হাইকোর্টের রুল-ঢাকা ভাগের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ নয়-স্থিতাবস্থা বজায় রাখা প্রশ্নে দুই বিচারপতির দুইমত
ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) ভেঙে পাস হওয়া স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) বিল-২০১১ কেন অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী হবে না, তা চানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।একই সঙ্গে অবিলম্বে সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তাও জানতে চেয়েছেন আদালত।এদিকে সরকারের করা বিলের আগে সিটি করপোরেশন যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থায় রাখতে এবং মেয়র ও কাউন্সিলরদের
দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে স্থিতাবস্থা জারির আদেশের ওপর দুই বিচারপতি দ্বিধাবিভক্ত আদেশ দিয়েছেন। বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি দুই মাস স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দেন।
আর কনিষ্ঠ বিচারপতি আবেদনটি খারিজ করে দেন। ফলে এ বিষয়ে হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত কী তা ঠিক করতে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতি অন্য কোনো বেঞ্চে পাঠাবেন।
সিটি করপোরেশনের বিভক্তি করা নিয়ে ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকার করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি ফরিদ আহম্মদ ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের বেঞ্চ গতকাল বুধবার এ রুল জারি করেন। সংসদ সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে গতকাল আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, এ আদেশের পর প্রশাসক নিয়োগে আইনগত কোনো বাধা নেই।
তবে খোকার আইনজীবী ব্যারিস্টার আখতার ইমাম বলেছেন, 'আমাদের দৃষ্টিতে খোকাই মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তার পরও সরকার প্রশাসক নিয়োগ দিলে আদালতে আসব।'
আদালতে সাদেক হোসেন খোকার পক্ষে ছিলেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আখতার ইমাম, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ও ব্যারিস্টার রাসনা ইমাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা।
গতকাল দুপুরে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন)-২০১১ বিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সাদেক হোসেন খোকা এ রিট আবেদন করেন। এরপর আদালতে দুই দফা শুনানি হয়। শুনানি শেষ হয় বিকেল পৌনে ৫টায়।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে ডিসিসি ভাগ করে বিল পাস করা হয়েছে। এখন রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিলেই এটি আইনে পরিণত হবে। মাহবুবে আলম বলেন, 'আমাদের সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদে আছে কোন আইন বিবেচনায় থাকলে সেটা আদালত বিবেচনায় নেবেন না। এটাও একই রকম। এটা এখন বিবেচনায় আছে। আমরা আদালতকে এ বিষয়টি বলেছি। এখনো আইন হয়নি। তার আগে রিট করা হয়েছে।' এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
আখতার ইমাম বলেন, ৪০০ বছরের পুরনো ঢাকাকে মাত্র চার মিনিটে বিভক্ত করা হয়েছে। এটা আইনত ঠিক হয়নি।
শুনানিতে ড. কামাল হোসেন বলেন, মাত্র সাড়ে চার মিনিটে ঢাকা ভাগ হয়ে গেল। বিদ্যুৎ বেগে (সুপারসনিক) বিল পাস করা গণতন্ত্র হতে পারে না। সামরিক শাসনেই এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তিনি বলেন, 'সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদে ঢাকার কথা বলা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী এ ঢাকা হবে অখণ্ড ঢাকা। সংবিধানের ১৫ তম সংশোধনীর পর এত দ্রুত বিল পাস করা সংবিধানের প্রতি অশ্রদ্ধা ছাড়া আর কিছুই নয়। সংসদীয় গণতন্ত্র শুধুই কথার কথা নয়, এটা একটা প্রক্রিয়া। সংবিধান কোনো ধরনের সুপারসনিক গতিকে সমর্থন করে না। এটা গণতান্ত্রিক রীতি নয়। দেড় কোটি মানুষ সংসদের এ সিদ্ধান্তে ভুক্তভোগী। তাদের কোনো মতামত না নিয়ে, সংসদে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়া, বিলটি পাস হয়েছে। সামরিক সরকার অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারকে গণতান্ত্রিক রীতি মানতে হয়। একদিকে সামরিক শাসন, অন্যদিকে সাংবিধানিক শাসন।' তিনি বলেন, এ বিল পাসের মাধ্যমে অনেক সাংবিধানিক বিচ্যুতি ঘটেছে। সংবিধান বলছে রাজধানী হবে ঢাকা। রাজধানীর সীমানা আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে। ঢাকাকে ভাগ করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের মতো সংসদ সদস্য সরকারের রয়েছে। সরকার চাইলে নতুন সংবিধান তৈরি করতে পারবে। সরকার তো পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেছে। এর পরও সংবিধান সংশোধন না করে সুপারসনিক গতিতে যেভাবে সংসদে বিল পাস হয়েছে, তা সংবিধানের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের মেয়াদোত্তীর্ণের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা। এ সময়ের মধ্যে নির্বাচন কেন হলো না, সে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে ডাকা প্রয়োজন। ড. কামাল বলেন, 'অ্যাটর্নি জেনারেলসহ বিজ্ঞ আইনজীবীরা অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। তাঁরা আমাকে একটা নজির দেখান, যেখানে সাড়ে চার মিনিটে সংসদে কোনো আইন পাস হয়েছে। এটা আমাদের পুরো জাতির জন্য বিব্রতকর। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, সব ভালো, সব ভালো। এটা ভদ্রলোকের কথা নয়। আমরাও প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতা করতে চাই। প্রশাসক নিয়োগ হবে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। আদালত দুই সপ্তাহ রুল দিতে পারেন। এরপর শুনানি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।'
আখতার ইমাম বলেন, 'সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল বলে আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন। এ রায়ের গুরুত্ব হচ্ছে অনির্বাচিত ব্যক্তিরা দেশ চালাতে পারবেন না। এখানেও তাই হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়েই সিটি করপোরেশন চলতে হবে। এ বিল থাকলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, নতুন আইন অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তিকেই এখন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া যাবে। যেকোনো সরকার রাজনৈতিকভাবে এ আইনের অপব্যবহার করতে পারে।'
শুনানির শুরুতেই হাইকোর্ট অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে জানতে চান, নির্বাচিত সরকারের শাসনের কথা বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়েছে। এখন আবার প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এটা কেন? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'এ প্রশ্নে আমি পরে আসছি।'
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'বিলটিতে এখনো রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করেননি। তাঁর স্বাক্ষরের আগেই রিট আবেদন করা হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ রিট হয়েছে। বিলে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরের আগেই বিল চ্যালেঞ্জ করে রিট চলতে পারে না। এ নিয়ে বিলম্ব করলেও সমস্যা নেই। অতীতে বিল পাসের বহু বছর পর পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। এটি নজিরবিহীন।
দুপুর আড়াইটায় শুনানির এক পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সময় চান। তিনি আজ বৃহস্পতিবার শুনানির দিন ঠিক করতে বলেন। জবাবে আদালত বলেন, 'তাহলে আপনি আন্ডারটেকেন দেন যে এ সময়ে কোনো প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে না।' তখন অ্যাটর্নি জেনারেল ৪টায় শুনানি করতে বলেন। এরপর বিকেল ৪টায় আবার শুনানি হয়।
আদেশের পর সাদেক হোসেন খোকা সাংবাদিকদের বলেন, 'এটা জনগণের বিজয়। এত দিন জনগণ বলে আসছিল। আজ আদালত তা স্বীকার করে নিল।'
No comments