অকৃতজ্ঞ মানুষ! by আবু এন এম ওয়াহিদ
ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ড সেইন্ট লুশার রডনি বে ভিলেজে এক নাগাড়ে তিন দিন সম্মেলন-ব্যস্ততার পর স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, কান্তি এসে শরীরে ভর করছে। মনের অবস্থাও একটু বিষণœ বৈকি। বেশ ক’দিন ধরে বাড়ির বাইরে। ই-মেইল মারফত জানতে পারছি, অফিস ও সংসারের না-করা কাজের ফর্দ দিনে দিনে লম্বা হচ্ছে। প্রতিদিন বিকেলে যেখানে ছেলেমেয়েদের খোঁজখবর নিতাম, সেটাও আর হয়ে উঠছে না। ফিরে গেলেই কাস শুরু হবে। সেমিস্টারের সূচনা-প্রস্তুতি কিছুটা বাকি রয়েছে। হাতে পাবো মাত্র দুই দিন। এ অল্প সময়ে সব কিছু গুছিয়ে উঠতে পারব তো! এসব নিয়ে হোটেলের লবিতে দিনদুপুরে একা একা বসে ভাবছি আর হৈ হুল্লোড়রত মানুষের বিরামহীন আনাগোনা দেখছি।
কেউ চেক ইন করছে, কেউবা চেক আউট। কেউ বসে চা-কফি খাচ্ছে। এক হাতে কাপ, আরেক হাতে কানের কাছে সেলফোন ধরে কানাকানিÑ কত কথা! যেন তার শেষ নেই! কেউ আমার মতোই গম্ভীর হয়ে একাকী বসে আছে। কেউ প্রিয়জনের ঘাড়ে মাথা রেখে আদরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কোনায় বসে দুই বান্ধবী চুটিয়ে গল্প করছে। আর মাঝে মাঝে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। একজন কালো আরেক জন সাদা। বিষয়বস্তু কী, জানার কিংবা বোঝার উপায় নেই যতই কৌতূহল থাকুক না কেন। কিছুক্ষণ পরপর স্বল্পবসনা অল্প বয়সী নারীরা কাঁধে টাওয়েল ঝুলিয়ে ফিপফপ পরে সাঁতার কাটতে সি বিচে যাচ্ছে। রুম সার্ভিস ও মেইন্টেন্যান্সের লোকজন আসছে, যাচ্ছে, ফ্রন্টডেস্ক থেকে নির্দেশনা নিচ্ছে। সেন্ট লুশায় এখন টুরিস্টদের মওসুম। তাই হোটেল লবির এই রমরমা অবস্থা দিনরাত বলতে গেলে একই রকম।
হঠাৎ দেখি ডেভিড আমার সামনে। পায়ে স্যান্ডেল, পরনে হাফপ্যান্ট, খালি গায়ে টাওয়েল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলল, ‘আবু, চল যাই বিচে।’ বললাম, ‘আমি পানিতে নামব না। তা ছাড়া আমার চেক আউটের সময় বেশি বাকি নেই। তুমি যাও।’ ডেভিড কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান অধ্যাপক। এসেছে নর্থ ক্যারোলাইনা থেকে। পরিচয় মাত্র দুই দিনের। অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ভদ্রলোক। অতি সহজেই না জানা, না চেনা মানুষকে কাছে টেনে নিতে পারে। ও নাছোড়বান্দা। আমাকে না নিয়ে সে যাবে না। বলল, ‘তোমার চেক আউটের এখনো দুই ঘণ্টা বাকি। বিচে যেতে সময় লাগে মাত্র পাঁচ মিনিট। আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে চলে আসব। এত কাছে এসে এত সুন্দর বিচ না দেখে গেলে ভবিষ্যতে পস্তাবে। আবার কবে এখানে আসবে তার কি কোনো ঠিক আছে?’ চল, চল, বলে আমাকে হাত ধরে টেনে তুলে নিলো। বিচ যে সুন্দর সেটা ভালো করেই জানে। কারণ সে প্রতিদিন একবার সেখানে যায়।
লবি থেকে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর হোটেলের শাটল সার্ভিস এলো। ভ্যানে উঠে বসলাম, সত্যি সত্যি পাঁচ মিনিটে চলে গেলাম বে গার্ডেনস রিসোর্টে। বিল্ডিংয়ের পেছনেই সেন্ট লুশার বিখ্যাত রডনি বে বিচ। ছোট্ট, কিন্তু সৌন্দর্যে অতুলনীয়। সত্যিই না গেলে পস্তাতাম! ডেভিড সরাসরি গিয়ে পানিতে নামল এবং আমি ঘন চেপ্টা পাতার একটি ঝাঁকড়া ছোট্ট শালগাছের নিচে গিয়ে হেলান দিয়ে বসলাম খালি বিচ চেয়ারে। চেয়ারগুলো হেলিয়ে পুরোদস্তুর শোয়া যায়। বিচের দুই পাশে খাড়া উঁচু পাহাড়। এদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বিচের তপ্ত বালুতে তরুণ-তরুণীদের প্রাণচাঞ্চল্য উপভোগ করার মতো! সামনে সীমাহীন সাগর। দিগন্তরেখায় আসমান মিশে গেছে দরিয়ার নীল পানিতে। অলস বসে বসে দেখছি, একটার পর একটা ঢেউ তীরে এসে আছড়ে পড়ছে। কোনোটার পানি ফুলেফেঁপে অনেক দূর ওপরে ওঠে, কোনোটা নিচেই থেকে যায়। একই সময়, একই হাওয়া, মাধ্যাকর্ষণের টানও ভিন্ন হওয়ার কথা নয়, কিন্তু ঢেউগুলোর শক্তিমত্তায় এই তারতম্য কেন, অনেক চিন্তা করেও জবাব পাইনি।
ছোট বড় অসংখ্য নৌকা এলোপাতাড়ি ছোটাছুটি করছে। কোনোটা ইঞ্জিনচালিত। কোনোটা চলছে পালের হাওয়ায়। কোনোটা আবার বৈঠা বাওয়া কাঠের নাও। মিস্ত্রিরা গাছ কেটে বানিয়েছেন। একটু দূরে দুই-একটি জেলে নৌকা। দৃষ্টি আরেকটু প্রসারিত করলে বেশ দূরে দেখা যায় ক্রুজ শিপ। মনে হয় যেন একটি বিশাল ১২ তলা দালান পানির ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছে। গাংচিল কিচিরমিচির শব্দ করে ওড়াউড়ি করছে। স্মার্ট ফোন বের করে কয়েকটি ছবি তুললাম। কিছুটা ভিডিও করার কোশেশ করলাম, কিন্তু পারলাম না। একে তো আনাড়ি ক্যামেরাম্যান, তার ওপর নতুন স্মার্ট ফোন, ব্যবহারে অভ্যস্ত হইনি, হয়তোবা তাই। বাড়িতে ফিরে এ কথা যখন আমার মেয়েদের বলব, তখন তারা হাসাহাসি করবে, আর বলবে, ‘আব্বু, ইউ আর কিউট’! তন্ময় হয়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ একটি মাছি উড়ে এসে বসল বাঁ হাতে। মাছি তাড়াতে গিয়ে দৃষ্টি ফিরে এলো মাটিতে শালগাছের নিচে।
বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি, একটি লোক বালুতে বসে ছুরি দিয়ে ঝুনো নারিকেল কেটে কেটে পাখির বাসা এবং পাখি বানাচ্ছে। একটু ওপরে তাকিয়ে দেখি, সে তার পণ্যসামগ্রী শালগাছের চ্যাপ্টা পাতার সাথে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। তার বানানো পাখি আর পাখির বাসাগুলো বাতাসে দুলছে। দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। সে পাখির ছবি তুললাম। অনুরোধে তারও একটি ছবি তুলে নিলাম। তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী? লোকটি বলল, মাইকেল। কী জাতের পাখি বানাচ্ছ? হামিং বার্ড। ওই মুহূর্তে লোকটি কাজ ফেলে একদৃষ্টিতে সাগরের দিকে তাকিয়েছিল। প্রশ্ন করলাম, তুমি কী দেখছ? সে বলল, তুমি যা দেখছ আমিও তাই দেখছি। বললাম, সাগর পাড়ে এলে তুমি কী দেখো? কী বোঝো? কী ভাব? তোমার কী অনুভূতি হয়? মাইকেল বলল, তোমার ধৈর্য আছে? শুনবে আমার কথা? বললাম, অবশ্যই।
মাইকেল বলল, ‘আমার পাখির মুখ আছে, ঠোঁটও আছে, কিন্তু সে ডাকে না, কিচিরমিচির করে না। আর ওই যে দেখছ বিশাল সাগর, সীমাহীন মহাসাগর, তার বুকে আছে অফুরন্ত জলরাশি তার তো কোনো মুখ নেই, কিন্তু খেয়াল করে শোনো, কী ভয়ঙ্কর কানফাটা তার গর্জনের আওয়াজ।’ মাইকেল আরো বলল, ‘আমার পাখির দুটো ডানা আছে, কিন্তু সে ওড়ে না, উড়তে পারে না। আর সামনে চেয়ে দেখ, সাগরের অথৈ নীল পানি, তার তো কোনো পাখনা নেই, কিন্তু বাষ্প হয়ে সে দিব্যি ওপরে উঠে যায়, বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাখির মতো, চলে যায় দেশ থেকে দেশান্তরে, দূর-দূরান্তরে! কে তার ঠিকানা রাখে! সময় হলে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির বেশে ঝরে পড়ে পৃথিবীর গায়ে। সিক্ত শীতল করে দেয় উষ্ণ ভূমিকে। ফুলে ফলে ভরে তোলে আমাদের এই মায়াবী পৃথিবীকে।’
বললাম, ‘বা! মাইকেল, তুমি তো চমৎকার বলেছ! এর ওপর আর কোনো কথা চলে না!’ মাইকেল এখানে থেমে যেতে পারত এবং আমিও আজকের মতো আমার বয়ানের সমাপনী টেনে দিতে পারতাম। কিন্তু না, তা হলো না। মাইকেল এখানে থামল না। সে বলেই চলল। বলল, ‘আমার পাখি গান করে না, ওড়েও না, তবু মানুষ তা টাকা দিয়ে কেনে। আমার ব্যবসায় হয়, মুনাফা হয়, এতে আমার সংসার চলে। আর ওই সাগরের নোনা পানি, যা না থাকলে তো আমরা ডাঙায় মিষ্টি পানি পেতাম না।
মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, গাছপালা, লতাগুল্ম সব মরে ছারখার হয়ে যেত। অথচ এই সাগর যে তৈরি করল, পানি দিয়ে তার বুক ভরে দিলো, যে তামাম জীবকুলকে বাঁচিয়ে রাখল, অনেক মানুষ আছে এর বিনিময়ে তো কিছু দেয়ই না, জীবনে হয়তো একটিবারও স্মরণ করে না, কালেভদ্রে একটা ধন্যবাদও দেয় না। কী হারামি না আমরা মানুষের জাত! আচ্ছা, বলতে পারো, মানুষ কেন এত অকৃতজ্ঞ হয়!’
wahid2569@gmail.com
কেউ চেক ইন করছে, কেউবা চেক আউট। কেউ বসে চা-কফি খাচ্ছে। এক হাতে কাপ, আরেক হাতে কানের কাছে সেলফোন ধরে কানাকানিÑ কত কথা! যেন তার শেষ নেই! কেউ আমার মতোই গম্ভীর হয়ে একাকী বসে আছে। কেউ প্রিয়জনের ঘাড়ে মাথা রেখে আদরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কোনায় বসে দুই বান্ধবী চুটিয়ে গল্প করছে। আর মাঝে মাঝে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। একজন কালো আরেক জন সাদা। বিষয়বস্তু কী, জানার কিংবা বোঝার উপায় নেই যতই কৌতূহল থাকুক না কেন। কিছুক্ষণ পরপর স্বল্পবসনা অল্প বয়সী নারীরা কাঁধে টাওয়েল ঝুলিয়ে ফিপফপ পরে সাঁতার কাটতে সি বিচে যাচ্ছে। রুম সার্ভিস ও মেইন্টেন্যান্সের লোকজন আসছে, যাচ্ছে, ফ্রন্টডেস্ক থেকে নির্দেশনা নিচ্ছে। সেন্ট লুশায় এখন টুরিস্টদের মওসুম। তাই হোটেল লবির এই রমরমা অবস্থা দিনরাত বলতে গেলে একই রকম।
হঠাৎ দেখি ডেভিড আমার সামনে। পায়ে স্যান্ডেল, পরনে হাফপ্যান্ট, খালি গায়ে টাওয়েল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলল, ‘আবু, চল যাই বিচে।’ বললাম, ‘আমি পানিতে নামব না। তা ছাড়া আমার চেক আউটের সময় বেশি বাকি নেই। তুমি যাও।’ ডেভিড কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান অধ্যাপক। এসেছে নর্থ ক্যারোলাইনা থেকে। পরিচয় মাত্র দুই দিনের। অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ভদ্রলোক। অতি সহজেই না জানা, না চেনা মানুষকে কাছে টেনে নিতে পারে। ও নাছোড়বান্দা। আমাকে না নিয়ে সে যাবে না। বলল, ‘তোমার চেক আউটের এখনো দুই ঘণ্টা বাকি। বিচে যেতে সময় লাগে মাত্র পাঁচ মিনিট। আমরা এক ঘণ্টার মধ্যে চলে আসব। এত কাছে এসে এত সুন্দর বিচ না দেখে গেলে ভবিষ্যতে পস্তাবে। আবার কবে এখানে আসবে তার কি কোনো ঠিক আছে?’ চল, চল, বলে আমাকে হাত ধরে টেনে তুলে নিলো। বিচ যে সুন্দর সেটা ভালো করেই জানে। কারণ সে প্রতিদিন একবার সেখানে যায়।
লবি থেকে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর হোটেলের শাটল সার্ভিস এলো। ভ্যানে উঠে বসলাম, সত্যি সত্যি পাঁচ মিনিটে চলে গেলাম বে গার্ডেনস রিসোর্টে। বিল্ডিংয়ের পেছনেই সেন্ট লুশার বিখ্যাত রডনি বে বিচ। ছোট্ট, কিন্তু সৌন্দর্যে অতুলনীয়। সত্যিই না গেলে পস্তাতাম! ডেভিড সরাসরি গিয়ে পানিতে নামল এবং আমি ঘন চেপ্টা পাতার একটি ঝাঁকড়া ছোট্ট শালগাছের নিচে গিয়ে হেলান দিয়ে বসলাম খালি বিচ চেয়ারে। চেয়ারগুলো হেলিয়ে পুরোদস্তুর শোয়া যায়। বিচের দুই পাশে খাড়া উঁচু পাহাড়। এদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বিচের তপ্ত বালুতে তরুণ-তরুণীদের প্রাণচাঞ্চল্য উপভোগ করার মতো! সামনে সীমাহীন সাগর। দিগন্তরেখায় আসমান মিশে গেছে দরিয়ার নীল পানিতে। অলস বসে বসে দেখছি, একটার পর একটা ঢেউ তীরে এসে আছড়ে পড়ছে। কোনোটার পানি ফুলেফেঁপে অনেক দূর ওপরে ওঠে, কোনোটা নিচেই থেকে যায়। একই সময়, একই হাওয়া, মাধ্যাকর্ষণের টানও ভিন্ন হওয়ার কথা নয়, কিন্তু ঢেউগুলোর শক্তিমত্তায় এই তারতম্য কেন, অনেক চিন্তা করেও জবাব পাইনি।
ছোট বড় অসংখ্য নৌকা এলোপাতাড়ি ছোটাছুটি করছে। কোনোটা ইঞ্জিনচালিত। কোনোটা চলছে পালের হাওয়ায়। কোনোটা আবার বৈঠা বাওয়া কাঠের নাও। মিস্ত্রিরা গাছ কেটে বানিয়েছেন। একটু দূরে দুই-একটি জেলে নৌকা। দৃষ্টি আরেকটু প্রসারিত করলে বেশ দূরে দেখা যায় ক্রুজ শিপ। মনে হয় যেন একটি বিশাল ১২ তলা দালান পানির ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছে। গাংচিল কিচিরমিচির শব্দ করে ওড়াউড়ি করছে। স্মার্ট ফোন বের করে কয়েকটি ছবি তুললাম। কিছুটা ভিডিও করার কোশেশ করলাম, কিন্তু পারলাম না। একে তো আনাড়ি ক্যামেরাম্যান, তার ওপর নতুন স্মার্ট ফোন, ব্যবহারে অভ্যস্ত হইনি, হয়তোবা তাই। বাড়িতে ফিরে এ কথা যখন আমার মেয়েদের বলব, তখন তারা হাসাহাসি করবে, আর বলবে, ‘আব্বু, ইউ আর কিউট’! তন্ময় হয়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ একটি মাছি উড়ে এসে বসল বাঁ হাতে। মাছি তাড়াতে গিয়ে দৃষ্টি ফিরে এলো মাটিতে শালগাছের নিচে।
বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি, একটি লোক বালুতে বসে ছুরি দিয়ে ঝুনো নারিকেল কেটে কেটে পাখির বাসা এবং পাখি বানাচ্ছে। একটু ওপরে তাকিয়ে দেখি, সে তার পণ্যসামগ্রী শালগাছের চ্যাপ্টা পাতার সাথে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে। তার বানানো পাখি আর পাখির বাসাগুলো বাতাসে দুলছে। দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। সে পাখির ছবি তুললাম। অনুরোধে তারও একটি ছবি তুলে নিলাম। তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী? লোকটি বলল, মাইকেল। কী জাতের পাখি বানাচ্ছ? হামিং বার্ড। ওই মুহূর্তে লোকটি কাজ ফেলে একদৃষ্টিতে সাগরের দিকে তাকিয়েছিল। প্রশ্ন করলাম, তুমি কী দেখছ? সে বলল, তুমি যা দেখছ আমিও তাই দেখছি। বললাম, সাগর পাড়ে এলে তুমি কী দেখো? কী বোঝো? কী ভাব? তোমার কী অনুভূতি হয়? মাইকেল বলল, তোমার ধৈর্য আছে? শুনবে আমার কথা? বললাম, অবশ্যই।
মাইকেল বলল, ‘আমার পাখির মুখ আছে, ঠোঁটও আছে, কিন্তু সে ডাকে না, কিচিরমিচির করে না। আর ওই যে দেখছ বিশাল সাগর, সীমাহীন মহাসাগর, তার বুকে আছে অফুরন্ত জলরাশি তার তো কোনো মুখ নেই, কিন্তু খেয়াল করে শোনো, কী ভয়ঙ্কর কানফাটা তার গর্জনের আওয়াজ।’ মাইকেল আরো বলল, ‘আমার পাখির দুটো ডানা আছে, কিন্তু সে ওড়ে না, উড়তে পারে না। আর সামনে চেয়ে দেখ, সাগরের অথৈ নীল পানি, তার তো কোনো পাখনা নেই, কিন্তু বাষ্প হয়ে সে দিব্যি ওপরে উঠে যায়, বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাখির মতো, চলে যায় দেশ থেকে দেশান্তরে, দূর-দূরান্তরে! কে তার ঠিকানা রাখে! সময় হলে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির বেশে ঝরে পড়ে পৃথিবীর গায়ে। সিক্ত শীতল করে দেয় উষ্ণ ভূমিকে। ফুলে ফলে ভরে তোলে আমাদের এই মায়াবী পৃথিবীকে।’
বললাম, ‘বা! মাইকেল, তুমি তো চমৎকার বলেছ! এর ওপর আর কোনো কথা চলে না!’ মাইকেল এখানে থেমে যেতে পারত এবং আমিও আজকের মতো আমার বয়ানের সমাপনী টেনে দিতে পারতাম। কিন্তু না, তা হলো না। মাইকেল এখানে থামল না। সে বলেই চলল। বলল, ‘আমার পাখি গান করে না, ওড়েও না, তবু মানুষ তা টাকা দিয়ে কেনে। আমার ব্যবসায় হয়, মুনাফা হয়, এতে আমার সংসার চলে। আর ওই সাগরের নোনা পানি, যা না থাকলে তো আমরা ডাঙায় মিষ্টি পানি পেতাম না।
মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, গাছপালা, লতাগুল্ম সব মরে ছারখার হয়ে যেত। অথচ এই সাগর যে তৈরি করল, পানি দিয়ে তার বুক ভরে দিলো, যে তামাম জীবকুলকে বাঁচিয়ে রাখল, অনেক মানুষ আছে এর বিনিময়ে তো কিছু দেয়ই না, জীবনে হয়তো একটিবারও স্মরণ করে না, কালেভদ্রে একটা ধন্যবাদও দেয় না। কী হারামি না আমরা মানুষের জাত! আচ্ছা, বলতে পারো, মানুষ কেন এত অকৃতজ্ঞ হয়!’
wahid2569@gmail.com
No comments