সাঁওতাল গ্রামে হামলার বিচার চাই
(দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার হাবিবপুর চিড়াকুটা গ্রামে আদিবাসীদের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। জানুয়ারি ২৫, ২০১৫ দুপুরে তোলা ছবি l প্রথম আলো) দিনাজপুর
জেলার পার্বতীপুর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের হাবিবপুর গ্রাম,
আদিবাসীদের কাছে যা চিড়াকুটা নামে পরিচিত, ২৪ জানুয়ারি সকালে ভূমিদস্যুরা
সেখানে হামলা চালিয়ে আদিবাসী গ্রামকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিয়েছে।
ভূমিদস্যুরা শুধু হামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি, আদিবাসীদের সহায়-সম্বল সবকিছু
লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এমনকি গ্রামের টিউবওয়েল পর্যন্ত তারা খুলে নিয়ে গেছে
এবং ঘটনাস্থল ত্যাগ করার আগে আদিবাসীদের বাড়িঘরেও আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
গর্ভবতী একজন নারীসহ আদিবাসী নারীদের মারধর ও শ্লীলতাহানি করে। বর্তমানে
আদিবাসীরা সহায়-সম্বলহীন হয়ে এই প্রচণ্ড শীতের প্রকোপে খোলা আকাশের নিচে
খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে। জানা যায়, আদিবাসী-বাঙালি সংঘর্ষের একপর্যায়ে
সেদিন আত্মরক্ষার তাগিদে আদিবাসীরা তির ছুড়লে একজন বাঙালি তিরবিদ্ধ হন
এবং পরে তিনি মারা যান; যেকোনো হত্যাকাণ্ডই নিন্দনীয়, আমরা এর তীব্র
নিন্দা জানাই এবং তদন্ত সাপেক্ষে এর বিচার দাবি করি। কিন্তু এর জন্য পুরো
আদিবাসী গ্রামকে জ্বালিয়ে দেওয়া কখনোই কাম্য হতে পারে না। যেখানে
আইন-আদালত আছে, সেখানে যদি কেউ অন্যায় করে, তাহলে তার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে
ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু তাই বলে পুরো আদিবাসী গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে,
এটা হতে পারে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশ প্রশাসন ঘটনাস্থলে পৌঁছার
পরও আদিবাসীদের গ্রামে ভূমিদস্যুরা হামলা চালাচ্ছিল। কিন্তু তাদের কাউকেই
পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারল না। ঘটনার শেষে শুধু ১৯ জন আদিবাসীকেই গ্রেপ্তার
করা হলো। এর মধ্যে এনটিনিউস হাসদা নামে একজন এসএসসি পরীক্ষার্থীও রয়েছে,
আগামী ২ ফেব্রুয়ারি থেকে যার পরীক্ষা শুরু হবে। এ বিষয়ে পার্বতীপুর থানার
ওসি বলেছেন, তাদের এ সময়ে গ্রেপ্তার না করলে আদিবাসীরাও খুন হয়ে যেত। আসলেই
কী ঘটেছে তা জানতে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতারা ২৫ জানুয়ারি সকালবেলা
চিড়াকুটা গ্রামে গিয়ে দেখতে পান পুরো গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
শুধু ছাই আর ভাঙাচোরা মাটির দেয়াল ছাড়া বাকি বলতে কিছু নেই। আদিবাসী
নারীদের কান্না পুরো পরিবেশকে গুমোট করে রেখেছে। আদিবাসী শিশুরাও অসহায়
দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। গ্রামের দু-একজন পুরুষ বাদে সবাই গ্রাম ছেড়ে
পালিয়েছেন। উঠতি বয়সের মেয়েদেরও ঘটনার পরে গ্রাম থেকে তাদের আত্মীয়স্বজনের
বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সময় গ্রামে অবস্থানরত মানুষজনের সঙ্গে কথা
বলে জানা গেছে, ২৪ জানুয়ারি আনুমানিক সকাল আটটার সময় হাবিবপুর গ্রামের
জহিরুল ইসলাম ও তাঁর ভাই জিয়ারুল মণ্ডল দলবল নিয়ে গ্রামের মৃত রঘুনাথ টুডুর
ছেলে যোশেফ টুডু ও তাঁর পরিবারের দখলে থাকা ১৯ একর জমিতে (পত্তনি দলিলের
মাধ্যমে প্রাপ্ত জমি) জোরপূর্বক ধানের জমি তৈরি করার চেষ্টা করেন। বেশ
কয়েক বছর ধরেই জহিরুল ইসলাম জমিটি নিজের বলে দাবি করছিলেন। এ নিয়ে তাঁদের
মধ্যে মামলাও চলমান ছিল। জমি চাষের একপর্যায়ে যোশেফ টুডুর পরিবারের লোকজন
জমি চাষ করতে বাধা দিলে তাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এ সময় আদিবাসীরা
আত্মরক্ষার তাগিদে তির ছুড়লে জহিরুল ইসলাম ও তাঁর ছেলে শফিউল ইসলাম সোহাগ
(২২) তিরবিদ্ধ হন। পরে সোহাগ মারা যান। এ সময় রাকিব টুডু, রবেন টুডু,
কাবলু টুডুসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনা প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জহিরুল
ইসলামের আত্মীয়স্বজনসহ আশপাশের কয়েক শ বাঙালি লাঠি, হাঁসুয়া ও বিভিন্ন
দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আদিবাসীদের গ্রামে হামলা চালায় এবং লুটপাট শুরু
করে। এই হামলায় গ্রামের ৬০টি আদিবাসী পরিবারের ঘরবাড়ি তছনছ করা হয়।
হামলাকারীরা আদিবাসীদের বাড়িঘরের জিনিসপত্র ভেঙে চুরমার করে এবং মূল্যবান
জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় হামলাকারীরা আদিবাসীদের বাড়িঘরে
আগুন ধরিয়ে দেয়। নিরীহ আদিবাসীরা হামলাকারীদের থামানোর চেষ্টা করলে তাদের
ধরে পেটানো হয়। এ সময় গ্রামের লোকজন প্রাণের ভয়ে অনেকেই পালিয়ে যায়।
এখনো গ্রামের অনেকেই পালিয়ে আছে। হামলাকারীদের আক্রমণে মিখেলিনা মুরমু
(২৮) নামের একজন গর্ভবতী আদিবাসী নারী ও গুরুতর আহত মিখায়েল টুডু দিনাজপুর
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। ঘটনার পর পুলিশ এলেও তাদের সামনেই
হামলাকারীরা ভাঙচুর ও লুটপাটের তাণ্ডবলীলা চালাতে থাকে। পরে অতিরিক্ত
পুলিশ, বিজিবি, র্যাব গেলে হামলাকারীরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এ ঘটনায় ফুলমনি
হাঁসদা (৩৬) পাঁচটি গরু, চারটি রাজহাঁস ও পাঁচ বস্তা চাল হারিয়েছেন; আইনাস
সরেন (৪৮) আটটি গরু হারিয়েছেন। এ ছাড়া গ্রামের রেনাতুল হেমব্রম, নিলিমা
হেমব্রম, বিশু মার্ডি, ইসাহাক মার্ডি, সুখিয়া মার্ডি, সায়েরাকুস হেমব্রম,
দিপালী টুডু, ইলিয়াস মারিয়া মুরমু, পুতুল মুরমুসহ গ্রামের সব পরিবারের মোট
নয়টি শ্যালো মেশিন, আটটি টিউবওয়েল, প্রায় ২০০ গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস,
মুরগি নিয়ে গেছে লুণ্ঠনকারীরা। আদিবাসীদের পোষা তিনটি শূকরকেও মেরে
ফেলেছে। এ ছাড়া দরজা-জানালা থেকে শুরু করে হাঁড়ি, কড়াই, তেল, মরিচ,
লবণসহ সবকিছুই লুট করে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় গ্রামের মধ্যে অবস্থিত কারিতাস
পরিচালিত একটি স্কুলসহ গ্রামের সবার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায়
আমরা গভীরভাবে লক্ষ করছি যে আদিবাসীদের সঙ্গে ভূমিদস্যুদের সংঘর্ষে একজন
নিহত হওয়ার পরে ভূমিদস্যুরা খুবই চতুরতার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে
আদিবাসীদের গ্রামে হামলা চালিয়ে পুরো গ্রামকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। নিহত
ব্যক্তির পরিবারের পক্ষে ২৮ জনের নামসহ ১৪ জন অজ্ঞাত করে আদিবাসীদের
বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও করা হয়েছে। অপর দিকে আমরা যদি একটু পেছনে ফিরে তাকাই
তাহলে দেখা যাবে, গত বছরের ২ আগস্ট ঢুডু সরেনকে যখন ভূমিদস্যুরা হত্যা
করল, তখন তো আদিবাসীরা বাঙালিদের গ্রামে হামলা চালায়নি। তাহলে এই ঘটনায়
কেন পুরো আদিবাসী গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হলো? পুরো গ্রামের আদিবাসীদের
সঙ্গে নিশ্চয় জমি নিয়ে বিবাদ ছিল না। গ্রামের একটি পরিবারের সঙ্গে বিবাদের
জেরে যে সংঘর্ষ হয়েছে, সেখানেও পুরো গ্রামের আদিবাসীরা জড়িত ছিল না। যিনি
মারা গেছেন, তাঁকেও নিশ্চয় গ্রামের সবাই মিলে মেরে ফেলেনি। তাহলে কেন
গ্রামের সব আদিবাসীর ঘরবাড়িতে হামলা চালানো হলো? কেনই বা তাদের ঘরবাড়ি
জ্বালিয়ে দেওয়া হলো? শুধু এ ঘটনাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে উত্তরবঙ্গের
আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন বাড়ছে, তা সংবাদপত্রে প্রকাশিত
সংবাদগুলো দেখলেও বোঝা যায়। ঘটনাক্রমে যে যুবকটি নিহত হয়েছেন, সেখানে যদি
একজন আদিবাসী যুবক নিহত হতেন, তাহলে কি আদিবাসীরা বাঙালিদের ওই গ্রামে
হামলা চালাত? আমারা মনে করি একমাত্র সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই
আদিবাসীদের গ্রামে এ ধরনের হামলা হয়েছে। সরকারযন্ত্র সব সময় ও সর্বত্র
আদিবাসীদের প্রতি সাম্প্রদায়িক আচরণ বজায় রেখেছে। আদিবাসীরা যতই এ
রাষ্ট্রকে নিজের বলে বুকে টেনে নেয়, রাষ্ট্র তত দূরে সরে যায়। আদিবাসীরা
কখনোই আইনকে অবজ্ঞা করে না বা আইন নিজের হাতে তুলে নেয় না। আমরা বলতে চাই,
কেউ যদি কোনো অন্যায় করে, সে আদিবাসী হোক আর বাঙালিই হোক, তাকে
রাষ্ট্রের আইনের মধ্যে এনে তার শাস্তি রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। জনগণকেও
রাষ্ট্রের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আইনকে সহযোগিতা করতে হবে। অন্যথায়
আইন নিজের হাতে যারা তুলে নেয়, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকেও পদক্ষেপ নিতে
হবে। এমতাবস্থায় চিড়াকুটা আদিবাসী গ্রামের নিরীহ আদিবাসীদের ওপর
বর্বরোচিত এই সাম্প্রদায়িক হামলার তীব্র নিন্দা এবং ভূমিদস্যুসহ হামলাকারী
ও লুটপাটকারীদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে সরকারের
কাছে নিম্নলিখিত দাবিসমূহ উত্থাপন করছি:
এক . আদিবাসী-বাঙালি সংঘর্ষে একজন নিহতের ঘটনায় তদন্ত সাপেক্ষের বিচার করতে হবে; দুই. ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার চিড়াকুটা সাঁওতাল গ্রামে হামলাকারী, অগ্নিসংযোগকারী ও লুটপাটকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে; তিন. ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী পরিবারগুলোকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসন করতে হবে; চার. আদিবাসী গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; পাঁচ. আদিবাসীদের সঙ্গে চলমান বিবদমান জমির নিষ্পত্তি করতে হবে; ছয়. খাসজমি আদিবাসীদের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে; সাত. সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।
লেখকবৃন্দ মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।
প্রতিবেদক >> পংকজ ভট্টাচার্য, মেজবাহ কামাল, মানিক সরেণ, রিপনচন্দ্র বানাই, হরেন্দ্রনাথ সিং, তারিক হোসেন, দীপায়ন খীসা ও রোবায়েত ফেরদৌস
এক . আদিবাসী-বাঙালি সংঘর্ষে একজন নিহতের ঘটনায় তদন্ত সাপেক্ষের বিচার করতে হবে; দুই. ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার চিড়াকুটা সাঁওতাল গ্রামে হামলাকারী, অগ্নিসংযোগকারী ও লুটপাটকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে; তিন. ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী পরিবারগুলোকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসন করতে হবে; চার. আদিবাসী গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; পাঁচ. আদিবাসীদের সঙ্গে চলমান বিবদমান জমির নিষ্পত্তি করতে হবে; ছয়. খাসজমি আদিবাসীদের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হবে; সাত. সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।
লেখকবৃন্দ মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।
প্রতিবেদক >> পংকজ ভট্টাচার্য, মেজবাহ কামাল, মানিক সরেণ, রিপনচন্দ্র বানাই, হরেন্দ্রনাথ সিং, তারিক হোসেন, দীপায়ন খীসা ও রোবায়েত ফেরদৌস
No comments