগরিক সাধারণকে অধিক সেবা প্রদানার্থে দুই ভাগে ভাগ করার আইন করেছে বর্তমান সরকার। এতে করে ঢাকার ৪০০ বছরের ঐতিহ্য নষ্ট হয়েছে, সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে, ঢাকা বিভক্তি আইন শুধু সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে পাস করা হয়েছে_ ইত্যাকার মন্তব্য এসেছে রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে। একজন খদ্দরের লুঙ্গি ও খদ্দরের চাদর পরা, আমাদেরই বন্ধু, সুহৃদ এমন কথা বলেছেন_ দুই করপোরেশনে ঢাকা বিভক্তির আইন বিলুপ্ত করা না হলে কঠোর আন্দোলনে যাবেন তিনি সরকারের বিরুদ্ধে।
এসব ক্ষোভের অর্থ আমার ঠিক বোধগম্য হয় না। দুই করপোরেশনে ভাগ হলে শহরের নামটা তো ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই থেকে যাচ্ছে। ঐতিহ্যের ক্ষতিটা হয় কোথায়? স্থানীয় সংসদ নির্বাচনে সংবিধান লঙ্ঘনের যে আশঙ্কা ছিল তা এতদসম্পর্কীয় বিল বা আইন পাস করায় আর নেই। বন্ধু সৈয়দ আবুল মকসুদকে বলি, গান্ধীবাদী হতে চাইছেন, গান্ধী কিন্তু রাগী মানুষ ছিলেন না। গান্ধীবাদী আন্না হাজারের উত্থানও কিন্তু বিরোধী দলের তাঁবেদারি করে হয়নি। সমাজের লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, শোষিত, অনগ্রসর মানুষের ভেতরে বসবাস করে তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সাফল্য অর্জনের মধ্য দিয়ে আন্না হাজারে তার নির্লোভ সমাজদরদি ভাবমূর্তিটি অর্জন করেছেন। আর ঐতিহ্য সময়ের কোনো বিন্দুতে এসে তো শেষ হয়ে যায় না। এটি চলমান, পরিবর্তনশীল এবং সময়ের ধারায় নব নব গৌরব অর্জনকারী একটি বিষয়। ঢাকা শহরকে উত্তর ঢাকা ও দক্ষিণ ঢাকা বললে মাথায় বাজ পড়ার তো কোনো কারণ দেখছি না। এরপর টিপাইমুখ নিয়ে আলোচনা করার কথা। কিন্তু লেখাটা যথেষ্ট লম্বা হয়ে গেছে। বারান্তরে টিপাইমুখ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা রইল।
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
দেশে এখন শীর্ষ আলোচনায় রয়েছে তিনটি ইস্যু। এক. খুলনাগামী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার রোডমার্চ; দুই. ভারতে সিলেটের অনতিদূরে টিপাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রসঙ্গ; তিন. ঐতিহ্যবাহী ঢাকা নগরীকে দু'ভাগে বিভক্ত করার সরকারি পদক্ষেপ। এ তিনটি প্রসঙ্গেই দেশের সুশীল সমাজ, রাজনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা সভা-সমিতি ও সংবাদপত্রে বিবৃতি, আলোচনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তাদের ধ্যান-ধারণা ব্যক্ত করে চলেছেন। প্রথমে বলে নিই, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাকার ক্ষতিকর রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে সরে এসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কল্যাণকর ও শুভ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বিএনপি। হরতাল ইত্যাদির বিকল্প হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে রোডমার্চ ও দেশের নানা স্থানে শান্তিপূর্ণ গণসংযোগ। অতীতের বিএনপি-আওয়ামী লীগের রাজনীতির চেয়ে রোডমার্চ ও গণসংযোগের রাজনীতি সর্বাংশেই অত্যন্ত ইতিবাচক। বিএনপি নেতৃত্ব এবং বিএনপি রাজনীতির কর্ণধার খালেদা জিয়াকে এ জন্য প্রশংসা ও সাধুবাদ জানাই। গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটি ইতিবাচক পন্থা অবলম্বনে বাংলাদেশে তারা একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
রোডমার্চ বিএনপির রাজনীতিকে জনগণের সঙ্গে গাঢ় সংযোগ স্থাপনে এবং ক্ষমতাসীন সরকারের 'সীমাহীন' ব্যর্থতা জনগণের কাছে তুলে ধরার একটি অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তবে বিএনপির রোডমার্চ বহুলাংশে কার শো বা গাড়ি প্রদর্শনী হয়ে দাঁড়াচ্ছে কি-না এই প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়েছে ইতিমধ্যেই। গত ২৬ নভেম্বর খুলনাগামী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার রোডমার্চের একটি ছবি ছাপা হয়েছে ইংরেজি ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায়। ছবিতে দেখা যায়, রোডমার্চে সামান্যসংখ্যক লোক এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তবে রাস্তাজুড়েই গাড়ি আর গাড়ি। গাড়ির বহরে বেশিরভাগ দামি জিপ কিংবা মাইক্রোবাস। রোডমার্চের নামে এই গাড়ি প্রদর্শনী নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে বিএনপির রাজনৈতিক আন্তরিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠা বিচিত্র নয়। বিষয়টি রোডমার্চ হলে নেত্রী খালেদা জিয়া এবং তার দলের গুটিকয়েক বয়স্ক ও অসুস্থ লোকের জন্য কয়েকটি গাড়ি থাকতেই পারে। কিন্তু কয়েক হাজার গাড়ি নিয়ে রাজনীতির নামে ওই মোটর প্রদর্শনী কতটা কাম্য ও রাজনীতিসুলভ_ তা প্রশ্নাতীত নয় বলে অনেকে মনে করেন।
প্রতিবেশী ভারতে বিজেপি নেতা এল কে আদভানি সম্প্রতি গণসংযোগমূলক একটি লোকযাত্রা সম্পন্ন করেছেন। গেছেন তিনি ভারতের বহু স্থানে। কিন্তু রথের মতো একটি মাত্র বাহন ছাড়া তার লোকযাত্রায় আর কোনো গাড়ি দেখা যায়নি। আদভানির বয়স এখন ৮৪ বছর। গণসংযোগে নেমে একটি বাহন তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে ব্যবহার করতেই পারেন, সেটাই তিনি করেছেন। দেশের সব লোককে লোকযাত্রায় শামিল করার চেষ্টা তিনি করেননি। একেক জায়গায় কিছু লোক লোকযাত্রা অভিযান থেকে সরে গেছে, আবার সেই জায়গা থেকে কিছু লোক আদভানির মিছিলে যোগ দিয়েছে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তার সার্বক্ষণিক মিছিলটি বরাবর বেশ বড়ই ছিল।
অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, রোডমার্চের নামে মোটর-জিপ গাড়ির প্রদর্শনী রাজনীতিতে পেশিশক্তিরই যেন নামান্তর। শত শত মোটরসাইকেল ও গাড়ির বহর নিয়ে নেতানেত্রীকে গন্তব্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিচিত্র পন্থা বের করার কৃতিত্ব অবশ্য বিএনপিরই এবং বিএনপির যুবদল ও ছাত্রদলের সোনার ছেলেরাই বিএনপির ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'হোন্ডা-গুণ্ডা' পন্থার আবিষ্কর্তা ও প্রয়োগকারী হিসেবে পরিগণিত। রোডমার্চের নামে খালেদা জিয়ার কার-জিপবহরের বিশাল প্রদর্শনী সেই 'হোন্ডা-গুণ্ডা'র বিষয়টিই যেন মনে করিয়ে দেয়।
খুলনায় খালেদা জিয়া বিশাল জনসভা করেছেন। দেশের রাজনীতিসচেতন মানুষ রাজনীতিতে সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চান বৈকি। সেই হিসাবে বিএনপি এবং খালেদা জিয়া যে দেশের আরেক বড় দল আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দিতে চেষ্টা করবেন, সেটা খুবই সঙ্গত এবং স্বাভাবিক। দেশের ইতিবাচক রাজনীতির ক্ষেত্রেও সেটা একটা কাম্য বিষয়। তবে সত্যের খাতিরে বলতে হয়, বিশাল জনসভা সবসময়ই বিশাল জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য দেয় না। কথাটা আওয়ামী লীগ-বিএনপি, জাতীয় পার্টি ইত্যাদি সব দলের জন্যই প্রযোজ্য। রাজনৈতিক নেতারা দেশটা কীভাবে চালাবেন তা জানতেই রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যায় সর্বস্তরের লোকজন। সে ক্ষেত্রে বড় নেতানেত্রীর জনসভা তো বিশাল বা সমুদ্র-বিশাল হয়ে উঠতেই পারে। তবে রাজনীতিবিদরা যেন দয়া করে মনে রাখেন, শুধু ক্রোধ জাহির করলে কিংবা জনগণকে বড় বড় আশ্বাস দিলে অথবা সরকার সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ বললেই জনগণ তা গ্রহণ বা বিশ্বাস করবে না! যিনি বা যারা এসব কথা বলছেন শাসন-ক্ষমতায় থাকার সময় জনগণের জন্য তারা কী করেছেন আর নিজের জন্য, নিজের আত্মজের জন্য, আত্মীয়স্বজন এবং দলের লোকদের আখের গোছানোর জন্য ক্ষমতার কতটা অপব্যবহার তারা করেছেন এসব প্রশ্নও কিন্তু জনগণ মনে মনে পোষণ করে। শুধু গর্জন করলেই বর্ষণ হয় না। বিএনপি এবং খালেদা জিয়ার নিজেদের স্বার্থেই কথাগুলো স্মরণ রাখা উচিত।
বেশিদিন তো নয়, মাত্র তিন বছর আগে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় ছিল। এই ক'বছরে হাওয়া ভবনের কথা কিন্তু লোকে ভুলে যায়নি। ভুলে যায়নি জঙ্গি উত্থানের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দানের কথা। বাংলাভাই, শায়খ আবদুর রহমান গং তো গত জোট সরকারেরই সৃষ্টি। বিদেশি শক্তির চাপে শায়খ আবদুর রহমান, বাংলাভাইসহ ৬ জঙ্গিকে ফাঁসি দিতে বিএনপি জোট সরকার বাধ্য হয়েছিল বটে। তবে এরপরও সেই আমলে গোপনে ও প্রকাশ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গি উত্থান থেমে থাকেনি। লস্কর-ই-তৈয়বা, হুজি, জয়শ-ই-মোহাম্মদ প্রভৃতি বিদেশি জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশে তাদের শিকড় তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে নির্ভয়ে এবং নির্বিবাদে। জঙ্গি নেতারা বাংলাদেশে নির্ভয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে। দুবাইয়ে সন্ত্রাসী নেতা দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে প্রকাশ্যে বৈঠক হয়েছিল কার? এরপরও বিএনপি স্বপ্ন দেখে জঙ্গি উত্থান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, শামস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টার, মঞ্জুরুল ইমাম প্রমুখের হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারী বলে কথিত সেই নেপথ্য খলনায়ক হবেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী! বাংলাদেশে ভেড়া-ছাগল নয়, মানুষ বাস করে।
মনে হতেই পারে বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে বড় বেশি রূঢ় ও কঠোর-কঠিন কথা বলছি! কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, যারা সত্যের পক্ষে তারা আমার এই উপস্থাপনাকে সত্য বলেই গ্রহণ করবেন। সুশীল সমাজও নিশ্চয় মাত্র তিন বছর আগের বিএনপি-জামায়াতের জঙ্গি উত্থানে পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথেচ্ছ লুটপাট, হাজার হাজার কোটি ডলার বিদেশে পাচার, পিএসসি, ইসি, বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্র, দুর্নীতি দমন কমিশন প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দলীয়করণের কথা ভুলে যায়নি। ভুলে যাওয়া উচিত নয়, বিএনপি ১৯৯১-১৯৯৬ পর্বে একবার এবং জামায়াতকে নিয়ে ২০০১-২০০৬ সময় পর্বে দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় গিয়ে দুই আমলেই এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎও উৎপাদন করেনি। ভাবতে ইচ্ছা হয়, এটা কি ইচ্ছাকৃত? তা নইলে এমনটা হয় কেন এবং কীভাবে? গরিব, উন্নয়নশীল দেশে উন্নয়নের প্রথম শর্ত বিদ্যুৎ। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ বা অবহেলিত করে রাখার অর্থ দেশকে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে নিক্ষেপ করা তথা ব্যর্থ রাষ্ট্র বা ফেইলড স্টেট হওয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া। দু'বারই কেন বিএনপি এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা নেয়নি_ এই রহস্যপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেশবাসীকে বিএনপির দেওয়া উচিত রাজনৈতিক স্বচ্ছতার কারণে। বর্তমান সরকারকে 'সর্বক্ষেত্রে' ব্যর্থ বলার আগে আরও কিছু প্রশ্নের ব্যাখ্যা হওয়া নিতান্তই দরকার। জবাব দিতে হবে, বিগত আমলে দেশকে দুর্নীতির স্বর্গ করে তোলা হয়েছিল কি-না? জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটানো ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছিল কি-না। আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা, বিদ্যুৎ উৎপাদন একেবারেই বন্ধ করে 'খাম্বা' শিল্পের প্রসার ঘটানো_ এগুলোই-বা কেন এবং কিসের কারণে? কাউকে গালমন্দ ও ব্যর্থ বলার আগে বিএনপি এবং দলীয়প্রধান খালেদা জিয়ার উচিত তার রোডমার্চ এবং অন্যান্য জনসভায় এসব প্রশ্ন ও অভিযোগের জবাব দেওয়া। তাহলে বুঝব খালেদা জিয়া জনগণকে মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছেন না। তাহলে বুঝব, জঙ্গি উত্থানে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে এবং বাংলাদেশকে জামায়াতের কাঙ্ক্ষিত দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করার গোপন অভিলাষ তাদের নেই। ছিল না কোনোদিন।
আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা অবশ্যই আছে। রাস্তাঘাটের মেরামতকে এখন পর্যন্ত তারা ততটা গুরুত্ব দেয়নি। ভুক্তভোগী মানুষ এই ব্যর্থতা নিয়ে বলাবলি করে। আওয়ামী লীগের গ্রামকেন্দ্রিক বহু সাফল্য এই বলাবলির মধ্যে ম্লান হয়ে যায়। ঢাকার উড়াল সেতু, মেট্রো রেল এবং প্রশাসন ও অন্যান্য স্তরে বিরাজমান দুর্নীতি রোধের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাও বলতে গেলে নেওয়া হয়নি। দুদক দুর্নীতি দমনে বিএনপি আমলের মতোই দুর্বল এবং অকার্যকর। এ ছাড়া শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে না পারা_ এসবই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা বৈকি।
তবে এরপরও গত তিন বছরে মহাজোট সরকারের সাফল্য মোটেও তুচ্ছ নয়। আগের আমলে সৃষ্ট পাহাড়-প্রমাণ বিদ্যুৎ সংকটের সুরাহা তারা অনেকটা করে ফেলেছে। ২০১৪ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বাংশে না হলেও বহুলাংশে তারা যে সফল হবে অনেকের মতো আমিও সেটা বিশ্বাস করি। দেশ শাসনে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সেরা সাফল্য দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। আইন লঙ্ঘনকারী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ কিংবা ছাত্রলীগের হলেও তাকে বা তাদের সবাইকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনের হাতে সোপর্দ হতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনমনীয় ও আপসহীন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দুই স্বৈরশাসক ও বিএনপি শাসক দলের আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে তেমন দেখা যায়নি। বরং বিপরীতটাই দেখা গেছে। ২০০১-০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে বগুড়ার এক লোক চাল কেনা বাবদ রাষ্ট্রের ৪০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিল। আইনের হাতে ওই দলীয় তস্করকে তুলে না দিয়ে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ছেলে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সেই সহযোগীকে ডেকে আনিয়ে সামান্য মৌখিক তিরস্কার করে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই হলো দলীয় লোকের দুর্নীতির বিচার। এ রকম দৃষ্টান্ত চাইলে হাজার হাজার তুলে ধরা যায়।
আওয়ামী লীগের বর্তমান শাসনামলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কাজ যে চলছে, এটা স্বীকার না করে গত্যন্তর নেই। এটা নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগের একটি বড় এবং উল্লেখযোগ্য সাফল্য। গ্রামীণ অর্থনীতি আগের যে কোনো আমলের চেয়ে চাঙ্গা। নানা স্থানে রাস্তাঘাটের বেহাল দশা ছাড়া সরকারের বিপক্ষে তাদের তেমন কোনো অভিযোগ নেই। এ ছাড়া শিল্প-বাণিজ্যের সূচকও মোটামুটি ইতিবাচক। রফতানির পরিমাণ বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও বাড়ছে। বাড়ছে কর্মসংস্থানের পরিধি। এসবই বর্তমান সরকারের সাফল্যের মধ্যে পড়ে। স্বাধীনতার পক্ষের একজন সমর্থক এবং হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বলি, আওয়ামী লীগ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য মোটামুটি স্থিতিশীল রাখতে পারলে, শেয়ার মার্কেটে কয়েকজন ব্যবসায়ীর কারসাজি বন্ধ করে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা নিয়ে মার্কেট মোটামুটি স্থিতিশীল রাখতে পারলে, দু'বছরে উড়াল সেতু ও মেট্রো রেল নির্মাণ সম্পন্ন করতে পারলে, পদ্মা সেতুর কাজ অন্তত ৪০ ভাগ সম্পন্ন করতে পারলে কোনো তর্জন-গর্জনই আওয়ামী লীগের পরবর্তী দফায় ক্ষমতায় যাওয়া রোধ করতে পারবে না। মানুষ তো দেখছে, আওয়ামী লীগ দেশের প্রধান সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে_ বিএনপি কিংবা বিএনপি-জামায়াতের আমলে সেই ধরনের কোনো চেষ্টা বা পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
আসা যাক ভিন্ন প্রসঙ্গে। ঢাকাকে প্রশাসনিক সুবিধার্থে ও নাগরিক সাধারণকে অধিক সেবা প্রদানার্থে দুই ভাগে ভাগ করার আইন করেছে বর্তমান সরকার। এতে করে ঢাকার ৪০০ বছরের ঐতিহ্য নষ্ট হয়েছে, সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে, ঢাকা বিভক্তি আইন শুধু সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে পাস করা হয়েছে_ ইত্যাকার মন্তব্য এসেছে রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে। একজন খদ্দরের লুঙ্গি ও খদ্দরের চাদর পরা, আমাদেরই বন্ধু, সুহৃদ এমন কথা বলেছেন_ দুই করপোরেশনে ঢাকা বিভক্তির আইন বিলুপ্ত করা না হলে কঠোর আন্দোলনে যাবেন তিনি সরকারের বিরুদ্ধে।
এসব ক্ষোভের অর্থ আমার ঠিক বোধগম্য হয় না। দুই করপোরেশনে ভাগ হলে শহরের নামটা তো ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই থেকে যাচ্ছে। ঐতিহ্যের ক্ষতিটা হয় কোথায়? স্থানীয় সংসদ নির্বাচনে সংবিধান লঙ্ঘনের যে আশঙ্কা ছিল তা এতদসম্পর্কীয় বিল বা আইন পাস করায় আর নেই। বন্ধু সৈয়দ আবুল মকসুদকে বলি, গান্ধীবাদী হতে চাইছেন, গান্ধী কিন্তু রাগী মানুষ ছিলেন না। গান্ধীবাদী আন্না হাজারের উত্থানও কিন্তু বিরোধী দলের তাঁবেদারি করে হয়নি। সমাজের লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, শোষিত, অনগ্রসর মানুষের ভেতরে বসবাস করে তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সাফল্য অর্জনের মধ্য দিয়ে আন্না হাজারে তার নির্লোভ সমাজদরদি ভাবমূর্তিটি অর্জন করেছেন। আর ঐতিহ্য সময়ের কোনো বিন্দুতে এসে তো শেষ হয়ে যায় না। এটি চলমান, পরিবর্তনশীল এবং সময়ের ধারায় নব নব গৌরব অর্জনকারী একটি বিষয়। ঢাকা শহরকে উত্তর ঢাকা ও দক্ষিণ ঢাকা বললে মাথায় বাজ পড়ার তো কোনো কারণ দেখছি না। এরপর টিপাইমুখ নিয়ে আলোচনা করার কথা। কিন্তু লেখাটা যথেষ্ট লম্বা হয়ে গেছে। বারান্তরে টিপাইমুখ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা রইল।
রাহাত খান : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments