‘আমরা খেটে খাই রাজনীতি বুঝি না’ by আল আমিন
আমরা
গরিব। মেহেনতি মানুষ। দিন আনি দিন খাই। একদিন না কাজ করলে সংসারে টানাপড়েন
শুরু হয়। এভাবেই দিন যায়। কোন রাজনীতি বুঝি না। তবু কেন আমাদের ওপর এমন
নৃশংস পেট্রলবোমা হামলা করা হলো? ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি ট্রাকচালক মিলন হোসেন। মিলন
ওই বার্ন ইউনিটে হরতাল ও অবরোধের ভিকটিমের জন্য ৫০ নম্বর বিশেষ ওয়ার্ডে
চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গতকাল দুপুরে ওই ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, পোড়া চামড়া আর
ওষুধের উৎকট গন্ধ। সঙ্গে দগ্ধ রোগী ও স্বজনদের কান্নার শব্দ। চিকিৎসক ও
সেবিকারা রোগীদের নিয়ে ব্যস্ত। ওই ওয়ার্ড বাদেও বার্ন ইউনিটের দ্বিতীয় তলার
আরেকটি ওয়ার্ডে অবরোধ ও হরতালে আহত দগ্ধ রোগীরা ভর্তি আছেন। বার্র্ন
ইউনিটের বিশেষ এই ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, দরজার কাছাকাছি ১ নম্বর বেডে
চিকিৎসাধীন আছেন ট্রাকচালক মিলন হোসেন। ওই বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আহতের দিকে
নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছেন তার ছোটভাই শিপন মিয়া। পাশে বসা স্ত্রী মিনা
আক্তার। তাদের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে বেদনার অশ্রু। আহত ট্রাকচালক পোড়ার
যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। ছোটভাই শিপন মিয়া জানান, গত ২৭শে জানুয়ারি রাত
৯টায় মাগুরার শালিখা থানার আড়পাড়া রোডে আদাবাহী একটি ট্রাক চালিয়ে আসছিলেন
তার ভাই মিলন। এ সময় দুর্বৃত্তরা তাদের ওই ট্রাকের সামনের কাঁচ লক্ষ্য করে
একটি পেট্রলবোমা হামলা চালায়। এতে তার ভাই দগ্ধ হন। এরপর পথচারীরা তাকে
উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে, পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের
বার্র্ন ও সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করেন। তিনি আরো জানান, তার ভাইয়ের দু্ই
হাত, দুই পা, শরীরের বিভিন্নস্থান পুড়ে গেছে। শ্বাসনালীও পুড়েছে। চিকিৎসকরা
জানিয়েছেন, তার শরীরের পোড়ার পরিমাণ ১০ শতাংশ। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে
বলেন, আমাদের বাবা আবদুর রশিদ মারা যাওয়ার পর পরিবারের অন্যতম উপার্জনক্ষম
ব্যক্তি তার ভাই মিলন। দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমা হামলার পর পরিবারে
আর্থিক টানাপড়েন দেখা দিয়েছে। বাইরে থেকে চিকিৎসার ওষুধ কিনতে হচ্ছে। এর
দায়ভার কে নিবে? তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সবাই নিজেদের স্বার্থের কারণে
অবরোধ- হরতাল ডাকেন। কিন্তু, গরিব মানুষদের নিয়ে তারা চিন্তা করেন না যে,
তারা কিভাবে দিন-যাপন করবেন। তাদের এই সহিংস কর্মকাণ্ড বন্ধ করার সময়
এসেছে। নইলে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে যারা পেট্রোল বোমা হামলা চালিয়ে
মানুষকে পুড়িয়ে মারছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। দগ্ধ মিলনের
গ্রামের বাড়ি যশোর জেলার বেনাপোল থানার নারায়ণপুর এলাকায়। পাঁচ ভাই এক
বোনের মধ্যে মিলন তিন নম্বর। তিনি দুই কন্যা সন্তানের জনক। ওই ওয়ার্ডের তিন
নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন সিদ্দিকুর রহমান (৪০)। তার শরীরের গলা, হাত ও মাথার
একপাশ দগ্ধ হয়েছে। শ্বাসনালীর একপাশ দগ্ধ হয়েছে। তার শরীরের ১৭ শতাংশ পুড়ে
গেছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। বেডের পাশে মাদুর বিছিয়ে বসে থাকা তার
স্ত্রী শরিফা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, গত ৫ই জানুয়ারি অবরোধে
ময়মনসিংহ জেলার সদর থানার জেলা স্কুল মোড়ে অটোবাইক চালিয়ে যাওয়ার সময়
দৃর্বৃত্তরা পেট্রলবোমা হামলা চালায়। এতে তার স্বামী দগ্ধ হন। পরে পথচারীরা
তাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করেন। খবর পেয়ে পরিবারের লোকজন তাকে ঢাকা
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করেন। তিনি আরও
জানান, আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আমার স্বামী। দিনের
পরিশ্রমের টাকায় সংসার চলে। ২৪ দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চিকিৎসার ওষুধপত্র কেনা হচ্ছে। এইভাবে আর
কতদিন? প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি। সিদ্দিকুর রহমানের পিতার নাম ইদ্রিস আলী।
গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার সদর থানার পুলিশ লাইনের কাসর মোড় এলাকায়। তিনি
তিন সন্তানের জনক। হরতাল ভিকটিম ওয়ার্ডে ৮ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন আছেন
লেগুনাচালক সেলিম উদ্দীন (৩৯)। তার শরীরের ৩৬ শতাংশ পুড়ে গেছে। শ্বাসনালী
সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতের
স্ত্রী হাসি বেগম জানান, ১১ জানুয়ারি দক্ষিণ কমলাপুর মোড়ে চলন্ত লেগুনায়
দুইজন যুবক একটি পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। এতে ওই লেগুনার চালক তার স্বামী
সেলিম গুরুতর দগ্ধ হন। এরপর পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের
বার্ন ইউনিটে ভর্তি করেন। তিনি আরও বলেন, লেগুনার চালক হিসেবে সারা দিনে যা
আয় করতেন তা দিয়েই তাদের সংসার চলে। স্বামী দগ্ধ হওয়ায় তার উপার্জন বন্ধ
হয়ে গেছে। সংসারে অভাব-অনটন দেখা দিয়েছে। তিনি আরও জানান, আত্মীয়-স্বজনদের
কাছে ঋণ নিয়ে চলতে হচ্ছে। তার দগ্ধ স্বামীর অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে।
উন্নতি হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘আমার ও আমার দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার
দেখছি। চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না।’ দগ্ধ সেলিমের পিতার নাম ফজল আলী। মুগদার
মদিনাবাদের বাবুল মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের
বার্ন ও সার্জারি ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল জানান, বার্ন
ইউনিটে এখন পযর্ন্ত অবরোধের ভিকটিম ৪৮ জন ভর্তি আছেন। অবরোধে দগ্ধ হওয়া
রোগীদের জন্য তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
No comments