বিপর্যস্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি by ড. আবদুল লতিফ মাসুম
রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রবক্তা পুরুষদ্বয়:
গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড এবং সিডনি ভার্বা তাদের সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য
সিভিক কালচার’(১৯৬৩) এ রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিশ্লেষণ এবং বিভাজন করেছেন।
লুসিয়ান ডব্লিউ পাই-এর ব্যাখ্যায় বলা যায়: একটি সমাজের রাজনৈতিক আচরণ,
মূল্যবোধ এবং রীতি-নীতির সমষ্টিই ওই সমাজের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। দীর্ঘকাল
ধরে অনুসৃত বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ‘সংকীর্ণ’ এ কথা বলা কঠিন। আজকের
বাংলাদেশে আমরা যে সংস্কৃতির পরিচয় পাচ্ছি আসলেই কি তা আমাদের রাজনীতির
মূলধারার প্রতিনিধিত্ব করে? আমাদের আচার-আচরণে এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপে যে
রাজনৈতিক সংস্কৃতি উপস্থাপিত হচ্ছে তা কি মৌলিক, না কৃত্রিম? সাম্প্রতিক
গবেষণায় রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে: বাস্তব এবং আরোপিত।
জনগণ আসলেই যা বিশ্বাস করে এবং ধারণ করে তা হচ্ছে ‘বাস্তব সংস্কৃতি’।
অপরদিকে আরোপিত সংস্কৃতি হচ্ছে তা, যা শক্তি অথবা ভীতি প্রদশর্নের মাধ্যমে
জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। (অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব সোসিওলজি: ২০০৯: ৫৭২)
এই তত্ত্ব কথাটুকু মনে রাখলে আমাদের ইদানীং রাজনৈতিক আচরণ এবং উচ্চারিত
শব্দাবলি বোঝা সহজতর হবে।
আমরা আচরণে না হলেও সংবিধান মোতাবেক একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বসবাস করি। সংসদীয় গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এখানে রাজনৈতিক দল একটি অপরিহার্য অনুসঙ্গ। যে দল জনগণের সম্মতি লাভ করে তারা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য শাসন করার অধিকার লাভ করে। জাতীয় সংসদে যারা সরকারের পরে বেশি আসন পায় তারা বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে। বিরোধী নেত্রী আমাদের দেশেও মন্ত্রীর মর্যাদা পায়। আর সংসদে যেসব দলের আসন থাকে তাদেরকেও উপযুক্ত সম্মান দেয়া হয়। সম্মান দেয়া হয় এই কারণে যে বিরোধী মানে শত্রু নয়। একই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভিন্নমত পোষণকারী মাত্র। আমাদের রাজনৈতিক বৈরিতা শত্রুতায় পর্যবসিত হতে দেখে সচেতন নাগরিক মাত্রই বিচলিত।
বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাদের দেশে আন্দোলন চলছে। বিএনপি চেয়ারপারসন, ২০ দলীয় নেত্রী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অবরোধের ডাক দিয়েছেন। তার অনুসৃত রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কৌশল বা কর্মসূচির সঙ্গে সবাই একমত হবেন- এটা নাও হতে পারে। প্রতিটি নাগরিকের অধিকার রয়েছে তার কর্মসূচির কঠোর সমালোচনা করার। নিত্যদিন চ্যানেলে এবং পত্র পত্রিকায় এসব সমালোচনাও লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত বৈরী সরকারি দল আন্দোলনকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যা অস্বাভাবিক তা হচ্ছে তার প্রতি আচরণ এবং আরোপিত শব্দাবলী।
---ক. বেগম খালেদা জিয়া ৩রা জানুয়ারি ২০১৫ যখন তার কার্যালয় থেকে সম্ভাব্য সমাবেশ স্থলে রওনা দেন তখন তাকে গেটে আটকে দেয়া হয়। শুধু তাই নয় পরদিন ইট বালুর ট্রাক দিয়ে তার কার্যালয় ঘিরে দেয়া হয়। শ’ শ’ পুলিশ মোতায়েন করা হয়, যাতে তিনি বের না হতে পারেন। এভাবে ২০ দিন তাকে অবরুদ্ধ রাখা হয়। সরকার থেকে বলা হয়, তার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। একজন মন্ত্রী বলেন, ইট-বালু খালেদা জিয়া এনেছেন তার ভবন নির্মাণের জন্য।
---খ. একজন খ্যাতিমান মন্ত্রী প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, খালেদা জিয়ার বিদ্যুৎ, টেলিফোন এবং পানির লাইন কেটে দেয়া হবে। অনেকে এটাকে শুধু হুমকি মনে করলেও একদিন সত্যি সত্যিই বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ, টেলিফোন এবং ইন্টারনেটের লাইন কেটে দেয়া হয়। লাইন কেটে দেয়া লোকেরা বলে থানার নির্দেশে তারা এ কাজ করেছে। গুলশান থানা বলে তারা কিছুই জানে না। মন্ত্রী বলেন, কর্মচারী এবং বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ওই লাইন কেটে দিয়েছে। আর একজন মন্ত্রী ওই লাইন কেটে দেয়ার জন্য শ্রমিক কর্মচারীদের ধন্যবাদ জানান।
---গ. বেগম খালেদা জিয়ার কর্মসূচি দ্বারা এসএসসি পরীক্ষা ব্যাহত হলে শিশুদের দিয়ে তার কার্যালয়ের সম্মুখে মানববন্ধন করানো হয়। বারকয়েক ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন ঘেরাও-এর ঘোষণা দিয়ে ওই কার্যালয়ের অতি নিকটে পৌঁছে যায়। একজন যুবক তার কার্যালয়ে ইট নিক্ষেপ করলে তাকে পাগল বলে ছেড়ে দেয়া হয়। ঝাটা মিছিলকারীদেরকে তার কার্যালয়ের সম্মুখে অবস্থান করার অনুমতি দেয়া হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রীর সরাসরি নেতৃত্বে শ্রমিক কর্মচারীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এগুলে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এসব নিরাপত্তাহীনতার মাঝে যখন কার্যালয়ে কাটাতারের বেড়া দেয়া হয় তখন দায়িত্বশীল লোকেরা বিরূপ মন্তব্য করে।
---ঘ. সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ওই কার্যালয়ে তার সঙ্গে দেখা করার পরপরই গুলিবিদ্ধ হন। আরেক উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী, বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। এখন কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে গেটে রক্ষিত রেজিস্ট্রারে স্বাক্ষর করতে বলে পুলিশ।
---ঙ. একপর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের খাবার বন্ধ করে দেয়া হয়। চ্যানেলে প্রচারিত ছবিতে দেখা যায় খাবার বহনকারী রিকশা ভ্যানটি কার্যালয়ের গেটে পৌঁছলে পুলিশ ভ্যানগাড়ি চালককে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। বরং একজন পুলিশ ভ্যানগাড়িতে উঠে বসে খাবারগুলো গুলশান থানায় নিয়ে যায়। অন্য একটি সংবাদ চিত্রে (দ্য ডেইলি স্টার, ১৬ই ফেব্রুয়ারি, শেষ পৃষ্ঠা) দেখা যায় আহূত খাবার ফুটপাতে রেখে দিয়ে সাদা পোশাকের একজন পুলিশ রিকশাওয়ালাকে তাড়িয়ে দেয়। জিজ্ঞাসিত হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ বলে ‘উপরের নির্দেশ’। বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন কোন এক সন্ধ্যায় বেগম খালেদা জিয়ার জন্য রান্না করা কিছু খাবার নিয়ে গেলে তাকে আটক করা হয়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী খাবার না নিতে দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। আওয়ামী লীগ নেতা ড. হাছান মাহমুদ বলেন, খাবার নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া নাটক করছেন। অবশেষে সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অফিসে থাকার কি যুক্তি তা আমরা বুঝি না। উনি অফিসে বসে আছেন। আবার কিছু দরদি দেখলাম লিখছে, ওনার খাবার যাচ্ছে না। অফিসে খাবার যাবে কেন? অফিসে আসবে, অফিস করবে, অফিস শেষে বাড়ি ফিরবে। বাড়িতে গিয়ে খাবার খাবে।’
এসব ঘটনাবলী এবং বক্তব্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোন পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে সে বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না। শুধু এটুকু বলা যায় বাংলাদেশের মানুষকে বোকা ভাবার কোন কারণ নেই।
---চ. আচরণ সংস্কৃতি দেখলেন। উচ্চারণ আরও তীব্র এবং হিংস্র। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, অর্ধমন্ত্রী এবং নেতা, পাতি নেতারা প্রতিদিন খালেদা জিয়াকে কটু কথা বলে যাচ্ছেন। সেসব ভাষা লিখলে দ্বিতীয়বার অন্যায় হবে ভেবে আর উল্লেখ করলাম না। এসব দেখে দেশে একজন প্রবীণ ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আবুল মকসুদ মন্তব্য করেন, ‘অসুন্দর ভাষায় কাউকে গালাগাল দেয়া আর গায়ে হাত তোলার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?” (প্রথম আলো, ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)।
বাংলাদেশের সমাজ সংস্কৃতি এবং জীবনবোধ সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম ধারণা আছে উপর্যুক্ত ঘটনাবলী তাদেরকে নিঃসন্দেহে বিস্মিত করবে। এই সেই দেশ, যে দেশের মানুষ নিজে না খেয়ে পরকে খাওয়ায়। এই সেই দেশ, যে দেশের মানুষ অপরকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়। এই সেই দেশ, যে দেশে গালাগালি হানাহানি মারামারি খুনোখুনিকে মানুষ ঘৃণা করে। হিংসা প্রতিহিংসা গ্রেপ্তারি বা হত্যার হুমকির মতো ঘটনাবলীকে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক মনে করে না। এ দেশের মানুষ মনে করে মানবিক আবেদন দিয়েই চলমান মানবিক বিপর্যয়কে অতিক্রম করতে হবে। বাংলাদেশের আবহমান লালিত সংস্কৃতির বিপরীতে প্রতিফলিত বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটি আপাত, কৃত্রিম এবং আরোপিত ঘটনা হতে বাধ্য। রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘যখন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে পড়ে বা সন্দেহ সঙ্কটে নিপতিত হয় তখন বৈধতার সঙ্কট সৃষ্টি হয়’। আর বাংলাদেশের সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন আমরা এখন একটি বৈধতার সঙ্কট সময় অতিক্রম করছি। বৈধতার সঙ্কট সৃষ্টি হয় তখন, যখন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সত্যকে মিথ্যা বলে প্রচার করে, ব্যর্থতাকে চমক, প্রতারণা এবং ষড়যন্ত্র দিয়ে ঢেকে দিতে চায়। এ ধরনের রাজনৈতিক দুর্যোগ সহসাই নাগরিক সাধারণকে গোটা ব্যবস্থার প্রতি ক্ষিপ্ত করে তুলতে পারে। সুতরাং রাজনীতিক এবং আমলাদের উচিত আবহমান লালিত বাংলার সহজাত রাজনৈতিক সংস্কৃতির লালন-পালন, ধারণ-সংরক্ষণ এবং প্রতিস্থাপন- নিশ্চিত করা।
আমরা আচরণে না হলেও সংবিধান মোতাবেক একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বসবাস করি। সংসদীয় গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এখানে রাজনৈতিক দল একটি অপরিহার্য অনুসঙ্গ। যে দল জনগণের সম্মতি লাভ করে তারা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য শাসন করার অধিকার লাভ করে। জাতীয় সংসদে যারা সরকারের পরে বেশি আসন পায় তারা বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে। বিরোধী নেত্রী আমাদের দেশেও মন্ত্রীর মর্যাদা পায়। আর সংসদে যেসব দলের আসন থাকে তাদেরকেও উপযুক্ত সম্মান দেয়া হয়। সম্মান দেয়া হয় এই কারণে যে বিরোধী মানে শত্রু নয়। একই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভিন্নমত পোষণকারী মাত্র। আমাদের রাজনৈতিক বৈরিতা শত্রুতায় পর্যবসিত হতে দেখে সচেতন নাগরিক মাত্রই বিচলিত।
বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাদের দেশে আন্দোলন চলছে। বিএনপি চেয়ারপারসন, ২০ দলীয় নেত্রী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অবরোধের ডাক দিয়েছেন। তার অনুসৃত রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কৌশল বা কর্মসূচির সঙ্গে সবাই একমত হবেন- এটা নাও হতে পারে। প্রতিটি নাগরিকের অধিকার রয়েছে তার কর্মসূচির কঠোর সমালোচনা করার। নিত্যদিন চ্যানেলে এবং পত্র পত্রিকায় এসব সমালোচনাও লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত বৈরী সরকারি দল আন্দোলনকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যা অস্বাভাবিক তা হচ্ছে তার প্রতি আচরণ এবং আরোপিত শব্দাবলী।
---ক. বেগম খালেদা জিয়া ৩রা জানুয়ারি ২০১৫ যখন তার কার্যালয় থেকে সম্ভাব্য সমাবেশ স্থলে রওনা দেন তখন তাকে গেটে আটকে দেয়া হয়। শুধু তাই নয় পরদিন ইট বালুর ট্রাক দিয়ে তার কার্যালয় ঘিরে দেয়া হয়। শ’ শ’ পুলিশ মোতায়েন করা হয়, যাতে তিনি বের না হতে পারেন। এভাবে ২০ দিন তাকে অবরুদ্ধ রাখা হয়। সরকার থেকে বলা হয়, তার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। একজন মন্ত্রী বলেন, ইট-বালু খালেদা জিয়া এনেছেন তার ভবন নির্মাণের জন্য।
---খ. একজন খ্যাতিমান মন্ত্রী প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, খালেদা জিয়ার বিদ্যুৎ, টেলিফোন এবং পানির লাইন কেটে দেয়া হবে। অনেকে এটাকে শুধু হুমকি মনে করলেও একদিন সত্যি সত্যিই বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ, টেলিফোন এবং ইন্টারনেটের লাইন কেটে দেয়া হয়। লাইন কেটে দেয়া লোকেরা বলে থানার নির্দেশে তারা এ কাজ করেছে। গুলশান থানা বলে তারা কিছুই জানে না। মন্ত্রী বলেন, কর্মচারী এবং বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ওই লাইন কেটে দিয়েছে। আর একজন মন্ত্রী ওই লাইন কেটে দেয়ার জন্য শ্রমিক কর্মচারীদের ধন্যবাদ জানান।
---গ. বেগম খালেদা জিয়ার কর্মসূচি দ্বারা এসএসসি পরীক্ষা ব্যাহত হলে শিশুদের দিয়ে তার কার্যালয়ের সম্মুখে মানববন্ধন করানো হয়। বারকয়েক ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন ঘেরাও-এর ঘোষণা দিয়ে ওই কার্যালয়ের অতি নিকটে পৌঁছে যায়। একজন যুবক তার কার্যালয়ে ইট নিক্ষেপ করলে তাকে পাগল বলে ছেড়ে দেয়া হয়। ঝাটা মিছিলকারীদেরকে তার কার্যালয়ের সম্মুখে অবস্থান করার অনুমতি দেয়া হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রীর সরাসরি নেতৃত্বে শ্রমিক কর্মচারীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এগুলে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এসব নিরাপত্তাহীনতার মাঝে যখন কার্যালয়ে কাটাতারের বেড়া দেয়া হয় তখন দায়িত্বশীল লোকেরা বিরূপ মন্তব্য করে।
---ঘ. সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ওই কার্যালয়ে তার সঙ্গে দেখা করার পরপরই গুলিবিদ্ধ হন। আরেক উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী, বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। এখন কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে গেটে রক্ষিত রেজিস্ট্রারে স্বাক্ষর করতে বলে পুলিশ।
---ঙ. একপর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের খাবার বন্ধ করে দেয়া হয়। চ্যানেলে প্রচারিত ছবিতে দেখা যায় খাবার বহনকারী রিকশা ভ্যানটি কার্যালয়ের গেটে পৌঁছলে পুলিশ ভ্যানগাড়ি চালককে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। বরং একজন পুলিশ ভ্যানগাড়িতে উঠে বসে খাবারগুলো গুলশান থানায় নিয়ে যায়। অন্য একটি সংবাদ চিত্রে (দ্য ডেইলি স্টার, ১৬ই ফেব্রুয়ারি, শেষ পৃষ্ঠা) দেখা যায় আহূত খাবার ফুটপাতে রেখে দিয়ে সাদা পোশাকের একজন পুলিশ রিকশাওয়ালাকে তাড়িয়ে দেয়। জিজ্ঞাসিত হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ বলে ‘উপরের নির্দেশ’। বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন কোন এক সন্ধ্যায় বেগম খালেদা জিয়ার জন্য রান্না করা কিছু খাবার নিয়ে গেলে তাকে আটক করা হয়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী খাবার না নিতে দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। আওয়ামী লীগ নেতা ড. হাছান মাহমুদ বলেন, খাবার নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া নাটক করছেন। অবশেষে সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অফিসে থাকার কি যুক্তি তা আমরা বুঝি না। উনি অফিসে বসে আছেন। আবার কিছু দরদি দেখলাম লিখছে, ওনার খাবার যাচ্ছে না। অফিসে খাবার যাবে কেন? অফিসে আসবে, অফিস করবে, অফিস শেষে বাড়ি ফিরবে। বাড়িতে গিয়ে খাবার খাবে।’
এসব ঘটনাবলী এবং বক্তব্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোন পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে সে বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না। শুধু এটুকু বলা যায় বাংলাদেশের মানুষকে বোকা ভাবার কোন কারণ নেই।
---চ. আচরণ সংস্কৃতি দেখলেন। উচ্চারণ আরও তীব্র এবং হিংস্র। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, অর্ধমন্ত্রী এবং নেতা, পাতি নেতারা প্রতিদিন খালেদা জিয়াকে কটু কথা বলে যাচ্ছেন। সেসব ভাষা লিখলে দ্বিতীয়বার অন্যায় হবে ভেবে আর উল্লেখ করলাম না। এসব দেখে দেশে একজন প্রবীণ ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আবুল মকসুদ মন্তব্য করেন, ‘অসুন্দর ভাষায় কাউকে গালাগাল দেয়া আর গায়ে হাত তোলার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?” (প্রথম আলো, ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)।
বাংলাদেশের সমাজ সংস্কৃতি এবং জীবনবোধ সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম ধারণা আছে উপর্যুক্ত ঘটনাবলী তাদেরকে নিঃসন্দেহে বিস্মিত করবে। এই সেই দেশ, যে দেশের মানুষ নিজে না খেয়ে পরকে খাওয়ায়। এই সেই দেশ, যে দেশের মানুষ অপরকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়। এই সেই দেশ, যে দেশে গালাগালি হানাহানি মারামারি খুনোখুনিকে মানুষ ঘৃণা করে। হিংসা প্রতিহিংসা গ্রেপ্তারি বা হত্যার হুমকির মতো ঘটনাবলীকে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক মনে করে না। এ দেশের মানুষ মনে করে মানবিক আবেদন দিয়েই চলমান মানবিক বিপর্যয়কে অতিক্রম করতে হবে। বাংলাদেশের আবহমান লালিত সংস্কৃতির বিপরীতে প্রতিফলিত বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটি আপাত, কৃত্রিম এবং আরোপিত ঘটনা হতে বাধ্য। রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘যখন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে পড়ে বা সন্দেহ সঙ্কটে নিপতিত হয় তখন বৈধতার সঙ্কট সৃষ্টি হয়’। আর বাংলাদেশের সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন আমরা এখন একটি বৈধতার সঙ্কট সময় অতিক্রম করছি। বৈধতার সঙ্কট সৃষ্টি হয় তখন, যখন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সত্যকে মিথ্যা বলে প্রচার করে, ব্যর্থতাকে চমক, প্রতারণা এবং ষড়যন্ত্র দিয়ে ঢেকে দিতে চায়। এ ধরনের রাজনৈতিক দুর্যোগ সহসাই নাগরিক সাধারণকে গোটা ব্যবস্থার প্রতি ক্ষিপ্ত করে তুলতে পারে। সুতরাং রাজনীতিক এবং আমলাদের উচিত আবহমান লালিত বাংলার সহজাত রাজনৈতিক সংস্কৃতির লালন-পালন, ধারণ-সংরক্ষণ এবং প্রতিস্থাপন- নিশ্চিত করা।
No comments