কোথাও কোনো আলো নেই by আনিসুল হক
ব্যারিস্টার
মওদুদ আহমদ কিছুদিন আগে একটা কথা বলেছিলেন, যার ওপরে আর কথা হয় না,
বিএনপিকে লোকে ভোট দিতে প্রস্তুত আছে, কিন্তু বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য
জীবন দিতে প্রস্তুত নেই। বিএনপি একটা জনপ্রিয় দল, ভোটে ভালো করার ঐতিহ্য
তার আছে। এ বিষয়ে অবশ্য ড. হুমায়ুন আজাদের প্রবচন স্মরণীয়, আওয়ামী লীগ যার
প্রতিপক্ষ, ভোটে জিততে তার কিছুই করার দরকার পড়ে না। বিএনপি যে জনপ্রিয়,
আরাফাত রহমান কোকোর জানাজায় বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে সেটা আবারও
প্রমাণিত হলো। এত মানুষ যদি জানাজায় যেতে পারেন, তাহলে বিএনপির ডাকা
রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ঢাকায় লোক হয় না কেন? এর একটা উত্তর হলো, সরকার
বিএনপির কর্মসূচি হতে দেয় না, নানা রকমের বাধা সৃষ্টি করে। সেই জায়গাতেই
আসে মওদুদ আহমদের কথাটা, বিএনপিকে ভোট দিতে রাজি আছে মানুষ, জানাজায় যেতে
রাজি আছে, কিন্তু জীবনবাজি রেখে তার জন্য সংগ্রাম করতে রাজি নয়। না থাকার
কারণ আছে। অতীতে তুমি অনেকবার ক্ষমতায় গিয়েছ, জনগণের জন্য কী করেছ? তবু এই
দেশে মানুষ বিরোধীদের সমর্থন করে। কারণ, সর্বশেষ সরকারের ব্যর্থতার
দাগগুলো তাদের পিঠে দগদগ করে। বিএনপির কর্মসূচিতে লোকসমাগম না হওয়ার
আরেকটা কারণ, কর্মসূচির চরিত্রের প্রথম থেকেই ধ্বংসাত্মক, কখনো কখনো
জঙ্গি বা সন্ত্রাসী রূপ পরিগ্রহ করা। রাজনৈতিক আন্দোলনে সফল হতে হলে
অবশ্যই তার চরিত্র হতে হবে অহিংসাত্মক। মার খাব, মার খেয়ে মাটি কামড়ে পড়ে
থাকব, তবু মার দেব না—নৈতিক মনোবল এতটা শক্তিশালী হলেই কেবল আন্দোলনে
জয়লাভ করা যায়। সিজার শ্যাভেজ (১৯২৭-১৯৯৩) নামের মার্কিন শ্রমিকনেতা
বলেছিলেন, ‘অহিংস আন্দোলন খুব কঠিন কাজ, এটা হলো আত্মত্যাগের ব্রত, এটা
হলো বিজয়ের জন্য ধৈর্যধারণ’। মহাত্মা গান্ধী তা-ই করেছিলেন। আফ্রিকায়
শ্রমিক আন্দোলনে যখন পুলিশ নিষ্ঠুরভাবে মার দিচ্ছিল, তখন একজনের পর একজন
এসে মার খেয়েছেন এবং একসময় ক্ষমতাসীনের হাত অবশ হয়ে এসেছে। বাংলাদেশের
স্বাধীনতা আন্দোলনেও তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান এই নীতিই অবলম্বন করেছিলেন।
পঞ্চাশের দশকে জেলখানায় বন্দী শেখ মুজিবের কাছ থেকে নেওয়া স্পেশাল
ব্রাঞ্চের জবানবন্দিগুলো পড়ে দেখুন, তিনি বলতেন, আমি জীবন দেব, তবু
পূর্ববাংলার মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে যাব, বন্ডসই দিয়ে মুক্তি নেব
না। কাজী নজরুল ইসলাম যেমনটা বলেছেন, এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে
বিকল। বিএনপিতে সেই নেতা কই, যিনি বলবেন, আমি জীবন দেব, তবু দেশের মানুষের
মুক্তির জন্য রাজপথ ছাড়ব না। নিরাপদ দূরত্বে বসে টেলিফোন করে কিংবা ভিডিও
মেসেজ দিয়ে কিংবা প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়ে ভাড়াটে
লোককে দিয়ে পেট্রলবোমা ছুড়ে নিরীহ যাত্রী ও চালকদের পুড়িয়ে মারার নাম
আন্দোলন নয়। এখানে বিএনপিওয়ালারা আরেকটা কথা বলেন, বাসে আগুন বিরোধী দল
দেয় না, সরকারের লোকেরা দেয়, আর বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপায়। অভিযোগ
তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু আওয়ামী লীগ যা চায়, তা-ই করে দেওয়ার দায়িত্ব কি
বিএনপির? এর আগে বিএনপি বলত, আওয়ামী লীগ চায় না, বিএনপি পার্লামেন্টে যাক।
আওয়ামী লীগ চায় না, তাদের চাওয়া বাস্তবায়নের দায়িত্ব বিএনপির, তাই তারা
সংসদে গেল না। এর পরের কথা, আওয়ামী লীগ চায় না, বিএনপি নির্বাচনে যাক।
কাজেই সেই চাওয়া বাস্তবায়নের দায়িত্ব বিএনপির। সরকার চায় রাস্তায় বাস পুড়ে
নিরীহ যাত্রী দগ্ধ হোক, কাজেই তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব বা কৃতিত্ব
বিএনপির। আসলে বিএনপি জানে না, তারা কতটা জনপ্রিয় এবং বিএনপি জানে না, তারা
কী চায়। ২০১৩ সালে খালেদা জিয়া আলটিমেটাম দিলেন, তারিখ বেঁধে দিলেন, এর
মধ্যে আলোচনা শুরু করা না হলে হরতাল। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন
আমন্ত্রণ জানালেন, আসুন, চা খেয়ে যান, আলোচনা শুরু হোক, হরতাল
প্রত্যাহার করুন—খালেদা জিয়ার আলটিমেটাম শেষ হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী এই
আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া হরতাল প্রত্যাহার করলেন না। এবারও
বিএনপি বলছে, আলোচনার টেবিলে সরকারকে তারা বসাতে চায়। শেখ হাসিনা চলে
গেলেন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে, আপন সন্তানের মৃত্যুতে শয্যাশায়ী
শোকগ্রস্ত খালেদা জিয়া ঘুমিয়েছিলেন, কিন্তু গোটা বিএনপিতে একজনও ছিল না,
যিনি শেখ হাসিনাকে দরজাটা খুলে সালাম দিতে পারতেন? ওই দিন শেখ হাসিনাকে
ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হলেই সব সমস্যার সমাধান হতো, এটা অতি আশাবাদীও বিশ্বাস
করবে না, তবু যোগাযোগের একটা সূত্র তো পাওয়া যেতে পারত! এখন বিএনপি যদি
তার আন্দোলনকে সফল করতে চায়, তাকে প্রথমে জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচির
বিরুদ্ধে কর্মসূচি দিতে হবে। তারা যদি মনেই করে, এসব সরকার করে (রাজশাহীতে
বাসে আক্রমণ সেরে পলায়নরত শিবিরের নেতাদের ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তাদের
পরিচয়ও প্রকাশ করা হয়েছে, বোমা বানাতে গিয়ে ছাত্রদল কর্মীর হাত উড়ে গেছে,
তা সত্ত্বেও), তাহলে সরকারের এহেন ন্যক্কারজনক কাজের বিরুদ্ধেই তো প্রথম
নামতে হবে বিএনপিকে! বিএনপির ভোটার আছে। সেই ভোটারদের রাজপথে নিয়ে আসতে
পারতে হবে। তাহলেই কেবল বিএনপির আন্দোলন সফলতার মুখ দেখবে। আর সেই কাজটা
করার সময় নিজের জনসমর্থনের ওপরে এই আস্থা রাখতে হবে যে স্বাধীনতাবিরোধী
যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে ছাড়াই তারা যথেষ্ট জনপ্রিয়। বিএনপির জামায়াতের সঙ্গ
প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে পরিত্যাগ করার মধ্যেই আগামীকালের বাংলাদেশের কল্যাণ
নিহিত। একবার নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া বেতার-টিভি ভাষণে বলেছিলেন,
বিএনপি একটি ‘আধুনিক’ ‘প্রগতিশীল’ দল। বিএনপির কথায় ও কাজে তার প্রমাণ দিতে
হবে। হিংসা বর্জন করতে হবে। ক্ষমতাসীনেরা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় মানুষের
সমাবেশকে। বিএনপিকে মানুষের সমাবেশ ঘটাতে হবে। সেটা করতে হবে অহিংসার শক্তি
দিয়ে। সরকার সমাবেশ ঘটাতে দিতে চায় না, হিংসা ছাড়া আর কী পথ আছে—এই ভাবনা
সর্বনাশা ও আত্মঘাতী! কবে কোন সরকার সভা-সমাবেশে বাধা দেয়নি? ১৯৫২ সালে
দিয়েছে, ১৯৬৯ সালে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের মার্চে দিয়েছে। ১৯৯০ সালের নভেম্বরে
কারফিউ জারি করেছিল এরশাদ সরকার। সেই কারফিউ ভেঙে জুমার নামাজ সেরে বায়তুল
মোকাররম থেকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ মিছিল
করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই প্রেক্ষাপট আর এই প্রেক্ষাপট তো এক না। এক না
হলে বাস্তবতা বুঝে সেই রকমের কর্মসূচি দিন, প্রথম দফাতেই কেন এমন কর্মসূচি
দিলেন, যা থেকে আর ফেরা যায় না? পেট্রলবোমা মেরে সরকারবিরোধী আন্দোলন
সফল করা যায় না, যাবে না। গোটা পৃথিবীতে এই সময়ে এমন কোনো উদাহরণ নেই,
যেখানে সন্ত্রাস করে কোনো পক্ষ তাদের অধিকার আদায় করে নিতে পেরেছে।
আলোচনাই শেষ পর্যন্ত করতে হয়, এটাই সমাধানের পথ। কী হবে এখন? বিরোধী দল
অবরোধ তুলবে না। সরকারও ছাড় দেবে না। এই রকম চলতেই থাকবে। মানুষ তার
নিজের প্রয়োজনে গাড়িঘোড়া নিয়ে বের হবে। মাঝেমধ্যে পেট্রলবোমা পড়বে।
তাতে যাঁরা নিহত হবেন, দগ্ধ হয়ে কাতরাবেন, এর চেয়ে মরণই ভালো ছিল বলে
কাতরাবেন অগ্নিদগ্ধ যন্ত্রণাবিদ্ধ যে আদমসন্তান, একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে
কাঁদবেন যে মা, আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠবে যাঁদের রোদনে, তাঁদের মধ্যে বিএনপির
ভোটারও থাকবেন, আওয়ামী লীগের ভোটারও থাকবেন। দেশ পেছাবে। অর্থনীতি
মন্দীভূত হবে। দেশটা বৈরুত হয়ে যাবে। তবু কারও পাষাণ হৃদয় গলবে না।
রাজনৈতিক সমস্যাকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে দেখে সরকার কঠোর থেকে
কঠোরতর হবে। মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘটবে। অবরোধ তুলে নিয়ে মানুষের সমাবেশ
ঘটানোর কৌশল নিয়ে যদি বিএনপি এগোয়, তাদের আন্দোলন সফল হতে পারে। তা
তারা করবে না। সে ইচ্ছা মোটেও তাদের নেই। তা করার জন্য যে নৈতিক শক্তি
দরকার, তাও তাদের নেই। ক্ষমতা চাই, কারণ আমরাই কেবল দেশপ্রেমিক, আমাদের
হাতেই দেশ নিরাপদ—এই ফ্যাসিবাদী চিন্তা দিয়ে চালিত হবে উভয় পক্ষই। মানুষের
কল্যাণের জন্য দরকার আমার ক্ষমতা, এই যুক্তিতে পুড়িয়ে মারা হবে মানুষকে,
পুড়িয়ে মারা হবে দেশের ভবিষ্যৎ। কাজেই এই সংকটের কোনো আশু সমাধান নেই।
এই সংকটের কোনো আশু সমাধান চোখে পড়ছে না। এই অবস্থায় আমরা কী করতে
পারি? শান্তিকামী ও সমঝোতাকামী মানুষের সমাবেশগুলো বড় করে তোলাই হয়তো
হতে পারে এখনকার কর্তব্য।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments