ব্রেকিং নিউজ! by জসিম উদ্দিন
এবি
ডি ভিলিয়ার্সের রেকর্ড। বাংলাদেশের তিন ডজন টিভি চ্যানেল প্রায় সবাই এক
সাথে ব্রেক করেছে। দর্শক-শ্রোতারা দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে
উদ্বিগ্ন। মানুষের কাছে এখন সবচেয়ে কাঙ্খিত সংবাদ রাজনৈতিক অচলাবস্থা
নিরসন। সমঝোতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা। খেলাপ্রেমিক ছাড়া এই
কঠিন নামটি সাধারণ বাংলাদেশীদের কাছে পরিচিত নয়। অনেকে চ্যানেল পরিবর্তন
করে বোঝার চেষ্টা করেছেন বিষয়টি কী। দক্ষিণ আফ্রিকার এই মারকুটে
ব্যাটসম্যান ৩১ বলে সেঞ্চুরি করার রেকর্ড গড়েছেন। এর আগে রেকর্ডটি দখলে ছিল
নিউজিল্যান্ডের অ্যান্ডারসনের। তিনি ৩৬ বলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে
রেকর্ডটি গড়েন। এর আগে রেকর্ডটি ১৮ বছর ধরে অক্ষত ছিল পাকিস্তানের শহীদ
আফ্রিদির। ভারতের জনশক্তি রফতানির আকর্ষণীয় বাজার বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে
সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স যায় ভারতে। মেধা ও শ্রম বিক্রি করে বাংলাদেশী
শ্রমিকেরা যে আয় করেন, তার একটা বিরাট অংশ আবার ভারতে চলে যায়। বিশ্বের
কাছে গরিব হলেও ভারতের কাছে বাংলাদেশ অন্তত ধনী দেশ। পশ্চিমবঙ্গের অনেক
বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এ দেশে নানান পেশায় জড়িত। সে দিনের বাংলাদেশী টিভির
ব্রেকিং নিউজ দেখে তারা একটু অবাক হয়েছেন নিশ্চয়ই। বাংলাদেশ ভারতীয় টিভি
চ্যানেলের বড় বাজার। ধর্মীয় আবহের ওপর ভিত্তি করে সেখানে বেশির ভাগ
চ্যানেলের অনুষ্ঠানমালা নির্মিত হয়। বাংলাদেশে ৩০-৩৫টি টিভি চ্যানেল আছে
বটে; জনপ্রিয়তায় পশ্চিমবঙ্গের চ্যানেলগুলোর কাছে বড় ব্যবধানে হেরে রয়েছে
চ্যানেলগুলো। কল্পকাহিনীর কনটেন্টেও ঠাকুর গনেশ কালী অত্যন্ত পূজনীয়।
ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষায় তাদের প্রতিশ্রুতিপূরণ ধন্যবাদ পেতে পারে। নাচ-গান
এগুলো তাদের জীবন ও ধর্মের সাথে মিশে গেছে নিবিড়ভাবে। সস্তা কাহিনী নির্মাণ
ও বিন্যাসে অত্যন্ত দক্ষতা অর্জন করেছে ভারতীয়রা। এগুলোর সাথে পারিবারিক
দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ মিশিয়ে যে সোপ ওপেরা তৈরি হচ্ছে তা বাংলাদেশের মাকের্টে
হিট করেছে। পশ্চিমবঙ্গের এই পাঠকেরা দেশে গিয়ে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল
দেখতে পান না। কারণ সে দেশে বাংলাদেশী চ্যানেলের প্রবেশাধিকার দেয়া হয়নি।
বাংলাদেশে অবস্থানকারী পশ্চিমবঙ্গের দর্শক শ্রোতারা সে দিন টিভি
চ্যানেলগুলো দেখে একটু হাসাহাসি করার কথা। প্রথমত তারা মনে করে উঠতে পারেন
এতগুলো চ্যানেল সব স্পোর্টস চ্যানেল হয়ে গেল কি না। দণি আফ্রিকার নাগরিকেরা
খুশি হবেন বাংলাদেশে একজন ডি ভিলিয়ার্সকে নিয়ে খুব হইচই হচ্ছে। বাংলাদেশের
কোনো অসচেতন পাঠক ভাবতে পারেন ডি ভিলিয়ার্সটা আবার কে। সাকিব আল হাসান,
মাশরাফি, মুশফিক, তামিম ক্রিকেটার হিসেবে তো সে এই নামগুলোই জানে। ক্রিকেট
আসলেই রেকর্ডের খেলা। শত বছরের এই খেলায় প্রায় প্রতিদিনের ম্যাচেই রেকর্ড
থাকে। সর্বনিন্ম ১৭ বলে যত দিন না সেঞ্চুরি হচ্ছে তত দিন পর্যন্ত এখানে
রেকর্ডের সুযোগ থেকে যাচ্ছে। যতবার আগের সেঞ্চুরিয়ানদের টপকে যাবে কেউ
ততবারই এক দিনের খেলায় এই একটি আইটেমে রেকর্ড হতেই থাকবে। ক্রিকেটে রেকর্ড
হওয়ার এ ধরনের শত শত আইটেম রয়েছে। পশ্চিম বা বাকি বিশ্বের কোনো নাগরিক আরো
বেশি বিভ্রান্ত হতে পারেন। তারা উদ্বিগ্ন বাংলাদেশে নিজেদের নিরাপত্তা
নিয়ে। এখন অবশ্য কূটনৈতিক পাড়ায় কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
রাস্তার মোড়ে মোড়ে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে।
টিভি চ্যানেলের নিচে যখন ‘ব্রেকিং নিউজ’ ইংরেজি শব্দদ্বয় লাফিয়ে ওঠে, তারা
রাজনৈতিক কোনো খবর বলেই তড়াক করে উঠবেন। দুঃসময়ে খেলার একটি রেকর্ড সব
চ্যানেলে একসাথে ব্রেক করায় অনেকে খেই হারিয়েছেন। টিভি চ্যানেলগুলো এভাবে
পাঠকদের প্রায়ই এলোমেলো করে দিচ্ছে। ভারতে হয়ে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনের সময়
কোনো ব্রেকিং নিউজ নিয়ে জি, সনি বা ভারতীয় অন্য কোনো কল্পকাহিনীর চ্যানেলে
বাংলাদেশী পাঠক-শ্রোতাকে ডিস্টার্ব হতে হয়নি। গৃহিণীদের মজলিসে আলোচনার
বিষয় এখন একটিই। সেটি হচ্ছে পরকীয়া, পারিবারিক বিরোধ ও সামাজিক অনাচারকে
ককটেল করে তৈরি করা ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর ধারাবাহিক। হিন্দু পুরাণ এবং
তাদের দেব-দেবীর পূজা-অর্চনাকে অবশ্য অত্যন্ত মর্যাদা দিয়ে এর সাথে জুড়ে
দেয়া হয়। ধর্মীয় প্রতীকগুলোকে তারা অত্যন্ত মর্যাদার সাথে চিত্রিত করে।
তারা সেকুলার কিন্তু এর নামে নিজেদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের এতটুকু
হানি করতে রাজি নয় তারা। সস্তা চরিত্র নির্মাণে অত্যন্ত দক্ষ তারা। বিশেষ
করে বাঙালি ও ভারতীয় নারীর আবেগের স্থানকে শনাক্ত করতে তারা পারঙ্গম। এর
সাথে ধর্মীয় চরিত্রগুলোকে জড়িয়ে দেয়া হয়। তবে দিনশেষে এ সিরিয়াল পরিবারের
মধ্যে কূটনীতি চর্চা আর অনাচার ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ভূমিকা রাখছে। এই সোপ
ওপেরায় হিরোর চরিত্র আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তেমনিভাবে শঠ ও খারাপ চরিত্রগুলোকে
অত্যন্ত ধারালো করা হয়। এ চরিত্রগুলো আমাদের নারীদের মজলিস জমজমাট করে
রাখে। তা এতটাই গ্রাস করে নিয়েছে যে এ সিরিয়ালগুলো না দেখা মানে পিছিয়ে পড়া
হিসেবে গণ্য হতে হয়। একবার নয় একাধিকবার দেখে যে যতটা আত্মস্থ করতে পেরেছে
সে ততটা স্মার্ট হিসেবে উপস্থাপন করতে পারছে নিজেদের আড্ডায়। চ্যানেলগুলো
ধারাবাহিক একটি এপিসোড প্রতিদিন দুই-তিনবার করেও রিপিট করে। কাজেই পাঠকদের
মিস হওয়া তো দূরের কথা একাধিকবার দেখাও হয়। রান্নাবান্না, ধোয়া-মোছা,
শিশুদের সেবাযত্ন ও স্কুলে নেয়া-আনা এখন বুয়াদের হাতে চলে গেছে। যারা চাকরি
করেন তারাও অবসর সময়টা এ সিরিয়ালেই দিচ্ছেন। একেবারে সবাই ভারতীয়
নি¤œমানের সোপ ওপেরায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছেন এমনটা বলা সঠিক হবে না। অনেকেই
সচেতন রয়েছেন যে মোহাচ্ছন্ন করা সিরিয়ালগুলোর মধ্যে শেখার কিছু নেই। তারা
সচেতনভাবে এগুলো এড়িয়ে চলেন। সার্বিকভাবে ভারতীয় মিডিয়ার একটা মান রয়েছে।
বাংলাদেশের ডজন ডজন টিভি চ্যানেলের বিষয়বস্তু একই। এটা একধরনের অপচয় ছাড়া
অন্য কিছু নয়। কিন্তু ভারতীয়রা অপচয়ের ব্যাপারে সাবধান। স্পোর্টসের জন্য
তারা স্পোর্টস চ্যানেলকে যথেষ্ট মনে করে। নিউজ চ্যানেলে ভরপুর সংবাদ দেখানো
হয়। খেলার খবরও সেখানে স্থান পায় গুরুত্ব অনুযায়ী। তাদের চ্যানেলগুলোর
একটা সম্পাদকীয় নীতি রয়েছে বলে বোঝা যায়। চ্যানেলের পক্ষ থেকে মটিভেশনও
রয়েছে কিন্তু সেটাও পাঠককে আহত করে না। এনডিটিভির সংবাদ ও বিশ্লেষণ দেখে
দেশটির কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি বিতৃষ্ণা ভাব আসবে না। অন্যান্য নিউজ
চ্যানেলকে পেশাদার বলতে হবে। কনটেন্ট বা কর্মসূচি নির্বাচনে তারা যতœশীল।
তাই সনি বা জি বাংলার কল্পকাহিনী নিয়ে তৈরি করা প্যাঁচালে যারা বুঁদ হয়ে
থাকেন, তাদের মোদির জয়-পরাজয় নিয়ে খবর ডিস্টার্ব করতে পারে না। ইউরোপ
আমেরিকার চানেলগুলোর দিকে লক্ষ করলে একই অবস্থা দেখা যাবে। প্রত্যেকের
সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। সে অনুযায়ী তারা তাদের অনুষ্ঠানমালা নির্মাণ
করে। যারা খাবার আইটেম নিয়ে অনুষ্ঠান করে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তাদের বিষয় নয়।
আবার যারা দৈনন্দিন খবর পাঠকের কাছে পৌঁছায় তারা জঙ্গলের পশুপ্রাণী নিয়ে
অনুষ্ঠান দেখায় না। চ্যানেলটি প্রতিষ্ঠার আগে নির্ধারিত হয় যে তা কী মেসেজ
দেবে। এর অনুকরণে টিভি চ্যানেল গড়ে উঠছে দেশে দেশে। সার্কের প্রতিবেশী দেশ
শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও পাকিস্তানও আমাদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে প্রায়
প্রতিটি চ্যনেলের কনটেন্ট একই। সবার অনুষ্ঠানসূচি ঘুরপাক খাচ্ছে চার-পাঁচটি
আইটেমের মধ্যে। নাটক, সিনেমা, গান, ধর্ম রেসিপি সংবাদ ও সংবাদ বিশ্লেষণ।
একই জিনিস সবাই করছে। রাজনীতি নিয়ে এসব চ্যানেলের গৎবাঁধা নগ্ন অবস্থান
পাঠকদের বিরক্ত করে। কয়েকটি বিশেষ ঘটনার পর দেশের টিভি চ্যানেলগুলো
জনপ্রিয়তা হারায়। এতগুলো চ্যানেল বাংলাদেশে হয়েছে কিন্তু নতুন কিছু নেই।
এক চ্যানেলকে নকল করে চলছে অন্য চ্যানেল। সম্পাদকীয় নীতি একেবারে দুর্বল।
অনেক চ্যানেলই তাদের সংবাদও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সরকারি টেলিভিশন বিটিভির
সমগোত্রীয়। সরকারের সমর্থন করতে গিয়ে এমন ভাবসাব নিচ্ছে তা খোদ সরকারের
কর্তাব্যক্তিদের জন্য বিব্রতকর হচ্ছে। সবচেয়ে মজার হবে সরকারের পরিবর্তনে
এরা যখন সম্পুর্ণ বিপরীত অবস্থান নেবে। তা একটা দেখার মতো বিষয় হবে
নিশ্চয়। মিডিয়া জাতীয় উন্নতি ও প্রগতিতে অবদান রাখবে। কিন্তু এ ধরনের
চর্বিত চর্বণ কোনো উপকারে আসবে না সে পথে। তোষামোদি তেল মর্দন কারো জন্য
কল্যাণকর নয়। প্রতিটি চ্যানেলকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে সেটা করতে হবে। এ জন্য
জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা দরকার। যাদের যোগ্যতা রয়েছে সংবাদ প্রচারের তারা
সংবাদ চ্যানেল চালাবে। যারা যোগ্যতা দেখাবে প্রকৃতি পরিবেশ খনিজ নিয়ে
অনুষ্ঠান তৈরি করবে। বিনোদনের জন্যও বিশেষায়িত চ্যানেল থাকবে। এর মাধ্যমে
জাতীয় অপচয় রোধ করতে হবে। ভারতের জাতীয় নির্বাচনে দেখা গেছে নিউজ চ্যানেল
ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল এ-বিষয়ক মাতামাতি হয়নি। এমনকি নির্বাচনের ফলাফল
ঘোষণার সময় পর্যন্ত বিশেষ চ্যানেলগুলোতে নিজস্ব নির্ধারিত অনুষ্ঠান চলতে
দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিটিভি সব সময়ের মতো এখন একেবারে সরকারি
মুখপাত্রের ভূমিকায় রয়েছে। দর্শক শ্রোতারা হঠাৎ হঠাৎ করে আকাশ হতে পড়েন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান কোকোর মৃত্যুর ঘটনাটি তারা
দিলো না। কিন্তু ছয় ঘণ্টা পর প্রধানমন্ত্রী যখন বিএনপি কার্যালয় থেকে ফিরে
এলেন তখন তাকে সে খবর দিতে হলো। এখন যাদের অন্য কোনো মাধ্যমে কোকোর মৃত্যুর
খবর জানা হলো না তারা হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর ফিরে যাওয়ার খবরটি শুনে খেই
হারিয়ে ফেলবেন। অনেক ক্ষেত্রে চ্যানেলগুলোর খবরে পাঠক এমন খেই হারাচ্ছেন।
খবর প্রচারে পক্ষপাতদুষ্টতা বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা
তলানিতে নিয়ে গেছে রাজনৈতিক অবস্থান নেয়ার কারণে। যারা খবরকে নিরপেক্ষ দিতে
চেয়েছিল সেই চ্যানেলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন যেন খবরের মাঠে অরাজকতা
চলছে। রোম যখন পুড়ছে তারা তখন বাজাচ্ছেন বাঁশি।
jjshim146@yahoo.com
jjshim146@yahoo.com
No comments