বাকস্বাধীনতার নতুন দরজা by মিজানুর রহমান খান

বাকস্বাধীনতা নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক আলোচিত রায় আমাকে ১৯৯৬ সালের ১২ মে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া একটি অভিমতকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। নোটবই নিষিদ্ধকরণ আইন, ১৯৮০-কে বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করে হাইকোর্ট বাতিল করেছিলেন। এ মামলাটি নোটবই নিয়ে হলেও এতে বাকস্বাধীনতার সীমাসংক্রান্ত সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িত ছিল। এর সমর্থনে হাইকোর্ট সনদ দিয়েছিলেন। সেই সুবাদে আপিল বিভাগ এ বিষয়ে ৩: ১ ভোটে বিভক্ত রায় দেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে (যার ভিত্তি ছিল মূলত ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়) ১৯৮০ সালের আইনটি সাংবিধানিক বলে টিকে যায়। একমাত্র ভিন্নমত প্রদানকারী বিচারপতি লতিফুর রহমান রায় দেন যে এটা অসাংবিধানিক। কারণ, সংসদ ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’ না মেনে আইন করেছে। বিচারপতি লতিফুর রহমান লিখেছিলেন, ‘সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ওপর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর আগে কী কী রায় দিয়েছিলেন, তা আমি খতিয়ে দেখলাম কিন্তু কিছুই পেলাম না।’ এরপর ১৯ বছর কেটে গেছে। কিন্তু ১৯ বছর পরেও তাঁর পর্যবেক্ষণ প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। এই সময়ে দেওয়া তেমন কোনো রায় আমাদের নজরে পড়েনি, যেখানে বাকস্বাধীনতা–সংক্রান্ত ৩৯ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ ও ব্যাপ্তি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। প্রচণ্ড রকম অস্পষ্টতার দোষে দুষ্ট ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ক ধারার বিরুদ্ধে করা মামলার (তসলিমা নাসরিন অন্যতম আবেদনকারী, তথ্যসূত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস) কারণে ভারতবাসীরই কেবল নয়, আমাদের আশ্বস্ত হওয়ার একটা বিরাট কারণ সৃষ্টি হয়েছে। সেটা এই অর্থে যে বাংলাদেশ সংবিধানের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা-সংক্রান্ত ৩৯ অনুচ্ছেদটা বুঝতে ১২৩ পৃষ্ঠার এই রায়টি একটি মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে কাজে দেবে। ভারতের সংসদের বিরাট দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে এই রায়ে। কারণ, কোনো ফৌজদারি আইনের বিধানাবলি খুব বেশি ‘অস্পষ্ট’ হলে তা যে প্রচণ্ড কালাকানুনের নামান্তর, তা নতুন কথা নয়। ওই রায়ে বিচারকেরা ইতিপূর্বে (ষাটের দশক থেকে) নিজেদের আদালতের দেওয়া এত বেশি রায়ের বরাত দিয়েছেন, তা পড়ে আমরা বিস্মিত হই যে ভারতীয় আইনসভা কীভাবে এ রকম একটি আইন পাস করতে পারল।
তবে যেটা লক্ষণীয় সেটা হলো, ভারতের তথ্যমন্ত্রী দ্রুততার সঙ্গে ৬৬ক ধারা বাতিলের সিদ্ধান্তকে শিরোধার্য বলে মেনে নিয়েছেন। ওই ৬৬ক ধারাটির মায়ের পেটের আপন ভাই হলো বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা। না, আপন ভাই বললে ভয়াবহতা চাপা পড়বে। কারও মনে হতে পারে, তাহলে ভারতীয় আইনপ্রণেতারাও বাংলাদেশিদের মতো দায়িত্বহীন আইন পাস করতে পারেন। কিন্তু বিষয়টি পুরোপুরি তা নয়। বাংলাদেশে আমরা ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে উচ্চকিত। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করছে না। ভারতে এটা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৬৬ক ধারায় মামলা করার আগে সতর্কতা অবলম্বনে গাইডলাইন পাঠিয়েছিল। এখানে সবাই চুপ, এমনকি এর মূল রূপকার বিএনপি-জামায়াত চক্রও চুপ করে আছে।
বাংলাদেশি ৫৭ ধারা হলো ‘ ইলেকট্রনিক ফরমে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ’-সংক্রান্ত। এতে বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। এর দায়ে অনধিক চৌদ্দ বছর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷’ ভারতের আইনে শাস্তি ছিল মাত্র তিন বছরের। বিএনপি–জামায়াত করেছিল ১০ বছর। আর অধিকতর গণতন্ত্রী বলে দাবিদার আওয়ামী লীগ ২০১৩ সালে এতে সংশোধনী এনে ১০ বছরের সাজাকে ১৪ বছরে উন্নীত করেছে।
ভারতীয় বিচারকেরা ওই বিধানকে অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দিতে মার্কিন সংবিধান ও তাদের সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ের বরাত দিয়েছেন। বিচারপতি আর এফ নারিম্যান একটি মজার কথা লিখেছেন। তিনি বলেন, ‘এই আদালতের প্রতিটি উল্লেখযোগ্য রায়ে অটলান্টিকের ওপারের উদাহরণ হাজির করা হয়।’ এতে কোনো অসুবিধা নেই। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টেরও ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বরাত দেওয়া ছাড়া চলে না। তাই ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের আলোকে বলতে পারি, বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেওয়া অবস্থান নৈতিক বিবেচনায় অসাংবিধানিক বলে নাকচ হয়ে যাওয়া উচিত। ভারতে বাতিল হওয়া ৬৬ক এর চেয়ে আমাদের ৫৭ ধারাটি বাকস্বাধীনতার প্রতি আরও বেশি ভয়ংকর।
ভারতের তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী রবিশংকর প্রসাদ রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ‘যারা ক্ষমতায় থাকবে, তাদের অবশ্যই উদার হতে হবে।’ বাংলাদেশের মন্ত্রীরা ও সংশ্লিষ্টরা কি অচিরেই তাঁর কথার প্রতিধ্বনি তুলবেন? তথ্য কমিশনে ফোন করে তাঁদের একটা সমার্থক প্রতিক্রিয়া পাব, এই আশায় দিল্লিতে রায়টি ঘোষণার পরদিন (২৫ মার্চ) বেলা দেড়টায় ফোন করেছিলাম। কিন্তু প্রধান তথ্য কমিশনার মোহাম্মদ ফারুক ও তথ্য কমিশনার অধ্যাপক খুরশীদা জানালেন, তাঁরা বিষয়টি এখনো জানেন না। আপনারা কখনো কি ৫৭ ধারা সম্পর্কে কোনো অভিমত কোথাও রেখেছেন? বললেন, না।
এখানে স্মরণযোগ্য যে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, ৬৬ক ধারা তথ্যের অধিকারের ওপর বিরাট হুমকি।
এটা আশা করার সময় যে ভারতের আদালত ও সরকারের অবস্থানের প্রতি নীতিগত সাড়া দিয়ে বিএনপি-জামায়াত প্রবর্তিত কালাকানুনকে বহাল রাখা এবং ২০১৩ সালে বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নেওয়ার জন্য ক্ষমতাসীনেরা অনুশোচনা করবেন। আমরা খুব ধন্দে ছিলাম যে কে কাকে নকল করল? কারণ, ভারতের আইনে ৬৬ক ধারাটি কার্যকর হয় ২০০৯ সালের ২৭ অক্টোবর। আর বাংলাদেশে ৫৭ ধারাটি যুক্ত করা হয়েছিল ২০০৬ সালেই। তাহলে কি ভারত বাংলাদেশকে অনুসরণ করেছিল?
ওই রায়ে এর উত্তর পেয়ে অবাকই হলাম। ১৯৩৫ সালের ব্রিটিশ পোস্ট অফিস আইনের ১০(২)ক ধারায় বলা হয়েছিল, টেলিফোনের মাধ্যমে গ্রসলি অফেন্সিভ, ইন্ডিসেন্ট, অবসিন বার্তা পাঠানো যাবে না।
১৯৫৩ সালের ব্রিটিশ পোস্ট অফিস আইনের ৬৬ ধারায় এটি আবার প্রতিস্থাপিত হয়। আমাদের ৫৭ ধারাটি আসলে ব্রিটেনের এই ৬৬ ধারা থেকে নেওয়া। এটা একটা উদাহরণ যে একই বিধান ভারত ও বাংলাদেশ তাদের অভিন্ন ঔপনিবেশিক প্রভুর কাছ থেকে অঞ্জলি ভরে গ্রহণ করতে গিয়ে কে কেমন আচরণ করেছে। বাংলাদেশ তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়েছে। আমাদের নকলনবিশদের অপরিণামদর্শী উদ্ভাবন হলো, ওই ৫৭ ধারার মধ্যে ‘ধর্মীয় অনুভূতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ও আইনশৃঙ্খলা, নীতিভ্রষ্ট হওয়া’ ইত্যাদি বিষয় ঢোকানো। ব্রিটেন তা করেনি। ভারতের ৬৬ক-তেও এসব নেই। এমনকি সেখানে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির কথা একদম অনুপস্থিত। সুতরাং যদি আমরা সরলীকরণ করি যে বাংলাদেশি শাসকেরা যা করেছেন, ভারতও পরে তা-ই নকল করেছে, তাহলে সেটা ভুল হবে।
১৯৫৩ সালের আইনে মানহানি ও অশ্লীল বার্তা পাঠানোর দায়ে এক মাস জেল বা ১০ পাউন্ড জরিমানার বিধান ছিল। ১৯৮১ সালের ব্রিটিশ টেলিকমিউনিকেশনস আইনের ৪৯ ধারায় আবার ওই বিধানের প্রতিস্থাপন ঘটে, যা ১৯৮৪ সালে পুনরায় ৪৩ ধারায় আসে। সবশেষ বিদ্যমান ২০০৩ সালের ব্রিটিশ টেলিকমিউনিকেশনস অইনের ১২৭ ধারায় অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে এবারে খুব সংকীর্ণ করে (মিথ্যা, অশ্লীল ও মানহানিকর শব্দ বাদ দিয়ে) পাবলিক ইলেকট্রনিক কমিউনিকেশনস নেটওয়ার্কের অযথাযথ ব্যবহারকে দণ্ডনীয় করা হয়। নির্দিষ্টভাবে এতে কেবল ‘অত্যন্ত আক্রমণাত্মক, শিষ্টাচারবিরুদ্ধ, অশ্লীল ও ভীতিকর প্রকৃতির’ বার্তা আদান-প্রদানকে নিষিদ্ধ করা হয়। সুতরাং এটা পরিহাস যে বাংলাদেশ ও ভারত ২০০৩ সালের সংশোধিত বিধানকে নয়, বরং ১৯৩৫ বা ১৯৫৩ সালের ব্রিটিশ আইন থেকে আমদানির দিকে ঝুঁকেছে।
আগেই যেমনটা বলেছি, এটা বহুকাল থেকেই দেখার বিষয় যে বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ (২) অনুচ্ছেদ যে কথা বলেছে তা নাগরিকেরা কীভাবে মেনে চলবে। কারণ, তার সামনে নিত্যনতুন শৃঙ্খল। তাকে ক্রমাগত কালো আইনের বেড়ি পরানো হচ্ছে। অনুমান করি আইন তৈরির সময় ৩৯(২) অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে হয়তো মনের মাধুরী মিশিয়ে ৫৭ ধারা সৃষ্টি করা হয়েছে। সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ আটটি বিষয়ে (রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা, নৈতিকতা, আদালত অবমাননা, মানহানি ও অপরাধ সংঘটন) সম্পর্কে সংসদকে আইন করার এখতিয়ার দিয়েছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় তাই আমাদের জন্য একটি নতুন দরজা উন্মোচন করে দিয়েছে। ৬৬ক ধারাটি বাতিল করার প্রধান যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, এটি ভারতীয় সংবিধানের ১৯(১) ক এবং ১৯ অনুচ্ছেদের ২ দফার পরিপন্থী। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৬ সালের ওই রায়ে (১৭ বিএলডি ৯৪) যথার্থই উল্লেখ করেছেন যে ভারতের ১৯ অনুচ্ছেদ এবং বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ সমতুল্য। আর এখন আমরা সুস্পষ্টভাবে জানলাম যেটা বিচারপতি নরিম্যান লিখেছেন, বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণে এই আটটি (ভারতের সংবিধানেও অভিন্ন আটটি বিষয় উল্লেখিত) নির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া রাষ্ট্র কোনো আইন তৈরি করতে পারবে না। আর আটটি বিষয়ে যেনতেন আইন করলেই হবে না, তাকে অবশ্যই ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’-এর শর্ত পূরণ করতে হবে, যার মূল কথা হলো, বাকস্বাধীনতার সীমা সংকোচনকারী যেকোনো বিধান অবশ্যই ‘সংকীর্ণতম’ হতে হবে। টুঁটি চেপে ধরা হাতটা উদ্ধত নয়, কুঁচকে থাকবে। সুতরাং ওই আটটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তরফে খেয়ালখুশির জায়গা ভারতের রায়টি নিশ্চিতভাবেই রুদ্ধ করে দিয়েছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.