রাধারমণের গানে ভেসে by মামুন মিজানুর রহমান

৫ নভেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মাঠে অনুষ্ঠিত হয় রাধারমণ সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর আয়োজনে দিনব্যাপী 'রাধারমণ সংগীত উৎসব'। বিস্তারিত লিখেছেন মামুন মিজানুর রহমান'মনে মনে নাই গো, আমারে বন্ধুয়ার মনে নাই গো' রাধারমণের এই বিখ্যাত গানটি হয়তো সর্বাংশে বা এক অর্থে সত্য নয়। রাধারমণকে ভক্তরা, গানরসিকরা ভোলেননি। তিনি শ্রোতাদের প্রাণে ঠিকই উজ্জ্বল আছেন, উজ্জ্বল থাকবেন।


রাধারমণের সংগীত উৎসবে শ্রোতাদের উচ্ছ্বাস এমনই ইঙ্গিত করে। শিল্পকলা একাডেমীর মাঠ রাধারমণের সংগীতে ভেসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল আগে থেকেই। আগের দিনই শামিয়ানা টানিয়ে মাঠে আনা হয় উৎসবের আমেজ। ঢাকায়ও রাধারমণ ভক্তরা উৎসবের খবর-পত্রিকায় পড়ে ও নানাজনের কাছে শুনে আগে থেকেই উৎসবে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। বিশেষত সিলেট অঞ্চলের ঢাকাবাসীদের রয়েছে এই দিনটির জন্য অপেক্ষা। সিলেট অঞ্চলের মাটির গানে ডুবে যাওয়ার এই সুযোগ হেলায় নষ্ট করতে চাননি অনেকে। শুক্রবার সকাল থেকেই শত শত শ্রোতার উপস্থিতিতে ভরে যায় প্যান্ডেল। রাধারমণের গানের প্রবীণ শিল্পী সুষমা দাসের কণ্ঠে 'শুধু ভক্তি দিয়ে তোর কি হবে রে, সরল ভাব তোর নাই অন্তরে'_এই গানটির মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। রামকানাই দাসের গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরুর কথা থাকলেও তিনি উপস্থিত সত্ত্বেও অসুস্থতার কারণে গাইতে পারেননি। সকাল ৯টা থেকে এক ঘণ্টার উদ্বোধনী-পূর্ব সময়ে একক সংগীত পরিবেশন করেন সুধীর লাল দাস, দিলরুবা খান, গৌরব হোসেন, আবুল কালাম আজাদ ও বদরুন্নেসা ডালিয়া। এ পর্বে গান করেন অধিকাংশ প্রবীণ ও প্রখ্যাত রাধারমণ শিল্পীরা। এ পর্বে সুনামগঞ্জের আন্তর্জাতিক রাধারমণ একাডেমীরও ছিল চমৎকার দলীয় পরিবেশনা।
সকাল ১০টায় উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রবীণ শিল্পী সুষমা দাস। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, বিশেষ অতিথি ছিলেন ড. করুণাময় গোস্বামী। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন নিশীথ দত্ত, বিশ্বজিৎ রায়, মাহমুদ সেলিম। বক্তারা আলোচনায় তুলে ধরেন রাধারমণের গানের দর্শন ও প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়। সিলেটের এই কৃতী সন্তান তাঁর গানে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সরল ও আবেগী ভাষায় 'মানবজীবন'। তাঁর গানের মধ্যে রয়েছে সরল অথচ গভীর জীবন-দর্শন। ১৮৩৫ সালে সুনামগঞ্জের কেশবপুরে তাঁর আবির্ভাব। বৈষ্ণব সহজিয়া তত্ত্বে রচিত তাঁর গানের সংখ্যা কয়েক হাজার। এ পর্বে একক সংগীত পরিবেশন করেন অনিমেশ বিজয় চৌধুরী, মালতী পাল ও আহসান জামিল আনাছ।
বিকেলের পর্ব শুরু হয় ৩টায়। এ পর্বে যেন শ্রোতার ঢল নামে। সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসে, ভিড় তত বাড়ে। প্লাস্টিকের একটি চেয়ারে দুজন করে বসতেও দেখা গেছে। রাধারমণের অপূর্ব লোকজ গানের তালে তালে শরীর দোলাতে দেখা যায় প্রায় সবাইকে। এ পর্বে ছিল সিলেট বিভাগ ধামাইল উন্নয়ন পরিষদের পরিবেশনায় অসাধারণ ধামাইল নৃত্য। সন্ধ্যায় রাধারমণ রচিত অভিনব লোকজ আঙ্গিকের এই ধামাইল নাচ হাততালি একটু বেশিই কুড়ায়। এর পর একক গান পরিবেশন করেন ৮৭ বছর বয়সী শিল্পী চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ। বয়সের ভারে কুজো হয়ে যাওয়া এই শিল্পী উদাত্ত গলায় গেয়ে শোনান 'তুমি আও না কেনে রসের বৃন্দাবনে', 'নাগর জিজ্ঞাসি তোমারে', 'আজ কেনে প্রাণ কেন্দে কেন্দে'সহ পাঁচটি গান। এ পর্বে আরো একক সংগীত পরিবেশন করেন রঞ্জন চৌধুরী, শুক্লা দে, অনিমেশ বিজয় চৌধুরী, সেলিম চৌধুরী, বিশ্বজিৎ রায়, অনিমা মুক্তি, সাথী রায় বর্মণ, সৈয়দ আশিকুর রহমান, জামালউদ্দিন হোসেন বান্না। রাত নেমে এলেও শ্রোতার ঘাটতি হয় না। নেমে আসা হালকা ঠাণ্ডার মধ্যেও বেশির ভাগ শ্রোতা ছিলেন শেষ পর্যন্ত।

No comments

Powered by Blogger.